#ওহে প্রিয় .
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব ১৬
১২.
ফজরের আজানের পূর্বমুহূর্ত ঘুম ভেঙে গেলো আমার। এমনি এমনি নয় অদ্ভুত এক ক্রন্দনধ্বনিতে পা থেকে মাথা অবদি শিউরে ওঠে ঘুম ভেঙে যায়। হাঁটু থেকে পা অবদি থরথর করে কাঁপছে আমার। এমন কান্না আজ অবদি শুনিনি। ভৌতিক সিনেমায় অতৃপ্ত আত্মারা যেভাবে মাঝরাতে বিদঘুটে অন্ধকারে বসে থমথমে পরিবেশে কান্না করে। যেই কান্নায় থাকে একরাশ ক্লেশমিশ্রিত অনুভূতি। অসহনীয় ব্যাথায় কাতরাতে থাকা অনুভূতি। ঠিক তেমনি ক্রন্দনধ্বনি ভেসে আসছিলো। শক্রবার পড়েছে তাঁর মানে আজকেই আমার বিয়ে। একদিকে বুকের ভিতর তোলপাড় সৃষ্টি অন্যদিকে সেই কান্না। আপু পাশে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাচ্ছে। নির্মলকে চিঠি পাঠিয়েছি একদিন কেটে গেছে হাতে পেলে নিশ্চয়ই বসে থাকতো না। তাঁর মানে আমাকেই কিছু একটা করতে হবে৷ আপুকে ফিসফিসিয়ে ডাকতে শুরু করতেই আপু ঘুমজড়ানো কন্ঠে জিগ্যেস করলো,
-‘ সকাল হয়ে গেছে ‘?
-‘ না আপু তাড়াতাড়ি ওঠ দেখ কে যেনো কান্না করছে। এই আপু ওঠনা ‘। বলেই ঝাকাতে শুরু করি।
আপুর কানে যখন কান্নাটা স্পষ্টতর হয় আপুও ধড়ফড়িয়ে ওঠে বসে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে তাই বললো পানি দিতে। আপুকে পানি দিয়ে নিজেও এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে খেয়ে নিলাম। আপু দ্রুত টর্চ নিয়ে জানালা খুলে পুকুরের দিকে আলো ধরলেন। আমি চোখ বড় বড় করে চেয়ে দেখি একটি কালো কুকুর বসে কাঁদছে। আপু দেখা মাএই আঁতকে ওঠলো এক ঢোক গিলে ভয়ার্ত কন্ঠে বললো,
-‘ সাবারে গভীর রাতে কুকুর নেহায়ে নেহায়ে কান্না করা তো ভালো লক্ষণ না। নিশ্চয়ই কোন অঘটন ঘটবো। আম্মার কাছে শুনছি দাদা মরণের আগেও মাঝরাতে বাড়ির পাশে কুকুর এসে কাঁদতো ‘।
আপুর কথাটা আমি হেলায় ফেলায় ছেড়ে দিয়ে বললাম,
-‘ ধূর কি যে বলিস আপু এসব কুসংস্কার এগুলো মানতে হয় না। কুকুরের কান্নার সাথে মানুষ মরার কি সম্পর্ক যত্তসব আজগুবি কথাবার্তা। তবে কান্নাটা খুবই ভয়ংকর দেখ আমার হার্টবিট কতো দ্রুত ওঠানামা করছে ‘
আপু আমার বুকে হাত চেপে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর আবার শুয়ে পড়লো বিছানায়। কিন্তু আমার চোখে আর ঘুম ধরা দিলো না। ফজরের আজান দিতেই নামাজ পড়ে নিলাম। নামাজ শেষে চুপচাপ বিছানায় গিয়ে বসে রইলাম। ভাবতে থাকলাম হয় পালাবো নয়তো বিয়ে করে নিবো। তাই বলে সংসার করবো না। কারণ আমি জানতাম বিয়ে হোক যাইহোক না কেনো নির্মল জাষ্ট একটা খবর পেলেই যে ভাবেই হোক আমাকে এখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে। সময় যেনো খুব দ্রুত সড়ে যাচ্ছিলো। দুপুর হতেই আপু শাড়ি,গয়না নিয়ে আমাকে সাজাতে শুরু করলো। আকাশের অবস্থা সুবিধার না। যে কোন সময় বৃষ্টি ঝড়ে পড়বে। বরপক্ষরা তাই আগে ভাগেই আসবে দ্রুত বিয়ে পড়িয়ে বউ নিয়ে যাবে। ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে সাজগোজ করতে হলো আমাকে। বৈশাখ মাসের শেষের দিক। সময়ে অসময়ে আকাশ বাজনা বাজিয়ে জলের স্রতোধারা নামিয়ে দিতে শুরু করে পৃথিবীর বুকে। বৃষ্টি কখনো কান্না হয়ে ঝরে কখনো বা হাসি। দিনের ফুটফুটে আলোকে বিদঘুটে অন্ধকারে পরিণত করে দিতে কয়েক মিনিটও সময় নেননি সৃষ্টিকর্তা। চারদিকে অন্ধকারে মাখামাখি। প্রবল বাতাসের বেগে গাছপালা ভেঙে চৌচির হয়ে যায়। তীব্র বাতাসে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দে মানুষের কোলাহল হয়ে যায় অতি নগন্য। সেই সুযোগ টাকেই কাজে লাগাই আমি। ত্বরান্বিত হয়ে গায়ের সব গহনা খুলে ব্যাগপএ আর কিছু টাকা নিয়ে আপুকে রুমে রেখেই বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে দেই। ভিতর থেকে আপু কি বলছিলো সেগুলো শোনার জন্য সময় নষ্ট না করে ব্যাগ বুকে জড়িয়ে খালি পায়ে ভিজতে ভিজতেই দেই দৌড়। কেউ দেখেছে? কেউ ডেকেছে? এসব দেখা বা ভাবার সময়টুকুও নিইনি। কখনো শাড়ির সাথে পা বেজে পড়ে যাওয়ার পূর্বমূহর্তেই নিজেকে সামলে নেই। কখনো বা বড়সড় আঘাত পেলেও সেই আঘাতকে অতি তুচ্ছ করে দেখি। এই ঝড়, বৃষ্টি তে আমার পিছু নেওয়ার জন্য কেউ বসে থাকবে না নিশ্চয়ই। বাবা,চাচারা বাজারে গেছেন। মা চাচি রান্না ঘরে নিশ্চয় বাটা ঘষা করছিলো। অল্পসংখ্যক আত্মীয় তাঁরাও ঝড়,বৃষ্টি দেখে অন্য ঘরে ঘাপটি মেরে বসে আছে। তবুও আমি তরান্বিত হয়ে ছুটে যাচ্ছিলাম। বুকের ভিতর ধড়ফড় ধড়ফড় ধ্বনি টা বোধহয় কলহ শুরু করে দিয়েছে আজ। তাণ্ডবের সূচনা শুধু পৃথিবীর বুকেই ঘটেনি। আমার বুকেও তাণ্ডবের সূচনা হয়েছিল তখন। খালি পায়ে বাসস্ট্যান্ডের দিকে দৌড়াচ্ছিলাম। বেজে পড়লাম তো পড়লাম সেই কাকাতো ভাই সাব্বিরের সাথেই বেজে পড়লাম। দুহাত ভর্তি বাজার করে বাড়ি ফিরছিলো বেচারা। আমাকে দেখেই এক চিৎকার দিয়ে বললো,
-‘ সাবারে তুই কই যাস ‘।
আমি ওকে ধাক্কা দিয়েই আবার দৌড় লাগাই। মাগরিবের আজানের পূর্বমুহূর্ত চারদিকে যেমন আবছা আলো থাকে সে সময়টিতে চারপাশ ঠিক তেমনি ছিলো। যে কজন মানুষ সামনে পড়েছে তাঁরা কাকভেজা হয়ে বাড়ি ফিরছিলো আশেপাশে তেমন দৃষ্টি ফেলার সময় তাঁদের হয়নি। কিছুলোকের দৃষ্টি পড়লেও পাত্তা দেয়নি। আর সাব্বির সে তো আমার ধাক্কা খেয়েই থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি দূর থেকে চিল্লিয়ে শুধু বলে দিলাম,
-‘ ভাই আমার বাড়ি যা আম্মাকে বলে দিস আমার জন্য চিন্তা না করতে আমি শহড়ে ফিরে যাচ্ছি ‘।
.
লাল শাড়ি পরিহিত আমি বিধ্বস্ত মুখশ্রীতে বসে আছি বাসে। পৃথিবীর বুকে সুনামি হওয়ার পর পরিবেশ যেমন থমথমে থাকে আমার মুখশ্রীতে তেমন একটি ভাব৷ কিন্তু বুকে বয়ে চলেছে অসহনীয় ব্যাথা৷ আবার সে ব্যাথায় স্বস্তিও বোধ করছিলাম। জিতেছি যে ভালোবাসার জিত হয়েছে। আমার নির্মলের অপেক্ষার অবসান ঘটতে চলেছে। প্রথম দর্শনে খানিক চমকালেও শেষ হাসিটা আজ সে হাসবেই। বাসের কনট্রাক্টর থেকে শুরু করে প্রতিটি যাএীই আড় চোখে তাকাচ্ছিলো। অনেকে আবার কানাঘুষাও করছিলো। করবে নাইবা কেনো? বিধ্বস্ত মুখশ্রীতে বিয়ের কনে সাজে বসে আছি৷ বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়েছি তা আমার সাজসজ্জা আর মুখশ্রীতেই ফুটে ওঠেছে। কিন্তু এতে আমার জায় আসেনা। পুরো পৃথিবীর সম্মুখে আজ আমি কলঙ্কিত তবুও নেই কোন আপত্তি। সকল দুঃখ,সকল বেদনা, সকল বদনাম,সকল কলঙ্ক গায়ে মেখেই আমি ছুটে চলেছি আমার প্রিয়র নিকটে।
সকল ব্যাকুলতার অবসান ঘটিয়ে আটটার দিকে ঢাকায় পৌঁছালাম আমি। বাস থেকে নামতেই শরীর অকর্মণ্য হয়ে গেলো। কয়েক পা ফেলতেই মাথাটা ঘুরে গেলো। সারাদিন না খেয়ে ছয়ঘন্টা জার্নি করার ফল ছিলো। তারওপর পায়ের বিভিন্ন অংশ ছিলে গেছে। খালি পায়ে বেশ অনেকটুকু রাস্তা হাঁটতে হয়েছে যে৷ কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে রিকশায় ওঠে পড়লাম। বৃষ্টিভেজা রাতের শহর। পরিবেশ টা কেমন ভ্যাপসা। রাতের শহরও কোলাহল পূর্ণ। রাতের শুরু হয়েছে ধীরে ধীরে জনমানব শূন্য হতে থাকবে। রাস্তার এক পাশে ড্রেনের ওপারেই কয়েক জোরা কাক ডাকছে। কাকের কর্কশ ডাকে আমার কর্ণকুহরে রক্তপাত ঘটিয়ে ফেলার উপক্রম। ভ্রু কুঁচকে গলায় স্বাভাবিক স্বর ফিরিয়ে আনার তীব্র চেষ্টা করে আধভাঙা আওয়াজে রিকশাওয়ালাকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
-‘ মামা তারাতাড়ি চলুন ‘।
১৩.
রিকশার ভাড়া মিটিয়ে বাড়ি প্রবেশ করি। আশ্চর্য সদর দরজা খোলাই ছিলো। রাত বাজে আটটা পঁচিশ এ সময় দরজা খোলা? এই নির্মল, নির্ঝর কে নিয়ে আর পাড়া যায় না। ছেলেদুটো বড্ড বেখেয়ালি। নিশ্চয়ই মামিরা আসেনি তাই এই অবস্থা বাড়ির। বিরবির করতে করতে মামির রুমের তালা খুলে ঢুকে ব্যাগপএ রেখে উপরে গিয়ে নির্মলের রুম চেক দিলাম। নাহ রুমে নেই কিন্তু রুমটা বড্ড অগোছালো। বিছানা থেকে নির্মলের শার্টগুলো গুছিয়ে কাবার্ডে রেখে দিলাম। ছেলেটা একটা শার্ট পড়ার জন্য একশটা অগোছালো করে তবেই পড়ে আর গোছানোর নাম নেয় না। তয়ালে রশিতে ঝুলিয়ে দিলাম। বালিশগুলো ঠিক করতেই নির্মলের বাটন ফোনটা চোখে পড়লো। বিরক্ত হয়ে ওর ফোন নিয়ে নির্ঝরকে ফোন দিয়ে কানে ফোন ধরেই সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে থাকলাম৷ কি বেআক্কেল ছেলে ফোনটাও সাথে রাখেনা রুমে রেখে দিয়েছে। টেলিফোন থেকে যদি ফোন দিতাম তাহলেতো পেতামই না। মশাই রুমে ফোন রেখে বাইরে টোটো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে হয়তো। এইদিকে আমি যে পুরো একটা বিশ্ব জয় করে ফিরেছি সে খবর কি সে জানে? এই তাঁর ভালোবাসার নমুনা হুহ! বাসায় আসুক আজ সব সুধে আসলে মিটিয়ে নিবো। আরেকদফা আশ্চর্য হলাম। এই নির্ঝরটাও ফোন ধরছে না। দুই ভাইয়ের কাহিনী কি হুম? মেজাজ খারাপ করে সোফায় বসতে যেতেই কিছুতে পাড়া লাগলো। দেখার জন্য ঝুঁকতেই ভীতিকর বিস্ময় নিয়ে কাগজটা হাতে তুলে নিলাম৷ হ্যাঁ এটা সেই কাগজটাই হ্যাঁ এখানে সেই লিখাগুলোই রয়েছে গত দুদিন আগে লেখা যে কাগজটি আমি সাব্বির কে দিয়ে নির্মলের ঠিকানায় পাঠিয়েছি। ওহ মাই গড তাঁর মানে নির্মল চিঠিটা পেয়েছে। তাহলে সে কোথায়? চিঠি পেয়ে উন্মাদ হয়ে গ্রামে চলে যায় নি তো? পুরো শরীরে ঘাম ছেড়ে দিলো আমার। নির্ঝরও ফোন ধরছে না। একহাতে পুরো মুখ মুছে ডায়নিং টেবিল থেকে একগ্লাস পানি খেয়ে আবারো নির্ঝরকে ট্রাই করতে থাকলাম আর পুরো ড্রয়িংরুমে পাইচারি শুরু করে দিলাম। হঠাৎই মেঝের একপাশে চোখ পড়লো। পা থেকে মাথা অবদি পুরো গা শিউরে ওঠে হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেলো আমার ।
চলবে…
.