বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৯
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
ফজরের সময় ঘুম থেকে উঠার মাধ্যমে আজকের দিন শুরু হলো। এমনিতেও রাতে তেমন ঘুমাতে পারিনি আমি। পরেরদিন কোন জরুরি কাজ থাকলে সেই রাতে আমার ঘুম ধরেনা। এ আমার এক বহু পুরনো বাজে স্বভাব! আজকেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবুও আজ ভোরেই উঠেছি, বোনের বিয়ে বলে কথা! আজ বিশ্রামের সুযোগ নেই হাতে!
নামাজ পড়ে রুমের বাইরে বের হতেই দেখি আন্টিও উঠে গেছেন। টুকটাক কাজ করাও শুরু করে দিয়েছেন। আমাকে আসতে দেখে আলতো হাসলেন তিনি। আমি আন্টিকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
—রাইসার বিদায়ের কথা মনে করে তোমার অনেক মন খারাপ, তাইনা আন্টি?
—না রে মা। আমি ঠিক আছি।
(মলিন সুরে বললেন আন্টি)
—দেখতে পাচ্ছি তো তুমি কতটা ঠিক আছো! দেখো আন্টি, আমি জানি তোমার মন খারাপ হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। একমাত্র মেয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে আজকে, এটা যেকোন মায়ের কাছেই খুব কস্টের ব্যাপার। কিন্তু তুমি যদি এভাবে ভেঙে পড়ো তবে রাইসার কি হবে বলো তো? ওর জন্য হলেও নিজেকে সামলাতে হবে তোমার। আর তুমি মন খারাপ করো কেন? আমি আছিনা? রাইসার অভাব পূরণ করতে না পারলেও আমি তোমায় মন খারাপ করে থাকতে দিবোনা, বুঝেছো?
আমার কথা শুনে আন্টি হালকা হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন আমায়। তার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো নোনা জল। পৃথিবীর সব মায়ের মন বোধহয় এমন নরমই হয়!!
_________
শাড়ি পড়ার জন্য আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কুচি ঠিক করার চেস্টা করছি। কারণ শাড়ি পড়ার ক্ষেত্রে আমার অভিজ্ঞতা একেবারেই নেই বললেই চলে। শাড়ি আমার ভীষণ পছন্দ হলেও ক্ষেত্রবিশেষ ব্যতীত শাড়ি ছুয়েও দেখা হয়নি কখনো। যতবার পড়েছি আন্টি সাহায্য করেছেন কিন্তু আজ তিনি ভীষণ ব্যস্ত তাই নিজে নিজেই চেস্টা করতে হচ্ছে আমায়। ইউটিউব দেখে কোনরকম দেখতে মানানসই লাগার মতো শাড়ি পড়ে ফেললাম আমি। মাঝপথে যেন এটা খুলে না যায় সেই দোয়া করতে লাগলাম মনে মনে! বিয়েবাড়ি ভর্তি মানুষের সামনে এরকম অবস্থা হলে লজ্জায় কাউকে মুখই দেখাতে পারবো না আমি!
তবে এখন বেশি কিছু ভাবার সময় নেই, মেকাপ করাও বাকি আছে এখনো। এদিকে রেডি হয়ে রাইসাকে দেখতে যেতে হবে ওর রুমে। চিন্তাভাবনার মধ্যেই আলতো হাতে মেকাপ করে নিলাম আমি। চুলগুলো পুরোপুরি না আচড়িয়ে হালকা এলোমেলো করে খোলাই রাখলাম। আয়নায় তাকিয়ে দেখলাম, নাহ দেখতে খুব একটা খারাপ লাগছে না! নীলরঙা শাড়িতে বেশ ভালোই দেখাচ্ছে আমাকে!
রাইসার রুমে নক করতেই গেট খুলে দিলো পার্লারের আপুটা। তাকে পেরিয়ে সামনে এগিয়ে যেতেই লাল টুকটুকে জামদানীতে রাইসাকে দেখতে পেলাম আমি! ভীষণ সুন্দর লাগছে ওকে! আজ তো প্রান্ত ভাইয়া ওকে দেখে পাগল হয়ে যাবেন ভেবে হাসলাম আপন মনেই। আমাকে দেখে রাইসাও প্রশংসা করলো আমার। আমাদের কথার মাঝেই ওর বাকি কাজিনরা প্রবেশ করলো রুমে। পার্লার থেকে রেডি হয়ে এসেছে সবাই আজকে। খুব ভালো লাগছে প্রত্যেককে! ওদের থেকে জানলাম বাইরে আত্মীয়স্বজনরা সবাই চলে এসেছেন যে যার মতো। ড্রয়িংরুমে বসে আছেন সবাই।
এখন অপেক্ষা শুধু বরপক্ষের আসার!
সবাই মিলে আড্ডা দিচ্ছিলাম রাইসার রুমে। বিয়ে পরবর্তী আলোচনা নিয়ে ওকে বেশ ক্ষেপানো হচ্ছিলো। রাইসা লজ্জা পেলেও বাকিরা সবাই বেশ উপভোগ করছিলাম ব্যাপারটা! আমাদের গল্পের মধ্যে রুমে প্রবেশ করলেন রায়হান ভাইয়া। এসেই জানালেন বরপক্ষ এসে গেছে। এটা শুনেই রাইসা হাত খামচে ধরলো আমার। বুঝলাম ও নার্ভাস হয়ে গেছে বেচারি। ওর হাতের উপর হাত রেখে ভরসার আশ্বাস দিলাম ওকে। তারপর সবাই মিলে বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো বউকে তার বরের কাছে।
মুখোমুখি বসে আছেন প্রান্ত ভাইয়া ও রাইসা। ভাইয়ার পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছেন তার দুই ভাই-বোন ও কাজিনরা। আর রাইসার পাশে দাঁড়িয়ে আছি আমি, রায়হান ভাইয়া সহ ওর বাকি কাজিনরা। একটু পরেই কাজি সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করবেন! বেশ এক্সাইটমেন্ট কাজ করছে সবার মধ্যে! প্রান্ত ভাইয়ার কাজিনদের অবশ্য ভাবই আলাদা। পাঞ্জাবির সাথে সানগ্লাস পড়ে দাঁড়িয়ে আছেন সবাই। কে কোনদিক তাকিয়ে আছে কিছু বুঝা যাচ্ছে না। পূর্ণ ভাইয়ার রোগ কি সবার লাগলো নাকি ভাবতে লাগলাম আমি।
ভাবতে ভাবতেই চোখ গেলো পূর্ণ ভাইয়ার দিকে! ফর্সা শরীরে নেভি-ব্লু রং এর পাঞ্জাবি দারুণ মানিয়েছে। হাতা গুটিয়ে রেখেছেন কনুই পর্যন্ত। তবে তার ঠোঁটের কোণায় সুক্ষ্ম হাসির রেখা দেখা যাচ্ছে। এই লোকটা হাসতেও পারে? অবাক হয়ে গেলাম আমি। তবে তার মুচকি হাসির কারণটা কি ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম নাহ আমি।
আমার চিন্তার মধ্যেই রায়হান ভাইয়া ডাকলেন আমায়। তার দিকে তাকাতেই হাসিমুখে বললেন,
—শাড়িতে বেশ সুন্দর লাগছে তোমায়। নিজে নিজেই পড়েছো নাকি?
হঠাৎ করেই তার মুখে নিজের প্রশংসা শুনে একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম আমি। হালকা হেসে ধন্যবাদ দিয়ে বললাম নিজেই পড়েছি। রায়হান ভাইয়া আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু কাজি সাহেবের কথার প্রভাবে মাঝপথেই থামলেন তিনি। যথারীতি বিয়ে পড়ানো শুরু হলো। প্রান্ত ভাইয়াকে কবুল বলার কথা সাথে সাথেই উনি গটগট করে তিনবারই বলে দিলেন। রাইসাও প্রথমে একটু সময় নিলেও পরে ঠিকি কবুল বললো। সাইন করা এবং বাকি ফর্মালিটিজ শেষ হওয়ার মাধ্যমে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন তারা!
বিয়ে পড়ানো শেষ হতেই মেহমানদের খাবার সেশন চালু হলো। এক এক করে ব্যাচে ব্যাচে খেতে গেলেন সবাই। আংকেল-আন্টির সাথে আমি ও রায়হান ভাইয়া তদারকি করছি মেহমানদের। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম ছবি তুলায় ব্যস্ত বাকি সবাই। শুধু পূর্ণ ভাইয়াই এক পাশে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছেন। নিশ্চয়ই অফিসের ফোনই হবে! ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকলাম সেদিকে। এই লোকটার কি এমন কাজ যে নিজের ভাইয়ের বিয়েতেও তাকে অফিসের লোকের সাথে ফোনে কথা বলতে হবে?
একটা দিন কি ছুটিতে থাকা যায়না! আজব। পরে ভাবলাম উনি যাই করুক, আমার কি?
হঠাৎ উনি আমার এদিকে তাকাতেই আমি দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নিলাম অন্যদিকে! ভাগ্যিস দেখেননি আমায়। নয়তো না জানি কি মনে করতেন উনার দিকে এতক্ষণ তাকিয়ে থাকার জন্য! ছিঃ!!
একটু পর প্রিয়াকে দেখলাম আপন মনে ছবি তুলছে নিজের। সাথে একা একা ভিডিও করছে চারপাশের! মেয়েটা বড়ই চঞ্চল। মুচকি হেসে ভাবলাম আমি!
__________
দুই ব্যাচ খাওয়া শেষ হতেই আস্তে আস্তে কিছু মেহমান চলে যেতে শুরু করেছে অল্প অল্প করে। এতক্ষণ চারদিকে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে আমার শাড়ির অবস্থা নাজেহাল প্রায়। নিরিবিলি পেয়ে কোনরকম কুচি হাতে ধরে নিজ রুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম আমি। উদ্দেশ্য এই এলোমেলো শাড়িকে ঠিক করে পড়া! তাড়াহুড়োর মধ্যে সামনের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করে রায়হান ভাইয়াকে আমার দিকে আসতে দেখে লজ্জায় ও চিন্তায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম আমি! কোনদিক যাবো না যাবো ভাবতেই শাড়ির কুচি পায়ের নিচে পরায় পড়ে গেলাম মাটিতে। আমাকে হঠাৎ করে পড়তে দেখে অবাক হয়ে এগিয়ে এলেন রায়হান ভাইয়াও কিন্তু আমার শাড়ির আচলে পা পিছলে আমার সাথে পড়ে গেলেন উনিও।
হঠাৎ করেই যে এত বিশ্রি পরিস্থিতিতে পড়বো আমার কিছুতেই মাথায় আসেনি! রাগে-ভয়ে-লজ্জায় যেন থম মেরে আছি আমি। কি করবো বুঝে উঠতে পারছিনা। রায়হান ভাইয়াও অপ্রস্তুতভাবে অন্যদিকে তাকিয়ে আছেন হতভম্ব হয়ে! তিনিও এইরকম পরিস্থিতি আশা করেন নি আমার মতো! কোনমতে নিচের শাড়ির আচল দিয়ে গা ঢেকে মাটি থেকে উঠতে যাবো এমন সময় কিছু মহিলার আওয়াজ শুনলাম,
—দেখো দেখো, বিয়েবাড়ির মধ্যেই কি শুরু করেছে এরা? লজ্জাশরমের মাথা খেয়েছে আজকালকার ছেলেমেয়েরা।
তাদের কথায় অলরেডি আরও লোকজন ভীড় জমাতে শুরু করেছেন। তাদের কথা শুনে ও এত মানুষ দেখে আমার মাথা ঘুরে উঠলো। না জানি কি ভাবছে সবাই আমাদের নিয়ে? ছিহ!! এর মধ্যে রায়হান ভাইয়া ততক্ষণে উঠে দাড়িয়েছেন। আমি কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। হঠাৎ করেই যেন মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে আমার। এরই মধ্যে সামা আপু এগিয়ে এসে আমাকে টেনে তুলে শাড়ির আচল দিয়ে ভালো করে মুড়িয়ে দিলেন আমায়। আংকেল-আন্টিসহ পূর্ণ ভাইয়ারাও চলে এসেছেন এতক্ষণে! না জানি আমায় কি ভাবছেন তারা! আড়চোখে পূর্ণ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখি সানগ্লাস খুলে ফেলেছেন এতক্ষণে। শক্ত হাতের মুঠোয় চেপে ধরে আছেন সেটাকে। দূর থেকে মনে হলো তার হাত যেন কাপছে তবে সেটা আমার চোখের ভুল কি না জানিনা!
লজ্জায়-অপমানে মাথা নিচু করে রেখেছি আমি। এদিকে রায়হান ভাইয়া বিয়েবাড়ির সবাইকে বুঝাতে শুরু করেছেন যে আমাদের মধ্যে যা ভাবছেন তারা, তেমন কিছুই হয়নি কিন্তু কেউ তার কথা মানতে নারাজ! মনে হচ্ছে পরিস্থিতি অন্যদিকে চলে যেতে শুরু করেছে।
_____
নিজ রুমে বসে চোখের জল ফেলছি আমি! কস্মিনকালেও ভাবিনি এইরকম জঘন্য পরিস্থিতিতে পড়বো আমি। তাও আবার রায়হান ভাইয়ার সাথে! যাকে আমি এতটা সম্মান করি। এখন তো তার দিকে চোখই মিলাতে পারবোনা আমি আর। দাদি ইতোমধ্যেই রেগে হইচই শুরু করে দিয়েছেন! তার শান্তশিষ্ট নাতিকে নাকি রুপের জালে ফাসিয়েছি আমি। পরের মেয়ে কোনোদিন আপন হয়না! তার কথা শুনে মনে কস্ট লাগলেও ঠিক কি রিয়েকশন দিবো ভেবে পাচ্ছি না আমি! প্রমাণই বা কি আছে আমার কাছে? কিছুই তো করার নেই আমার। আমি বললেও কেউ বিশ্বাস করবেনা হয়তো।
আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের এলোমেলো চেহারার দিকে তাকালাম আমি। কেদেকেটে কাজল লেপ্টে গেছে চোখের চারপাশে। ভাবলাম আদৌ এটা লেখা ছিলো আমার কপালে? কি দোষ করেছি আমি!
এই অপমানের দাগ কিভাবে মিটাবো আমি নিজের চরিত্র থেকে? কিন্তু আমার চোখের জলের সাক্ষী হিসেবে সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কেউ নেই পাশে।
#চলবে
কেমন লাগলো সবার নতুন টুইস্ট? জানাতে ভুলবেন না আমায়। আর আগেই বলে দিচ্ছি কাল ভীষণ ব্যস্ত থাকবো আমি তাই লেখার সময় হয়তো পাবোনা। এজন্য আজই দিয়ে দিলাম পর্বটা। কেউ কাল অপেক্ষা করবেন না প্লিজ? ধন্যবাদ।