বৃষ্টিময় প্রেম
পর্ব ২২
লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা
দূর আকাশে চাঁদ উঠেছে, তার সৌন্দর্যের আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। বারান্দার এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন পূর্ণ, উনার থেকে খানিকটা দূরত্ব রেখে অপর পাশে দাঁড়িয়ে আছি আমি। চাঁদের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি আমি। নিজের উপর কারও দৃষ্টি অনুভব হতেই দ্রুত পাশ ফিরে তাকালাম। আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন পূর্ণ৷ আমি তাকাতেই চোখ পুনরায় চাঁদের দিকে ফেরালেন উনি! ভ্রু কুচকে গেলো আমার! আড়ালে যখন তাকিয়েই ছিলেন তখন আমি তাকানোর পর দৃষ্টি ফেরানোর মানে কি? অদ্ভুত লোক একটা!!
বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হলো, দুজনের মধ্যে কোন কথা নেই। নীরবতাটাই যেন আমাদের মধ্যে দেয়াল হয়ে দাড়িয়েছে৷ তবে কি কথা দিয়ে শুরু করবো আমি নিজেও ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম নাহ! হঠাৎ মাথায় এলো চুড়িগুলোর জন্য ধন্যবাদ বলবো উনাকে। যেই ভাবা সেই কাজ। কিন্তু উনাকে থ্যাংকস বলার জন্য মুখ খুলতেই মাঝখান থেকে ডিস্টার্ব দিলো আমার ফোন!! কর্কশ শব্দে কেপে উঠলো ফোনটা আমার হাতের মুঠোয়। সেই শব্দ শুনে পূর্ণও এতক্ষণে ঘুরে তাকিয়েছেন আমার দিকে। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি আমার বেস্টু বুশরা ফোন দিয়েছে! ওর নাম দেখেই কোনমতে বারান্দা থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। কারণ পূর্ণর সামনে ওর সাথে কথা বলা যাবেনা! আর যাই হোক, দুই বান্ধবী একসাথে কথা বললে যে কি কি গল্প হয় তা আর অন্য কারও সামনে করা যায় নাকি?!
____________
রুমের বাহিরে গিয়ে কথা বলতে এসেছি বুশরার সাথে। ফোন ধরতেই শুনা গেলো ওর উত্তেজিত কণ্ঠ,
—হ্যালো তুর, শয়তান মাইয়া। বিয়ে করে তো ভুলেই গেছিস আমাকে।
—তোর মতো শেওড়াগাছের পেত্নীকে কি আর ভুলা যায় বল? মাঝেমধ্যে তো তোকে স্বপ্নে দেখে আমার ঘুমই ভেঙে যায় মাঝরাতে!! (শয়তানি হেসে)
—ধুর, ফাজিল মাইয়া। সবকিছুতেই ফাইজলামি তোর! রাখ এসব এখন!! এই সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ কেন তোরে ফোন দিসি সেটা শুনবিনা?
—ও হ্যাঁ, তাই তো! এটাই আগে বল। জানিস, উনার সাথে কথা বলতে ধরেছিলাম ঠিক ওই টাইমে কল দিছোস তুই। আর টাইমিং পাইলিনা ভাই!!
—ওহহো এখন দেখি এসবও চলে!! পুরা বউদের মতো ডায়লগ দেওয়া শুরু করেছিস দেখছি!! যাই হোক, সরি দোস্ত। না জেনেশুনে তোদের কাবাবে হাড্ডি হওয়ার জন্য। তবে যেই কথাটা এখন বলবো ওটা শুনে তোরও মাথা ঘুরবে নিশ্চিত!!
—কি হয়েছে?? তাড়াতাড়ি বল!! তোর কথা শুনেই আমার টেনশন শুরু হইছে!!
—যাক এবার আসলি লাইনে! যেটা বলছিলাম সেটা হলো আমাদের এইচএসসির রেসাল্ট দিবে নাকি খুব তাড়াতাড়িই। শুনেই তো আমার ভয় লাগতেছে দোস্ত!! আব্বু তো বলে দিছে রেসাল্ট খারাপ হলে আমাকে রিকশাওয়ালার সাথে বিয়ে দিবে!! (কাদো কাদো গলায়)
ওর কথা শুনে এই টেনশনের মধ্যেও খুব হাসি পেলো আমার। তবুও বেস্টু বলে কথা। সান্তনা তো দিতেই হবে! তাই ওকে বললাম,
—আচ্ছা চিন্তা করিস না, আমাদের রেজাল্ট ভালোই হবে ইন শা আল্লাহ। তবে এইদিক দিয়ে আমি বেচে গেছি দোস্ত!!
—মানে? রেজাল্টের আগেই কিভাবে বেচে গেলি?
—আরে গাধি, ভুলে গেছিস আমার বিয়ে হয়ে গেছে!! তাই আর রিকশাওয়ালার সাথে বিয়ে হবে কি না এই চিন্তা করতে হচ্ছেনা, শুধু রেজাল্টের চিন্তা করলেই হচ্ছে আমার!
দাত কেলিয়ে বললাম আমি।
—ইশ দোস্ত, আজ প্রথমবার তোর উপর হিংসা হচ্ছে আমার। আসলেই মারাত্মক একটা জামাই পেয়েছিস। আমি তো রাইসার আইডিতে উনার ছবি দেখেই ক্রাশ খেয়ে ফেলেছি! এত্ত হ্যান্ডসাম ছেলেকে দুলাভাই ডাকতে হবে ভেবেই আমার মনটা ভেঙে গেছে!! (দুঃখী গলায়)
—ছি ছি! আমার জামাইয়ের উপর নজর দিস। লুচু মাইয়া কোথাকার!! দুলাভাই হয় তোর!
—বাপরে! বিয়ে না হতেই “আমার জামাই” বলা শুরু করেছিস?? তুই তো দেখি অলরেডি দুলাভাইয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিস!!
বুশরার কথায় লজ্জা পেলাম আমি। হঠাৎ করেই কিভাবে রিয়েক্ট করে ফেলেছি ভাবতেই লজ্জা লাগছে এখন! যদিও একটু জেলাস ফিল হয়েছিলো ও পূর্ণ ভাইয়ার প্রশংসা করায়, কিন্তু তাও এমন রিয়েকশন দিবো সেটা বুঝিনি আমি। মুখ ফসকে বলে দিয়েছি কথাটা!! যাই হোক, বুশরার সাথে আরও কিছুক্ষণ কথা বলে, গল্পগুজব করে পরে ফিরে চলে আসছিলাম রুমে!
পথিমধ্যে দেখা হলো রাইসার সাথে। ও আমার দিকেই আসছিলো, আমাকে দেখেই বললো,
—কি রে তুরফা, তোর নাকি রেজাল্ট দিবে কয়দিন পর। জানিস কিছু??
—হ্যাঁ রে, শুনেছি। বুশরা ফোন দিয়েছিলো এজন্য এখনি। ওর থেকেই শুনলাম।
চিন্তিত মুখে বললাম।
—টেনশন হচ্ছে তোর?? (আমার গালে হাত রেখে)
—হবেনা আবার? যদিও আমি পরীক্ষা ভালোই দিয়েছি তবুও সত্যি বলতে খুব টেনশন হচ্ছে আমার।
—কিসের টেনশন হচ্ছে আমার মেয়েটার??
হঠাৎ করেই বড়াম্মুর কথা শুনে আমরা দুজন পিছন ফিরে তাকালাম। বড়াম্মু আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। তাকে দেখে বললাম,
—আমার এইচএসসির রেজাল্ট দিবে কয়দিন পর বড়াম্মু৷ খুব টেনশনে আছি আর বলোনা।
—এই পাগলি, এত টেনশনের কি আছে? আমি জানি তুই অনেক ভালো রেজাল্ট করবি! যা হওয়ার দেখা যাবে! একদম চিন্তা করিস নাহ!
—নাহ বড়াম্মু, তুমি জানোনা পরীক্ষার আগে টেনশনে আমার কি হাল হয়। আমার মন অন্য কোন দিকে ডাইভার্ট করতে হবে এখন! নয়তো সারাদিনই টেনশন করবো। আমাকে কোন কাজ দেও তো, বড়াম্মু!!
—আচ্ছা, তুই রুমে যেয়ে রেস্ট নে এখন। আমি ভেবে দেখছি তোকে কি কাজ দেওয়া যায় কাল!!
বড়াম্মুর কথায় মাথা নাড়লাম আমি। নিজ রুমে চলে এলাম, সাথে রাইসাও চলে গেলো ওর রুমে।
______________
সেই কখন থেকে একা একা বসে আছি রুমে। প্রচুর বোর হচ্ছি অনেকক্ষণ থেকেই। পূর্ণটা যে কই গেছেন এই রাতের বেলা আল্লাহ মালুম! মন চাইছে নিজেও রুমের বাইরে যাই কিন্তু এতক্ষণ রুমের বাইরেই ছিলাম তাই আর যেতে মন চাচ্ছেনা!
কিন্তু রুমে বসে একা একা মশাকে রক্তদান করা ছাড়া আর কোন কাজও পাচ্ছিনা আমি! রাইসার সাথে যে গল্প করব তারও সুযোগ নেই কারণ প্রান্ত ভাইয়া আছে ওর সাথে এখন। আমার নিজের বর না হয় টাইম দেয়না তাই বলে অন্যদের যেয়ে ডিস্টার্ব করব এটা মোটেও ঠিক হবেনা! ভাবলাম আমি!
উফফ,,একটা মশা বেশ অনেকক্ষণ ধরে একটু বেশিই বিরক্ত করছে। নাহ,এটাকে তো মারতেই হবে!! আমি ধরব ওটাকে কিন্তু মেইন টাইমে শয়তান মশাটা উড়ে গেলো, আমিও খুব মনোযোগের সাথে ওর পিছে পিছে ওকে মারতে গেলাম আর তখনি মশাটা সামনেই কিছু একটার উপর উড়ে গিয়ে বসলো। আমিও সুযোগ মতো মেরে দিলাম এক চড়! যাক, এতগুলো রক্ত খাওয়ার পর অবশেষে মশাটা ইন্তিকাল করলো ভেবে দাত কেলিয়ে সেই একটা হাসি দিলাম আমি!
আর তখনি হঠাৎ পূর্ণর চিৎকার শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। সামনে উনি রক্তচক্ষু নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কিন্তু আমি তৎক্ষণাৎ উনার এমন রাগ করার মতো কি করলাম বুঝতে পারলাম নাহ। একটা মশাই তো মেরেছি, এর জন্য এভাবে চিল্লাতে হবে নাকি? আমি অবাক হয়ে বললাম,
–কি হয়েছে? এভাবে ষাড়ের মতো চিল্লাচ্ছেন কেন?? (ভ্রু কুচকে)
–হোয়াট দ্যা হেল? তুমি কি অন্ধ?? আমাকে মারলে কেন তুমি আবার এখন ষাড় বলছো?? তোমার সাহস তো খুব বেশি হয়ে গেছে দেখছি!! (চিল্লিয়ে)
–কিহ!! আজব তো। আপনাকে কখন মারলাম আমি? আমি তো স্রেফ ওই মশাকে মেরেছি!
(অবাক হয়ে)
–আচ্ছা তাই? তো মিস স্টুপিড, মশাটা কোথায় বসেছে সেটা না দেখেই মেরে দিয়েছো নাকি?
(দাতে দাত চেপে)
আমি এবার ভালো করে তাকিয়ে লক্ষ্য করলাম। উনার বাম গালের একটু নিচ বরাবর মশার রক্ত লেগে আছে। এটা দেখেই ভয়ে জানপাখি উড়ে গেলো আমার!! ইশরে,,তার মানে আমি বেচারার গাল বরাবর মেরে দিয়েছি তাই বলে? এজন্যই এত রেগেছেন উনি! আল্লাহ!! হয়তো মারটা একটু জোরেই মেরেছিলাম মশার জন্য, তাই তো উনার ফর্সা গালের ওই জায়গাটা খানিকটা লালচে হয়ে আছে!! সেটা দেখে খুব আফসোস হলো আমার!! নিজের উপর নিজেরি রাগ হলো খুব! পূর্ণ ঠিকি বলে। আমিও আসলেই একটা স্টুপিড! কি থেকে কি করে ফেলি নিজেও বুঝিনা!!
এখন কি করবি তুই, তুরফা? আরও মশা মার বেশি করে!! স্টুপিড কোথাকার!!
নিজ মনেই ভেবে নিজেকে বকা দিলাম আমি। এদিকে পূর্ণ এখনও আমার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে আছেন। উনার রাগ তো ভাঙাতে হবে। আর কিভাবে এ কাজ করবো সেটা ভাবতে লাগলাম আমি!!
#চলবে
.
.