বৃষ্টিময় প্রেম
পর্ব ৪৬
লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা
নির্জন রাস্তায় ছুটে চলছে বাইক। বৃষ্টির বেগ কমেনি একটুও, বরং সময়ের সাথে সাথে একটু করে বাড়ছে যেন! বেশ জোরেই বাইক চালাচ্ছেন পূর্ণ, উনার শার্ট ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে গিয়েছে, সেই কাধে হাত রেখে নিঃশব্দে বসে আছি আমি। লুকিংগ্লাসে খানিকটা সময় পর পর চোখাচোখি হচ্ছে দুজনের! বলা বাহুল্য, ফাকা রাস্তায় এমন বৃষ্টিময় মুহুর্ত- ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করছি আমরা। নীরবতা কাটিয়ে পূর্ণকে প্রশ্ন করলাম,
—আচ্ছা, আপনি এই বৃষ্টির মধ্যে বাইকেই কেন যেতে চাইলেন? দেখুন না অযথাই ভিজে যাচ্ছি আমরা। আমাকে আপনার সাথে যদি নেওয়াই লাগতো তবে আপনার বন্ধুদের গাড়িতে গেলেও তো পারতাম?
আমার প্রশ্নে পূর্ণ ভ্রু কুচকালেন যা বাইকের আয়নায় স্পষ্ট দেখতে পেলাম আমি। ব্যাঙ্গাত্বক সুরে বললেন,
—ওদের সাথে এক গাড়িতে তুমি যেতে চাও? শুনলে না ওরা কেমন কথা বলছিলো? রেস্টুরেন্টে ওইটুক শুনেই তো অসস্তিতে পড়ছিলে, একান্তে আমাকে ওরা কিসব বলেছে সেসব শুনলে তো নির্ঘাত অজ্ঞান হয়ে যেতে! যার জন্য করলাম চুরি সেই বলে চোর! দুনিয়াটা সত্যিই নিষ্ঠুর। বুঝলে, তুরফা?
ঠোঁট বাকিয়ে বললেন উনি। উনার কথা শুনে আমি কিছুটা লজ্জা পেলাম! আমি কি অতসব ভেবেছি নাকি? তাই কথা ঘুরানোর জন্য বললাম,
—তা না হয় বুঝলাম কিন্তু আমি তো এমনিতেও রাইসাদের সাথে আমাদের গাড়িতে আসছিলাম তাই না? ওদের সাথেই আসতাম না হয়! জায়গা তো ছিলোই ওখানে। আপনি হঠাৎ কেন আমার সাথে বাইকে যেতে চাইলেন?
আমার এত প্রশ্নে পূর্ণ বেশ বিরক্ত হলেন বোধহয়। তীক্ষ্ণ চোখে আয়নায় আমার দিক তাকিয়ে বললেন,
—কেন আমার সাথে বাইকে যেতে ভালো লাগছেনা তোমার? গাড়িতে রায়হানের সাথে গেলে খুব ভালো লাগতো, তাই না?
উনার কথায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম আমি! এখানে রায়হান ভাইয়া কই থেকে আসলেন? ইতস্তত গলায় বললাম,
—রায়হান ভাই কি করেছেন? উনি তো যেতেই চাচ্ছিলেন না, পরে সবার কথায় রাজি হয়ে গেলেন আমাদের সাথে যাওয়ার জন্য৷ প্রান্ত ভাইয়াই তো বলেছিলেন উনাকে…
—আমি জানি, তোমাকে আর বলতে হবেনা। প্রান্তটারও কি দরকার ছিলো রায়হানকে তোমাদের গাড়িতে যাওয়ার কথা বলার আমি বুঝিনা! রায়হানের সাথে তোমাকে আমি যেতে দিবো?
—কেন দিবেন না?
উনার চোখেমুখে জেলাসি ছড়িয়ে আছে, সেটাকে একটু বাড়াতে ইচ্ছে করেই অবুঝের মতো প্রশ্ন করলাম আমি। পূর্ণ চোয়াল শক্ত করে বললেন,
—তুমি কি বুঝোনা ও তোমাকে পছন্দ করে? অবশ্য বুঝবে কি করে? বুঝার জন্য মাথায় ঘিলু থাকতে হয়, যেটা তোমার মাথায় নেই। আমার সাথে এতদিন একসাথে থেকে আমারটাই বুঝোনি আর তো রায়হানেরটা! স্টুপিড!
একটু থেমে আবার বললেন,
—আজকে তো তোমার জন্য বিরহের গানও গাইছিলো, আমার এত রাগ হচ্ছিলো নাহ! শুধু নেহাৎই বন্ধুমহলের সবাই ছিলো সেখানে আর রায়হান আমার পূর্বপরিচিত এজন্য নিজেকে কন্ট্রোল করছিলাম আমি। নয়তো অন্য কেউ আমার সামনে আমারই বউয়ের জন্য গান গাইবে সেটা আমি মোটেও সহ্য করতাম না!
কথাগুলো বলতে বলতে রাগের চোটে বাইকের স্পীড বাড়িয়ে দিলেন উনি। এখন উনাকে আর রাগানো যাবেনা, ঠান্ডা করতে হবে। তাই আমি উনার কাধ থেকে হাত সরিয়ে তার কোমড় ভালো করে জড়িয়ে ধরে কোমল কন্ঠে বললাম,
—শান্ত হোন আপনি। রায়হান ভাইয়া আমাকে বিয়ের আগে পছন্দ করলেও আমার মনে হয়না এখন তার মনে এমন কিছু আছে। সবারই তো অতীত থাকে তাই না? আর আপনি এত রেগে যাচ্ছেন কেন? আমার ভয় লাগছে, প্লিজ স্পীড একটু কমান।
আমার নরম কথায় ও আচরণে কাজ হলো বোধহয়। পূর্ণ খানিকটা শান্ত হলেন, বাইকের স্পীড কমে গেলো। পূর্ণ কিছুক্ষণ চুপ করে হঠাৎ অভিযোগের সুরে বললেন,
—আমি জানি রায়হান এখন মুভ অন করার চেস্টা করছে। তোমাকে দেখেই ও এখন চোখ ফিরিয়ে নেয়, আমি খেয়াল করেছি। আর আমি এটাও জানি যে ও খারাপ ছেলে নয়। কিন্তু আমিও বা কি করবো বলো? তোমাকে আমি ছাড়া অন্য কেউ পছন্দ করে, তোমাকে নিয়ে অন্য কেউ ভাবে এটা ভাবতেই আমার রাগ চলে আসে। আমি তখন নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি। তুমি আমার বউ, অন্য কেউ কেন তোমাকে পছন্দ করবে? এখানে যদি আমার রাগ আসে তবে সেটা কি আমার দোষ, তুর পাখি?
হঠাৎ পূর্ণর এমন বাচ্চাসুলভ কথায় বেশ মজা পেলাম আমি। তবে উনার কথায় ও আচরণে স্পষ্ট পুরুষালি অধিকারবোধ। কোথায় যেন শুনেছিলাম প্রেমিকাকে অন্য পুরুষের সাথে দেখে যদি তার পা থেকে মাথা অব্দি না জ্বলে তবে সে কিসের প্রেমিক? এখন পূর্ণকে দেখে কথাটির হাতেকলমে প্রমাণ পেয়ে গেলাম আমি! উনি তো আমার প্রেমিকও নন, আমার স্বামী। যে মানুষটার আমার উপর অধিকারবোধ এ দুনিয়ায় সবথেকে বেশি! তাই উনার মুখে এসব কথায় আমি আজ অবাক হলাম নাহ, বরং উনার আচরণ বেশ মানানসই লাগলো আমার কাছে! আয়না ভেদ করে লক্ষ করলাম উনাকে! বৃষ্টির পানি ভিজিয়ে দিচ্ছে তার সুন্দর মুখশ্রী! মাঝেমধ্যে চোখের পাপড়ির উপর পড়া পানির ফোটাগুলো সরাতে হুটহাটই চোখ পিটপিট করছেন সামনের দিকে তাকিয়ে! দৃশ্যটা কেন জানি বেশ চমৎকার লাগলো আমার কাছে।
হঠাৎ করেই আজ উনাকে বড্ড বেশি ভালো লাগছে আমার কাছে! বিয়ের পর থেকে ভালো তাকে সবসময়ই লেগেছে কিন্তু আজ উনার মনের কথাগুলো জানার পর থেকে যেন আলাদা প্রশান্তি কাজ করছে আমার মাঝে, উনার প্রতি কোন জড়তা কাজ করছেনা আর! পূর্ণও অনেকটাই সহজ হয়ে গেছেন আমার সাথে, সরাসরি মনের কথাগুলো প্রকাশ করছেন। বিষয়টা ভাবতে ভাবতেই এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো মুখে! পুনরায় আয়নায় তাকিয়ে দেখি পূর্ণ নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে চুপচাপ বাইক চালাচ্ছেন মনোযোগ দিয়ে! ইশ এত্ত সুন্দর লাগছে কেন লোকটাকে? উনাকে দেখার মাঝেই আচমকা একটা অদ্ভুত ইচ্ছা জেগে উঠলো মনে! হুট করেই একটা দুঃসাহসিক কাজ করে ফেললাম আমি! হঠাৎই উনার সাথে ঘেঁষে পেছন হতেই এগিয়ে তার গালে টুপ করে চুমু দিয়ে ফেললাম। আমার আচরণে স্তব্ধ হয়ে তৎক্ষনাৎ জোরে ব্রেক কষলেন পূর্ণ! হঠাৎ বাইক থেমে যাওয়ায় ভয়ে উনাকে খামচে ধরে তার পিঠের সাথে লেপ্টে যাই আমি।
এদিকে পূর্ণ জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন। যেন আমার দ্বারা এমন সময়ে এমন আচরণ কস্মিনকালেও আশা করেননি উনি! আমার হাত পেছন থেকে তার বুকের উপর ধরে থাকায় টের পেলাম উনার বুকের দ্রুততম হৃদস্পন্দন। ধুকপুকানি যেন বেড়েই চলেছে ক্ষণে ক্ষণে! এদিকে আবেশের বশে কি করে ফেলেছি বোধগম্য হতেই লজ্জায় নুইয়ে গেলাম আমি! মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছি কোন কথা ছাড়াই৷ খানিকক্ষণ বাদে পূর্ণ গলা ঝেড়ে পুনরায় বাইক স্টার্ট দিতে দিতে বললেন,
—হঠাৎ করে এমন আক্রমণ করে আমার তৃষ্ণা বাড়িয়ে দিলে কেন, বৃষ্টিকন্যা? আমার প্রতি তোমার এ অবিচার কিন্তু বৃষ্টিও সহ্য করবেনা!
পূর্ণর কথা বলতে দেরি কিন্তু বৃষ্টির বেগ বাড়তে দেরি হলোনা! যেন বৃষ্টিও সায় দিলো উনার কথায়! এদিকে এতক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজে আমার নাজেহাল অবস্থা। পূর্ণ কিছু বলার আগেই হাচ্চি দিলাম আমি। বাইক চালানো শুরু করে আয়নায় আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে পূর্ণ বললেন,
—দেখেছো? আমার জন্য চিন্তা করছিলে তুমি এখন নিজেই হাচ্চি দিচ্ছো! আর কোন কথা নয়, বাসার প্রায় কাছেই এসে পড়েছি আমরা। এখনি বাসায় পৌঁছে যাবো দুজন।
_________________
বৃষ্টিময় সেই দিনের পর থেকে বেশ কিছুদিন অতিক্রান্ত হয়েছে। ওইদিন বাসায় আসার পর আমার জ্বর এসেছিলো। কিন্তু পূর্ণ এবার বকেননি আমায়, চুপচাপ মাথায় পট্টি দিয়ে ওষুধ খাইয়ে দিয়েছেন। ওইদিনের পর থেকে গম্ভীর পূর্ণর পরিবর্তে এক কোমল পূর্ণর দেখা আমি সচারাচরই পাই! তবে এক ব্যাপারে উনি এখনো কঠোর আছেন আর তা হলো আমার পড়াশুনার ক্ষেত্রে! রোজ রাত করে আমার পড়া চেক করেন। যেদিন পড়তে দেন তার পরেরদিন নিয়ম করে চেক করেন সব পড়া ঠিকমতো করেছি কি না। যদিও আমি নিয়মিতই পড়াশুনা করি তবুও যদি মাঝেমধ্যে কোন কারণে পড়াশুনায় ফাকিবাজি করি তবে সেদিন আর রক্ষে নেই আমার! ঠিকই উনার কড়া বকুনি হজম করতে হয়! মন খারাপ করে থেকেও লাভ হয়না, যেহেতু এডমিশন টেষ্ট এর খুবই অল্পদিন বাকি তাই আগে পড়া আদায় করে দিতে হয় এরপরই উনি মানেন। তার আগে আমার কথা চলেনা উনার উপর! এছাড়াও মাঝেমধ্যে হুটহাট চুড়ি, ফুল, চকোলেট এসব ছোটখাটো গিফট দেওয়া তো আছেই উনার। সব মিলিয়ে ভালোই চলছিলো জীবন।
এরই মধ্যে রাইসার থেকে খবর পেলাম রায়হান ভাইয়া অন্য কোম্পানিতে জয়েন হয়েছেন, সেখানে বেশ ভালো পদে যোগ দিয়েছেন! আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো উনার নতুন অফিসটা প্রিয়ার কলেজের একদম কাছেই! এ কথাটা অবশ্য আমি প্রিয়ার থেকেই জানতে পারলাম। সাথে প্রিয়া আরও বললো,
—জানো ভাবী, রায়হান ভাই অনেক ভালো মানুষ। আমার মনে হয় উনার জীবনে হয়তো কেউ ছিলো যার জন্য উনি শুরুতে সহজে মিশতে চাইতেন না আমার সাথে। তবে এখন দেখছি উনার পরিবর্তন হচ্ছে। প্রথম প্রথম উনার ফেসবুক আইডি নেওয়ার পর তো ঠিকমতো জবাবই দিতেন না আমাকে। এভোয়েড করতেন এক প্রকার। তবে এখন দেখি মাঝেমধ্যেই নিজে থেকেই মেসেজ দেন, আমার খোজ-খবর নেন! বলতে গেলে আমার সাথে বেশ অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে কথা বলা শুরু করেছেন।
প্রিয়ার কথায় স্বস্তি পেলাম আমি। আমি তো বরাবরই চেয়েছিলাম রায়হান ভাই আমার আশায় অযথা পড়ে না থেকে নিজ জীবনে মুভ অন করুক। আর এখন সেটাই হচ্ছে। উনি একজন বুদ্ধিমান মানুষের পরিচয় দিয়ে নিজের ভালো বুঝেছেন এবং নিজেকে পরিবর্তন করছেন তার ভালোর জন্য! এর চেয়ে ভালো সংবাদ আর কি হতে পারে! তাই হাসিমুখে প্রিয়াকে বললাম,
—বাহ! তাহলে তো বেশ ভালোই। রায়হান ভাই আসলেও ভালো মানুষ। যদি তোমাকে মন থেকে পছন্দ করেন তাহলে তুমি জিতে যাবে!
—আমার মনে হয় একটু-আধটু পছন্দ করতে শুরু করেছেন। সেদিন নিজে থেকেই বললেন আমার কলেজের কাছে তার অফিস। সময় পেলে একদিন দেখা করবেন আমার সাথে!
লাজুক হেসে বললো প্রিয়া। ওর কথায় চোখ বড় বড় করে তাকালাম আমি! দুস্টু সুরে বললাম,
—বাহ ননদিনী, তুমি তো দেখি অনেক ফাস্ট হয়ে গেছো! ইতোমধ্যেই রায়হান ভাইকে প্রেমের জালে ফাসিয়েও দিয়েছো!
—ধুর ভাবী, তুমিও নাহ! তবে আমি ভাবছি অন্য কথা! যদি আমাদের প্রেম শুরু হয় তবে বাবা-মা তো মেনে নিবেই আশা করি। কিন্তু ভয়ে আছি আমার ভাইদের নিয়ে! যদিও প্রান্ত ভাইয়াকে আমি নিজেই রাজি করিয়ে নিতে পারবো, কিন্তু বড় ভাইয়াকে রাজি করানোর দায়িত্ব তোমার! তাকে বলতেও আমার ভয় লাগবে!
প্রিয়ার কথা শুনে চমকে উঠলাম আমি। পূর্ণকে আমি রাজি করাবো ওর আর রায়হান ভাইয়ের ব্যাপারে? উনি আদৌ রাজি হবেন তো? সেদিন বাইকে বলা উনার কথা মনে পড়লো হঠাৎ! পূর্ণ উনার একমাত্র বোনের ব্যাপারে যথেষ্ট পজেসিভ। অনেক আদরে বড় করেছেন প্রিয়াকে! যে ছেলে তার বউকে পছন্দ করতো এককালে তার সাথে কি নিজের বোনকে বিয়ে দিতে আদৌ রাজি হবে কোন ভাই? উনি যদি আমার উপর রাগ করেন?
বিষয়টা হঠাৎ করেই কেমন যেন জটিল হয়ে গেলো। প্রিয়ার কথা শুনে মাথার মধ্যে এলোমেলো ভাবনাগুলোর কুন্ডলী পেকে গেলো যেন!
#চলবে
.