বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৬৬
লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
নিশুতি রাতে আধার কক্ষে নির্ঘুম চোখে একে-অপরের কাছাকাছি নিশ্চুপ শুয়ে আছি দুজনে। পূর্ণর বুকে মাথা রাখায় তার হৃদপিণ্ডের ঢিপঢিপ করতে থাকা স্পন্দন শুনা যাচ্ছে স্পষ্ট! অবশেষে এতক্ষণের নীরবতায় উপসংহার ঘটিয়ে তিনি শান্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন,
—কি গিফট নিবে বললে না যে?
—লাগবেনা কিছু।
—সিরিয়াসলি? আমি তো শুনেছিলাম তোমরা মেয়েরা গিফট বলতে পাগল। এদিকে তুমি দেখি নিতে চাইছোনা। হিসাবটা মিললোনা যে?
—আপনার এত হিসাব মিলাতে হবেনা। আপনি এখন রেস্ট করুন, ওটাই সবচেয়ে প্রয়োজন আপনার জন্য।
কিছুটা গম্ভীর কণ্ঠেই বললাম। আচমকা এমন কণ্ঠ শুনে পূর্ণ এক পলক তাকালেন আমার দিকে। ভ্রু উচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
—কি হয়েছে তোমার? মন খারাপ মনে হচ্ছে?
—কিছুই হয়নি!
—এবার তো আমি শিওর কিছু হয়েছে। এত ঠান্ডাভাবে উত্তর দিচ্ছো কেন? আমাকে বলবেনা, তুর পাখি? কি হয়েছে তোমার?
আমি তবুও নিশ্চুপ থাকায় উনি উদাস কণ্ঠে বললেন,
—ওহ বুঝেছি। বিয়ের পর তোমার প্রথম জন্মদিনটাকে স্পেশাল করতে পারিনি দেখে মন খারাপ করছো? আসলে আমার প্ল্যান ছিলো কাল তোমাকে নিয়ে ঘুরার কিন্তু এমন অবস্থায় এসে ফেসে যাবো কল্পনাও করিনি! আমি সরি…
—চুপ করুন প্লিজ? আপনার এসব কথা আমি আর নিতে পাচ্ছিনা! আমার খুব গিল্টি ফিল হচ্ছে আপনাকে দেখে৷
মনের ভেতর চলতে থাকা অস্বস্তিকে আর থামাতে না পেরে অবশেষে মুখ ফসকে বলেই ফেললাম! আমার কথায় পূর্ণ ভ্রু কুচকে বললেন,
—তুমি শান্ত হও আগে। বেশ অস্থির লাগছে তোমায়। আর তুমি কেন গিলটি ফিল করছো বুঝলাম না? আমার এক্সিডেন্টের জন্য নিজেকে দায়ী ভাবছো নাকি?
উনার প্রশ্নে কোনো কিছু না বলেই চুপচাপ আরেকটু শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। উনি আমার জন্য এতদূর থেকে এভাবে চলে এসেছেন ভেবে যতটা না খুশি লাগছে মনে, তার চেয়েও বেশি কস্ট লাগছে এই ভেবে যে – যদি উনি আমার জন্য এভাবে তাড়াতাড়ি করে চলে না আসতেন তবে হয়তো আগামীকাল সুস্থভাবে ঢাকায় ফিরতে পারতেন! এসব ভাবনার মাঝে কখন যে অক্ষিদ্বয় পুনরায় ভিজে গেলো অনুভব করতে পারিনি! তার আগেই আমার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া নোনাজলে তার টিশার্ট ভিজে যেতেই হন্তদন্ত গলায় পূর্ণ বললেন,
—ইশ! আবার কাদছো কেন? আরে বাবা, তোমার তো দোষ নেই এখানে। দেখো তুরফা, এটা একটা নরমাল ব্যাপার, বুঝেছো? রাস্তাঘাটে চলতে গেলে কার কখন কোন দূর্ঘটনা হবে এটা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ বলতে পারেনা। তাই এমন একটা বিষয়ের জন্য নিজেকে ব্লেম করা বন্ধ করো। আর আমার কিন্তু একটুও ভালো লাগছেনা তোমায় এভাবে দেখে।
তার কথায় কিছুটা শান্ত হয়ে চোখের পানি মুছলাম। নিচু গলায় ধীর স্বরে বললাম,
—আচ্ছা, সরি বলছি তো। আর বলবোনা এভাবে কখনো।
—গুড। তবে একটা ব্যাপার এখনো বুঝতে পাচ্ছিনা, জানো?
—কি বুঝতে পারছেন না?
—ভাবছিলাম তুমি তো আগে এমন ছিঁচকাদুনে ছিলেনা। অথচ এখন দেখি কথায় কথায় কেদে ফেলো। এরকম হলে তো বিপদ! তুমি এমন ছিঁচকাদুনে হলে আমার বাচ্চাদের কি হবে?
হঠাৎ করে এই প্রথম তার মুখে বাচ্চাদের কথা শুনে এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেলো মনের ভেতর। রক্তিম আবরণ ছেয়ে গেলো তন-মন জুড়ে! ঝট করে তার কাছে থেকে সরে দূরে বসে বললাম,
—ছিইই! এই আপনি ঘুমান তো! রাত জেগে এসব আজেবাজে কথা বলছেন কেন? একটু আগেই না বলছিলেন আমি ঘুমের ডিস্টার্ব দিচ্ছি! তো এখন ঘুম ধরছেনা আপনার?
আমার কথা শুনে হালকা হাসলেন তিনি। দুস্টু গলায় আড়চোখে চেয়ে বললেন,
—যে অবস্থা হয়েছে আমার, ঘুমানো ছাড়া উপায়ও নেই। ভালো না হওয়া পর্যন্ত তো ঘুমাতেই হবে! এমন হবে আগে জানলে তো আস্তেধীরেই আসতাম।
মাঝরাতে তার মুখে এসব কথা শুনে চোখ পাকিয়ে তাকাতেই উনি চোখ বন্ধ করলেন। তা দেখে আমি পুনরায় শুয়ে পড়তেই বলে উঠলেন,
—এবার কিন্তু সিরিয়াসলি বলছি। কি গিফট নিবে বলো না? বারবার জিজ্ঞেস করবোনা কিন্তু!
—আমিও তো সিরিয়াসলি-ই বললাম। কিচ্ছু লাগবেনা আমার! কিছু মাথায় আসছেনা এখন। তবে আপনি যদি কিছু দিতেই চান তাহলে একটা প্রমিস করুন আমায়?
—কি প্রমিস করবো? এই তুমি আবার কিছু লুকাচ্ছোনা তো আমার থেকে?
—আরে নাহ! অযথাই কিসব ভাবছেন? আমি তো এখন শুধু একটাই প্রমিস চাই আর সেটা হলো আপনি নিজের যত্ন নিবেন, নিজের খেয়াল রাখবেন ঠিকভাবে। প্লিজ? কারণ আমার দিক ভাবতে ভাবতে আপনি নিজের ব্যাপারে একদম খামখেয়ালি হয়ে গেছেন। জানেন, আল্লাহর পক্ষ থেকে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় নেয়ামত আপনি। সেই আপনিই যদি নিজের ব্যাপারে উদাসীন হোন, এসব কিন্তু আমি মানবোনা। আপনার যেমন আমার অযত্ন দেখলে খারাপ লাগে, তেমনি আমারও আপনার নিজের ব্যাপারে উদাসীনতা দেখা পছন্দ নয়।
এক নিশ্বাসে নিজের মনের অনুভুতিগুলো প্রকাশ করে তার উত্তরের আশায় প্রহর গুনছিলাম। ভেবেছিলাম হয়তো ভালো কিছু বলবেন কিন্তু উনি মুগ্ধচোখে চেয়ে থাকলেও মুখে উঠলেন,
—এটা একটু ফিল্মি হয়ে গেলোনা, বউ? তুমি দেখি সিনেমার নায়িকাদের মতো ডায়লোগ শুরু করেছ…
—আচ্ছা, ঠিক আছে। গুড নাইট।
আশাহত হয়ে উনার গায়ে জ্বা/লা ধরানোর মতো কথা শুনে তাচ্ছিল্যপূর্ণ জবাব দিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। খানিকক্ষণ বাদে অনুভব হলো তিনি নড়ছেন, মনে হলো যেন আমার দিকেই এগিয়ে আসছেন। অতঃপর না চাইতেও চোখ খুলে তার দিক তাকিয়ে বললাম,
—এভাবে নড়ছেন কেন আবার? একবার ব্যাথা পেলে তখন বুঝবেন!
—তুমি ওদিক সরে গেছো কেন, বউ? আমি তো মজা করে বলছিলাম। এখন তুমি এগিয়ে না আসলে আমি কি করবো?
পাগল লোকটার কথায় হতাশ চোখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপচাপ তার দিক এগিয়ে যেতেই যেন সন্তুষ্ট হলেন তিনি। একহাতে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে তার শান্ত গলায় প্রতিধ্বনিত হলো,
—ওকে ফাইন! আমি তোমার কথা শুনলাম যাও। আই প্রমিস নিজের খেয়াল রাখবো। তবে তুমি কিন্তু ভুলে যাচ্ছো তোমার সামনের সপ্তাহে পরীক্ষা। আমার তো এখন থেকেই টেনশন হচ্ছে। আল্লাহ জানে তোমার রেজাল্ট কি হবে? এবার তুমি প্রমিস করো যে কাল থেকে সবকিছু ভুলে তুমি ভালোভাবে পড়ালেখা করবে? আমি দেখতে চাই শেষ হাসিটাও যেন তোমারই হয়। মনে থাকবে না, তুর পাখি?
হঠাৎ এডমিশন নামক যুদ্ধের কথায় ধুক করে উঠলো বুক! দুরুদুরু বুকে মাথা নাড়িয়ে পূর্ণর কথায় সায় দিলাম! আসলেই তো আর একটুও সময় নেই হাতে। যদি উনার সাথে ঢাকায় থাকার ইচ্ছে থাকে, তবে এ কয়দিন কোনোরুপ সময় নস্ট না করে ভালোভাবে পড়াশুনা করতে হবে!
দৃঢ় চিত্তে মনে সংকল্প এটে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম।
_______________________
দেখতে দেখতে এগিয়ে গেলো সময় নামক ঘড়ির কাটা। চোখের পলকে কেটে গেলো সপ্তাহখানেক সময়। এ ক’দিনে পূর্ণ বেশ কিছুটা সুস্থ হয়েছেন! হাতের ব্যান্ডেজ খুলা হয়েছে তবে পায়ের ব্যথা এখনো পুরোপুরি ঠিক না হওয়ায় খুব একটা হাটাচলা করছেন না, যার দরুন তার অফিস যাওয়া এখনো বন্ধ। সবসময় কাজে করায় অভ্যস্ত মানুষগুলো বেশিদিন কাজহীন বসে থাকলে যা হয়, পূর্ণর ক্ষেত্রেও ঠিক সে অবস্থাই হয়েছে এ কয়দিনে। হাতের ব্যান্ডেজ খোলার আগ অব্দি তো ল্যাপটপেও কোন কাজ করতে পারতেন না। তখন শুধু বাসায় বসে বসে আমায় পড়ার তাগিদ দেওয়া ছিলো যেন তার প্রধান কাজ! হাত ভালো হওয়ার পর থেকে এ অত্যাচার অবশ্য কিছুটা কমেছে তিনি কাজে ব্যস্ত থাকায়, কিন্তু তবুও নিজের টুকটাক কাজের সাথে সাথেই আমার সকল দিকে লক্ষ্য রাখতে তার ব্যতিক্রম হয়নি কখনো!
অবশেষে দিন গুনতে গুনতে আজকে আমার এডমিশন পরীক্ষার দিন। যে দিনের জন্য কতশত নির্ঘুম রাত কেটেছে, চিন্তায়-অস্থিরতায় কেটে গেছে এতগুলো সময়! পূর্ণ এখনো পুরোপুরি হাটাচলা না করায় ঠিক হয়েছে রাইসা যাবে আমার সাথে পরীক্ষার হলে। রেডি হয়ে দরকারি কাগজপত্র পেন্সিলব্যাগে ভরে কেন্দ্রের উদ্দেশ্য রুম থেকে বের হচ্ছিলাম। বিছানায় বসে থাকা পূর্ণ হাতের ইশারায় তার দিকে ডাকতেই এগিয়ে গেলাম সেদিকে। শান্ত চোখে আমার দিক চেয়ে বললেন,
—ঠান্ডা মাথায় পরীক্ষা দিয়ো। পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই রেজাল্টের চিন্তা করবেনা একদম। যা যা পারবে আগে সেগুলোর উত্তর দিবে আর না পারলে অতি উত্তেজিত হয়ে ঘাবড়ে যাবেনা। মনে রাখবে তুমি নিজের সাধ্যমতো চেস্টা করেছো, এখন এর ভালোমন্দ ফলাফল যা-ই আসে সেটা ভাগ্যের উপর নির্ভর করছে। ঠিক আছে?
—হুম।
—বেস্ট অফ লাক, তুর পাখি। যেটা হবে ভালোর জন্যই হবে! অতিরিক্ত চিন্তা করবেনা!
—ইন শা আল্লাহ।
—হু। এখন যাও। দেরি হয়ে যাবে তোমার! আর পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে আমায় ফোন দিয়ো, কেমন?
উনার কথার বিনিময়ে মাথা নাড়িয়ে রুম থেকে বের হয়ে চলে এলাম। রাইসা বাইরে দাড়িয়েই ছিলো আমার জন্য, বাসার সবার থেকে দোয়া ও শুভকামনা নিয়ে নিজের প্রস্তুতি এবং আল্লাহর উপর ভরসা নিয়ে চলে গেলাম পরীক্ষা দিতে!
___________________
গাড়ি চলছে আপন গতিতে। পরীক্ষার হল থেকে বাসায় ফিরছি রাইসার সাথে এবং হল থেকে বের হওয়ার পর থেকেই এক প্রকার নীরবতা পালন করছি। কেননা যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসের সাথে পরীক্ষার হলে ঢুকার পরেও যেরুপ আশা করেছিলাম সেরুপ পরীক্ষা হয়নি। এখন ঢাকায় চান্স পাওয়া না পাওয়াটা আসলেও আমার ভাগ্যের উপর নির্ভর করছে! বলতে গেলে ফিফটি-ফিফটি চান্স আছে। যেগুলো কমন এসেছিলো দাগিয়েছি কিন্তু উত্তেজনায় কয়েকটা ভুল উত্তর দাগিয়ে নিজের উপরই নিজের রাগ হচ্ছিলো প্রচুর কিন্তু ততক্ষণে আমি নিরুপায়। এখন নেগেটিভ মার্কিং এর জন্য চান্স পাওয়া নিয়ে সন্দেহ কাজ করছে মনে।
বিষয়টা রাইসাকে জানালেও ভয়ের চোটে পূর্ণকে বলতেও পারিনি ফোনে। কারণ উনি ঠিক কেমনভাবে রিয়েক্ট করবেন তা আমার অজানা, হয়তো সামনে থেকে আমাকে সান্তনা দিলেও মনে মনে ঠিকই কস্ট পাবেন। এসব ভাবনার মাঝেই পাশ থেকে রাইসা বলে উঠলো,
—আরে তুর, এত চিন্তা করছিস কেন? আমার মন বলছে তুই এখানেই চান্স পাবি! দেখিস ঠিক এটাই হবে। ব্রেইনে এত প্রেসার দিস না!
—আমার সত্যিই ভয় করছে রে। সবাই তো ঢাকায় চান্স পাওয়ার উদ্দেশ্যেই পরীক্ষা দেয়, এত এত কম্পিটিশন এখানে। আল্লাহ না করুক যদি আমার এখানে না হয়? তাহলে আমার কি হবে? তোদেরকে ছেড়ে অন্য শহরে থাকবো কিভাবে আমি?
—অযথাই চিন্তা করছিস তুই। আমার মনে হয়না পূর্ণ ভাইয়া তোকে অন্য কোথাও যেতে দিবে। আর সে প্রয়োজনও পড়বেনা! তোর এখানেই হয়ে যাবে। এখন এসব কথা বাদ দে তো। বাসায় যেয়েও আর এগুলো বলবিনা খবরদার!
রাইসার কথায় ফোস করে এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকলাম। ও তো জানেনা পূর্ণ বাকিসব ক্ষেত্রে ভালো হলেও পড়াশুনার ব্যাপারে প্রচুর স্ট্রিক্ট। যেভাবে শক্ত গলায় অন্য শহরে রেখে আসার কথা বলেছিলেন আমায়, মনে হয়না সে কথার অনড় করবেন তিনি! সুতরাং, বাহ্যিকভাবে রাইসার সান্ত্বনায় কাজ হলোনা। মস্তিষ্ক সেদিকে সাড়া দিলেও মনে মনে সুপ্ত ভয় হানা দিলো ঠিকই! আপাত ভাবে বাহিরের দৃশ্যে মনোযোগী হতেই চোখে পড়লো দূরের আকাশে মুক্ত মনে উড়ে যেতে থাকা দুটো পাখির দিকে, হয়তো গন্তব্য তাদের একই নীড়ে! বিশালাকার গাছটার সামনে যেতেই আরও কিছু পাখির ভীড়ে পথ হারিয়ে একটি পাখি তাদের সাথে চলে গেলো অন্যদিকে, এদিকে অপর পাখিটি থেকে গেলো মগডালের নীড়ে!
ভীত হয়ে থাকা অবচেতন মনে আচমকা প্রশ্ন এলো- আমার ও পূর্ণর সাথেও যদি এমন হয়?
চলবে…….