অনির কলমে আদ্রিয়ান পর্ব ১৫
উনিশ অক্টোবর। দিনটা ছিল আমার জন্মদিন। তবে আমার এবারের গোটা জন্মমাসটাই ছিল বিরক্তির মাস। কারণ হল এই মাসেই ছিল পরপর চার-চারটা পরীক্ষা, তারমধ্যে আপির বিয়ে, রিসিপশনটা অ্যাটেন্ড করতে না পারার দুঃখ। সব মিলিয়ে মেজাজ তখন তুঙ্গে। তবে অরু, তীব্র, তন্ময় জন্মদিনের ছয়দিন আগেই বাড়ি বয়ে এসে চমকে দিয়েছে আমাকে। কেট-টেক কেটে হৈ হৈ করে আমার জন্মদিন পালন করে গেছে। কারণটা ছিল জন্মদিনের দিন ওরা কেউই থাকতে পারবেনা শরীয়তপুর। আর আমার জন্মদিনটা মিস করে যাবে? সেটা হতেই পারেনা। তাই এমন অদ্ভুত কাজ করে বসল। ওদের এই অদ্ভুত পাগলামী আমার মোটেও মন্দ লাগেনি। বরং মনে মনে আনন্দে নেচে উঠেছিলাম আমি।
রাত তখন দশটার খানিকটা বেশি বাজে হয়তো। আমি বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে শুয়ে বার্থডে উইশের মেসেজগুলো পড়ছি। মনটা ভালো নেই একদম। জন্মদিনটা বাড়িতে বসে বসে ঝিমিয়ে কাটল। আপি শ্বশুরবাড়ি আছে। বাকি কাজিনরাও একেকজন একেক জায়গায়। সুতরাং ওরা চাইলেও আমার জন্মদিন সেলিব্রেট করতে পারছিল না। সেইজন্য ওদেরও ভীষণ মন খারাপ ছিল। তবে কাল রাত বারোটার দিকে আপি ভিডিও কল করেছিল। রায়হান ভাইয়া কেক নিয়ে এসেছে। আমার হয়ে আপি নিজেই কেক কেটেছে। কেক কেটে কেঁদেও ফেলেছে মেয়েটা। আমারও ভীষণ কান্না পাচ্ছিল, কিন্তু কাঁদিনি। উল্টে রায়হান ভাইয়াকে ধমকের সুরে বলেছি, ‘কী করেছো আমার বোনকে? কাঁদছে কেনো?’ বেচারা রায়হান ভাইয়া বোকার মতো তাকিয়ে ছিল আমাদের দুই বোনের দিকে। সারাদিনের কথাগুলো ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। উনিশ বছরে এমন উদ্ভট জন্মদিন এর আগে কোনদিন যায়নি আমার। আর দেড় ঘন্টার মধ্যে জন্মদিন শেষও হয়ে যাবে।
পাশের রুম থেকে হঠাৎ করেই আদ্রিয়ান ভাইয়ের গলার স্বর শুনতে পেলাম। খানিকটা অবাক হয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম দশটার বেশি বাজে। এতো রাতে কেন এসেছে এ বাড়িতে? আমি চুপচাপ বসে রইলাম। আসলে আসুক। আমার কী? উনিতো আমার জন্মদিনটাও মনে রাখেননি। সুতরাং আমিও তাকে নিয়ে ভাবছি না, ভাবব না। মনে অভিমানের পাহাড় জমিয়ে রেখে আবার ফোনে চোখ দিলাম। বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পরেও এখনো ওনার গলার আওয়াজ পাচ্ছি মাঝেমাঝে। যায়নি এখনো? এবার উঠে গেলাম বাইরে। খানিকটা উঁকি দিয়ে দেখলাম মহাশয় খাচ্ছেন। আজব! এখানে এসে খাচ্ছে কেন? তাঁর বাড়িতে রান্না হয়নি? না-কি কোন অকাজ করেছে বলে মামণি আজ খেতে দেয়নি? গাল ফুলিয়ে আবার ফিরে এলাম নিজের রুমে। প্রায় মিনিট পনেরো পরে হঠাৎই আব্বু ডাকল আমাকে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও পাশের ঘরে গেলাম আব্বু ডাকাতে। আমি গিয়ে দাঁড়াতেই আব্বু বলল, ‘তোর মানিক আঙ্কেল তোকে আজ ঐ বাড়িতে ডেকেছে। আদ্রিয়ানকে পাঠিয়েছে তোকে নিতে।’
আমি একপ্রকার বিষম খেলাম। ছোটবেলায় অনেকরাত মানিক আঙ্কেলের বাড়িতে কাটিয়েছি। বড় হওয়ার পর তারা শরীয়তপুর আসার পরেও দু রাত ছিলাম। কিন্তু আদ্রিয়ান ভাই থাকাকালীন কখনও রাতে থাকিনি ঐ বাড়িতে। কিন্তু হঠাৎ করে মানিক আঙ্কেল কেন ডাকবে? আদ্রিয়ান ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি নিশ্চিন্তে বসে বসে ফোন স্ক্রোল করছেন। যেন এদিকে কী নিয়ে কথা হচ্ছে সেটা নিয়ে তার কোন মাথাব্যথা নেই। আমি আব্বুকে বললাম, ‘ আব্বু এতো রাতে যাব? কাল সকালে গেলে হয়না? কাউকে নিতে হবেনা আমি নিজেই চলে যাব।’
আব্বু বলল, ‘সমস্যা কী? এখনই যাও। বাড়িতে কী কাজ তোমার?’
‘ আমার যেতে ইচ্ছে করছেনা। ঘুম পাচ্ছে।’
‘ ঘুম পাচ্ছে? এমনিতে তো সারারাত জেগে পার করে দাও। আজ এগারোটা বাজেই তোমার ঘুম পাচ্ছে? তোমার আঙ্কেল তোমাকে রোজ রোজ ডাকে? ডেকেছে যখন যাও।’
কিন্তু আমি একপ্রকার জেদ ধরে বসলাম যে যাবোনা। যাবোনা মানে যাবোই না। আসলে আদ্রিয়ান ভাইয়ের সাথে না যাওয়ার জন্যেই এতো টালবাহানা। লোকটাকে সহ্য হচ্ছেনা আমার। আব্বু এবার খানিকটা বিরক্ত হল। খানিকটা ধমকের সুরে বলর, ‘প্রয়োজন না হলে নিশ্চয়ই এতো রাতে ছেলেটাকে পাঠাতো না। এতোদূর এসে ফিরে যাবে? তাড়াতাড়ি গিয়ে রেডি হয়ে এসো।’
আব্বুর ধমকে চুপসে গেলাম আমি। আর কিছু বলার সাহস পেলাম না। ভদ্র মেয়ের মতো চুপচাপ চলে গেলাম রুমে তৈরী হতে। রাগে পা থেকে মাথা অবধি জ্বলে উঠছে আমার। কান্নাও পাচ্ছে। সবসময় সবার এতো জোর জবরদস্তি ভালো লাগেনা। আমার ইচ্ছের কোন দাম নেই না-কি? আমি তৈরী হয়ে বেরিয়ে আব্বুকে বললাম, ‘আব্বু আমি রেডি।’
আব্বু আদ্রিয়ান ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ আদ্রিয়ান এবার বেরিয়ে পড়। এগারোটার বেশি বেজে গেছে।’
আদ্রিয়ান ভাই ফোনটা জিন্সের পকেটে রাখতে রাখতে উঠে দাঁড়ালেন। বাড়ির সবাইকে বিদায় দিয়ে আমাকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। আম্মু আদ্রিয়ান ভাইকে বারবার সাবধান করে দিলেন সাবধানে বাইক চালিয়ে যাওয়ার জন্যে। বাড়ির সামনে রাস্তায় এসে আদ্রিয়ান ভাই নিজের বাইকে উঠে বসলেন। বাইক স্টার্ট দিয়ে আমার দিকে তাকাতেই আমি চুপচাপ পেছনে উঠে বসলাম। কোন কথা না বলে বাইক ধরে বসে রইলাম চুপচাপ। উনি ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, ‘ সমস্যা কী? কাঁধে হাত রাখছিস না কেন? বাইক থেকে পড়ে রক্তারক্তি কান্ড ঘটানোর ইচ্ছা আছে না-কি?’
আমি থমথমে গলায় বললাম, ‘ আমি এভাবেই ঠিক আছি।’
উনি কিছু বললেন না। বাইক চলতে শুরু করল নিজের মতো। শাহি মসজিদ অবধি ভালোই চলছিল। কিন্তু শাহি মসজিদ দিয়ে টার্ন নেওয়ার সময় টাল সামলাতে পারছিলাম না। চট করেই দু হাতে ওনার কাঁধ আঁকড়ে ধরলাম। না হলে নির্ঘাত পড়ে যেতাম। বুঝতে পারলাম উনি হাসছেন। আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম,
‘ হাসছেন কেন?’
আদ্রিয়ান ভাই কৌতুক করে বললেন,
‘ আমার সব কথাই তোর মিষ্টি লাগে, কিন্তু বাসি হয়ে গেলে।’
আমি কিছু না বলে ভ্রু জোড়া কুঁচকে ওনার থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম কিন্তু কাঁধ থেকে হাত সরানোর সাহস পেলাম না। বাইক মাঝারি গতিতে চালাচ্ছে সে। কিন্তু টিএনটি পার হওয়ার পরেই গতি খানিকটা বাড়িয়ে দিলেন। মনে মনে খানিকটা ভয় লাগলেও মুখে কিছু বললাম না। শুধু ওনার কাঁধদুটো আরও শক্ত করে ধরলাম।
শরীয়তপুর সদরে পৌঁছনোর পর দেখলাম আদ্রিয়ান ভাই ওনার বাড়ির রাস্তা দিয়ে না ঢুকে সোজা এগিয়ে যাচ্ছেন। আমি অবাক হলাম। একটু জোরেই বললাম, ‘ এই! কোথায় যাচ্ছেন আপনি? বাড়ির রাস্তা ছেড়ে এসেছেন তো!’
আদ্রিয়ান ভাই এবারেও ঠাট্টা করে বললেন, ‘শ্বশুর বাড়ির রাস্তা একদম মুখস্হ করে রেখেছিস দেখছি। রাতের অন্ধকারেও স্পষ্ট চিন্তে পারিস। আহা, কী টান।’
আমি বিরক্তি ঝেড়ে বললাম, ‘ মজা করবেন না তো? যাচ্ছি কোথায়?’
‘ দেখি কোথায় যাওয়া যায়। তুই চুপচাপ বসে থাক।’
নির্বিকারভাবে বললেন উনি। আমি বোকার মতো তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে। এতোরাতে কোথায় যাচ্ছেন? তাও সাথে আমাকে নিয়ে? এরপর ভাবলাম কোথাও হয়তো কাজ আছে। সেটা সেরে বাড়ি যাবেন। অসহ্য! সব কাজ সেরে আমায় আনতে গেলে কী হতো? এসব আকাশ-পাতাল চিন্তা করতে করতে বাইকটা নিয়ে উনি পৌঁছালেন কলোনির মাঠ। মাঠের মধ্যখান দিয়ে বাইকটা চালিয়ে নিয়ে একটা বড় গাছের কাছে নিয়ে থামালেন। আমি নেমে দাঁড়ালাম। উনিও চাবি খুলে পকেটে রাখতে রাখতে নেমে এলেন বাইক থেকে। আশপাশটা একদম ফাঁকা। মাঝেমাঝে দু-একজন দেখা যাচ্ছে দূরে। আমি কিছু বুঝতে না পেরে বললাম, ‘ এখানে এলাম কেন আমরা? কত রাত হয়ে গেছে দেখেছেন? বাড়ি যাবেন না?’
উনি আশেপাশে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে বললেন, ‘ বাড়ি ফেরার কী দরকার? মাঝেমাঝে খোলা আকাশের নিচে থাকাও ভালো। সেই ছাদ, সেই বিছানা, সেই টেবিল, বই, খাতা, ল্যাপটপ একঘেয়ে লাগেনা? মাঝেমাঝে স্বাদ বদল প্রয়োজন।’
আমি ওনার দিকে বোকা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম, ‘ রাত বিরাতে আপনার এমন জঘন্য মজা করার ইচ্ছে হল আদ্রিয়ান ভাই?’
উনি এতক্ষণে আমার দিকে ভালোভাবে তাকালেন। আজ বাড়ি আসার পর থেকে এই পর্যন্ত তেমনভাবে তাকান নি আমার দিকে। আমার দিকে সম্পূর্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলেন উনি। বললেন, ‘এটাইতো সমস্যা। আমার সিরিয়াস কথাগুলো তোর কাছে নিছকই মজা বলে মনে হয়, আর মজাগুলোকে মনে হয় ভয়ানক সিরিয়াস কথা। সমস্যাটা কোথায় বলতো? আমার রিঅ্যাকশন সিস্টেমে? নাকি তোর মাথার নাটবল্টুতে?’
আমি ভাষাহীন চোখে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। মানুষটা যেমন অদ্ভুত তার কথাগুলোও তেমনই অদ্ভুত। কোন এক অদ্ভুত লগ্নেই জন্ম এর। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। দু পকেটে হাত ঢুকিয়ে উনি এগিয়ে গেলেন পাশের পুকুরটার দিকে। আশেপাশে কেউ নেই তাই বাধ্য হয়ে আমিও ছুটলাম ওনার পেছন পেছন। মাঠের পাশের বড় পুকুরের পাড়ে সিঁড়িতে গিয়ে বসলেন উনি। আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। পৌনে বারোটা বাজে, মানিক আঙ্কেল নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে? আর আব্বু নিশ্চয়ই আঙ্কেলকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেছে পৌঁছেছি কি-না? যদি শোনে এখনো আমরা পৌঁছাতে পারিনি চিন্তা করবেতো। অথচ লোকটার কোন হেলদোল নেই? আর যারা একসঙ্গে আমাদের দেখবে তারা কী ভাববে? আমি সিঁড়ির দু ধাপ নেমে বললাম, ‘ ভাইয়া বসলেন কেন? অনেক রাত হয়ে গেছে। সবাই টেনশন করছে। ফোন করেছিলেন বাড়িতে?’
উনি আমার দিকে ফিরে চাইলেন না। হাত দিয়ে ওনার পাশে বসতে ইশারা করে বললেন, ‘ এখানে বস। কী সুন্দর হাওয়া আসছে। পুকুরের পানিগুলো চাঁদের আলোতে চমৎকার লাগছে।’
আমার মেজাজ এবার ভয়ানক খারাপ হল। লোকটা এমন কেন? চিন্তা, ভয়, অস্বস্তি কী ওনার জন্যে তৈরী হয়নি? বেশ বুঝতে পারলাম আমি ওখানে গিয়ে না বসা অবধি উনি আর একটা শব্দও উচ্চারণ করবেন না। হনহনে পায়ে গিয়ে বসলাম ওনার পাশে। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম, ‘এবার দয়া করে বলবেন কী হচ্ছে?’
‘ কিছু হচ্ছেনাতো। তুই কিছু হতে দেখছিস?’
আমি ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। বুঝলাম এভাবে হবেনা। আমি যত রেগে যাব উনি আমাকে তত রাগাবেন। নিজেকে শান্ত করতে হবে। লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে কন্ঠস্বর বেশ অনেকটা অসহায় করে বললাম, ‘ বাড়িতে সবাই চিন্তা করবেনা? রাত হয়েছে তো।’
উনি পাশে গুড়ো হয়ে পড়ে থাকা টাইলসের টুকরোগুলো পুকুরে ছুড়তে ছুড়তে বললেন, ‘কেউ চিন্তা করছেনা।’
আমি অবাক কন্ঠে বললাম, ‘চিন্তা করছেনা?’
‘ উহু! কারণ আমার লাভলি হাসান আঙ্কেল জানে তুই আমাদের বাড়িতে আছিস। আর আমার বাবা মানে তোর মানিক আঙ্কেল জানে তুই তোর বান্ধবীর বাড়িতে গেছিস।’
‘ বান্ধবীর বাড়িতে?’ চোখ কপালে ওঠার জোগাড় হল আমার।
উনি এবারেও নির্বিকারভাবে বললেন, ‘ হুম। তোর বার্থডে সেলিব্রেট করতে চাইছে অরুমিতা। ঢাকা থেকে ছুটে এসেছে শরীয়তপুর। কালকেই আসতে চেয়েছিল কিন্তু পারেনি। অনেএএএক কষ্টে সব ম্যানেজ করে আজ এসেছে। যদিও বারোটার পর জন্মদিন শেষ তবুও রাতে একসাথে থাকতে চাইছে। মজা করবে তাই। কিন্তু আঙ্কেল কিছুতেই রাজি হচ্ছেনা। একমাত্র ভরসা আদ্রিয়ান ভাই। তাই বাবার কথা বলে তোকে বাড়ি থেকে বের করে অরুমিতার বাড়ি অবধি পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছি আমি। আর রাতটা আমি ফরহাদের বাড়িতে কাটাচ্ছি।’
আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। এর ছেলের মস্তিষ্ক কী দিয়ে তৈরী? যদিও মগজে ধার না থাকলে কেমব্রিজের মতো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের জায়গা করে নিতে পারতো না। আমি হতাশ হয়ে গালে হাত দিয়ে বললাম, ‘আগে জানতাম না আমার বান্দরনী অরু আমাকে এতো ভালোবাসে।’
হেসে ফেললেন আদ্রিয়ান ভাই। সেই মোহনীয় হাসি। আমিও হাসলাম। কিছু একটা ভেবে বললাম, ‘ যা গল্প বানিয়েছেন আজ রাতেতো দুই বাড়ির কোন বাড়িতেই ফেরা সম্ভব না। কী করবেন ভেবেছেন?’
‘ ভাবছি।’
আমি চোখ বড়বড় করে তাকালাম ওনার দিকে। ভাবছেন? এতো বড় একটা কান্ড ঘটিয়ে এখন উনি ভাবছেন? মানে কোন প্ল্যান করা নেই? এখন করবেন? আল্লাহ এ কোন পাগলের পাল্লায় পড়েছি আমি? কিছু বলা এখন বৃথা তাই বিরক্তি নিয়ে চুপচাপ বসে রইলাম। হঠাৎই উনি অনেকটা এগিয়ে বসলেন আমার দিকে। একদম গা ঘেঁষে। আমি ওনার দিকে তাকাতেই উনি আমার কানের দিকে ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘ শুভ জন্মদিন আদ্রিয়ানের মায়াবিনী।’
আমি চমকে উঠলাম। চোখে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে। উনি সাথেসাথেই চোখ সরিয়ে নিলেন। যেন কিছুই হয়নি। তারসাথে ওনার হাতের ঘড়িটা টুট টুট আওয়াজ করে জানান দিল বারোটা বেজে গেছে। অর্থাৎ হিসেবমতো আমার জন্মদিন শেষ। শেষ উইশটা তাহলে সেই করল? তারমানে মনে ছিল ওনার? উনি ওনার ফোনে কিছু একটা টাইপ করছেন। টাইপ করা শেষে ফোনটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। আমি ভ্রু কুঁচকে ফোনটা হাতে নিয়ে ফোনের স্ক্রিনে তাকালাম। স্ক্রিনে লেখা আছে,
‘জন্মদিনে তোমাকে প্রথম উইশ করতে চাওয়া লোকের অভাব নেই। বারোটা বাজতেই অজস্র উইশ পেয়েছিলে নিশ্চয়ই? কিন্তু আমি ভীড় মোটেও পছন্দ করিনা। তাই সবার শেষে উইশ করলাম। ভীড় কম ছিল। পুরো মাসব্যাপি উপহারের ভারী ভারী বাক্স ঘরে ঢুকিয়েছো। আমি না হয় অন্যকিছু দেই। ফিল্মি স্টাইলে ফানুস টানুস উড়িয়ে এলাহি কান্ড করে উইশ করতে পারলাম না বলে আমি মোটেও দুঃখিত নই। কারণ এটা ফিল্ম না আমি ফিল্মের হিরোও নই। বাস্তবে এসব করতে গেলে এখনই লোক জড়ো হয়ে যেতো কাহিনী কী দেখার জন্যে। তাই সেসব বাদ। ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের পক্ষ থেকে তার মায়াবিনীর জন্যে একটা স্বপ্নরাত উপহার দিচ্ছি। দুজনের ব্যক্তিগত রাত। শুধুই দুজনের।’
আমি ফোনটা বাড়িয়ে দিলাম ওনার দিকে। ওনার দিকে তাকালাম না। হয়তো উনিও না তাকিয়েই ফোনটা নিলেন। আমি পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে আছি। ঠোঁটে লাজুক হাসি। এমন মনে হচ্ছে ওনার দিকে তাকালেই এখন আমি মাটিতে মিশে যাব। কিছুক্ষণ পর ওনার হাত জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা এলিয়ে বসে রইলাম আমি। দৃষ্টি পুকুরে পড়া চাঁদের প্রতিবিম্বের দিকে। উনিও কী সেদিকেই দেখছেন? রাত একটার দিকে খেয়াল করলাম মাঠের এক কোণে দুজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দিকে তাকাচ্ছে মাঝেমাঝে। আমি বললাম, ‘এভাবে সারারাত বাইরে থাকাটা কী ঠিক হবে? যারা দেখবে তারাই খারাপ ভাববে না?’
‘ ভাবলে ভাবুক। তাতে তোমার বা আমার কী? আমরা কী খারাপ কিছু করছি? লাইক কিসিং বা আরও ইন্টিমেট কিছু?’
আমি ওনার বাহুতে হালকা কিল মেরে বললাম, ‘অসভ্য লোক।’
উনি আবার চমৎকারভাবে হাসলেন। একটু পরে উঠে গিয়ে পাশের ইটের রাস্তাটা দিয়ে হাঁটতে ফোনে কারো সাথে কথা বলছেন উনি। অদ্ভুত লাগছিল আমার কাছে। ইচ্ছে করেই নানারকম উদ্ভট চিন্তা আনছিলাম মাথায়। যেমন, উনি আমাকে বিক্রি করে দেবেন, নিশ্চয়ই মাথায় উল্টাপাল্টা কিছু ঘুরছে ইত্যাদি। কিন্তু কোন চিন্তাই পাত্তা পেলোনা। এই লোকটার কাছে নিজেকে কোনদিন অনিরাপদ ভাবতেও পারিনা আমি।
রাত আড়াইটার দিকে উনি আমায় নিয়ে আবার রওনা হলেন অজানা গন্তব্যে। এবারেও আমি জানিনা আমরা কোথায় যাচ্ছি। একদম ফাঁকা রাস্তা দিয়ে বাইকটা চলছে। পুরোনো সিনেমা হলটার পাশের একটা বিল্ডিং এর সামনে উনি থামালেন বাইকটা। আমাকে নিয়ে বিল্ডিং এ ঢুকলেন। ফ্ল্যাটের বাইরে আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে ভেতরে ঢুকলেন উনি। এখানে ওনার দুই বন্ধু থাকে ভাড়া নিয়ে। ওদের সাথেই কোন কথা আছে হয়তো। বেশ কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এলেন। আমি কোমরে হাত দিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললাম, ‘কী ব্যাপার বলুনতো? সত্যি সত্যি আমাকে পাচার-টাচার করার পরিকল্পনা করছেন না-কি?’
উনি আমার মাথায় হাত দিয়ে মৃদু ধাক্কা মেরে বলল, ‘বের হ ডাফার!’
আমি মাথা ডলে মুখ ফুলিয়ে নিচে নেমে এলাম বাইকের কাছে। উনিও এলেন ওনার সাথে ওনার বয়সী একটা ছেলেও নেমে এলো। হাতে একটা ক্যান। লোকটা বাইকে পেট্রোল ভরে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ সরি ভাবি। ঘরে ডাকতে পারলাম না। সাহেবের কড়া নির্দেশ আছে। দিনের বেলা একদিন আসবেন কিন্তু।’
আদ্রিয়ান ভাইয়ের দিকে ইশারা করে বললেন কথাটা। আমি শুধু একটু হাসার চেষ্টা করলাম। লোকটা চলে যেতেই আদ্রিয়ান ভাই বাইকে উঠে বসলেন। আমি উঠে বসতে বসতে বললাম, ‘এবার কোথায় যাচ্ছি?’
‘ আংগারিয়া ব্রিজ।’
যেমন কথা তেমনই কাজ। দুজনেই পৌঁছালাম আঙ্গারিয়া ব্রিজের কাছে। ব্রিজের মাঝামাঝি থামালেন উনি বাইকটা। রেলিং এর সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম আমি। উনি বাইকের সঙ্গে ঝোলানো একটা ব্যাগ বের করলেন। ব্যাগটার ভেতর থেকে বের করলেন একটা ছোট হটপট। হটপট নিয়ে আমার কাছে আসতে আমি বললাম, ‘কী আছে এতে?’
উনি মৃদু হেসে বক্সটা খুলতে খুলতে বলল, ‘ মা পিঁয়াজু বানিয়েছে। বলেছে তোমাকে দিতে। তুমিতো গেলেনা বাড়িতে।’
বলে বক্সটা থেকে একটা পিয়াঁজু নিয়ে আমার মুখে পুরে দিলেন। আমি চিবুতে চিবুতে বললাম, ‘মামণির পিঁয়াজু বরাবরই ফার্স্ট ক্লাস হয়।’
উনি এবারও হাসলেন। আমিও একটা পিঁয়াজু নিয়ে এগিয়ে দিলাম ওনার মুখে। পিঁয়াজু খাওয়া শেষে উনি বক্সটা বন্ধ করতে করতে বললেন, ‘ ব্রিজের নিচে যাবে? নদীর পাড়টা বেশ সুন্দর।’
আমি হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লাম শুধু। উনি আমার হাত ধরলেন। হাত ধরে আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে দুজনে নেমে গেলাম ব্রিজের নিচে। আবছা আলোয় চমৎকার লাগছে জায়গাটা। নদীর পাড় তাই একটু জোরে বাতাস বইছে। নদীর পাশের বালুগুলোও চিকচিক করছে। দূরে সবুজ গাছপালা অন্ধকারে কালচে লাগছে। কী সুন্দর পরিবেশ! আমি বায়না করে বসলাম নদীর জলে পা ভিজিয়ে হাঁটবো। আজ আর নিষেধ করলেন না উনি। বিনাবাক্যে রাজি হয়ে গেলেন। জুতো-স্যান্ডেল খুলে দুজনেই হাঁটতে লাগলাম নদীর পাড় দিয়ে। আমি পাড়ের জলে পা ভিজিয়ে হাঁটছি আর উনি ভেজা বালুতে। হাঁটতে হাঁটতে একবার মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালাম ওনার দিকে। আবছা অন্ধকারেও কতটা মোহনীয় লাগছে ওনাকে! আমার প্রেমিকপুরুষ। এতক্ষণ সামনে তাকিয়ে থাকলেও এবার আমার দিকে তাকালেন উনি। মুচকি হেসে ওনার মুক্ত হাত দিয়ে বাতাসে উড়ে এসে আমার মুখে পড়া চুলগুলো সরিয়ে দিলে। কেউই কিছু বললাম না। নিঃশব্দে এতো কথা বলা গেলে শব্দ প্রয়োগের প্রয়োজন কী? তবে আমার হাত এক মুহূর্তের জন্যেও ছাড়েননি উনি। এভাবে দুজন কতক্ষণ হেঁটেছি সেই সময়টা হয়তো মাপিনি দুজনের কেউই। একটা সময় উনি নিজেই বলেছিলেন, অনেক হয়েছে এবার পানিতে পা আর না ভেজাতে।
ওখান থেকে বাইকে করে গেলাম সোজা মাদারিপুর। নির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য ছিলোনা। ব্যস এমনিই সময় কাটাতেই যাওয়া। মাদারিপুর লেকের কাছের স্ট্যান্ড অবধি গিয়ে আবার ফিরে এসেছি আমরা। ফিরে আসার সময়কার মুহূর্তটাও ছিল অসাধারণ। অন্ধকার কেটে গিয়ে ভোর হচ্ছিলো তখন। তখন কোন সংকোচ বা অভিমান ছিলোনা। তাই নিশ্চিন্ত মনে ওনার হাতের নিচ দিয়ে জড়িয়ে ধরে বসে ছিলাম বাইকে। শরীয়তপুর পৌঁছাতে পৌঁছাতে চারপাশটা ফর্সা হয়ে গেল। শরীয়তপুর কোর্টের সামনের চায়ের দোকানে বাইক থামালেন আদ্রিয়ান ভাই। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে মিষ্টি ভোর উপভোগ করতে করতে চা খেলাম দুজনে। ততক্ষণে মানুষজন আসা শুরু হয়েছে। আদ্রিয়ান ভাইয়ের পরিচিত দুজন জিজ্ঞেসও করেছে, আমি কে? উনি ওনার সেই বার্থডে ওয়ালা গল্পটাই সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করে দিয়েছে তাদের। সকাল সাড়ে সাতটার দিকে আমার বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে গেলেন উনি। কিন্তু বাড়িতে ঢুকলেন না। আমিও জোর করিনি। বাড়ি গিয়ে ঘুমোনো প্রয়োজন ওনার।
বাড়িতে এসে ঢুকে রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখি আম্মু রান্না করছে। আমি গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলাম আম্মুকে। গালে একটা চুমুও দিলাম। আম্মু অবাক হল আমাকে এতো সকাল সকাল বাড়িতে দেখে। আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘কী ব্যাপার? এতো খুশি যে? আর এতো সকাল সকাল চলে এলি যে?’
আমি ইতস্তত করে বললাম, ‘আসলে পড়া ছিল তাই আঙ্কেলকে বলে সকাল সকাল চলে এসেছি। আদ্রিয়ান ভাই দিয়ে গেছে।’
আম্মু তরকারি নাড়তে নাড়তে বলল, ‘ পড়াশোনা করে সীমা দিচ্ছে সে একেবারে। এমনিতেই ছেলেটা রাত জেগে পড়াশোনা করে। ওকে এতো ভোর ভোর উঠিয়ে কষ্ট না দিলে হতো না?’
আমি হতাশ দৃষ্টিতে তাকালাম আম্মুর দিকে। আর ভাবলাম, যদি তোমাকে বলতে পারতাম ছেলেটা রাত জেগে কী ভয়ানক পড়াশোনা করেছে!
.
.
[ রি-চেইক করিনি। ]