বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৬৭
লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
বাসায় প্রবেশ করতেই দূর থেকে বড়াম্মুর আওয়াজ কানে এলো। কথা শুনে মনে হলো নির্ঘাত বকা দিচ্ছেন কাউকে। ড্রয়িংরুমের সামনে যেতেই চোখ পড়লো সোফায় বসে থাকা পূর্ণর উপর, যিনি নির্বিকারভাবে গম্ভীর মুখে বসে আছেন চুপচাপ। শান্তচোখে তাকিয়ে আছেন মায়ের দিকে,
—তুই কি আমার কোন কথাই শুনবিনা? রুম থেকে উঠে আসলি কেন? আমি তো বলেছিলাম-ই কোনকিছু লাগলে আমায় ডাকবি। এখন কি মায়ের কথাও কানে যায়না তোর? নাকি পা পুরোপুরি ঠিক না হতেই আবার ব্যাথা পেয়ে বিছানায় পড়ে থাকার ইচ্ছে আছে?
একনাগাড়ে এসব বলে দম নেওয়ার জন্য থেমে গেলেন বড়াম্মু। পূর্ণ শান্তভাবেই মনোযোগের সহিত মায়ের কথাগুলো শুনলেন৷ খানিকবাদে বরাবরের ন্যায় গম্ভীর ভঙ্গিমায় বললেন,
—আমি ঠিক আছি, মা। এত চিন্তা করোনা। সারাদিন রুমে বসে বসে বোর হই বলেই এখানে চলে এলাম। পুরোপুরি ভালো না হলেও আগের তুলনায় এখন অনেকটাই বেটার ফিল করছি আমি। তাই খুব একটা ব্যাথাও হয়না হাটতে!
উনার কথায় তবুও বড়াম্মু শান্ত হলেন না। উদ্বিগ্ন মুখে আবারো বললেন,
—মায়ের কথা তো এখন তোদের আর ভালো লাগবেনা। খুব বড় হয়ে গেছিস কিনা? বিয়েশাদি হয়ে গেছে৷ এখন মায়ের কথা কেন…
বড়াম্মু আর কিছু বলার আগেই পাশ ফিরে আমায় ও রাইসাকে বাসায় ঢুকতে দেখে সেদিক এগিয়ে এলেন। দুজনের সামনে এসে প্রশ্ন করলেন,
—তোরা ফিরে এসেছিস! তুরফা, তোর পরীক্ষা কেমন হয়েছে? সব পেরেছিস না?
তার চোখেমুখে এত আশার আলো দেখে আমার মনের মাঝে আধার নামলো! কোনোভাবে ছোট্ট সুরে “হুম” বলেই ক্ষ্যান্ত হলাম। বড়াম্মু হয়তো আমার মনের অবস্থা বুঝলেন না। ক্লান্ত মুখশ্রী দেখে গালে হাত রেখে বলে উঠলেন,
—খুব টায়ার্ড লাগছে না? একটু বসে দম নে। ড্রয়িংরুমে পূর্ণ আছে, ওখানে যা। আমি লেবু কেটে রেখেছি, শরবত বানিয়ে আনছি! খেলে ভালো লাগবে!
বড়াম্মুর কথায় তাকে মিস্টি হাসি উপহার দিয়ে চলে এলাম ড্রয়িংরুমে। পূর্ণ যেন আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলেন সেভাবেই তাকালেন আমার দিকে। উনার চাহনি দেখে ইতস্তত হেসে সোফায় বসে পড়লাম তার পাশে! উনাকে এভাবে আমার জন্য অপেক্ষা করতে দেখে ভেবেছিলাম হয়তো এখনি জিজ্ঞেস করবেন কেমন পরীক্ষা দিয়েছি, আর তাহলেই ফেসে যাবো আমি! কেননা সামনাসামনি উনার কাছে মিথ্যা বলা আমার দ্বারা সম্ভব নয়। আর কেউ বুঝুক না বুঝুক, আমার চোরাচাহনিতে ঠিকই টের পেয়ে যাবেন তিনি! এসব ভেবেই বেশ নার্ভাস লাগছিলো নিজের। কিন্তু আমায় অবাক করে দিয়ে পূর্ণ এমন কোনো প্রশ্নই করলেন না! বরং কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলে উঠলেন,
—টেনশন হচ্ছে? দেখো তোমার এখানেই হয়ে যাবে। এত চিন্তা করোনা তো!
—আমিও তো পুরো রাস্তা ওকে এটাই বুঝাতে বুঝাতে এসেছি, ভাইয়া। কিন্তু ও আমার কথা শুনলে তো? মুখের এ হাল-টাই করে ছিলো সারাক্ষণ। এবার আপনিই বুঝান ওকে।
পূর্ণর কথার জবাবে পাশ থেকে হতাশ মুখে বলে উঠলো রাইসা। ওর কথায় উনি মিহি হেসে বললেন,
—তুরফা ঠিক হয়ে যাবে একটু পর। মাত্র পরীক্ষা দিয়ে এসেছে তাই এমন করছে। তুমি চিন্তা করোনা। আর থ্যাংক ইউ ওকে নিয়ে যাওয়ার জন্য!
—ইটস ওকে, ভাইয়া। তুরফা কি আমার বোন হয় না? এটা কোন ব্যাপারই নাহ!
আর কেউ কিছু বলার আগেই বড়াম্মু লেবুর শরবত নিয়ে ফিরে এলেন। যা খেয়ে তৃপ্ত হলো ক্লান্ত শরীর। হঠাৎ রাইসা বললো,
—মা, আমি একটু রুমে যাই? রেস্ট নিবো। শরীরটা ভালো লাগছেনা!
—অবশ্যই। এতক্ষণ বাইরে থেকে আসছিস রেস্ট তো নেওয়াই উচিত। রুমে যা। এই তুরফা, তুই-ও রুমে যা। ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নে। আর সাথে এই বেয়াদবটাকেও নিয়ে যা। আমি কিছু বললেও তো শুনেনা, তোর কথা যদি শুনে?
—উফফ, মা..
বিরক্তিতে “চ” উচ্চারণ করে চোখমুখ কুচকে বললেন পূর্ণ। সেদিক পাত্তা না দিয়েই নিজমনে রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে চলে গেলেন বড়াম্মু! তাদের মা-ছেলের কথাবার্তা শুনে আমার বেশ হাসি পেলো।
বড়াম্মু ও রাইসা চলে যেতেই পূর্ণ এগিয়ে এসে আমার কাধে মাথা রেখে বললেন,
—এতক্ষণ লাগে আসতে? আমি কতক্ষণ ধরে ওয়েট করছিলাম জানো?
—এটাকে আপনার লেইট মনে হয়? আমি তো কোন টাইম ওয়েস্ট করিনি। পরীক্ষা শেষে রাইসাকে খুজে পেতে যতক্ষণ লেগেছে ততক্ষণ দেরি হয়েছে শুধু। এটুকু সময়কে এতক্ষণ মনে হচ্ছে আপনার?
—হুম! কি করবো বলো? অফিসও যেতে পাচ্ছিনা যে টাইমপাস হবে। মা রুম থেকে বের হতেও দেয়না খুব একটা! সারাদিন একরুমে বসে কাজ করতে করতে আর ভালো লাগছিলো না তাই এখানে এযে তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে তোমার মন খারাপ। কি হয়েছে বলো? পরীক্ষা খুব খারাপ হয়েছে?
ব্যস! এটুকুতেই ধরে ফেললেন। লোকটা আমাকে এত সূক্ষ্মভাবে খেয়াল করেন যে তার থেকে কোনোকিছু সহজে লুকোনো দুষ্কর হয়ে পড়ে! কিন্তু এ মুহুর্তে আমি নিজের সাথে উনার মুডটা খারাপ করতে চাইছিনা তাই প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললাম,
—এমন কিছুই হয়নি। এতটাও খারাপ হয়নি, এখন দেখা যাক কি হয়। আল্লাহ ভরসা!
কথার মাঝেই ঘড়ির দিক চোখ পড়লো। সাথে সাথেই মনে পড়লো কিছু। কাধ থেকে উনার মাথা উঠিয়ে দ্রুত কণ্ঠে বললাম,
—এই আপনার না ওষুধ খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। খেয়েছেন সেটা?
—খাবো একটু পর। এত ওষুধ খেতে ভালো লাগেনা। ডিসগাস্টিং!
চোখমুখে আধার নামিয়ে চাপা স্বরে বললেন তিনি। তা দেখে হেসে ফেললেও মুখে প্রকাশ করলাম নাহ। পূর্ণ বাকি সব ব্যাপারে প্রচুর সিরিয়াস ও ম্যাচুরিটি দেখালেও এই একটা দিকে উনার ছোটকালের স্বভাব যায়নি! ওষুধ না খাওয়ার বাহানা খুজেন সবসময়। জোর করে তাকে ওষুধ খাওয়াতে হয়! তাই মেকি রাগ দেখিয়ে সোফা থেকে উঠে বললাম,
—একটু পর আবার কি? সময় হয়েছে মানে এখনি খেতে হবে। রুমে চলুন!
কথাটি বলে হাত বাড়িয়ে দিতেই তা মুঠোয় পুরে মুখটা বাংলার পাচের ন্যায় করে সোফা থেকে উঠলেন তিনি। এক হাতে আমার কাধে হাত রেখে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটতে হাটতেই বললেন,
—সিরিয়াসলি? তোমার সাথে রুমে যাচ্ছি ঠিকি কিন্তু ওষুধ আমি খাবোনা এখন। একদম মুড নেই ওসব ফালতু জিনিস খাওয়ার, বুঝেছো? এন্ড আই এম কমপ্লিটলি ফাইন। দেখো আমি ঠিকভাবেই হাটাচলা করছি। আমি সুস্থ আছি!
—হুম, তা তো দেখতেই পাচ্ছি কেমন আছেন।
উনার দিক তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে কথাটা বলতেই চোখ পাকিয়ে তাকালেন। এরই মাঝে রুমে চলে এলাম দুজনে। পূর্ণ খাটে যেয়ে বসতেই আমি ফ্রেশ হতে চলে গেলাম। বের হয়ে এসে উনার হাতে পানির গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে ওষুধের বক্স থেকে ওষুধ বের করছিলাম। এরই মধ্যে আন্টির কল এলো আমার ফোনে। এ সময় আন্টির কল আসায় বুঝলাম হয়তো পরীক্ষা কেমন দিয়েছি জানতে ফোন দিয়েছেন, দূরে থাকলেও আমার সব ব্যাপারে সর্বদাই মায়ের ন্যায় নজর থাকে যে তার! পূর্ণ যেন মোক্ষম সুযোগ পেয়ে গেলেন এবার। ওষুধের বক্সটা আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বললেন,
—আন্টি ফোন দিচ্ছে দেখো। রিসিভ করো তাড়াতাড়ি, কেটে যাবে তো!
—আগে আপনার ওষুধ…
—হুশ!
অতঃপর আমায় আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উনি কল রিসিভ করে লাউডস্পিকারে দিয়ে ফোন হাতে ধরিয়ে দিলেন আমার। সাথে সাথেই ও-পাশ থেকে আন্টির আওয়াজ,
—কি রে তুর, কেমন আছিস? পরীক্ষা কেমন হলো?
—এইতো আন্টি, ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? পরীক্ষাও হয়েছে মোটামুটি।
—আমিও ভালো আছি। বাসার সবাই ভালো? পূর্ণ কেমন আছে এখন? ও সুস্থ হলে বাসায় আসিস একদিন। অনেকদিন তো দেখা হয়না!
—হ্যাঁ, উনি তো ভালোই আছেন এখন। যাবো তাড়াতাড়িই তোমার বাসায়।
কথাটা শেষ করে আন্টি কিছু জবাব দেওয়ার আগেই পূর্ণ ওষুধের বক্স থেকে তড়িঘড়ি করে ওষুধ বের করলেন। আমি শুধু ভ্রু কুচকে দেখতে লাগলাম তার কাজকর্ম! এদিকে আন্টিকে বিদায় জানিয়ে ফোন রাখতে রাখতেই ইতোমধ্যে ওষুধ খাওয়ায় শেষ হয়ে গেছে তার। সরুচোখে সেদিক তাকিয়ে কিছু দ্বিধান্বিত গলায় শুধালাম,
—এতক্ষণ এতকিছু বলেও ওষুধ খাওয়ানো যাচ্ছিলোনা আর এখন নিজে থেকেই খেয়ে নিলেন? এত উন্নতি কিভাবে হলো?
অতঃপর থমথমে মুখে তার রাশভারি আওয়াজ,
—আমার যে ওষুধ খাওয়া বাকি আছে সে খেয়াল আছে তোমার? তুমি তো অসুস্থ বরকে একা রেখে আন্টির বাসায় ঘুরতে যেতে চাও! তুমি আমার একটুও সেবাযত্ন করোনা, তুর পাখি। ভেরি ব্যাড!
—ওহ, তাই? একটু আগেই না সুস্থ ছিলেন বলছিলেন, এখন আবার অসুস্থ হয়ে গেলেন?
তার পল্টিবাজ কথার বিপরীতে ব্যঙ্গাত্বক ভাবে প্রশ্নটা করতেই রাগী চোখে তাকালেন পূর্ণ। সেদিক চেয়ে ঠোঁট টিপে হাসলাম। হঠাৎ করেই মনে বড় এক প্রশ্নের উদয় হলো। যে মানুষটা সামান্য আন্টির বাসায় যাওয়া নিয়েই এমন কাহিনি করেন, আমি ঢাকার বাহিরে চান্স পেলে তার কি হবে?
বেশ কিছুক্ষণ নীরবতার পর দ্বিধাদ্বন্দ কাটিয়ে মনের প্রশ্নটা মুখে করেই ফেললাম। বেশ শান্ত স্বরে ধীর গলায় প্রশ্ন ছুড়লাম তার দিকে,
—আচ্ছা, যদি আমার বাই এনি চান্স ঢাকার মধ্যে চান্স না হয়? তাহলে কি হবে?
এ সময় এহেন প্রশ্নে মাথা তুলে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালেন পূর্ণ। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে আমার চেয়েও ধীর গলায় জবাব দিলেন,
—কি আর হবে? তোমাকে ঢাকার বাহিরে রেখে আসবো! এর বেশি আর কি হবে?
বলাবাহুল্য, তার থেকে এমন উত্তর আশা করিনি আমি। আচমকা উনার এমন উত্তরে ভয়ে-টেনশনে হিম হয়ে এলো শরীর! তার মানে উনি নিজ সিদ্ধান্তে অনড়! থমথমে মনে ভাবতে লাগলাম কয়দিন পর প্রকাশিতব্য আমার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা! মুহুর্তেই একরাশ বিষন্নতা ছেয়ে গেলো সমগ্র অন্তরজুড়ে!
#চলবে