মায়াবতী পর্ব ২৩
তানিশা সুলতানা
মুখোমুখি বসে আছে নিধি অর্ণব। অর্ণবের পাশে আনোয়ার। মূলত আনোয়ার এনেছে নিধিকে। রাস্তায় না কি দেখা হয়ে গেছিলো দুজনের। আজকে একটা স্পেশাল ডে। তাই তার মনে হলো নিধিকে নিয়ে আসা দরকার।
অর্ণব প্রথমে রেগে গেলেও পড়ে খুশি হয়েছে কারণ নিধির সাথে কথা বলার আছে।
আশা তিন মগ কফি এনে রাখে টি টেবিলে। তারপর স্বামীর পাশে বসে হাসি মুখে তাকায় নিধির দিকে।
আনোয়ার অর্ণবের শক্ত চোখমুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে কফির মগ হাতে নিয়ে তাতে চুমুক দেয়। আজকে কফিতে চিনি পড়েছে বেশি। খেয়ে বেশ আরাম পাচ্ছেন উনি। এমনিতে প্রতিদিন তেঁতো চা কফি গিলতে হয়।
মুখে কফি নিয়ে চোখ বন্ধ করে আয়েশ করে গিলছেন উনি। চোখে মুখে ফুটে উঠেছে তৃপ্তির হাসি৷
অর্ণব বাবার এক্সপেশন দেখে বিরক্ত হয়ে নিজের মগটা হাতে তুলে নেয়। তাতে চুমুক বসাতে যাবে তখনই আনোয়ার গম্ভীর গলায় বলে ওঠে
“দেশে এসেছে পর থেকেই সারাক্ষণ এদিক সেদিন ঘুরে বেড়াচ্ছে। পড়ালেখা শেষ করে এসেছো কি বাংলাদেশের মাঠঘাট দেখার জন্য?
নিধি বিরক্ত হয়। এই ভাষণ শোনার জন্য এসেছে না কি সে? তবুও ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে তোলে। একটু হলেও তাল মেলাতে হবে৷
” পাপা সবে কয়েকদিন হলো এসেছি। চাকরি খুঁজতে হবে তো?
“এমনিতে তো বাবা বলে ডাকো। এখন হবু বউয়ের সামনে পাপা? গিরগিটির থেকেও ভয়ংকর তুমি।
অর্ণব ভ্রু কুচকে বাবার দিকে তাকায়। নিধি হেসে ফেলে।
অর্ণব কফির মগ নামিয়ে আগের জায়গায় রেখে দেয়।
” আমি যাবো? কথা শেষ?
আনোয়ার তারাহুরো করে বলে
“আসল কথাই তো বললাম না এখনো।
অর্ণব সোজা হয়ে বসে। আশা বাঁকা চোখে স্বামীর দিকে তাকায়। চাকরি নিয়ে কিছু বললে সে এবার কড়া কথা শোনাবে এটাই তার মতলব।
কিন্তু তার সেই মতলবে এক বালটি পানি ঢেলে দিয়ে আনোয়ার বলে ওঠে
” এই সপ্তাহের মধ্যে আমার অফিসে জয়েন করবা দেন পরের সপ্তাহে তোমাদের বাগদত্তা সেরে ফেলবো।
নিধির খুশি আর দেখে কে? তার নাচতে ইচ্ছে করছে। তবুও ঠোঁট কামড়ে নিজের খুশি আটকায়।
আশা চিন্তিত হয়ে পড়ে। এতো দ্রুত ছেলের বিয়ে?
মুখ ফসকে বলেই ফেলে।
“একটু বেশিই তারাহুরো হয়ে গেলো না?
“আহহ আশা আর কতো অপেক্ষা করাতে চাও ছেলেকে? বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে তার।
আশা আনোয়ারের দিকে দাঁত কটমট করে তাকায়। উনি সেদিকে পাত্তা না দিয়ে কফি খাওয়ায় মন দেয়। এমনিতেও গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে গিয়ে কফি প্রায় ঠান্ডা হয়ে গেছে। বাকিটা ঠান্ডা করতে চাইছে না।
” বিয়ে করে নিয়েছি আলরেডি। এবার বাসর বাকি। সেটার ব্যবস্থা করো।
বলেই উঠে হনহনিয়ে চলে যায় অর্ণব। আশা শুকনো ঢোক গিলো রান্না ঘরে চলে যায়। আনোয়ার বিষম খায়। আর নিধি চিন্তায় পড়ে যায়। তাদের তো বিয়ে হয় নি। তাহলে অর্ণব কার কথা বললো? কাকে বিয়ে করেছে সে?
অথৈ আর্থি আর তন্নি তিনজনে মিলে কেক বানাচ্ছে চকলেট কেক। অর্ণবের ভীষণ প্রিয়। তন্নি কখনো কেক বানায় নি তাই আর্থির থেকে শিখছে।
অথৈ অনেকখন যাবত ছটফট করছে ছাঁদে যাওয়ার জন্য। কারণ সেখানেই সাজানোর হবে কেক কাটার জন্য। কিন্তু আর্থি যেতে দিচ্ছে না। তার কথা কেকের কাজ খানিকটা শেষ করে তারপর তিনজন এক সাথে যাবে।
আশা কয়েকবার রান্না ঘরে ঢুকতে চেয়েও পারে নি। তাকে কেউ এলাও করছে না। তাই সে আশেপাশে ঘুরঘুর করছে।
অর্ণব রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে তাই নিধি সেখান থেকে ফিরে এসেছে। এখন একা একা বোরিং লাগছে তাই আশা বেগমকে খেয়াল করে সেখানে আসে।
“আন্টি আপনি ভেতরে যাচ্ছেন না কেনো?
হাসি মুখে বলে নিধি। আশা পা থেকে মাথা পর্যন্ত নিধিকে দেখে। আগের দিনের ড্রেসআপ মেনে নিয়েছিলো ঠিক আছে বলে। কিন্তু আজকে?
হাতা কাটা টপস পড়েছে।
সেও হেসে বলে।
” ওরা কেক বানাচ্ছে। আমাকে এলাও করছে না।
“কেক কেনো?
” তুমি জানো না?
“আমি কি করে জানবো?
” আমার ছেলের জন্মদিন। তুমি ভূলে গেছো?
“ওহহহ সরি আন্টি। ভূলেই গেছিলাম আমি। আমার নিজের বার্থডে ছাড়া আর কারো বার্থডের কথা মনে থাকে না। এনিওয়ে
আমি যাই বার্থডে বয়কে উইস করে আসি।
নিধি যেতে নেয়। আশা ডাকে।
” আমার মেয়েরা তার ভাইকে সারপ্রাইজ দিতে চায়। এখন উইস করে সারপ্রাইজ নষ্ট করে দিও না।
আশা মনেমনে খুদ্ধ হয়ে। কেমন ভালোবাসে? যে প্রেমিকের বার্থডে টা মনে করে রাখতে পারে না। আদৌও এই মেয়েটা তার ছেলেকে ভালোবাসে তো?
কেক মোটামুটি তৈরি হতে দিয়ে ওরা ছাঁদে চলে যায়। তিনজন মিলে মুহুর্তের মধ্যে সুন্দর করে সব সাজিয়ে ফেলে।
সব কিছু সাজাতে সাজাতে রাত আটটা বেজে যায়।
তারপর সবাই মিলে খেতে বসে। অর্ণব তন্নির পাশে এসে বসেছে। নিধি সামনাসামনি বসেছে।
অথৈ আর আর্থি গল্প করছে আর খাচ্ছে। নিধিও নিজের মতো খেয়ে যাচ্ছে।
তন্নি মাথা নিচু করে মুখে খাবার পুরছে।
অর্ণব মুচকি হেসে তন্নির পায়ের ওপর নিজের পা রাখে৷ তন্নি চমকে চোখ দুটো বড়বড় করে তাকায়,অর্ণবের দিকে৷
অর্ণব তন্নির দিকে খানিকটা এগিয়ে বসে।
“খাইয়ে দাও আমায়।
নিজের বা হাত টা তন্নির বা হাতের ওপর রাখে। তন্নির মুখে খাবার ছিলো না চিঁবিয়েই গিলে ফেলে।
গলার স্বর নিচু করে বলে
” সবাই এখানে কি করে খাওয়াবো?
“তার মানে তুমি আমাকে খাওয়াতে চাও?
তন্নি আবারও চমকে ওঠে। সত্যিই তো। সে কি ওকে খাওয়াতে চায়?
” আমি কি খাবার নিয়ে রুমে চলে যাবো?
অর্ণব আবারও জিজ্ঞেস করে। তন্নি অসহায় চোখে তাকায় অর্ণবের দিকে।
“ওকে খাইয়ে দিতে হবে না। নিজে থেকে তাহলে আমার হাত ধরো।
অর্ণব বলা মাত্রই তন্নি অর্ণবের আগুলের ভাজে নিজের আঙুল ঢুকিয়ে দেয়। অর্ণব মুচকি হেসে সবার দিকে এক পলক তাকিয়ে হুট করে তন্নির কপালে চুমু দেয়।
সেকেন্ডের মধ্যে ঘটে যায় সব কিছু। তন্নি স্তব্ধ হয়ে যায়। অর্ণব স্বাভাবিক ভাবেই খেতে থাকে।
তন্নির খাওয়ার বারোটা বেজে যায়। সে এখনো ঘোর থেকে বের হতে পারছে না। হৃদপিন্ড ধুপবুক করছে। মনে হচ্ছে এখনো অর্ণবের ভেজা ঠোঁট দুটো কপালে লেগে আছে। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির ছোঁয়া হৃদকে অস্থির করে তুলছে।
অর্ণব খাবার মুখে পুরে এক পলক তাকায় তন্নির দিকে৷ তন্নির অবস্থা দেখে বাঁকা হাসে।
তারপর অথৈকে উদ্দেশ্য করে বলে
” অথৈ তোর তন্নিকে বলে দিস। লজ্জা না পেতে। লজ্জা পেলে তাকে অনির মাম্মামের মতো লাগে।
সকলে তাকায় অর্ণবের দিকে। তন্নি চোখ মুখ খিঁচে মাথা নিচু করে ফেলে।
“তোকে দেখতে কে বলছে;? সামনে নিধি আপু আছে তাকে দেখ। কি কিউট সুইট। তার থেকে তো আমারই চোখ ফিরছে না। তোর চোখ ফিরলো কি করে?
ভাই তুই নিধি আপুর সাথে চিট করছিস না তো?
নিধি আপুকে রেখে অনির মাম্মামের প্রেমে পড়ে যাস নি তো?
জাতি কিন্তু মানবে না। তোর পেছনে স্টাম্প মেরে লিখে দেবে ” অর্ণব চৌধুরীর চরিত্রে সমস্যা আছে”
গণধোলাই ও দিতে পারে।
অথৈয়ের কথা শুনে অর্ণব চোখ পাকিয়ে তাকায়। তন্নি খিলখিল করে হেসে ওঠে। নিধি ভ্রু কুচকে ফেলে।
তন্নির হাসি দেখে প্রাণ জুরিয়ে যায় অর্ণবের।
“তোমার হাসি খুব বাজে। কিন্তু আফসোস এই বাজে হাসিটার জন্য বছর খানি অপেক্ষা করতে হয়।
অর্ণবের কথা শুনে তন্নির হাসি বন্ধ হয়ে যায়। আর্থির আপাতত এদিকে মন নেই। সে ফোন দেখছে।
__
অথৈ আর তন্নি দুজন শাড়ি পড়েছে৷ তন্নিকে মূলত জোর করেই শাড়ি পড়িয়েছে অথৈ।
কালো সিল্কের শাড়িতে তন্নিকে বেশ মানিয়েছে
কালো শাড়ি ছোট হাতার ব্লাউজ লম্বা চুল গুলো বিনুনি গেঁথেছে। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক আর চোখে কাজল দুই হাত ভর্তি কালো চুড়ি ব্যাস তন্নি রেডি।
এবার তন্নিকে কেক সাজানোর জন্য রুম থেকে বের করে দেয় অথৈ।
অর্ণব কালো শার্ট পড়ে রেডি হয়ে রুম থেকে বের হয়। কি হচ্ছে জানা নেই তার। তবে এইটুকু বুঝতে পারছে তার জন্য সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে।
প্রথমদিনের মতো সামনে তাকাতেই অর্ণবের হার্ট লাফিয়ে ওঠে। কালো শাড়িতে তার মায়াবতী।
অর্ণব জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়।
” এই মেয়েটা আমাকে পাগল করেই ছাড়বে।
বিরবির করে বলে অর্ণব। তারপর লম্বা শ্বাস টেনে বড়বড় পা ফেলে তন্নির সামনে যায়। তন্নি কিছু বলতে যাবে তার আগেই হাত ধরে টেনে নিজের রুমে নিয়ে দরজা আটকে দেয়। এটা দেখতে পায় নিধি।
চলবে………………