জলনূপুর পর্ব ৩
Sharifa_Suhasini
কিন্তু আমি রাজি নই। বাবা, তোমরা নিজেদের ইচ্ছামতো মত দিতে পারো না। বিয়েটা যেহেতু আমার, তাই আমার মতামত নেওয়াটাও জরুরি। আমি আমান সাহেবকে বিয়ে করতে পারব না।
সবাই যখন বিজয়োউল্লাসের সূচনা করতে যাচ্ছে, ঠিক এমন মুহূর্তেই বেঁকে বসল নবনী। এত কষ্টে সবাইকে ম্যানেজ করেও সে যে ফিরে এসে তরী ডুবিয়ে দিচ্ছে, এই ভেবেই রিতুর যেন মাথায় হাত। নবনী যদি আমানকে বিয়ে না করতে চায়, তবে বাবা ফরিদ হোসেন এখন কি ভয়ানক সিদ্ধান্ত নিবেন, কে জানে! সে অসহায় দৃষ্টিতে অবনীর দিকে তাকালো। নবনী আবার বললো,
-রিতুকে উনার পছন্দ নয়, ঠিক আছে। বিয়ে হবে না। কিন্তু তাই বলে রিতুর রিপ্লেছে আমাকে দুধভাত হিসেবে চালিয়ে দেবার তো কোন মানে নেই। আচ্ছা আমান সাহেব, আপনি এলেন। আমাকেই আপনার পছন্দ এটাও হুট করে বলে দিলেন। কিন্তু আপনি কিভাবে ভাবলেন যে, আপনাকে আমি বিয়ে করবো। আপনি কি আমার অতীত জানেন?
-কি অতীত জানবো? ডিভোর্স আপনার দোষে হয়েছে কি-না, সেটা? আমি জানার আগ্রহ বোধ করছি না। এরপরও আপনি জানতে চাইলে আমার আপত্তি নেই। কখন বলবেন বলুন?
আমানের প্রশ্নে নবনী ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। সে ভেবেছিল, পাত্রপক্ষের থেকে অন্তত ডিভোর্সের কারণটুকু অন্তত জানতে চাইবে। অথচ এই মানুষগুলো সম্পূর্ণই উল্টো। প্রসঙ্গ পাল্টে নবনী আবার জিজ্ঞাসা করল,
-আমাকে আপনি কতটুকু চেনেন? দুজন মানুষ পরস্পরকে না চিনেই এভাবে বিয়ের কথা ভাবাটা ছেলেমানুষি।
আমান একবার উপস্থিত সবার দিকে চোখ বুলিয়ে নেয়। ক্রিকেট ম্যাচের শেষ বলের কারিশমা দেখার উৎসুক জনতার মত সবাই ওর দিকে ড্যাব ড্যাব চোখে চেয়ে আছে। আমান মৃদু হেসে বলে উঠলো,
-আপনাকে আমি রিতুকে চেনার আগে থেকেই চিনি। যে আপনার পছন্দের রং বেগুনি, পাহাড় পাহাড় বেশি টানে। টয়েনবি,হুমায়ুন আহমেদকে বেশি পড়েন। নজরুল করেন। দুধ কপি, ঠান্ডা ভাত আর ঘিয়ের সাথে ডিম এবং মাংসের টুকরো দিয়ে ভাজি আপনার প্রিয় খাবার। আন্টি দারুন বানান।
এতক্ষণে নবনীর মা তরু বেগম চুপচাপ বসেছিলেন। স্বামীর পাশে দুই একটা মতামত ফিসফিসিয়ে দিলেও মেয়েদের সিদ্ধান্তের মধ্যে তিনি কথা বলার প্রয়োজন বোধ করেননি। তার অবশ্য কারণও আছে। মুখের একপাশ প্যারালাইজড হয়ে যাবার পর থেকে যৎসামান্যই আওয়াজ করেন। আমাদের মুখে নিজেদের নিজস্ব রেসিপি কথা শুনে চোখ মুখ যেন চিকচিক করে উঠলো তার। আমান আবার বলল,
-এখন পর্যন্ত যেটুকু জানলাম, এর বাইরেও কি আপনাকে উত্তর দেবার প্রয়োজন আছে? থাকলে বলুন।
নবনী একেবারে চুপ হয়ে গেল। এই মানুষটা তাকে জানলো কিভাবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে মিটিমিটি চোখে বাড়ির অন্যসব সদস্যদের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করে, সবাই তার হ্যা বোধক উত্তরের অপেক্ষায় অধীর আগ্রহ চেয়ে আছে। নবনী কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে বাবা ফরিদ হোসেন কে বলল,
-আই নিড টাইম। বাবা, তোমরা কি আমাকে একটু সময় দিবে প্লিজ?
-দেখো নবনী, আমার ভাই বলে বলছি না। আমানের মত ছেলে লাকি একটা মিলে। আমি জানি, একবার ঠকে গিয়ে তুমি মানসিকভাবে মানুষের উপর থেকে কতখানি বিশ্বাস হারিয়েছো। ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে আমানের সম্পর্কে এতোটুকুই বলবো তুমি ঠকবে না।
নবনীকে আমান বিয়ে করলে ফৌজিয়া হবে তার নন। একজন ডিভোর্সি মেয়ের প্রতিও তাঁর সমান আগ্রহ দেখি ফরিদ হোসেন মুগ্ধ হয়ে গেলেন। এই পরিবার নিয়ে দুশ্চিন্তা করার বিন্দুমাত্র অবকাশ তার নেই। কিন্তু মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি কোন রিক্স নিতে চাইলেন না। আরমান খানের হাত ধরে বললেন,
-আমি জোর করলে আমার মেয়ে ঠিকই রাজি হবে। কিন্তু আমি সেটা চাই না। কারন, পূর্বের সিদ্ধান্তটাও আমারই ছিল। আমি চাই আমার মেয়ে মুক্তমনে সিদ্ধান্ত নিতে শিখুক। নিজের ইচ্ছায় বাঁচুক। আরমান ভাই, আমার কাছে নবনীর সিদ্ধান্তই শেষ সিদ্ধান্ত। ওর সময় চায়। আর আমি বাবা হিসেবে ওকে সেটা দেবো।
-আমি আর কি বলবো বলুন? সেটা নবনি আর আমান মিলেই ঠিক করুন। প্রথমবার আমার ছেলের মুখ ফুটে বলেছে ও কোন মেয়েকে পছন্দ করে। আমার কাছেও ওর সিদ্ধান্তই আসল। আমরা বরং ওদের উপরেই বাকিটা ছেড়ে দেই।
সেদিনের মত আরমান খান তার ছেলে-মেয়েকে নিয়ে বের হয়ে গেলেন। বাড়ির সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। সবচেয়ে খুশির ফোয়ারা ছুটেছিল তাথলের ঠোঁটে। শুধু নবনীই হতবিহ্বল হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে। এই আমান ছেলেটা তার সম্পর্কে সব জানে।কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব! নবনী পাশ ফিরে ঘরের দিকে পা বাড়াতেই রাতুলের উপর ওর দৃষ্টি পড়ে। আগের সেই চিন্তিত ফ্যাকাশে মুখের ভঙ্গি এখন আর তার নেই। রিতুর দিকে চেয়ে মুচকি হাসছে সে। নবনী বলল,
-তোদের মধ্যে সম্পর্ক আছে, এটা আগে বললেই হতো। মাঝখানে আমাকে এভাবে ফাঁসানোর মানে কি?
রিতু ভয়েস চমকে উঠে। তার বোন যে অতি বুদ্ধিমতী নারী, তা কি তার অজানা ছিল? নিশ্চয় না। তবুও সেধে বলার সাহস রিতুর হয়নি। লজ্জিত হয়ে সে বলে,
-আপা, বাবা জানতে পারলে আস্ত রাখবে না। তুমি তো জানোই, উনি হুটহাট নিজের মতই সিদ্ধান্ত নিতে পছন্দ করেন। তুমি প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও।
রিতু ওকে জড়িয়ে ধরার জন্য এগিয়ে গেলে সে থামিয়ে দিয়ে বলে ওঠে,
-কাছে আসিস না। এখন আমি দুই ঘন্টা ধরে গোসল করবো। তোরা কেউ বিরক্ত করবি না একদম। আর হ্যাঁ, আজকের ঘটনার পর আশা করি বাবা খুব সহজে তোর মতামত মেনে নিবেন।
-সত্যি? কিভাবে?
জানি না। মন বলছে, তাই বললাম। রাতুল, গেস্টদের উপলক্ষ করে আজ বাসায় ভালো আইটেম রান্না হয়েছে। খেয়ে যেও। আর রিতু, রাকিবের ভার্সিটি কাল থেকে চার দিনের ছুটি। ও বাসায় আসছে, বাবাকে বলে দিস।
নবনী আর পিছে ফিরে তাকায় না। যন্ত্রের মতো হেঁটে হেঁটে নিজের ঘরে চলে যায়। রাতুল মুগ্ধ হয়ে ভাবে নবনী আপা সত্যিই এমন স্নিগ্ধ কেন! কিন্তু নবনীর তা মনে হয় না। সে নিজেকে ভীষণ কাঠখোট্টা টাইপ মনে করে। ঠিক যেন শিমুল তুলার গাছ। কন্টকযুক্ত। বাইরে বের হতে ভালো লাগেনা, মিষ্টি ভালো লাগেনা কথাও বলে সামান্য। এই অভ্যাসটা ডিভোর্সের পর নয় বরং আজন্মই সে এমন। অথচ রিতু ঠিক তার উল্টো।
ফরিদ হোসেনের কোন এক বন্ধুর দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের কোম্পানি থেকে চাকরির ভাইবা দিয়ে বাসায় ফিরেছে নবনী। এভাবে বাসায় বসে থাকতে ভালো লাগছে না ওর। হঠাৎ হঠাৎ নতুন মানুষের সাথে আলাপ জমাতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। সেকারণেই সেদিন ঘুম থেকে উঠেই ব্রাশ না করে সোজা বাবার ঘরে গিয়ে বলল,
-বাবা, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি চাকরি করব।
-আমার ব্যবসা থেকে কি কম উপার্জন হচ্ছে?
-না। তুমি দারুন ব্যবসায়ী। এ নিয়ে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু আমি মেয়ে হয়ে তো ওসব দোকান, আড়ৎ সামলাতে পারিনা। ভার্সিটি শেষ করি ওসব করবে রাকিব। কারণ পাশ করে বেরোলেও তোমার ব্যবসার দশভাগের এক ভাগ বেতনের চাকরিও ও পাবেনা। যাই হোক, আমি চাকরি করতে চাই। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি।
-আচ্ছা, ঠিক আছে। তবে অপরিচিত কোথাও যেতে দেব না। দেখি, আমার এক বন্ধুকে বিকেলে কল দিবোনি।
বাবা সূত্রেই এখানে ভাইবা দিতে আসা। চাকরি প্রায় নিশ্চিত, নবনী তখনই ভাইবা বোর্ডে বলে উঠেছে দেখুন, আমি কিন্তু ডিভোর্সি। আপনাদের কোন সমস্যা হবেনা তো?
উপস্থিত সবাই হতবাক হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে জানান তাদের কোন সমস্যা নেই। নবনী সালাম দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। এই মুহূর্তে কেন জানি আর চাকরিটা টানছে না। বিরক্ত লাগছে। তপ্ত রোদে দাঁড়িয়ে সে রিক্সার অপেক্ষায় আছে, এমন সময় পাশ থেকে আমান বলে উঠলো,
-আপনি এখানে?
-আমার তো এখানেই থাকার কথা। বরং এই প্রশ্নটা তো আমার করার কথা। কাজকর্ম ফেলে স্টক করতে এসেছেন?
আমান মুচকি হাসলো। একটা কপির জার ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
-কথাটা আংশিক সত্য। হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরছিলাম। আপনার বাবাকে ফোন দিলে উনি জানান আপনি এখানে। তাই স্টক করতে চলে এলাম বিরক্ত হলে চলে যাচ্ছি।
_উহু, যেতে হবে না। আপনাকে অনেকগুলো প্রশ্ন করার আছে।
-করুন।
-আমি যেই আমানকে দেখছি, এটা আপনি নন। তাই না? আর আপনি আমার সম্পর্কে এত তথ্য কেন আর কিভাবে পেলেন?
আমানির নির্বাক হয়ে ওর দিকে তাকালো।
চলবে…..
যারা পেইজে ফলো না করে গল্প পড়ছেন, তারা পেজটি ফলো করে দিন।তাহলে পরবর্তী পর্ব পোস্ট করার সাথেই নোটিফিকেশন পেয়ে যাবেন। না হলে পরবর্তী পর্ব মিস হতে পারে।সকলে আমার পেইজে এড হয়ে নিন।কথা