মায়াবতী পর্ব ৩৬
তানিশা সুলতানা
অথৈয়ের থেকে এক ব্যাগ রক্ত নিয়েছে। অথৈ আরও দিতে চায়। কিন্তু ডাক্তার নিবে না। কারণ আরেক ব্যাগ নিলে অথৈ অসুস্থ হয়ে যাবে। সাগরের বাবা সাদ্দাম আর মা সালমা কিছুক্ষন পরেই চলে আসে
সাদ্দাম রক্ত আনতে বেরিয়েছে। সালমা কান্না করছে। সকালেও ছেলেকে নিজে হাতে খাইয়ে দিয়েছে আর এখনই ছেলেটা হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে৷ বেচারি মেনে নিতে পারছে না।
অথৈ মাথা নিচু করে বসে আছে। এখনো তন্নির কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি। কোথায় গেলো মেয়েটা? কেনো গেলো?
কি হলো তার? তন্নি ঠিক আছে তো?
সাগরের টেনশন তন্নির টেনশন দুটোর চাপ নিতে পারছে না অথৈ। মাথা ঘুরে আসে তার। বসে থাকতে পারে না। টলে পড়ে যায় ফ্লোরে।
সালমা বেগমের পাশেই বসে ছিলো অথৈ। অথৈকে পড়ে যেতে দেখে চিৎকার দিয়ে ওঠে উনি। ডাক্তার এগিয়ে আসে। মুহুর্তেই নার্স চলে আসে। অথৈকে ধরে কেবিনে নিয়ে যায়।
আনোয়ারকে কল করে সালমা। এলাকার পরিচিত নাম্বার ছিলো তার কাছে।
আনোয়ার সবেই ভিডিওটা দেখতে যাবে তখনই ফোন বেজে ওঠে।
খানিকটা বিরক্তি নিয়েই কল রিসিভ করে তিনি।
“হ্যালো”
ওপাশ থেকে সালমা কাঁদতে কাঁদতে বলে
” অথৈয়ের কিছু হয়ে হয়েছে। হাসপাতালে চলে আসুন।
আনোয়ারের হাত থেকে ফোনটা পড়ে যায়। তার ছোট মেয়ে তার জান। কি হয়েছে তার কলিজার?
চিৎকার করে আশাকে ডাকতে থাকে।
আশা নিধির সাথে পরামর্শ করতেছিলো কি করবে না করবে।
স্বামীর চিৎকার করা ডাকে সে দৌড়ে রুমে যায়।
আনোয়ার দরদর করে ঘামছে। হাত পা কাঁপছে তার। স্বামীর করুন পরিণতি দেখে আশা দৌড়ে স্বামীকে ধরে
“কি হয়েছে তোমার? এমন করছো কেনো?
আনোয়ার কাঁপা-কাঁপি গলায় বলে
” আমার অথৈ
“অথৈয়ের কি হয়েছে?
” হাসপাতালে ও।
আশা কেঁদে ফেলে। সে অর্ণবকে ডাকে। অর্ণব ততক্ষনে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে। আর্থি বাড়িতেই ছিলো। সে আসে। সবটা শুনে বাবা মাকে ধরে গাড়িতে বসায়। তারপর নিজে ড্রাইভ করে হাসপাতালের উদ্দেশ্য রওনা হয়।
অথৈকে স্যালাইন দেওয়া হয়েছে। সাথে ঘুমের ঔষধ। ঘুমের মধ্যেও সে বারবার তন্নি তন্নি করে উঠছে। আশা মেয়ের হাত ধরে বসে ছিলো। আনোয়ার পায়ের কাছে।
আর্থি আরেক হাত ধরে বসে আছে।
মেয়ের মুখ থেকে তন্নি নামটা শুনে আশা কেঁপে ওঠে। মনে পড়ে যায় তখনকার কথা।
তখন আনোয়ার বেরিয়ে যাওয়ার পরই আশা কল করেছিলো ইতি বেগমকে।
ইতি তন্নিকে ভালোবাসে না। সারাজীবন অনেক অত্যাচার করেছে মেয়েটার ওপর। ঠিক মতো খেতেও দেন নি। মেয়েটাকে অনেক কথা শুনিয়েছে।
কিন্তু যখন আশা তন্নিকে যা নয় তাই বলছিলো তখন কেনো জানি ইতির সহ্য হয় নি। খুব খারাপ লেগেছিলো।
ইতি বলেছিলো
“আমার মেয়ে আর আপনার ছেলে মেয়ের সাথে যোগাযোগ রাখবে না। আমি কথা দিচ্ছি। আর দয়া করে আমার স্বামীর কান ওবদি এই খবর পৌঁছাবেন না। সে খুব কষ্ট পাবে। মেয়েটা আমার ছোট। সে না বুঝেই ভুল করেছে। এই ভুল দ্বিতীয় বার হবে না।
বলেই ইতি কল কেটে দেয়। আশা থেমে থাকে নি। কল করেছিলো তারেক কে। যা নয় তাই বলে অপমান করেছে। তারেক বিদেশে যাওয়ার সময় আনোয়ারের থেকে কিছু টাকা ধার নিয়েছিলো সেটা নিয়েও খোঁটা দেয় আশা।
তন্নিকে বাজারি মেয়ে বলতেও সে দুবার ভাবে নি।
অপমান সহ্য করতে না পেরে তারেক কেঁদে ফেলেছিলো। হাত জোর করে আশাকে বলেছে
“ক্ষমা করে দিবেন আমার তন্নিকে। না বুঝে ভুল করেছে সে। দ্বিতীয় বার এই ভুল করবে না। আমার তন্নি আর কখনোই অর্ণব বাবার সাথে কথা বলবে না। আমি কথা দিচ্ছি আপনাকে।
” মনে থাকে যেনো।
এটা ভুলেও ভাববেন না আপনার মেয়েকে বড়লোক ছেলের পেছনে লেলিয়ে দিয়ে তাদের টাকায় বড়লোক হবেন। আমি বেঁচে থাকতে আপনার এই ইচ্ছে পূরণ হবে না।
তারেক বলে
“এতোটা সাধ্য নেই আমার। আমার মেয়ে এমন না। আর আমাদের চিন্তাভাবনাও এমন না।
বলেই তারেক কল কেটে দেয়। নিধি আর আশা বিশ্ব জয়ের হাসি দেয়।
এসব কথা মনে পড়তেই আশা চুপসে যায়। তন্নি চলে গেছে বলে অথৈ অসুস্থ হয়ে গেছে? কি পেয়েছে ওই মেয়ের মধ্যে তার ছেলে মেয়ে।
অবশ্য আশারও তন্নির প্রতি দুর্বলতা আছে। মেয়েটা সত্যিই খুব ভালো।
কিন্তু তার ছেলের নখেরও যোগ্য না। কোথায় তার হিরের টুকরো ছেলে আর কোথায় কাঁচ তন্নি।
এটা সে কখনোই মেনে নিবে না।
নিধির সাথে ছেলেটার বিয়ে হয়ে গেলে সে ইতি আর তারেকের থেকে ক্ষমা চেয়ে নেবে।
তন্নিকেও আবার আগের মতো ভালোবাসবে।
সাগর এখন বিপদ মুক্ত। রক্ত দেওয়ার পরে তার অবস্থার উন্নতি হয়েছে। মাথার আঘাতটা তার প্রবল। খুব বাজে ভাবে মাথায় আঘাত পেয়েছে। বেঁচে তো থাকবে কিন্তু সুস্থ হবে কি?
__
জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে তন্নি। গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছে সে। ছোট্ট একটা বাসা নিয়েছে। সেখানে সবই আছে।
এই যে ছোট্ট রুমটাতে একটা বেলকানিও আছে। এই রুমটা খানিকটা অর্ণবের রুমের মতো কিন্তু অতোটা বিলাসবহুল না।
জানালা দিয়ে পশ্চিম আকাশটা দেখা যাচ্ছে। সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। লাল আভা ছড়িয়েছে সূর্যের চারপাশে।
একটুখানি দেখা যাচ্ছে সূর্য। কয়েক মিনিটের মধ্যে এই টুকুও তলিয়ে যাবে। পৃথিবীতে অন্ধকার নেমে আসবে।
গোধূলি দেখে মন খানিকটা ফ্রেশ হয়ে যায় তন্নির।
তখনই আবার মনে পড়ে যায় বাবার বলা কথা গুলো। হাসি মুখটা চুপসে যায়। চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে। মনে মনে বলে
“আপনি আসবেন অর্ণব। আমাকে নিতে আপনাকে আসতেই হবে। আমিও যাবো আপনার সাথে। আপনাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি। আপনাকে ছাড়ার কথা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি না।
কিন্তু আমার বাবা মাকে করা অপমানের প্রতিশোধ আমি নিয়েই ছাড়বো।
আপনার মা কে ক্ষমা চাইতেই হবে।
তন্নি তার বাবা মায়ের ব্যাপারে খুব প্রসেসিভ।
আর আপনাকেও সোজা করে ছাড়বো আমি।
__
তন্নিদের বাসার নিচে দাঁড়িয়ে আছে অর্ণব। তন্নিকে না নিয়ে সে ফিরবেই না। বিয়ে করা বউ তন্নি তার। এতো সহজে সব কিছু মিটমাট হবে না। তন্নিকে জবাব দিতে হবে কেনো করলো এমনটা?
একজন লোক লাগিয়েছিলো অর্ণব তন্নিদের পেছনে। সেই অর্ণবকে জানিয়েছে তন্নি এখানে আছে।
আজকের দিনটা অর্ণব অন্য ভাবে শুরু করতে চেয়েছিলো। তন্নির মুখটা দেখে অফিসে যেতে চেয়েছিলো। তন্নি সবটা নষ্ট করে দিয়েছে।
এলোমেলো করে দিয়েছে অর্ণবের সমস্ত প্লান।
অর্ণব ঝাঁকড়া চুলে হাত বুলিয়ে দরজায়,টোকা দেয়।
ইতি বেগম এসে দরজা খুলে।
” কি চাই?
অর্ণব ভেতরে উঁকিঝুঁকি মারে
“আমি অর্ণব চৌধুরী। অনির পাপা।
” তো আমি কি করতে পারি?
অর্ণব হতাশ হয়। ভেবেছিলো বউটাই শুরু কর্কশ। এখন দেখছে শাশুড়ী কর্কশের চেয়েও বড় কিছু।
“অনির মাম্মামের সাথে কথা বলতে চাই আমি।
” এই নামে এখানে কেউ থাকে না।
“আরে থাকে তো। অথৈয়ের তন্নি।
” আমার মেয়ের থেকে দূরে থাকবা।
“আপনাকে যদি বলি আমার শশুড়ের থেকে দূরে থাকতে। আপনি পারবেন? কখনোই পারবেন না।
বিয়ের আগে যেমন তেমন। বিয়ের পরে বউ ছাড়া থাকাই যায় না। এটা ইতিহাসের বড়বড় কবিরা বলে গেছে।
ইতি বেগম লজ্জা পেয়ে যায়। এতো বেয়াদব ছেলে হয়?
“আজকে আমাদের বাসর শাশুড়ী মা। আমি বোনরা খাট সাজিয়ে অপেক্ষা করছে। কতো টাকার ফুল কিনেছি জানেন?
ইতি বেগম কথা বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। সে দরজা আটকাতে যায়। তন্নি পেছন থেকে বলে
” ওনাকে আসতে দাও মা। এতো টাকার ফুল পঁচে গেলে ওনার লস হয়ে যাবে।
চলবে…..