অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৩২
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
৩২.
ফ্লোরে পরে আছে পলাশের নিথর শরীরটা। ওসি সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন বডিটার ঠিক পাশে। দুজন হাবিলদার ছাড়া রুমের মধ্যে আর কাউকে এলাও করা হয়নি। ফারিয়া বডিটা দেখেই নাকমুখ কুঁচকে ফেলেছে। কী নিষ্ঠুরতা! তুহিন বডিটাকে ভালোভাবে কিছুক্ষণ লক্ষ্য করে বিশাল আকৃতির রুমটাতে ভালোভাবে চোখ বুলিয়ে নিল একবার। বিছানা, টি-টেবিল, সোফা সব ঠিকঠাক আছে। ঘরের আসবাবপত্র খুব বেশি লন্ডভন্ড হয়নি। বোঝা যাচ্ছে, ভিক্টিম নিজেকে প্রটেক্ট করার খুব বেশি সময় পায়নি। কিংবা শক্তি পায়নি।
এসে সবাইকে জেরা করে যেটুকু জানতে পেরেছে সে অনুযায়ী খু’নের সময় কেউ কিছুই টের পায়নি। সকালে রুম সার্ভিসের লোক রুমে নক করার পরেই প্রথম জানা যায় হোটেলে একটা মা’র্ডা’র হয়েছে। খু’নিকে দেখতে পায়নি কেউ। তমাল আর ফারিয়াকে গোটা ঘরটা সার্চ করে ফিঙ্গারপ্রিন্ট আর ব্লা’ডমার্ক কালেক্ট করার অর্ডার করে ওয়াশরুমে গেল তুহিন। প্রত্যেকটা জিনিস এমনকি কমোডটাও দেখে নিল ভালোভাবে। তেমন কিছুই পাওয়া গেল না। উল্লেখযোগ্য তেমন কিছুই না পেয়ে আবার ফিরে এলো লা’শের কাছে। ওসি খানিকটা এগিয়ে এসে বলল, ‘কিন্তু এটাতো আপনার ডিভিশনের মধ্যে পড়েনা। আপনাকে কেন ডেকে পাঠানো হলো বুঝতে পারলাম না।’
তুহিন লাশটার দিকে তাকিয়ে থেকেই অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, ‘ কারণ শেকড়টা আমার ডিভিশনে। সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যক্রমে ডালপালা এদিকে চলে এসছে। চিন্তা নেই। পরের কোন একটা কেইসে খু’নিকে বলে দেব শেকড়টা এই ডিভিশনে রেখে ডালপালা যাতে আমার ডিভিশনে পাঠিয়ে দেয়। শোধবোধ। নাকি সুদ চাই আপনার?’
ফিক করে হেসে ফেলল এক হাবিলদার। আরেকজন হাসতে গিয়েও সামলে নিল নিজেকে। মনে মনে মারাত্মক লজ্জা পেলেন ওসি। জেনেশুনে এরকম উদ্ভট প্রশ্ন করার জন্যে। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে ইতস্তত করে দাঁড়িয়ে রইল নিজের জায়গায়। তুহিন এক হাঁটু ভেঙ্গে বসল লা’শের সামনে। ওসির উদ্দেশ্যে বলল, ‘নামধাম সব জেনেছেন?’
‘ ইয়েস স্যার। হোটেল রেজিস্ট্রি করা আছে পলাশ মীর্জা নামে।’
কোন প্রতিক্রিয়া করল না তুহিন। যেন মোটামুটি আন্দাজ করাই ছিল নামটা। ওর সম্পূর্ণ মনোযোগ পলাশের র’ক্তা’ক্ত মুখটার দিকে। কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করছে সে। সারা মুখ জুড়ে আবছা আবছা সাদা পাউডার জাতীয় কিছু দেখতে পাচ্ছে। কী এগুলো? নিজের তর্জনী আঙুলে সামান্য পাউডার লাগিয়ে নিজের নাকের কাছে এনে ধরল তুহিন। অজান্তেই কুঁচকে গেল ওর নাক। হেরোইন! ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল তুহিন। পলাশের শরীরের ভয়ানক ক্ষতগুলো পরীক্ষা করল আরো একবার।
ওসি বলল, ‘কল পাওয়ার সাথে সাথেই আমরা সবাইকে হোটেলে আটকে রেখেছি স্যার। কাউকে বের হতে দেইনি।’
তুহিন চিন্তিত ভঙ্গিতে থুতনি চুলকে বলল, ‘ তাতে বিশেষ কোন উপকার হয়েছে বলে আমার মনে হচ্ছেনা। খু’নটা করে খু’নি সকাল অবধি এই হোটেলেই বসে ছিল বলে আপনার মনে হচ্ছে? এই আশায় যে কখন জানাজানি হবে, কখন পুলিশ এসে সবাইকে আটকে দেবে, তারপর সে পালাবে?’
তারপর একটু থেমে বলল, ‘তবে আটকে রেখে ভালো করেছেন। জিজ্ঞেস করার আছে আপনাকে অনেক কিছু।’
মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল ওসির কিন্তু তুহিনের পরবর্তী কথা শুনে স্বস্তি পেল। যাক, লোকটা একেবারেই অকাজের ভাবছে না ওকে। তাই খানিকটা উৎসাহিত হয়ে বলল, ‘ স্যার আমরা রেজিস্ট্রার চেক করে দেখেছি। পাঁচতলায় যে কয়েকটা রুম বুক করা আছে তারমধ্যে থেকে কেউ ঘর ছাড়েনি। তবে বেরিয়েছেন দুজন।’
তুহিন ভ্রু উঁচু করে বলল, ‘আর বাকি ফ্লোরগুলো?’
‘ তাতো দেখিনি স্যার।’
‘ দেখা উচিত ছিল। খু’নি অন্য ফ্লোরেও উঠে থাকতে পারে। যদিও সম্ভাবনা কম। যাই হোক, আমি দেখছি।’
এরমধ্যেই তমাল আর ফারিয়ার কাজও হয়ে গেল। উঠে দাঁড়িয়ে ফারিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ শেখ গাড়ি আর লোক পাঠিয়েছে?’
‘ জ্বি স্যার! পাঠিয়েছে। আপনি বললেই এসে লা’শটা নিয়ে যাবে।’
‘ আসতে বলো। আর এভিডেন্সগুলো নিয়ে তুমিও চলে যাও। কাজ শুরু করে দিতে হবে এক্ষুনি। প্রতিটা সেকেন্ড এখন ইম্পর্টেন্ট।’
‘ রাইট স্যার!’
বলে কল করার জন্যে কিছুটা সরে দাঁড়ালো ফারিয়া। তুহিন তমালকে বলল, ‘হোটেলের প্রতিটা ঘরে যাও। সকলকে জিজ্ঞাসাবাদ করো। ঐ স্কেচটা দেখাও সকলকে। এই হোটেলেই যেহুতু উঠেছে। কেউতো দেখে থাকবে ওকে।’
তমাল চলে যাচ্ছিল। তখনই তুহিন বলে উঠল, ‘ আর রুদ্রর ছবিটাও।’
তমালকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে তুহিন বলল, ‘ওকে পুরোপুরি সন্দেহের বাইরে ফেলে দেওয়ার মতো বিশেষ কিছু ঘটেনি এখনো।’
থতমত খেয়ে গেল তমাল ইতস্তত করে বলল, ‘জ্বি স্যার।’
তমালকে ওর কাজ বুঝিয়ে দিয়ে নিচে নামতেই প্রায় দৌড়ে এলো ম্যানেজার। হাপাতে হাপাতে বলল, ‘দুঃখিত স্যার। প্রচন্ড ইমার্জেন্সি এসে গিয়েছিল। তাই বেরোতে হয়েছে। কখন এসছেন?’
‘ অনেক্ষণ।’
তার প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ না দেখিয়ে কাজের কথায় এলো তুহিন। বলল, ‘ আমি রেজিস্ট্রার দেখতে চাই। কাল রাতে কে কে রুম ছেড়েছে। আর এটাও জানা দরকার কে কে এক্সিট করেছে কিন্তু এখানো ইন্টার করেনি।’
ম্যানেজার বিনয়ের হাসি হেসে বলল, ‘শিওর স্যার। চলুন।’
রেজিস্ট্রার থেকে জানা গেল মাত্র একজনই ঘর ছেড়েছে। কিন্তু সেটা কাল সন্ধ্যায়। তবে রাতে এক্সিট করে এখনো অবধি ইন্টার না করা রুমের সংখ্যা চারটা। নামগুলো শুনে সন্তুষ্ট হতে পারল না তুহিন। কারণ ওখানে রুদ্রর নাম নেই।রিসিপশনে বসা তরুণীকে ভালোভাবে লক্ষ্মীপুরের সম্ভাব্য খুনির স্কেচটা দেখিয়ে তুহিন বলল, ‘দেখুন তো যে চারজন বেরিয়েছে রাতে তারমধ্যে এই লোকটা ছিলো কি-না।’
মেয়েটা গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখল স্কেচটা। এরপর মাথা নেড়ে বলল, ‘না স্যার। এই লোক এই হোটেলে রুম নেয়নি।’
ভ্রুকুটি করল তুহিন। সন্দিহান কন্ঠে বলল, ‘আর ইউ শিওর?’
‘ আই গ্যারান্টি ইট!’
বোকার মতো দু সেকেন্ড তাকিয়ে রইল তুহিন তমালের দিকে। এরপর হঠাৎই কিছু একটা ভেবে দ্রুত রুদ্রর ছবিটা বের করে তুলে ধরল মেয়েটার সামনে। বলল, ‘একে?’
মেয়েটা স্হির চোখে তাকিয়ে রইল ছবিটার দিকে। দুচোখে মুগ্ধতা। বিরক্ত হলো তুহিন। বুঝল এই মেয়েও পিছলেছে। একে বাস্তবে ফিরিয়ে আনতে হবে। হাত দিয়ে টেবিলে পরপর দুবার আওয়াজ করে মেয়েটাকে স্বপ্ন থেকে ফিরিয়ে আনল তুহিন। গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘দেখেছেন একে?’
লজ্জিত হল মেয়েটা। ইতস্তত করে তুহিনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সরি স্যার। কিন্তু ইনিও ঘর নেননি।’
তুহিনের মেজাজ ভয়ংকর খারাপ হলো এবার। এটা কী মজা হচ্ছে নাকি? জায়গায় জায়গায় খুনির চেহারা বদলে যাচ্ছে কীকরে? ম্যাজিক না-কি? খুনের হিস্ট্রি, পলিটিক্স সব এক অথচ জিওগ্রাফিটা চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে কীকরে? ভানুমতির খেল দেখাচ্ছে খু’নি?
তমাল এসে তুহিনের মুখ দেখেই ঘাবড়ে গেল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে মেজাজ তুঙ্গে উঠে আছে লোকটার। এখন কথা বলার সাহস পাচ্ছেনা। তুহিন ঘাড় ফিরিয়ে তমালকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আরও রেগে গেল। ঝাঝালো কন্ঠে বলল, ‘চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছো কেন? বলে ফেলো!’
নড়েচড়ে উঠল তমাল। আরেকটু এগিয়ে এসে বলল, ‘স্কেচের লোকটাকে কেউ দেখেনি স্যার। আর না রুদ্রকে। দুজনের কেউই আসেনি এই হোটেলে। ওদের নাকি কাউকে দেখে সন্দেহ অবধি হয়নি।’
বাহ! ষোল কলা পূর্ণ। দাঁত নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজের মেজাজ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করল তুহিন। ঐ চারজনের নাম্বারে ডায়াল করে দুজনকে পাওয়া গেল। তারা এক্ষুনি আসছে হোটেলে। সুতরাং আপাত দৃষ্টাতে ধরে নেওয়া যাচ্ছে এরা খুনি নয়। বাকি রইল দুজন। রেজিস্ট্রার থেকে চারজনেরই সব ইনফরমেশন নিয়ে যাচাই করা আর যে দুজন আসছে তাদের সাথে কথা বলার দায়িত্ব তমালের ঘাড়ে দিয়ে ভয়ানক খারাপ মেজাজ নিয়ে তুহিন বেরিয়ে এলো হোটেল থেকে। খু’নির ওপর ভয়ানক রাগ হচ্ছে এখন ওর। কেন জানি রুদ্রর চেহারাটাই ভেসে উঠছে চোখের সামনে। যাকে কোনদিন সামনাসামনি দেখেই নি তাকেই বহু জন্মের শত্রু মনে হচ্ছে। রুদ্রকে ওর চাই। এই কেসের দায়ে না হলেও বাকি অপরাধগুলোর সুত্র ধরে হলেও চাই। বাই হুক অর বাই ক্রুক।
*
নিজের চ্যায়ারটাতে হেলান দিয়ে টেবিলের ওপর দু’পা তুলে চোখ বন্ধ করে গভীর ভাবনায় মগ্ন হয়ে আছে তুহিন। একটা লোককে এমন নির্মমভাবে খু’ন করে নাকের ডগা দিয়ে বেরিয়ে গেল কিন্তু কেউ কোন খোঁজ পেলোনা। রিডিকিউলাস!
অথচ যখন খুনের খবরটা ওদের কাছে এসে পৌঁছেছে। ততক্ষণে খুনি পগারপার। এখন একমাত্র শেখই ভরসা। দেখা যাক উনি কোন চমকপ্রদ তথ্য দিতে পারে কি-না। তুহিনের ভাবনার সুত্র ছেদ করে বেজে উঠল মোবাইল ফোন। মহিউদ্দিন শেখের কল। মুচকি হেসে কলটা রিসিভ করল। কৌতুকের স্বরে বলল, ‘কোথায় যেন পড়েছিলাম খারাপ মানুষ সহজে মরেনা। আপনার কথাই ভাবছিলাম আর আপনিই ফোন করলেন।’
‘ কম্প্লিমেন্টের জন্যে থ্যাংক ইউ। এবার কাজের কথা শোন।’
মহিউদ্দিনের গম্ভীর কন্ঠস্বর শুনে সতর্ক হয়ে উঠল তুহিন। গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলবে নিশ্চয়। কৌতুক ছেড়ে নিজেও গম্ভীর হয়ে বলল, ‘ হ্যাঁ বলুন।’
‘ তোমার ধারণা মোটামুটি ঠিক ছিল। মুখে হে’রো’ই’ন গুজে দিয়েছিল সবার আগে। এরপর বাকি কাজটা করতে খুব বেশি কষ্ট হয়নি। আর যেসব স্যাম্বল পাঠিয়েছিলে তাতে উল্লেখযোগ্য কিছুই পাওয়া যায়নি।’
তুহিন চোখ বুজে বসে রইল। আজ ওর হতাশ হওয়া দিবস। তুহিনকে চুপ থাকতে দেখে মহিউদ্দিন হেসে বলল, ‘এতো হতাশ হওয়ার কিছু নেই। ইন্টারেস্টিং খবর আছে।’
তুহিন নিরুৎসুক কন্ঠে বলল, ‘বলে ফেলুন।’
‘ গুলশানের দ্বিতীয় খু’ন আর মীরপুরের খু’টার সাথে এই খু’নটার দারুণ মিল আছে। প্রায় একই রকমভাবে মারা হয়েছে।’
চমকে উঠল তুহিন। দ্রুত টেবিল থেকে পা নামিয়ে সোজা হয়ে বসল। অবাক কন্ঠে বলল, ‘হুবহু একরকম?’
‘ আরে ভাই এটা মা’র্ডা’র। পরীক্ষার খাতায় টুকে লেখা রচনা না যে হুবহু একরকম হবে। যতটা সম্ভব একইরকম। প্রথমে তীব্র নেশা করিয়েছে। তারপর_’
ভ্রু কুঁচকে চুপচাপ কয়েক সেকেন্ড বসে রইল তুহিন। দ্রুত চিন্তা চলছে মাথায়। মহিউদ্দিন বুঝল এই ছেলে এখন চিন্তা করতে ব্যস্ত। ওর চিন্তায় কোনরকম ব্যাঘাত না ঘটিয়ে ফোন কেটে দিল মহিউদ্দিন। তুহিন আস্তে করে নামিয়ে রাখল ফোনটা। টেবিলে রাখার আগেই মেসেজ টোন বেজে উঠল। ইরার মেসেজ। লিখেছে, ‘রাতে ঘুমাও নি। খাবারটা ঠিকমতো খেয়ে নিও প্লিজ। ডিসটার্ব করার জন্যে সরি।’
মৃদু হাসল তুহিন। ছোট্ট একটা রিপ্লে লিখে টেবিলে রাখল। তখনই দরজায় নক করে তমাল বলল, ‘স্যার আসব?’
‘এসো।’
তমাল কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই তুহিন বলল, ‘অপ্রয়োজনীয় একটাও শব্দ ব্যবহার না করে রিপোর্ট করে ফেলো।’
বাপরে! ভয়ানক চটে আছে। গলা পরিস্কার করে তমাল বলল, ‘স্যার! চারজনের মধ্যে দুজনের সাথে সরাসরি কথা হয়েছে। তৃতীয়জন মহিলা। বয়স পয়ত্রিশ। কিন্তু চতুর্থজনের ইনফরমেশনগুলো নকল স্যার। ব্যাটা জালি মাল। তবে চিন্তা নেই স্যার, খোঁজ চলছে। এখন একটু সময় বেশি লাগবে এই যা।’
ঠোঁট বাকিয়ে হাসল তুহিন। লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বলল, ‘মীর্জার কী খবর?’
‘শওকত মীর্জা এখন দুবাই আছ। আর আপনি ঠিক বলেছেন। এই পলাশ ঐ শওকতের ছোট ভাই। শুনেছি শওকতের ছেলেও বাংলাদেশে আছে। কিন্তু কোথায় আছে জানিনা।’
চেয়ারে হেলান দিল তুহিন। মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘দেশে থাকলে পরবর্তী টার্গেট ঐ হবে। এতে আর কোন সন্দেহ আছে বলে মনে হচ্ছেনা। দেখো বাছাধন কোথায় আছে। খোঁজ নাও। আমার মনে হচ্ছে মরার আগেই যদি ওকে আমরা পেয়ে যাই। তাহলে খু’নিকে পাওয়া কঠিন হবেনা। তবে আপাতত শেখ দুটো ফাইল পাঠিয়েছে। ওগুলো একটু চেক করো।’
‘ ওকে স্যার।’
তুহিনের সামনের চেয়ারে ল্যাপটপ খুলে বসল তমাল।
তুহিন চোখ বন্ধ করে কলম ঘোরাতে ঘোরাতে আবার মগ্ন হয়ে গেল গভীর চিন্তায়। ব্যাপারটা ক্রমশ ঘোলা হয়ে উঠছে। নয়টা খু’ন হয়ে গেছে। অথচ সম্ভাব্য খু’নিদের কারো সঙ্গে কারো চেহারা মিলছে না। তাহলে ধরে নেওয়া যাক চেহারা বদলাচ্ছে খুনি। মেকআপ করে, ছদ্মবেশে। সেটা কে? রুদ্র? তিনটে গ্রুপের সমস্ত ফাইল ঘেটে যা দাঁড়িয়েছে তাতে দুজন ছাড়া বাকি যারা খু’ন হয়েছে তাদের মা’রা’র প্রপার রিজন একমাত্র ওর কাছেই আছে। অথচ ওর সাথে আবার লক্ষ্মীপুরের খু’নির ডিএনএ ম্যাচ করছেনা। কিন্তু সব খুনের এক এবং একমাত্র কারণ রাশেদ আমেরের ঐ নতুন প্রজেক্ট। এটাও অস্বীকার করা যাচ্ছেনা। আবার মহিউদ্দিন বলছে বাকি খুনগুলো আলাদাভাবে হলেও তিনটে খু’নের ধরণ এক। সবটা মিলে কী হচ্ছে? জগাখিচুড়ি!
#চলবে…
[ রি-চেক করিনি। সারাদিন কারেন্টে ভয়ানক জ্বালিয়েছে। চার্জের সমস্যা, নেটওয়ার্কের সমস্যা। অনেক কষ্টে একটু একটু করে লিখেছে। সুতরাং ছোট হয়েছে বটে। কাল একটা বর্ধিতাংশ দিয়ে দেব। ভালোবাসা।]
অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৩২২#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
৩২. [ বর্ধিতাংশ ]
সন্ধ্যা সাতটা বাজে। তুহিন এখনো ওভাবেই বসে আছে নিজের চেয়ারে। এখনো সেই একইকথা ভেবে চলেছে। সবরকমভাবে, সবরকম সম্ভাবনা দিয়ে বিষয়টা চিন্তা করে দেখেছে তুহিন। কিন্তু সব মিলে সেই একই জিনিস হচ্ছে। জগাখিচুড়ি। ভাবতে ভাবতে এবার ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে গেল তুহিনের। যথেষ্ট হয়েছে। আপাতত ও খু’নিকে নিয়ে ভাববে না। গিরগিটির মতো চেহারা বদলাচ্ছে সে। আদোও এক লোক কি-না, কোথায় আছে কিছুই জানেনা। সৌভাগ্যক্রমে খুনের প্যাটার্ন দেখে পরবর্তী টার্গেট কে হবে সেটা বুঝে গেছে। সুতরাং এখন অন্য রাস্তায় এগোতে হবে ওকে। ডালপালা একটু বেশিই ছড়িয়ে যাওয়ার পর কেসটা এসছে তুহিনের কাছে। তাই একসঙ্গে বাগে আনতে বেগ পেতে হচ্ছে ওকে। কিন্তু শেকড়? শেকড় বাবাজির যাওয়ার জায়গার বড় অভাব। সুতরাং শেকড় ধরে তুলতে হবে ওকে এখন। সকলের কাছে নিশ্চয়ই অনর্থক সময় বলে মনে হবে ব্যপারটা। কিন্তু আর কোনো রাস্তা নেই।
গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল তুহিন। চমকে উঠল তমাল। একটু আগে এসেছিল নতুন খবর নিয়ে। এতো নিখুঁত জাল ইনফরমেশনগুলো কোথা থেকে তৈরী হয়েছে সে সম্পর্কে খোঁজ নিতে লাগিয়ে দিয়েছে কিছু গোপন লোক। ঢাকা আর চট্টগ্রামে কারা এধরণের জিনিস বানায় তার একটা লিস্ট আছে ওদের কাছে। প্রত্যেককে ধরে খোঁজ করা হবে। কিন্তু এ সম্পর্কে তুহিনের কাছ থেকে কোনরকম উত্তর বা মতামত না পেয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল ওখানেই।
তুহিন মিনিট দুই পায়চারি করে আবার এসে বসল নিজের চেয়ারে। হেলান দিয়ে, গা ছেড়ে বেশ আরাম করে। আঙ্গুলের ইশারায় বসতে বলল তমালকে। খানিকটা ইতস্তত করে বসে পড়ল তমাল। তুহিন তমালের দিকে না তাকিয়েই চোখ বন্ধ করে বলল, ‘প্রায় দুই বছর আগে রাশেদ আমের যে প্রজেক্টে হাত দিয়েছিল সেই প্রজেক্ট শুরু হওয়ার আগে ভারত থেকে আসছিল একটা পেনড্রাইভ। কিন্তু বর্ডার ক্রস করার কিছুক্ষণের মধ্যেই ছিনিয়ে নেওয়া হল ওটা। কারা নিল?’
তমালের উত্তরে অপেক্ষা করল না তুহিন। নিজেই বলে চলল, ‘ব্লাক হোল বা ডার্ক নাইট। পথেও সম্ভবত অপর এক দল অ্যাটাক করেছিল রুদ্রর ওপর। অর্থাৎ দুটো দলই ভীষণভাবে চাইছিল প্রজেক্টটা বন্ধ করতে কিংবা হাতাতে। আর তারজন্যে তারা এতোটাই ডেসপারেট ছিল যে পেনড্রাইভটা কখন, কীভাবে কোথা থেকে আসছে সেসব তথ্য জোগাড়ের জন্যে কিনে নিয়েছিল সোলার সিস্টেমের কিছু লোক। যেমন সবুজ, খোকন, স্বপন এবং তপু। ভয়ানক রিস্ক নিয়েছিল ব্লাক হোল। কিন্তু কেন? কী এমন করতে চাইছিলেন রাশেদ বা_ মানে রাশেদ আমের?’
প্রশ্নটা করে নিজের মনেই একটু চমকে উঠল তুহিন। রাশেদ আমের আসলে করতো কী? আমের ফাউন্ডেশনের ফাইল ঘেটে কিংবা আমের ভিলার বৈঠক ঘরেও এমন কিছুই পেলোনা যার দ্বারা ব্যপারটা বোঝা যায়। এটা জানা গেছে ধনী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে একপ্রকার জুলুম করে টাকা আদায় করতো। কিন্তু কেন? কী হতো সেসব দিয়ে। এতো ডোনেশনের যা কাগজ দেখল। ওগুলো সব অরিজিনাল? ডার্ক নাইট বা ব্লাক হোলের সাথে শত্রুতার মূল কারণ কী ছিল। চোরাচালান, চাঁদাবাজি, অসৎ ব্যবসা ইত্যাদির জন্যে কুখ্যাত দুটি দল হলো ডার্ক নাইট আর ব্লাক হোল। সেখানে সোলার সিস্টেম কী এমন করতো যা উভয়ের পক্ষে ভারী হয়ে পরেছিল? প্রশ্নগুলো মনেই রাখল তুহিন। এদিকে তমাল কিছু একটা ভেবে নিয়ে বলল, ‘আর ব্লাক হোল আর ডার্ক নাইটওতো পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বি ছিল। হঠাৎ এক হলো কীকরে?’
হাসল তুহিন। বলল, ‘সহজ ব্যপার। শত্রুর শত্রু, পরম মিত্র। যখন দুটো দলের লক্ষই এক ও অভিন্ন ছিল এবং একা রাশেদ আমেরকে টলানো অসম্ভব ছিল তখন একসঙ্গে কাজ করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু তারচেয়েও বড় কথা হচ্ছে ঐ চারজনকে রুদ্র আর রাশেদ আমের শেষ করে দিয়েছিল। তাহলে পেনড্রাইভটা আনার পরে ওদের দলের গোপন খবরগুলো বের হচ্ছিল কীকরে? যেমন, রুদ্র কখন চট্টগ্রাম যাচ্ছে, কীভাবে যাচ্ছে, কোথায় উঠছে। আর এই প্রজেক্টটা সম্পূর্ণ না হওয়ার কারণ এটাই। অভ্যন্তরীণ সব খবর বেরিয়ে যাচ্ছিল। সোলার সিস্টেমের প্রতিটা পদক্ষেপ আগেই জেনে যাচ্ছিল বাকি দুই দল। সুতরাং গোড়া থেকে উপরে ফেলতে বেশি কষ্ট হয়নি।’
বিস্মিত দৃষ্টিতে তুহিনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল তমাল। ঘোর লাগা কন্ঠে বলল, ‘রাশেদ আমের আর রুদ্র থাকতেও এটা সম্ভব হল?’
‘ হয়েছে। ওরাও মানুষ ছিল তমাল। আর ভুল মানুষ করবেই। মারাত্মক কিছু একটা হয়েছিল কিন্তু সেটা দেখা যাচ্ছেনা। কেউ বুঝতেই পারছেনা।’
তমাল আবার কয়েক সেকেন্ডের জন্যে ভাবতে বসল। হঠাৎই বিস্ফোরিত চোখে তাকাল তুহিনের দিকে। প্রায় আটকে যাওয়া গলায় বলল, ‘ বিশ্বাসঘাতকতা!’
‘ নিঃসন্দেহে।’ নির্বিকারভাবে বলল তুহিন। ‘এটাই একমাত্র কারণ। আর এবার আমার লক্ষ্য এটা খুঁজে বের করা যে কাজটা কে করেছে।’
ভ্রু কুঁচকে ফেলল তমাল। হঠাৎ এমন কথা শুনবে বলে আশা করেনি। অবাক কন্ঠে বলল, ‘ কিন্তু স্যার, এটাতো আপনার কেস না।’
‘কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এটাই আমার কেস। একমাত্র এই রাস্তায় হেঁটেই সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে।’
‘ কাকে সন্দেহ হচ্ছে আপনার?’
‘ সবাইকে।’ নির্বিকারভাবে বলল তুহিন। ‘এমন অবস্থায় কাউকেই সন্দেহের বাইরে রাখা যায়না। তবে সে এমন কেউ যে দলের প্রত্যেকটা গোপন মিটিংয়ে উপস্থিত থাকতো, সব কথা শুনতো, সব প্লান জানতো। অর্থাৎ গ্রুপের প্রধান এবং বিশ্বস্ত লোকের মধ্যেই কেউ।’
‘এমনতো অনেকেই আছে?’
‘ নাহ। অনেকে নেই। রাশেদ আমের ছাড়া আমের ফাউন্ডেশনের উল্লেখযোগ্য নাম ছিল রুদ্র, উচ্ছ্বাস, জাফর আমের, ইকবাল। বাকিদের কাজ ভাগ করে দেওয়া থাকলেও এই পাঁচজন দলের সবকিছু জানতো। এ টু জেট। এই পাঁচজনের কোন একজন অনুপস্থিত থাকলে কোন মিটিং বা প্লান করা হতোনা। আমার সংগ্রহ করা তথ্য সেটাই বলছে। অর্থাৎ ঘাপলা ঐ পাঁচজনের মধ্যেই ছিল। রুদ্রকে সন্দেহের বাইরে রেখে দেওয়া যায়। কারণ রাশেদের পর সবকিছু ওরই হতো। এমনিতেও সোলার সিস্টেমের লিডার রাশেদ আমের হলেও রুদ্রর দাপট কোন অংশে কম ছিল না।
তমাল এবার নিজে একটু ভাবল। চিবুক চুলকে বলল, ‘আমার তাহলে মনে হচ্ছে জাফর নয়তো ইকবাল।’
এতক্ষণে চোখ খুলে তাকাল তুহিন। তমালের দিকে তাকিয়ে ডান পাশের ভ্রুটা উঁচু করে বলল, ‘ উচ্ছ্বাস কেন নয়?’
হকচকিয়ে গেল তমাল। একটা শুকনো ঢোক গিলে বলল, ‘আসলে যতটা শুনেছি ওর পক্ষে রাশেদ বা রুদ্রর ক্ষতি করা সম্ভব? ছেলেটাকে তো ভালো_’
তমালকে থামিয়ে দিল তুহিন। নিষ্ঠুর কন্ঠে বলল, ‘মানুষের সাথে বছরের পর বছর কাটানোর পরেও আসল চেহারা চেনা যায়না। আর তুমি কিছু রিপোর্ট আর ইন্সপেক্টরের আবেগমাখা কয়েকটা লাইন শুনেই ধরে নিলে ও বিট্রে করতে পারেনা। ভুলে যেওনা ও রাশেদ আমেরের রাস্তা থেকে তুলে আনা একটা গুটি মাত্র। পেছন থেকে ছু’রি মারলে খুব বেশি অবাক হওয়ার কিছু নেই।’
তমাল ভাবল কথাটা ফেলে দেওয়ার মতো নয়। যা কিছু হতে পারে। ‘কিন্তু কারণটা কী হতে পারে, স্যার?’
আবার ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল তুহিন বলল, ‘কাউকে বিট্রে করার জন্যে অনেক কারণ থাকতে পারে। ক্ষমতা, সম্পত্তি, প্রতিশোধ, লোভ। উচ্ছ্বাস, জাফর বা ইকবাল তিনজনের কাছে এই কারণগুলো থাকা অসম্ভব কিছু না। জাফরের নিজের বড় ভাইয়ের ক্ষমতা আর সম্পত্তি দখলের বাসনা জাগতেই পারে। ইকবালের মনে দলীয় কোন কারণে একপাক্ষিক বিদ্বেষ জন্মাতেই পারে, তারসাথে পকেটে পরতে পারে অন্য দলের দেওয়া মোটা অঙ্কের কিছু টাকা। উচ্ছ্বাসের মনে হতেই পারে সে দলের প্রয়োজনে ব্যবহার করা একটা সামান্য গুটি মাত্র। রাজা, রাজপুত্র, মন্ত্রীদের মধ্যে সে কেবলই এক অনুগত সেনপতি। এগুলোর মধ্যে কোনটা অসম্ভব তমাল?’
খুব মনোযোগ দিয়ে তুহিনের কথাগুলো শুনছিল তমাল। তুহিনের প্রশ্ন শুনে মাথা ঝাকিয়ে বলল, ‘সবই সম্ভব, স্যার।’
ফোন বেজে উঠল তুহিনের। ইরা ফোন করেছে। ফোনটা রিসিভ করে নিজের কন্ঠস্বর যথাসম্ভব ক্লান্ত করার চেষ্টা করে তুহিন বলল, ‘হ্যালো?’
‘ কোথায় আছো?’ ইরার মিষ্টি কন্ঠস্বর ভেসে এলো ওপাশ থেকে।
‘ অফিসে এখনো।’
‘ লাঞ্চ করেছিলে?’
‘ হুম। তুমি?
‘ করেছি। সাথে কে কে আছে?’
ইরার কন্ঠে হালকা ঝাঝ টের পেয়ে হেসে ফেলল তুহিন। বলল, ‘ফারিয়া নেই। তমাল আছে শুধু।’
‘ কে নেই জিজ্ঞেস করেছি আমি? ওও মেয়েটা নেই বলে খুব দুঃখ হচ্ছে বুঝি?’
হঠাৎ কৌতুক করার ইচ্ছে হলো তুহিনের। ব্যথিত কন্ঠে বলল, ‘ভীষণ! বুকটা কেমন টনটন করছে।’
‘ মেরে ফেলব কিন্তু। ধ্যাত!’
বলে ফোনটা কেটে দিল ইরা। তুহিন হালকা শব্দ করে হাসল। চেয়ারে হেলান দিয়ে কিছু একটা ভাবল চুপচাপ। তারপর বলল, ‘কাউকে বিট্রে করার আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ আমরা মিস করে গেছি তমাল।’
মুহূর্তেই কৌতূহলী হয়ে উঠল তমাল। বলল, ‘ কী স্যার?’
‘ হিংসা। যা নারী মনে ভয়ানকভাবে বাস করে।’
*
সকাল সাড়ে দশটা বেজে বিশ। গুলশানের রাস্তা দিয়ে স্বাভাবিক গতিতে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে তুহিন। কোন তাড়া নেই ওর। নিশ্চিন্ত মনে গুলশানের চকচকে রাস্তা আর দালানকোঠা দেখতে দেখতে এগোচ্ছে। আজ একাই এসেছে গুলশান। তমালকে শওকত মীর্জার ছেলে আর জাল ইনফরমেশনের ব্যাপারে খোঁজ নিতে পাঠিয়ে দিয়েছে। দুজন লোক লাগিয়েছে বর্তমানে আমের ভিলার বাকি সদস্যদের খোঁজ নেওয়ার জন্যে। মানুষগুলোতো সব ভোজবাজির মতো উড়ে যেতে পারেনা। তুহিনও অফিসে বসে সময় অপচয় না করে চলে এসছে গুলশান। আমের ভিলার ভেতরের কিছু তথ্য সংগ্রহ প্রয়োজন ওর। কিন্তু কীভাবে জানবে। ইন্সপেক্টরের কাছে? কিন্তু উনিতো ততটুকুই বলতে পারবেন যতটুকু তদন্তের খাতিরে জানতে পেরেছেন। এমন কাউকে চাই যে ঐ বাড়ির ভেতরে ছিল। সবটা জানে। কিন্তু সবতো হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে একপ্রকার। এমন কাউকে কোথায় পাবে ও? কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করে আরেকবার আমার ভিলায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল ও। একাই যাবে। হোলস্টারে হাত দিয়ে একবার চেক করে নিল বেরেটার অবস্থান। এরপর গাড়ি ছোটালো আমের ভিলার উদ্দেশ্যে।
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেল আমের ভিলার কাছে। কিন্তু গাড়িটা আমের ভিলার আশেপাশে নিলোনা তুহিন। অনেকটা দূরে গাড়ি পার্ক করে রেখে নেমে এলো। সহজ ভঙ্গিতে হেঁটে গেল ভিলার দিকে। স্বাভাবিকভাবে। যেন হেঁটে হেঁটে দেখছে এলাকাটা। আমের ভিলার গেইটের কাছে এসে চারপাশে দেখতে গিয়ে চমকে উঠল তুহিন। সেদিনের সেই পাগল মহিলাটা। গেইটের সামনে বসে আছে। সেদিনের মতো অশান্ত মনে হচ্ছেনা মহিলাকে। বেশ শান্ত। পাত্তা না দিয়ে তালা খুলতে যাচ্ছিল তুহিন। তখনই ঝট করে তাকাল মহিলা ওর দিকে। তুহিন ভাবল সেরেছে! এইনা আবার চেঁচিয়ে পিলে চমকে দেয়। মনে মনে সে পরিস্থিতির জন্যে তৈরী করে নিল নিজেকে। কিন্তু সেদিনের মতো চেঁচিয়ে উঠল না মহিলা। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, ‘ কীরে! আবার এসছিস? তোকে না বলেছি এ বাড়িতে বিষ আছে। চলে যা, নয়তো তুইও ম’র’বি।’
তুহিন তালা নাড়তে নাড়তে মুচকি হেসে বলল, ‘ বিষের নেশা আছে আমার। মরতেও খুব একটা আপত্তি নেই। তা এ বাড়ির বিষটা কোথায় শুনি? বাতাসে, মাটিতে, খাবারে না দেয়ালে?’
হঠাৎ পিশাচিনীর মতো হেসে উঠল মহিলা। সেই হাসি শুনে তুহিনের মেরুদণ্ডের ভেতর কেমন শিরশির করে উঠল। হতবাক চোখে তাকাল মহিলার দিকে। মহিলা হাসতে হাসতে বলল, ‘ এই বিষ সেই বিষ না। মনের বিষ, মনের। অন্যবিষের তো তাও ঔষধ হয়। মনে একবার বিষ ঢুকে গেলে আর উপায় থাকেনা। মানুষও জানোয়ায় হয়ে যায়। সে বিষ কেউ দেখতে পায়না। কিন্তু সবকিছু গ্রাস করে নেয়। সব, সব।’
স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে রইল তুহিন মহিলার ঘোলাটে চোখের দিকে। চোখদুটো স্পষ্ট বলে দিচ্ছে কতো ভয়ানক নিষ্ঠুরতার সাক্ষী হয়েছে সে।
*
অতীত –
মধ্যরাত। মেতে উঠেছে গুলশানের নামকরা বারটা। রঙিন আলোর মিছিল আর বার ডান্সারদের কোমরের একেকটা বাঁকে মজে উঠেছে পরিবেশ। একের পর এক হুইস্কির গ্লাস শেষ করে ফেলছে রুদ্র। থামার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা দেখা যাচ্ছেনা ওর মধ্যে। যেন অন্তকাল যাবত চালিয়ে যেতে পারবে এই প্রক্রিয়া। তীক্ষ্ণ চোখজোড়া কেমন লালচে হয়ে আছে।
ভীড় ঠেলে ভেতরে ঢুকল উচ্ছ্বাস। রুদ্রকে খুঁজে বের করতে বেশ বেগ পেতে হলো ওকে। দেখা মাত্র এগিয়ে গিয়ে বসল ওর পাশের চেয়ারে। চোখ ছোট ছোট করে গভীরভাবে দুমিনিট পর্যবেক্ষণ করল রুদ্রকে। রুদ্রর সেদিকে কোন মনোযোগ নেই। সব জাহান্নামে যাক কিচ্ছু যায় আসে না ওর। কাঁপাকাঁপা হাতে আবার গ্লাস ভর্তি করে মুখের কাছে নিতেই হাত ধরে ফেলল উচ্ছ্বাস। বলল, ‘এতোই যখন কষ্ট হচ্ছে তখন ছেড়ে দিলি কেন?’
রুদ্র পিটপিটে চোখে তাকাল উচ্ছ্বাসের দিকে। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘রুদ্র আমের কষ্ট পায়না।’
বলে আবার এক ঢোকে গ্লাস ফাঁকা করে ফেলল রুদ্র। উচ্ছ্বাস চোখের ইশারায় সেদিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘তাই বুঝি দেবদাসের মতো গ্লাসের পর গ্লাস ফাঁকা করছিস?’
‘ আমাকে নেশা করতে এই প্রথমবার দেখছিস?’ আরও একবার গ্লাস পূর্ণ করে বলল রুদ্র।
‘ না। কিন্তু রুদ্র আমেরকে নেশায় টালমাটাল হতে এই প্রথমবার দেখছি।’
হাসল রুদ্র। গ্লাসটা ফাঁকা করে উঠে দাঁড়াল। টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যাচ্ছিল। উচ্ছ্বাস ধরতে উঠছিল কিন্তু তার আগেই সামলে নিল নিজেকে। বলল, ‘চল।’
‘কোথায়?’ উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল উচ্ছ্বাস।
‘ বাড়িতে। ঘুম পাচ্ছে।’
হাত ভাজ করে রুদ্রর মুখে দিকে তাকাল উচ্ছ্বাস। তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলল, ‘ ইদানিং কোন শয্যাসঙ্গিনীর প্রয়োজন হয়না দেখছি। একটা মেয়ে এসে মনের সাথে সাথে শরীরকেও নিজের বশবর্তী করে ফেলল না-কি? এতো একেবারে নাটকীয় কারবার!’
উত্তর দিলোনা রুদ্র। টালমাটাল পায়ে বেরিয়ে এলো বার থেকে। ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল উচ্ছ্বাস। এরপর নিজেও বেরিয়ে এলো রুদ্রর পেছনে।
#চলবে…