অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৩৬
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
৩৬.
রাত আড়াইটা বাজে। তার কিছুক্ষণ আগে বার থেকে অর্ধমাতাল হয়ে ফিরে এসছে উচ্ছ্বাস। ঘরটা অন্ধকার রেখেই বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। চোখে ঘুম ভর করেছে সঙ্গে সঙ্গেই। শোয়ার ধরণটাও ছিল অদ্ভুত। হাঁটুর নিচের পুরো অংশটা ছিল বিছানার বাইরে, হাত দুটো ‘হ্যান্ডস আপ’ করার ভঙ্গিতে রেখে উপুড় হয়ে পড়ে ছিল। কিন্তু চোখে ঘুমটা একটু ভালোভাবে ধরা দিতেই বিরক্তিকর শব্দে বেজে উঠল ওর মোবাইল ফোন। ঘুমের ঘোরেই উচ্ছ্বাস ভেবে নিয়েছিল ফোনটা নিশ্চয়ই রুদ্রই করেছে। অর্ধঘুমে বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে উঠল ওর। চোখ বন্ধ রেখেই মুখ দিয়ে ‘চ্যাহ’ আওয়াজ করল। চোখ বুজেই কয়েক সেকেন্ড হাতরে খুঁজে নিল ফোনটা। রিসিভ করে বলল, ‘ শালা! বউ নিয়ে আসছিস আয়। আমার ঘুমের পিণ্ডি চটকাচ্ছিস কোন দুঃখে?’
উত্তরে পাল্টা গালির জন্যে অপেক্ষা করছিল উচ্ছ্বাস। কিন্তু তার বদলে মেয়েলি কন্ঠে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ পেলো। উচ্ছ্বাস চমকালো। ঘুম পালিয়ে গেল চোখ থেকে। প্রায় লাফিয়ে উঠে বসল। ব্যস্ত কন্ঠে বলল, ‘ নাজিফা! কী হয়েছে? কাঁদছো কেনো?’
‘ ব- বাবা। হসপিটাল..’
এইটুকু বলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল মেয়েটা। উচ্ছ্বাস স্তব্ধ হয়ে গেল। নাজিফার মতো শক্ত, স্পষ্টবাদী, ব্যক্তিত্বসম্পূর্ণ মেয়ের ফোন করে এভাবে কেঁদে ফেলা মানেই বড় কিছু হয়েছে।
ভোররাত। হসপিটালের করিডরের বেঞ্চটাতে বসে আছে উচ্ছ্বাস। চোখে ক্লান্তি আর ঘুম। হাঁটুর ওপর দু হাতের কুনুইয়ের ভর দিয়ে বসে আছে চুপচাপ। অপেক্ষা করছে নাজিফার জন্যে। কিছুক্ষণ আগের কথা মাথায় আসতেই ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নাজিফার মুখে হসপিটাল শব্দটা শুনে আর এক মুহূর্ত দেরী করেনি উচ্ছ্বাস। ঐ অবস্থাতেই ছুটে চলে এসছে। এসে জানতে পারল নাজিফার বাবা ব্রেইন স্ট্রোক করেছে। হসপিটালে উচ্ছ্বাসকে দেখেই দৌড়ে এসে ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে মেয়েটা। যেন এমনই একটা ভরসার বুক খুঁজছিল এতক্ষণ। যেখানে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে কাঁদতে পারবে। প্রায় পাঁচ মিনিটের মতো উচ্ছ্বাসের বুকে মাথা রেখে কান্না করেছে নাজিফা। প্রথম দুই মিনিট থমকে দাঁড়িয়ে ছিল উচ্ছ্বাস। কী করবে বুঝতে পারছিল না। কিন্তু পরে বিস্ময় নিয়েই নিজেও আলতো করে হাত রাখে নাজিফার পিঠে।
উচ্ছ্বাসের ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে করিডরে এসে উপস্থিত হল নাজিফা। একদম স্বাভাবিক লাগছে ওকে এখন। কে বলবে একটু আগেই এই মেয়েটা কেঁদেকেটে বুক ভাসাচ্ছিল! কিন্তু উচ্ছ্বাস জানে সেই কান্না কতোটা ভয় আর দুঃখের ছিল। বাবাকে খুব ভালোবাসে মেয়েটা। হয়তো সব মেয়েই বাসে। নাজিফা সোজা এসে বসল উচ্ছ্বাসের পাশে। জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে হেলান দিল দেয়ালে। কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকল। উচ্ছ্বাস বলল, ‘কেমন আছেন আঙ্কেল?’
নাজিফা উচ্ছ্বাসের দিকে না তাকিয়েই বলল, ‘আপাতত ভয়ের কোন কারণ নেই। সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা পাওয়ায় এ যাত্রায় বেঁচে গেছেন।’
আবারও কিছুক্ষণের নিরবতা চলল। এবারও নিরবতা ভাঙল উচ্ছ্বাস। বলল, ‘তোমার ভাইয়েরা কেউ নেই বাড়িতে?’
‘ না। ‘
‘ আন্টি কী ভেতরে?’
‘ হ্যাঁ।’
‘ ওনার খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই? খাবার আনবো?’
‘ মা কিছু খাবেনা এখন।’
‘ তুমি?’
‘ আমিও না।’
এবার খানিকটা ইতস্তত করছে উচ্ছ্বাস। নাজিফা হেলান দেওয়া অবস্থাতেই আড়চোখে তাকাল উচ্ছ্বাসের দিকে। পাঁচ সেকেন্ডের মতো তাকিয়ে থেকে বলল, ‘এসব উল্টাপাল্টা উত্তর জানা প্রশ্ন না করে আসলে যা বলতে চাইছো বলে ফেলো। বাঘিনী নই আমি। খেয়ে ফেলবো না তোমাকে।’
তার চেয়ে কম কী? কথাটা মনে মনে বললেও মুখে বলল, ‘আমাকে কেন ডাকলে? মানে, তুমিতো নিজেই অ্যাম্বুলেন্স, ভর্তি সবকিছুর ব্যবস্থা করেই ফেলেছিলে। আমারতো কোন প্রয়োজনই পড়ল না বসে থাকা ছাড়া।’
নাজিফা চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলল, ‘ আমি একজন নার্স। এসব কারণে অন্যকারো হেল্প নেব কেন?’
উচ্ছ্বাস খানিকটা অবাক হয়ে বলল, ‘তাহলে? ডাকলে কেনো?’
নাজিফা এবার সরাসরি উচ্ছ্বাসের চোখে চোখ রাখল। স্হির কন্ঠে বলল, ‘ এটাও তোমাকে বলে দেওয়া দরকার?’
‘ ডাকলে অথচ কারণ বলবে না?’
নাজিফা এবার ভালোভাবে ঘুরে বসল উচ্ছ্বাসের দিকে। পা থেকে মাথা অবধি পর্যবেক্ষণ করল একবার। তারপর হাত দিয়ে উচ্ছ্বাসের চুলগুলো ঠিক করতে করতে বলল, ‘ বলবো। যদি আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।’
‘ কী প্রশ্ন?’ অবাক হয়ে জানতে চাইল উচ্ছ্বাস।
‘ আমার একটা ফোন পেয়ে এমন পাগলের মতো দৌড়ে চলে এলে কেন? নিজের দিকে তাকিয়ে দেখেছো? এলোমেলো চুল, কোচকানো গেঞ্জি, বা পায়ে প্যান্ট খানিকটা বেশি ওপরে তোলা। আমার একটা কলে জগৎ ভুলে গেলে?’
উচ্ছ্বাস বাকরুদ্ধ। নাজিফা ওর চোখে চোখ রেখে ভ্রু নাচাল। উচ্ছ্বাস নড়েচড়ে বসল। অস্হির লাগছে হঠাৎ। ব্যস্ত হাতে বাঁ পায়ে প্যান্ট নামাতে নামাতে দ্রুত কথা ঘুরিয়ে বলল, ‘ চা খাবে? আনবো?’
ভ্রু জোড়া কুঁচকে চোখ ফিরিয়ে নিল নাজিফা। কিছু বলল না। উচ্ছ্বাস উত্তরের অপেক্ষা না করে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে। অজানা আশঙ্কায় হঠাৎ বুক কাঁপছে ওর। কোনভাবে নাজিফা ওকে ভালোবেসে ফেলছে না তো? কিন্তু ও তো এমন কোন ইঙ্গিত কোনদিনও দেয়নি নাজিফাকে। ও তো কোনদিন এটাও চায়নি যে নাজিফার সাথে ওর সরাসরি কখনও কথা হোক। কীভাবে কী হয়ে গেল নিজেও বুঝে উঠতে পারেনা। হঠাৎই নাজিফার নিজে থেকেই কথা বলতে আসা, নাম্বার দেওয়া। শুধু শিডিউল জানতে করা কলগুলো কবে যে বাড়তি আলাপের স্তরে পৌঁছে গেল নিজেও বোঝেনি উচ্ছ্বাস। হঠাৎ কেমন কেঁপে উঠল বুকটা। না চাইতেও নাজিফাকে নিজের সাথে জড়িয়ে ফেলেছে ও। ভুল হয়ে গেল নাতো?
*
অন্ধকার কেটে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে রাস্তা, গাছপালা, ভবন। পাখিদের কিচিরমিচির আওয়াজের ধ্বনি বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রাণ জুড়ানো ঠান্ডা সতেজ হাওয়া। প্রায় ফাঁকা রাস্তা দিয়ে মাঝারি গতিতে এগোচ্ছে রুদ্রর জিপ। পাশে প্রিয়তা। তার পেছন পেছন আসছে আরেকটা গাড়ি। রুদ্র শিস বাজাতে বাজাতে মনের সুখে গাড়ি চালাচ্ছে। প্রিয়তা ভ্রুকুটি করে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। রাগে দুঃখে গা জ্বলে যাচ্ছে ওর। রুদ্রর নির্বিকারভাবে বাজানো শিসের আওয়াজ সেই রাগে ঘিয়ের কাজ করছে। কিছু করতে না পেরে দাঁতে দাঁত চেপে বসে আছে চুপচাপ।
হঠাৎ কিছু একটা ভেবে উচ্ছ্বাসের নাম্বারে ফোন লাগালো রুদ্র। ব্লুটুথ কানেক্ট করে আবার ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো, ‘ কী ব্যপার গুরু? এতো সকাল সকাল?’
রুদ্র ভ্রু কুঁচকে সন্দিহান কন্ঠে বলল, ‘ আগে বল তুই কোন জায়গায় কোন আকাম করছিস? এতো ভোরে যে জগিং করতে উঠিস নি তা আমি জানি। কেইস কী?’
উচ্ছ্বাস এক হাতেই ওয়ান টাইম দুটো চায়ের কাপ ধরে বলল, ‘অনেক কথা। আয় বলছি। তুই এতো সকালে কী মনে করে? কোন ঝামেলা হয়েছে? ওদিকে সব ঠিক? ভাবি ঠিকঠাক আছে?’
রুদ্র আড়চোখে তাকাল প্রিয়তার দিকে। বাতাসে উড়ে আসা চুলগুলো বিরক্ত হয়ে সরাচ্ছে। বলল, ‘আছে। নিয়ে আসছি। আধঘন্টার মধ্যে বনানী থাকব।’
‘ গুলশান আসবি না?’
‘ না।, বাবা বলেছে বিয়ের পরেই প্রিয় আমের ভিলায় পা রাখবে। এই ছ’দিন বনানীতেই থাক। যে জন্যে কল করলাম। অনেকদিন হলো ঐ ফ্লাটে যাওয়া হয়না। তুই ইমিডিয়েটলি দুজন লোক পাঠিয়ে ফ্লাটটা পরিষ্কার করে রাখতে বল। আর দুজন মেয়ে মেইডের ব্যবস্থা করে দে। এই পাঁচদিন ওর সাথে থাকার জন্যে।’
‘ আর কিছু, স্যার?’ সকৌতুকে প্রশ্ন করল উচ্ছ্বাস।
‘ না বৎস। আপাতত এইটূকু করে ধন্য করো আমায়।’
‘ অবশ্যই। আপনাদের সেবা করার জন্যেই তো আমার জীবন নিবেদিত।’
মৃদু হেসে কল কাটল রুদ্র। ঘাড় ফিরিয়ে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ মীরা ছাড়া তোমার কাছের কোন বন্ধুবান্ধব আছে প্রিয়? বিয়েতে ইনভাইট করার মতো?’
প্রিয়তা চোখ কটমটে করে তাকাল রুদ্রর দিকে। ‘ খুব আমোদে আছেন মনে হচ্ছে?’
‘ কী জানি? হঠাৎ নিজেই নিজেকে চিনতে পারছি না। তুমি মানুষ নও, নিশ্চয়ই কোন মায়াকন্যা। হিপনোটাইজ করছো নাকি আমাকে? অদ্ভুত কাজকর্ম করছি।’
প্রিয়তা হতাশ ভঙ্গিতে বাইরে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এর সাথে কথা বলার ধৈর্য্য নেই ওর।
জীপ থামিয়ে সোজা কোলে করে ভেতরে নিয়ে এসেছে প্রিয়তাকে। প্রিয়তার ছোটাছুটি, নিষেধ কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। রুদ্রর গায়ের জোরের কাছে প্রিয়তা পিঁপড়া বৈ কিছুই নয়। প্রিয়তাকে নিয়ে সোজা বেডরুমে নিয়ে গেল রুদ্র। বিছানায় বসিয়ে দিয়ে ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল, ‘সারারাত ঘুমাও নি। খাবার বানাতে বলছি। খেয়ে ঘুমিয়ে নাও। দুজন মেয়ে আছে এখানে। ওরা দুপুরে ডেকে দেবে। কিছু লাগলে ওদের বলবে কেমন?’
প্রিয়তা এবার অসহায় গলায় বলল, ‘যেতে দিন আমাকে। বিয়ে করবোনা আমি আপনাকে।’
রুদ্র মুচকি হাসল। হাত দিয়ে প্রিয়তার কপালের চুল সরিয়ে বলল, ‘ কিছু করার নেই প্রিয়। আর কোন অপশন নেই। বিশ্বাস করো, আমার কাছেও নেই। আমি যদি তোমাকে এখন ছেড়েও দেই কালকের মধ্যে বাবা লোক লাগিয়ে আবার তোমাকে তুলে নিয়ে আসবে। সুতরাং আমাদের বিয়ে করতেই হচ্ছে। তাছাড়া আমারও তোমাকে ছেড়ে দেওয়ার কোন ইচ্ছে নেই। ছাড়ছিও না। সুতরাং সেরকম কিছু হওয়ার সম্ভাবনা নেই।’
প্রিয়তার কেঁদে ফেলার মতো অবস্থা হলো। বাচ্চাদের মতো করে বলল, ‘ আমি পুলিশ কেইস করব আপনাদের বাপ ছেলের নামে। একটা মেয়েকে জোর করে তুলে এনে এভাবে বিয়ে করতে বাধ্য করতে পারেন না আপনারা।’
রুদ্র জবাব দিলোনা। প্রিয়তা কথাটাকে ছেলেমানুষী কথার মতো এড়িয়ে গিয়ে রুদ্র উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। আজ হয়তো আমি আর আসব না। কাল কথা হবে।’
এরপর প্রিয়তার দিকে ঝুকে বলল, ‘আর পালানোর চেষ্টা করোনা। ফ্লাটের বাইরে আমার লোকেরা পালা করে চব্বিশ ঘন্টাই পাহারা দেবে। অযথা শক্তি নষ্ট করে কী লাভ?’
প্রিয়তা বোকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রুদ্রর দিকে। মাথা নামিয়ে ওর কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুইয়ে দিল রুদ্র। চোখ খিচে বন্ধ করে নিল প্রিয়তা। রুদ্র প্রিয়তাকে দেখতে দেখতে কয়েক পা পিছিয়ে ঘুরে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। ঠোঁটে মুচকি হাসি। এদিকে চাদর খামচে এখনও চোখ বুঝে রয়েছে প্রিয়তা। ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠেছে ওর অজান্তেই।
*
সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে ঘুম ভাঙল রুদ্রর। সকালে উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বাইরে খেয়ে নিয়েছে। ওখান থেকে সোজা চলে গেছে আমের ভিলায়। নিজের রুমে এসে গিয়ে গা এলিয়ে দিয়ছে বিছানায়। বিগত বারো দিনের সকল মানসিক অবসাদ, ক্লান্তি যেন এক ঘুমেই ধুয়ে মুছে ফেলতে চায় ও। বরাবরের মতো সারাদিনে কেউ ওকে ডিস্টার্ব করার সাহস পায়নি। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে বিছানার কোণায় চোখ পড়তেই মৃদু হাসল রুদ্র। গালে হাত দিয়ে বসে আছে কুহু। ছোট বাচ্চা বাচ্চা মুখটাতে বাচ্চা ভাবটা আরও বেড়ে গেছে। রুদ্রকে উঠতে দেখে সোজা হয়ে বসল। রুদ্র এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে ইশারায় কাছে ডাকল কুহুকে। কুহু দ্রুত এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল ভাইকে। রুদ্র নিজের বোনের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বলল, ‘সন্ধ্যা সন্ধ্যা আমার ঘাড় মটকাতে এসছিস নাকি? পেত্নী।’
কুহু হালকা করে কিল মারল রুদ্রর বুকে। সোজা হয়ে বসে চোখমুখ অদ্ভুতভাবে বিকৃত করে বোঝাল, ‘রাক্ষস!’
রুদ্র হাসল। কুহুও ঠোঁট চেপে হাসল। হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওর চোখজোড়া। আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল মুখমণ্ডল। উত্তেজিত হাতে বোঝালো, ‘তুমি সত্যিই বিয়ে করবে? তুমি? আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।’
রুদ্র কুহুর চুল হালকা করে টেনে ধরে বলল ‘কেন? আমার আগে তুই বিয়ে করার প্লান করেছিলি নাকি?’
কুহু ঠোঁট ফুলিয়ে নিজের চুল ছাড়িয়ে নিল। ইশারায় বলল, ‘আমাকে তাড়াতে পারলেই তো বাঁচো।’
রুদ্র হেসে বিছানা থেকে পা নামাল। ফোনটা হাতে নিয়ে সময় দেখল। কুহু তাকিয়ে আছে রুদ্রর দিকে। রুদ্র সেটা লক্ষ্য করে ভ্রু নাচিয়ে জানতে চাইল, কী হয়েছে? কুহু ইশারায় বলল, ‘জ্যোতি আপুর সাথে কথা বলবে না?’
রুদ্র খানিকটা চমকে উঠল। এতোসব চাপের মধ্যে জ্যোতির কথা ভুলেই গিয়েছিল ও। মেয়েটার সাথে কথা বলা দরকার। মনে কতখানি জখম নিয়ে বসে আছে কে জানে?
গোধূলির লালচে আকাশের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জ্যোতি। উদাস চোখে লক্ষ্য করছে প্রকৃতিকে। পাখিরা ঝাকে ঝাকে ফিরে যাচ্ছে নিজেদের নীড়ে। অথচ কালো আর লালচে রঙের সংমিশ্রণে সুসজ্জিত মেঘগুলো ভেসে যাচ্ছে উদ্দেশ্যহীনভাবে। মানুষের জীবনটাও বুঝি এরকমই। যাদের নীড় আছে তারা নির্দিষ্ট নীড়ে ছুটে চলে। আর যাদের নেই তারা উদ্দেশ্যহীনভাবে ভেসে বেড়ায়। নিরন্তর।
কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠল জ্যোতি। ঘাড় ফিরয়ে দেখল রুদ্র দাঁড়িয়ে আছ। গম্ভীর মুখে। জ্যোতি জোরপূর্বক একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘উঠে গেছো? কফি লাগবে? ইশ! সন্ধ্যা হয়ে গেছে না? আমি খেয়ালই করিনি। সরি হ্যাঁ। আমি নিয়ে আসছি এক্ষুনি।’
কথাগুলো ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে চলে যাচ্ছিল জ্যোতি। রুদ্র বলল, ‘আমি কফি চাইতে আসিনি।’
জ্যোতি দাঁড়িয়ে গেল। ঘুরে তাকিয়ে বলল, ‘ সামনের সপ্তাহ থেকে তো বউয়ের হাতের কফিই খাবে। এই সপ্তাহটা না হয় আমিই খাওয়ালাম।’
রুদ্র এগিয়ে এসে জ্যোতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, ‘রেগে আছিস?’
জ্যোতি চোখ সরিয়ে নিল। কিছু বলল না। রুদ্র বলল, ‘আমার ওপর রাগ বা অভিমানের কারণ নেই জ্যোতি। এমন নয় যে আমি তোকে ঠকিয়েছি। প্রেম, ভালোবাসা, অনভূতি যাই থাক সবটাই তোর নিজের ছিল। সেখানে কোথাও আমি ছিলাম না। থাকাতো দূরের কথা কোনদিন তেমন কোন ইশারাও করিনি আমি। বরং উল্টোটাই করেছি। তুই আমায় ভালোবেসেছিস সেটা তোর দোষ নয়। ঠিক তেমনই আমি তোকে ভালোবাসিনা সেটাও আমার দোষ হতে পারেনা।’
ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে রুদ্রর চোখে চোখ রেখে বলল, ‘রুদ্র আমের কৈফিয়ত দিচ্ছে?’
রুদ্র শক্ত কন্ঠে বলল, ‘ না। আমি রাশেদ আমের ছাড়া অন্য কাউকে কৈফিয়ত দেই না। শুধু বলে রাখছি। তোর কিছু কাজে বিরক্ত হতাম ঠিকই কিন্তু তোকে আমি পছন্দ করি জ্যোতি। হয়তো ভালোও বাসি। কিন্তু সেটা শুধুই পরিবারের সদস্য হিসেবে। সেকারণেই বলছি। মরিচিকার পেছনে ছুটিস না। জীবনটা গুছিয়ে নে।’
জ্যোতির হঠাৎ কান্না পেল। রুদ্রর কোন কথাই ওর মন বা মস্তিষ্ক বুঝলো না। অকারণ এক রাগ অভিমানে বিষিয়ে গেল মনটা। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকালো। আক্রোশ নিয়ে বলল, ‘মিথ্যুক তুমি। তুমি বলেছিলে কাউকে ভালোবাসবে না। কিন্তু তুমি বেসেছো। ঠক, প্রতারক তুমি একটা।’
রুদ্র এবার বিরক্ত হলো। এসব যুক্তিহীন কথার অর্থ কী? তবুও নিজেকে শান্ত রেখে বলল, ‘আমি বলেছিলাম কখনও কাউকে ভালোবাসব না। কিন্তু তোকে এই নিয়ে কোন কথা দেই নি। নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম আমি । আর সেই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছি। না চাইতেও হেরে গেছি আমি। প্রথমবার। নিজেরই কাছে। কিন্তু সেটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত বোঝাপড়া জ্যোতি।’
‘ মেয়েটা আমার চেয়েও সুন্দরী?’
রুদ্র চলে যাচ্ছিল। জ্যোতির কথায় পা থেমে গেল ওর। জ্যোতি এসে ওর সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কী হল বলো? আমার চেয়েও সুন্দরী মেয়েটা? ওর ফিগার বুঝি আমার চেয়েও বেশি আর্কষণীয়? বলো? কী দিয়ে আকৃষ্ট করল ও তোমাকে? কী পেয়েছো ওর মধ্যে যা আমার মধ্যে পাওনি? বলো? কী দিয়ে খুশি করল ও তোমাকে?’
চড় মারার উদ্দেশ্যে হাত তুলেও নিজেকে সামলে নিল রুদ্র। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে ওর। জ্যোতির দিকে ভয়ানক দৃষ্টি ফেলে শান্ত স্হির গলায় বলল, ‘তোর জায়গায় অন্যকেউ একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের সম্পর্কে এমন কথা বললে একটা বু’লে’ট খরচ করতে খুব বেশি ভাবতে হতোনা আমাকে। সেই মেয়েটা আমার ‘প্রিয়’ হলেতো একদমই না। কিন্তু তোকে ছেড়ে দিচ্ছি কারণ তোর প্রতি একটা সফ্ট কর্ণার আছে আমার। সে জন্যই নিজে থেকে তোর কাছে এসেছিলাম কথা বলতে। নিজের দোষে সেই জায়গাটা নষ্ট করিস না জ্যোতি। আমের ভিলার বাকি সবার মতো তুইও আমার কাছে স্পেশাল।’
কথাটা বলে হনহনে পায়ে ছাদ ত্যাগ করল রুদ্র। জ্যোতি ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেলল। কে এই মেয়ে! এতো বছরেও জ্যোতি যেই পাথরকে গলাতে ব্যর্থ হয়েছে, সেই পাথরকে এতো অনায়াসেই গলিয়ে দিল। এই অসাধ্য সাধন কে করল? কীকরে করল? কেন করল? চেষ্টা করেও ব্যপারটা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছেনা। ভেতরটা জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। সবকিছু বিষাক্ত লাগছে ওর।
*
বিছানায় হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে আছে প্রিয়তা। ফোন স্ক্রোল করছে। কিন্তু ফোনের দিকে তেমন মনোযোগ নেই ওর। বারবার আড়চোখে তাকাচ্ছে দরজার দিকে। নিজের অজান্তেই রুদ্রর জন্যে অপেক্ষা করছে ওর মন। সেইযে গতকাল সকালবেলা ওকে এখানে রেখে বেরিয়েছে এখনো আসেনি। বেলা এগারোটা বাজতে চলল। দুজন মেয়ে কাল থেকে একেবারে রাণীর মতো সেবা করে চলেছে ওর। এক গ্লাস পানিও নিজের হাতে নিয়ে খেতে পারছেনা। কী হচ্ছে, কী হতে চলেছে নিজেই বুঝে উঠতে পারছেনা এখনো। সত্যিই কী পাঁচদিন পর ওর আর রুদ্রর বিয়ে হবে? রুদ্র আমেরের স্ত্রী হবে ও? কিন্তু ও কী চায় নিজেও বুঝে উঠতে পারছেনা। কিছু কথা মাথায় ঘুরপাক খেতেই কেমন দোটনায় পড়ে যাচ্ছে ও। এই বারোদিনের বিচ্ছেদের মধ্যেই তৈরী হয়েছে দোটানার এই দেয়াল। গোমড়া মুখ ফোনটা সাইডে ছুড়ে রাখল প্রিয়তা। হাঁটু গুটিয়ে দু গালে হাত রেখে বসে রইল চুপচাপ।
হঠাৎ দরজার বাইরে থেকে দৃঢ়, গম্ভীর, পুরুষালি কন্ঠে কেউ বলল, ‘ আসব?’
চমকে উঠল প্রিয়তা। ভাবনার হঠাৎ এমন গম্ভীর শব্দের আক্রমণে ভয় পেয়েছে। তাকিয়ে দেখল অফ হোয়াইট রঙের পাঞ্জাবি পড়া এক লোক দাঁড়িয়ে আছে। গালে চাপ দাড়ি, চকচকে প্রশস্ত কপাল, ব্যাক ব্রাশ করা চুল। উচ্চতা প্রায় রুদ্রর মতো। সুঠাম শরীর। যেন আরও পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর পরের রুদ্রকে দেখতে পাচ্ছে প্রিয়তা। প্রিয়তার অনুমান ইনিই রুদ্রর বাবা। রাশেদ আমের। রুদ্র বলেছিল ওর বাবার বয়স বোঝা যায়না। বিস্ময় কাটতেই ঝট করে উঠে দাঁড়াল প্রিয়তা। ওড়না ঠিক করে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। রাশেদ ভেতরে আসলেন। বিছানার একপাশে বসে প্রিয়তার উদ্দেশ্য বললেন, ‘বসো।’
প্রিয়তা কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করে বসল। হাত-পা ঘেমে উঠেছে ওর। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। কী করবে বুঝতে পারছে না। রাশেদ ঘরের চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, ‘আমি রুদ্রর বাবা। রাশেদ, রাশেদ আমের।’
‘ আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল।’ এতক্ষণে গলা দিয়ে শব্দ বের হল প্রিয়তার।
রাশেদ সালামের জবাব দিয়ে ভ্রু কোঁচকালেন। মাথা দুলিয়ে বললেন, ‘আঙ্কেল! ডাকটা পছন্দ হয়নি আমার। বাবা বলার অভ্যেস করে ফেলো। এখন থেকেই।’
প্রিয়তা মূর্তির মতো বসে রইল কিছুক্ষণ। এরপর উঠে দাঁড়িয়ে কোনমতে বলল, ‘ চ-চা, কফি কিছু_’
কথাটা শেষ করতে দিলেননা রাশেদ। হাতের ইশারায় বসে পড়তে বললেন ওকে। প্রিয়তা তাই করল। ভয় কাটেনি ওর। রাশেদ বললেন, ‘তোমার নাম?’
প্রিয়তা অবাক হল। নিজের ছেলের বউ বানাচ্ছে। নিয়ে আসার আদেশ দিয়েছে। অথচ নাম জানেনা? নাকি জেনেই প্রশ্ন করছে? প্রিয়তা ইতস্তত করে বলল, ‘প্রিয়তা।’
‘ বাবার নাম নূরুল ইসলাম। মায়ের নাম আসিয়া। পাঁচ বছর বয়সে মা মারা যায়। এক বছরের মধ্যেই বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে। আর তার ঠিক ছ’মাস পর তোমাকে একটা আশ্রমে পাঠিয়ে দিয়ে তোমার বাবা তার বউ নিয়ে বিদেশ চলে যায়। ওখানেই তোমার পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা। প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর ওদিকেই আলাদা ঘর নিয়ে থাকতে তুমি। ঠিক?’
প্রিয়তা হতবাক। এরমধ্যেই সব খবর জোগাড় করে নিয়েছে! কীকরে?
‘ ঠিক?’
রাশেদ দ্বিতীয়বার প্রশ্নটা করলে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ায় প্রিয়তা। কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন রাশেদ। এরপর বললেন, ‘এই বিয়েতে রাজি তুমি?’
প্রিয়তা উত্তর দেওয়ার আগেই রাশেদ আবার বলল, ‘ আমি তোমাদের ব্যক্তিগত মান অভিমানের কথা জানতে চাইছি না। ওটা তোমরা নিজেদের মধ্যে মিটিয়ে নিও। ওসব ছাড়া বিয়েতে তুমি রাজি?’
প্রিয়তা কী বলবে বুঝতে পারছেনা। দ্বিধাগ্রস্ত মন নিয়ে মাথা নিচু করে বসে রইল চুপচাপ। প্রায় দুই মিনিটের নিরবতার পর রাশেদ মাথা ঝাঁকালেন। বললেন, ‘ মৌনতাকেই সম্মতি ধরে নিচ্ছি আমি। কাজ সেড়ে যাচ্ছিলাম এদিক দিয়ে। ভাবলাম দেখা করে যাই। আর বিয়ের ব্যপারে তোমার মতামতটাও এনশিওর করার ছিল। আমি এখন উঠছি। এরপর বিয়ের দিনই হয়তো দেখা হবে।’
উঠে দাঁড়ালেন রাশেদ। প্রিয়তাও দাঁড়াল। রাশেদ প্রিয়তার সামনে এসে ওর মাথায় আলতো করে হাত রেখে বললেন, ‘ভালো থেকো।’
চলে গেলেন রাশেদ আমের। রাশেদের যাওয়ার পথে স্হির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল প্রিয়তা।
#চলবে…
[ রি-চেইক করিনি। সকলেই রেসপন্স করবেন। আর গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি। হ্যাপি রিডিং।]