অন্তর্হিত কালকূট ..
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
৪১.
ঝলমলে মিষ্টি সকাল। গতকাল ঝড় হওয়াতে আকাশটা আজ পরিষ্কার। এক টুকরো মেঘও দেখা যাচ্ছেনা। রুদ্র প্রিয়তা দুজনেরই উঠতে দেরী হয়ে গেছে। বেলা অনেক হয়েছে। কিন্তু কেউ এখনো ওদের ডাকতে আসেনি।
রুদ্র শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে দেখল প্রিয়তাকে। ড্রেসিং-টেবিলের সামনে বসে গায়ে লোশন লাগাচ্ছে। দ্রুত হাত চলছে ওর। কেমন শুকনো দেখাচ্ছে মুখটা। মন ভালো নেই নাকি! ঘুম থেকে উঠে এখনো প্রিয়তাকে ভালোভাবে লক্ষ্য করার সুযোগ পায়নি রুদ্র। মেয়েটা ওকে জাগিয়ে দিয়েই শাওয়ার নিতে চলে গিয়েছিল। বের হওয়ার সাথেসাথেই ঠেলে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দিয়েছে রুদ্রকে। দেরী হওয়ার অযুহাতে। রুদ্রকে দেখেই প্রিয়তা ঝট করে উঠে দাঁড়াল। চোখ সরিয়ে কিছুটা ব্যস্ত সুরে বলল, ‘আপনার হয়ে গেছে? ব্রেকফাস্ট নিচে করবেন নাকি নিয়ে আসব?’
‘অনেক বেলা হয়ে গেছে। ঘরেই নিয়ে এসো।’
প্রিয়তা রুদ্রর দিকে না তাকিয়েই দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেল। ঘুম থেকে উঠেই রুদ্রকে এড়িয়ে যাচ্ছেন মেয়েটা। কারণটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি রুদ্রর। গতরাতের মুহূর্তগুলো মনে পড়ল। কী স্বর্গীয় অনুভূতি! অনেক মেয়েকেই নিজের শয্যাসঙ্গিনী বানিয়েছিল ও। তাতে কেবল জৈবিক চাহিদা ছিল। আর কিছুই না। অথচ কাল প্রিয়তার সংস্পর্শে থাকা প্রতিটা সেকেন্ড কত শান্তিময়, তৃপ্তিময়, অনুভূতিময় ছিলো। প্রিয়তার শরীরের প্রতিটা কম্পনে ও নিজেও শিউরে উঠছিল । কী পবিত্র অনুভূতি! কতো স্বস্তি! বৈধতার স্বস্তি। এর আগে কোনদিন এরকম অনুভব করেনি রুদ্র। একটা সময় পর প্রিয়তাও লাজ-লজ্জা ভুলে গিয়েছিল। বিভোর হয়ে গিয়েছিল রুদ্রতে। নিজের সেই আচরণের লজ্জাতেই শেষরাতে মুখ লুকিয়েছিল রুদ্রর বুকে। রুদ্র ফিসফিসিয়ে ডেকেছিল, ‘প্রিয় তাকাও।’
কিন্তু সেইযে মেয়ে মুখ লুকোলো, এরপর আর ঠিককরে তাকায়নি রুদ্রর দিকে। একটা বিষয় নিয়ে আফসোস হয় রুদ্রর। যদি প্রিয়তা ওর স্পর্শ করা প্রথম নারী হতো! জীবনে নিজের কোন কাজের জন্যেই আফসোস বা অনুতাপ ছিলোনা রুদ্রর। এই প্রথমবার হচ্ছে। কিন্তু অতীতকে চাইলেও বদলানো যায়না। যা ঘটে গেছে তাতে আর কিছু করার নেই ওর। তবে যে হাতে একবার নিজের প্রিয়কে স্পর্শ করেছে, সেইহাতে কোনদিন অন্যকোন মেয়েকে স্পর্শ করতে পারবেনা রুদ্র। চাইলেও পারবেনা। সেই সাহস, ক্ষমতা বা ইচ্ছা কোনটাই ওর নেই।
প্রিয়তা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই দৌড়ে এলো কুহু। দু হাতে জাপটে ধরে দুবার দোল খেলো। প্রিয়তা প্রথমে একটু হকচকিয়ে গেলেও পরে হেসে ফেলল। নিজেকে ছাড়িয়ে কুহুর দুটো গাল টেনে দিয়ে বলল, ‘এতো খুশি কেন? কী হয়েছে?’
কুহু ইশারা করে কিছু বলল। প্রিয়তা কিছুই বুঝল না। হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমি এখনো বুঝিনা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ।’
উচ্ছ্বাসও সোফাতেই বসে বসে কফি খাচ্ছিল। ওদের কথা শুনে সকৌতুকে বলল, ‘ওটা স্পেশাল ল্যাঙ্গুয়েজ বউমনি। দ্য ডান্সিং ল্যাঙ্গুয়েজ। আমিও বুঝিনা।’
প্রিয়তা বলল, ‘ কত্তো কিউট একটা ল্যাঙ্গুয়েজ। আপনি এতোদিনেও শিখতে পারোনি সেটা আপনার ব্যর্থতা। তবে আমিতো শিখে নেব। কুহু বলেছে। শিখিয়ে দেবে আমাকে।’
কুহু উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচাল। অর্থাৎ ‘দেখেছো।’ উচ্ছ্বাস মুখ ছোট করে প্রিয়তাকে বলল, ‘এটা কেমন হলো বউমনি? এসেই ননদের দলে ভিড়ে গেলে। দেবরকে চোখে পড়ল না?’
কুহু ভেংচি কাটল উচ্ছ্বাসকে উদ্দেশ্য করে। উচ্ছ্বাস চোখ পাকিয়ে চড় দেখালো। প্রিয়তা ঠোঁট চেপে হাসল। দ্বিতীয়বার এখানে আসার পর উচ্ছ্বাসের সাথে মাঝেমাঝে কথাবার্তা হয়েছে ওর। বিয়ের সুত্রে তা আরও বেড়েছে। দুজনে এখনো খুব বেশি ফ্রী না, কিন্তু স্বাভাবিক। প্রিয়তা উচ্ছ্বাস আর কুহুকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘তোমরা খেয়েছো?’
দুজনেই সম্মতি জানালো। প্রিয়তা এবার রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল। জ্যোতির বেরিয়ে এলো রান্নাঘর থেকে। জ্যোতিকে দেখে প্রিয়তা হাসল। উত্তরে জ্যোতিও হাসি দিল। এগিয়ে এসে বলল, ‘এতো তাড়াতাড়ি নেমে এলে যে?’
প্রিয়তা অস্বস্তিবোধ করল। ওর জানামতে ও বেশ দেরী করে উঠেছে। তাই খানিকটা ইতস্তত করে বলল, ‘দুঃখিত। আসলে ঘুম থেকে উঠতে দেরী_’
জ্যোতি ক্লিষ্ট হাসি হেসে বলল, ‘ দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই। আজকের সকালে উঠতে একটু দেরী হবে এটাই স্বাভাবিক।’
কিছুটা লজ্জা পেলো প্রিয়তা। কথা ঘোরাতে বলল, ‘ বাবা, কাকা সবাই খেয়েছে?’
‘ হ্যাঁ ওনারা খেয়ে-দেয়ে অনেক আগেই বেরিয়ে গেছেন। আর সবাইকে বলে গেছেন দরকার ছাড়া তোমাদের না ডাকতে।’
প্রিয়তার কান লাল হয়ে উঠল। এ কেমন বাড়ি! মুখে বলল, ‘ইশ! আমার আগেই উঠে যাওয়া উচিত ছিল।’
‘ ছাড়োতো! এটাকে টিপিকাল শ্বশুরবাড়ির মতো ভেবোনা। এখানকার লোকজন সবাই ইউনিক। শাশুড়ি না থাকার একটা সুবিধা বলতে পালো। যাক গে, তোমরা কী ওপরে খাবে নাকি নিচে? সবার কিন্তু খাওয়া শেষ। তোমরা দুজনেই বাকি।’
‘ব্রেকফাস্ট ওপরে নিয়ে যাই। এখন নিচে নামবেন না উনি। মীরা কী ওঠেনি এখনো?’
‘ উঠেছিল। খেয়ে এখন আবার ঘুমোচ্ছে। রাতে নাকি এলার্জি উঠেছিল বলে ঘুমাতে পারেনি ঠিকভাবে। তুমি কিচেনে যাও। নার্গিস খালা বা অন্যকেউ খাবার দিয়ে দেবে।’
প্রিয়তা মাথা নেড়ে ভেতরে চলে গেল। জ্যোতি ভারাক্রান্ত মন নিয়ে চলে এলো। সপ্তাহখানেক আগে অবধি এই কাজগুলো ও করতো। ওকে বারণ করার পরেও করতো। খুশি মনে। কিন্তু আজ সেই অধিকার ওর নেই। এখন রুদ্রর দেখাশোনা করার জন্যে স্হায়ীভাবে কেউ এসে গেছে। রুদ্রর সবকিছুতেই এখন তার অধিকার। শুধু রুদ্রর ওপর নয়। এই বাড়ির ওপরেও প্রিয়তার অধিকার। এটা প্রিয়তার সংসার। বসার ঘরে গিয়ে দেখল উচ্ছ্বাস আর কুহুর খুনশুটি, ঝগড়া। দুজনে মুখে ঝগড়া করছে। মাঝেমাঝে একে ওপরকে মারছে। রাশেদও বাইরে নিজের কাজে ব্যস্ত। সবাই ঠিক আছে। সবাই নিজেদের মতো ভালো আছে। ইদানিং ওর মনে হয় সত্যিই এ বাড়ির আশ্রিতা ও। কেউ কোনদিন ওর কথা ভাবেনি। গুরুত্ব দেয়নি। ওর কোন দাম নেই এ বাড়িতে।
প্রিয়তা ওদের খাবার নিয়ে ঘরে এসে দেখল রুদ্র বিছানায় হেলান দিয়ে বসে ফোন দেখছে। প্রিয়তা ভেতরে গিয়ে গলা ঝেড়ে রুদ্রর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। রুদ্র তাকাল। ট্রেটা বিছানার ওপর রেখে নিচু গলায় বলল, ‘আপনি খেয়ে নিন। আমি একটু আসছি।’
বলে প্রিয়তা চলে যেতে নিলেই রুদ্র ওর হাত ধরে ফেলল। প্রিয়তা দাঁড়িয়ে গেল। রুদ্র মাঝারি গোছের একটা টান দিয়ে ওকে বসিয়ে দিল নিজের কোলে। প্রিয়তা হতবাক হয়ে তাকাল রুদ্রর দিকে। রুদ্র ওর কোমর চেপে রেখে বলল, ‘সকাল থেকে পালাচ্ছো কেন?’
‘ কই পালাচ্ছি? ওয়াশরুমে জামা রেখে এসছেন। ধুয়ে আসছিতো।’
‘খেয়েছো?’
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে তাকাল রুদ্রর দিকে। বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আমিতো রোবট। দেখলেন না নিচে গেলাম আর এলাম। এতো অল্প সময়ে খাওয়া যায়?’
রুদ্র হাসল। প্রিয়তার ভেজা চুল নেড়ে দিয়ে বলল, ‘এইতো! মুখে খই ফুটেছে। তোমাকে এভাবেই ভালো লাগে। তুমি চুপচাপ থাকলে আমার মনটাও কেমন খারাপ হয়ে যায়।’
প্রিয়তা এবার রুদ্রর দিকে। রুদ্রর এতো সহজভাবে কথা বলাতে ওর লজ্জা ভাবটা যেন হঠাৎই উধাও হয়ে গেল। ও রুদ্রর চুলে মাঝে আঙুল গলিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমাকে ছেড়ে খেয়ে নিন। বের হবেন না আজ?’
রুদ্র প্রিয়তার চোখে চোখ রেখেই মাথা নাড়ল। এরপর হাত বাড়িয়ে খাবারের ট্রেটা কাছে আনল। খাবার তুলে প্রিয়তার মুখের সামনে নিয়ে বলল, ‘হা করো।’
প্রিয়তা কথা না বাড়িয়ে হা করল। রুদ্র নিজের হাতেই খাইয়ে দিল প্রিয়তাকে। সঙ্গে নিজেও খেলো। খাওয়া শেষে প্রিয়তা বাসনগুলো নিচে রেখে আবার রুমে আসতেই রুদ্র বলল, ‘প্রিয়, বাবা কল করেছিল। আমি বের হবো। আমার পোশাকটা একটু বার করে দাও তো।’
প্রিয়তা খানিকটা অবাক হয়ে বলল, ‘আমি?’
রুদ্র ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘আমার কী আরও দু চারটা বউ আছে নাকি?’
প্রিয়তা গিয়ে কাবার্ড খুলতে খুলতে বলল, ‘এখন তো দূরের কথা। আমি মরে গেলেও যদি অন্যকারো দিকে চোখ তুলে তাকান না, পেত্নী হয়ে এসে আপনার ঘাড় মটকাবো বলে দিলাম।’
রুদ্র মুখটা গম্ভীর হয়ে উঠল। কিছু বলতে গিয়েও বলল না। পোশাক পরে তৈরী হয়ে নিল। জ্যাকেটটা প্রিয়তাই পরিয়ে দিল। রুদ্র প্রিয়তার কোমরে হাত রেখে বলল, ‘মন খারাপ কেন? সকাল থেকে লক্ষ্য করছি। কী হয়েছে?’
‘কই? কিছুনা।’
‘আমাকে কখনও মিথ্যে বলবেনা প্রিয়।’
প্রিয়তা অযথাই রুদ্রর জ্যাকেটের জিপার নাড়তে নাড়তে ব্যথিত গলায় বলল, ‘আমার একটা পরিবার থাকলে আজ আমরাও সেই বাড়িতে যেতাম তাইনা? আমার মা আপনাকে যত্ন করে রান্না করে খাওয়াতো। সবকিছু কত সুন্দর হতো।’
রুদ্র মৃদু হেসে প্রিয়তার দু গালে হাত রেখে বলল, ‘জীবন একটাই প্রিয়। আর এক জীবনে সবার সবকিছু থাকেনা। অপূর্ণতা নিয়েই জীবন। তাই এসব নিয়ে মন খারাপ করোনা। তাড়াতাড়ি চলে আসব আজ। বিকেলে তোমাকে নিয়ে আশেপাশে কোথাও থেকে ঘুরে আসব। ভালো লাগবে।’
প্রিয়তা মুচকি হাসল। রুদ্র সযত্নে চুমু খেলো প্রেয়সীর কপালে।
*
চট্টগ্রাম শহর। শহরের প্রায় শেষপ্রান্তে ব্লাক হোল গ্রুপের লীডার, করিম তাজওয়ারের নিজস্ব বাড়ি। আগে ঢাকাতেই থাকতেন ওনারা। কিন্তু রাশেদের জন্যে ওখানে থাকা সম্ভব হয়নি। শত্রুতার শুরু তো সেখান থেকেই। কিন্তু এখন সেই শত্রুতাকে পরিণতি দেওয়ার সময় উপস্থিত। অনেক হয়েছে সাপসিঁড়ি খেলা। এবার মরণছোবল মারতে হবে। হয় এসপার, নয় ওসপার।
নিজের চেয়ারে বসে বসেই কথাগুলো ভাবছিল করিম। ঠোঁটের মাঝে জ্বলন্ত সিগারেট ধরে রেখেছে। গভীর চিন্তায় টানতেও ভুলে গেছে। কারণ এবারের খেলাটা ভয়ংকর। জয় যারই হোক। পরিণতি যে সকলেরই হাড় কাঁপিয়ে দেবে, তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
ওনার ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে কেউ ঘরে প্রবেশ করল। করিম তাজওয়ারের ছোট ছেলে। বড় ছেলের মৃত্যু হয়েছে পাঁচ বছর আগেই। পুলিশ এনকান্টারে। মনসুর এসেই ধাক্কা দিয়ে একটা চেয়ার ফেলে দিল। ছেলের বেয়াদবিতে জ্বলে উঠল করিম। ধমক দিয়ে বলল, ‘সম্রাট!’
সম্রাট গর্জে উঠল। আরেকটা চেয়ারে লাথি মারল। ফোস করে একটা শ্বাস ফেলল করিম। নিজেকে শান্ত করে বলল, ‘মাথা ঠান্ডা করো। বসো।’
সম্রাট জ্বলন্ত চোখে তাকাল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘তোমার মতো বসে বসে তামাশা দেখার ধৈর্য্য আমার নেই। তুমি সারাজীবন চেয়ারে বসে ভেবেই যাও। না ঢাকা ছাড়া হওয়ার সময় কিছু করতে পেরেছিলে। না নিজের বড় ছেলের এনকাউন্টারের সময়। আর না এখন পারবে। পুরো ব্লাকহোল ডুবে গেলেও তুমি চেয়ারে বসে ভেবেই যাবে।’
করিম তাজওয়ার নতুন একটা একটা সিগারেট ধরাল। সম্রাটের দিকে সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘এতো রাগ করছো কেন? একটা কথা ভুলে যেওনা শুধুমাত্র তোমার জন্যে, তোমার জন্যেই ডার্ক নাইটের প্রস্তাবে রাজি হতে হয়েছে আমাকে। হাত মেলাতে হয়েছে ওদের সঙ্গে। যেখানে ওরাও আমাদের শত্রুই ছিল।’
‘শুধু আমার জন্যে? এছাড়া আর কোন উপায় ছিল তোমাদের কাছে? এককভাবে সোলার সিস্টেমের বা* ছেড়ারও যোগ্যতা নেই তোমাদের। তাই এক হয়েছো।’
করিম মাথা নেড়ে বলল, ‘ মানছি। কিন্তু তুমি যেটা চাও সেটাতো হবে। তাহলে এতো চিন্তার কী আছে? আর এবারের জালটা যেভাবে সাজিয়েছি। কোনভাবে ওরা জিতে গেলেও নিজেদের ধ্বংস করেই জিততে হবে। অন্যকোন কোন পথ নেই।’
সম্রাট উত্তর দিলোনা। মেজাজ ঠিক হচ্ছেনা ওর। এ নিয়ে অনেক তর্ক বিতর্ক হয়ে গেছে। এসব নিয়ে কম ঝামেলা হয়নি বাপ-ব্যাটার মধ্যে। নিজেকে নিয়ে সম্রাট বলল, ‘ সে যাই হোক। রুদ্রকে আমার চাই। ওকে আমি নিজের হাতে খু’ন করব।’
করিম তাজওয়ার হেসে বললেন, ‘সে দেখা যাবে..’
আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন তাজওয়ার। কিন্তু তার টেবিলে রাখা টেলিফোন বেজে উঠল। কথা থামিয়ে একবার তাকালেন সম্রাটের দিকে। এরপর রিসিভার তুলে বলল, ‘হ্যালো?’
ওপাশ থেকে আসা কথা শুনে তেঁতে উঠল করিম। ঝাড়ি দিয়ে বলল, ‘এখানে ফোন করতে কে বলেছে! এইটুকু বুদ্ধি নেই মাথায়?’
ওপর পাশ থেকে আবার কেউ কিছু বলল। ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে করিম। শান্ত হয়ে বলল, ‘আচ্ছা চিন্তা করো না। আমি দেখছি। তুমি যেভাবে আছো থাকো। এখানে ফোন করো না। আমি সামলে নেব।’
বলে রিসিভারটা নামিয়ে রেখে তাকাল সম্রাটের দিকে। সিগারেট বের করছে। করিম রাগে গজগজ করে বলল, ‘গাধা পুষছি সব। এখানে ফোন করেছে। কোনভাবে ধরা পড়ে গেলে!’
সম্রাট সিগারেট আগুন ধরিয়ে বলল, ‘ওকে এখন এমনিতেও খরচের খাতাতেই ফেলে দাও। তোমার কী মনে হয় ও ধরা পড়বেনা? এতোদিন কোন ঝামেলা হয়নি। রুদ্র নিজেও বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত ছিল। কিন্তু এখন, বিশেষকরে খু’নটা হওয়ার পর আর না। ও এখন পাতালে গিয়ে লুকোলেও এক সপ্তাহের মধ্যে ওর ডেড বডি পাবে। লিখে রাখো।’
‘ কী করতে পাঠিয়েছিলাম আর কী করল। মারল কাকে? একটা কাজের মহিলাকে। ইডিয়ট!’
‘ ছাড়ো। আপাতত এটাতো জানা গেছে যে পরের সপ্তাহ থেকে কাজ শুরু করবে ওরা। আপাতত এটুকুই যথেষ্ট। ওকে আর প্রয়োজন নেই। ফেলুক মেরে। কিন্তু পুলিশের হাতে পড়লে ঝামেলা। হাতের ছাপ নেইতো ছু’রিতে?’
সোজা হয়ে বসল করিম। ইতস্তত করে বললেন, ‘সেটাতো জিজ্ঞেস করিনি।’
সম্রাট তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল, ‘লীডারের এই হাল হলে চ্যালারাতো সব গাধা হবেই। এজ এক্সপেক্টেড।’
করিম কী বলবেন বুঝতে পারলেন না। সম্রাট বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘মাঝেমাঝে আমার সন্দেহ হয় আমি আদোও তোমার ছেলে কি-না। আমার নিজের বাপ এতো গভেট হয় কীকরে!’
করিম হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন ছেলের দিকে। মাঝেমাঝে তার নিজেরও সন্দেহ হয়। এটা তারই ছেলে তো? কিন্তু স্ত্রীর সম্মানের কথা ভেবে সন্দেহটা সঙ্গেসঙ্গেই মনে দাফন করে ফেলে।
*
বর্তমান~
গুলশান থানার বসে আছে তুহিন। চিন্তিত ভঙ্গিতে চুমুক দিচ্ছে চায়ের কাপে। দ্বিতীয়বার আমের ভিলাটা সার্চ করেও বিশেষ কিছুই পায়নি। কয়েকটা কাগজপত্র ছাড়া। ওগুলো রেখে দিয়েছে নিজের কাছে। একান্তে নিড়িবিলি সময়ে পড়ে দেখবে। আর একটা জিনিস খেয়াল করে দেখেছে ও। আমের ভিলা হঠাৎ ফাঁকা হয়নি। বরং ইচ্ছাকৃতভাবেই ত্যাগ করা হয়েছে। বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে সবাই। কিন্তু হঠাৎ কেন? আর কোথায় আছে ওরা? আর ঐ পাগল মহিলা কে ছিল? ওরকম হাড় হিম করা হাসি হেসে একা একাই কীসব বকতে বকতে চলে গেল। কিন্তু সেই মহিলার একটা কথা নাড়া দিল তুহিনকে। ‘খু’ন। খু’নের পর খু’ন হয়েছে। যাস না। তুইও খু’ন হবি।’ আমের ভিলার মধ্যকার কেউ যদি খু’ন হয়ে থাকে তার কারণ দুটো হতে পারে। এক, বিশ্বাসঘাতকতা। দুই, অন্য গ্রুপের টার্গেট হওয়া। দুটো কারণই ওর কেসের জন্যে জরুরী। বিশ্বাসঘাতক টা কে ছিল সেটা জানাই সবচেয়ে জরুরী। সেটা জানতে পারলেই হয়তো এই কেসের জট খুলবে। তাই ওখান থেকে সোজা থানায় চলে এসছে। কিছু তথ্য প্রয়োজন।
এরমধ্যেই আজিজ চলে এলেন। নিজের চেয়ারে বসে বললেন, ‘সরি স্যার। অপেক্ষা করতে হল আপনাকে। বলুন। কিছু জানতে পারলেন?’
আজিজের প্রশ্নের উত্তর দিলোনা তুহিন। কাপটা নামিয়ে রেখে বলল, ‘আমের ভিলাতে ঠিক কতগুলো খু’ন হয়েছিল? যেগুলো আমি জানি ওগুলো বাদে।’
কয়েক সেকেন্ডের জন্যে থমকে গেলেন ইন্সপেক্টর। তারপর বললেন, ‘এমনিতে যেসব মার্ডার হতো সেগুলো কোনভাবে সোলার সিস্টেমের সঙ্গে যুক্ত হলেও আমের ভিলায় বা বাড়িতে হতোন। কিন্তু প্রথমবার এটা হয়েছিল সেদিন।’
‘কোনদিন?’
‘রুদ্র আর প্রিয়তার বিয়ের দিন।’
‘রুদ্র তাহলে প্রিয়তাকেই বিয়ে করেছিল! বাট, খু’নটা কার হলো?’
‘ওদের এক মেইড সার্ভেন্টের।’
তুহিন ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘ মেইডকে মেরে কার কী লাভ?’
‘কারণটা বের করতে পারিনি। তবে এইটুকু নিশ্চিত যে উদ্দেশ্য ঐ মহিলাকে মারা ছিলোনা। কোন কারণে মারতে হয়েছে।’
‘খু’নি কে সেটা বের করতে পেরেছিলেন?’
‘ হ্যাঁ।’
‘ তাহলে কারণটা বের করতে পারলেন না কেন?’
মৃদু হাসলেন আজিজ। তুহিনকে অপেক্ষা করতে বলে উঠে গেলেন। প্রায় পনেরো মিনিট পর ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে ফিরে এলেন একটা পুরোনো ফাইল নিয়ে। সেটা তুহিনের সামনে রেখে বললেন, ‘পড়ে দেখুন।’
তুহিন কথা না বাড়িয়ে ফাইলটা খুলে বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়ল। পড়ে নিজেই চমকে উঠল। বুঝতে পারল এই জাল ভয়ংকর জাল। এই জাল কেটে বের হতে ওকে খাটতে হবে। আরও অনেক খাটতে হবে।
#চলবে…