#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
শান্তা শ্যামার রুমে আসে।শ্যামা তখন মাত্র ফিরোজের সাথে কথা বলেছে।তার চোখেমুখে তখনো হাসির রেশ লেগে আছে।সে কলেজে যাবে বিধায় রেডি হচ্ছে।শান্তা বললো,
“তুই প্রেম করিসনা শতবার বললেও আমি বিশ্বাস করি না।”
হঠাৎ করে ভাবীর মুখে এমন কথা শুনে শ্যামা থমকে যায়।মাথা ঘুরিয়ে সতর্ক চোখে শান্তাকে দেখে বললো,
“কেনো কেনো?তোমার ধারণা এমন কেনো?”
“আমার ধারনা শুধু এটা না আমার ধারণা তোর বয়ফ্রেন্ডই বিয়েটা ভেঙ্গেছে।মাহিন কে যতোটুকু দেখেছি আমার তো একবারও মনে হয়নি অপছন্দ হয়েছে।বরং পারলে তখনই বিয়ে করে ফেলতো।”
শ্যামা শান্তার কথাটা নিয়ে ভাবে।তাহলে কি বিয়ে ভাঙ্গার পেছনে ফিরোজের হাত আছে?শ্যামা মনে মনে নিজেকে গাধা বলে অজস্র গালাগালি দিলো।এই সামান্য ব্যাপারটা এতোক্ষণ কেনো তার মাথায় আসেনি?ফিরোজ যে তার পাখিকে ছাড়বেনা এটা তার ভাবা উচিৎ ছিলো,আর সে কিনা ঢ্যাং ঢ্যাং করে এই সুখবরই ফিরোজকে দিতে গিয়েছে যে কিনা মূল কারিগর!
মনে মনে সে নিজে হাজারগুন অবাক হলেও শান্তার সামনে তা প্রকাশ করেনা,মুখে হাজারো মেঘের ভীড় জমিয়ে বললো,
“ফালতু কথা বলো না তো।”
“আমি প্রমাণ করে দেবো।দেখিস।”
শ্যামা ঠোঁট উল্টে বললো,
“কিছু থাকলে তো প্রমাণ হবে।”
“আচ্ছা!তাহলে রাতে ফুসুরফাসুর করে কার সাথে কথা বলিস?”
“কথা বলিনা।আমি রাতে পড়ি।রাতে পড়লে আমার মুখস্ত হয় বেশী।”
শান্তা আর কিছু বলার আগে শ্যামা ব্যাগ কাধে নিয়ে বেরিয়ে যায়।যাওয়ার আগে বললো,
“এতো চিন্তা করো না।আমি এমন কিছু করিনা।”
শান্তা শ্যামার যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে।তার সন্দেহের বীজ আরো শক্ত হয়ে গেথে যায়।
শ্যামা ফারিয়াকে বিয়ে ভাঙ্গার কথাটা বলাতে ফারিয়া খুব মন খারাপ করে।আফসোস করে বললো,
“থাক মন খারাপ করিসনা।দেখবি আরো ভালো কোথাও বিয়ে হবে।”
শ্যামা হাসে।ফারিয়ার দিকে তাকায়।ফারিয়ার ফোন এসেছে।হবু বরের সাথে কথা বলতে বলতে ফারিয়া মুচকি হাসছে।শ্যামা লক্ষ করেছে আজকাল ফারিয়ার চেহারার উজ্জ্বলতা যেনো অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।এই মেয়েটা তার ভালো বিয়ের প্রত্যাশা করছে যদি জানতে পারে তারই বড়ো ভাইয়ের সাথেই মধুর প্রণয়ে জড়িয়ে আছে তাহলে?ফারিয়া বোধহয় খুব রেগে যাবে।আগে শ্যামা ফারিয়ার সাথে ততোটা মিল মোহাব্বত ছিলো না কিন্তু একদিন ঘামে ভেজা রাগী ফিরোজকে দেখেই স্কুলে পড়ুয়া শ্যামার মনে বসন্ত এসে দোলা দিয়ে যায়।মনের গোপন কুঠুরিতে কোকিল মধুর স্বরে কুহু কুহু ডেকে যায়।শ্যামা কোকিলের না বলা কথাটা যেনো বুঝতে পারলো,কম্পনরত বুক নিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে ফিরোজকে দেখে কোকিলের কথাটা বুঝলো,ফিরোজকে তার রাজা বানানোর তীব্র ইচ্ছা মাথায় চাপলো।ভ,য় পেয়ে কাছে না গেলেও দূর থেকে ফিরোজকে গোগ্রাসে গিলে নিতো।ফিরোজের কাছে যাওয়ার বাহানায়ই ফারিয়ার সাথে বান্ধুবীর সম্পর্ক গড়ে তুলা।ফারিয়া তুখোর ছাত্রী।শ্যামা ততোটা ভালো ছাত্রী না হলেও মন দিয়ে পড়ে লেখাপড়ায় উন্নতি ঘটায়,ফারিয়ার সাথে শক্ত করে সম্পর্ক করে,আর এখন ফারিয়া তার প্রাণের বান্ধুবী।আর মাত্র তিনদিন পরেই ফারিয়ার বিয়ে।ফারিয়ার অনুরোধ হলো বিয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শ্যামাকে ফারিয়াদের বাড়িতে থাকতে হবে।কিন্তু দুজনেই চিন্তিত্ব এটা ভেবে যে সেদিন রিপনের সাথে ফিরোজের এতো বড়ো মনমালিন্য হয়ে গেলো এখন কি শ্যামাকে আসতে দেবে?ফারিয়া যে কোনো ভাবেই হোক শ্যামাকে তার কাছে রাখবে।সারাদিন কলেজ করে শ্যামা যখন বাড়ি আসে তখনো বাড়ির পরিবেশ থমথমে।মনে হচ্ছে বিয়ে ভাঙ্গেনি এর চেয়েও ভ’য়াবহ কোনো কিছু ঘটে গেছে।সে মাথা না ঘামিয়ে রুমে গিয়ে ফিরোজকে ফোন দেয়।ফিরোজ ফোন রিসিভ করলে শ্যামা সোজা প্রশ্ন করে,
“আপনিই বিয়েটা ভেঙ্গছেন তাই না?”
ফিরোজ মুচকি হাসে।তার পাখিটা এতোক্ষণে এইব্যাপারটা ধরতে পারলো?সে বললো,
“তুমি কিভাবে ভাবলে আমার শ্যামা পাখিকে আরেকজন নিয়ে যাবে এটা এই ফিরোজ মানবে?এই ফিরোজ!”
শ্যামা হেসে বললো,
“এতো ভাব নিয়েন না।আজকে নেয় নি তো কি হয়েছে যেকোনো দিন নিয়ে যাবে।”
“গায়ের একফোঁটা র,ক্ত অবশিষ্ট থাকতে তা সম্ভব না।”
শ্যামা ভ,য়ার্থ কন্ঠে বললো,
“যদি আব্বা অথবা ভাইয়া যদি জানতে পারে আপনিই বিয়ে ভেঙ্গেছেন তো আমাকে একদম মে’রে ফেলবে।”
ফিরোজ হেসে বললো,
“কেউ জানতে পারবেনা।এতো ভ,য় পেওনা।”
“কিভাবে করলেন এটা।”
“খুবই সহয কাজ।ব্যাটাতো আমাকে দেখেই ম্যাও ম্যাও শুরু করেছে।”
“যদি কাউকে বলে দেয় তাহলে কিন্তু ভালো হবেনা।আমি আরো বেশী বিপদে পড়বো।”
“বললে কি হবে তা ওই ছেলে ভালো করেই জানে।তুমি এতো চিন্তা করোনা।”
“আমি কেনো চিন্তা করি আমাকে হারালে বুঝবেন।”
ফিরোজ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে এই প্রথবারের মতো অসহায় গলায় বললো,
“আমি তোমাক ছাড়া নিজেকে ভাবতে পারিনা শ্যামা।তুমি আমাকে ছেড়ে যেওনা।”
ফিরোজের এমন বিমর্ষ গলা শুনে শ্যামার মন কেমনতর নাম না জানা ব্যাথার চিড়বিড়িয়ে উঠে।ফিসফিস করে আশ্বাস দেয়া গলায় বললো,
“আমি কখনো ছেড়ে যাবোনা।আমি আমার কাছে খুব দামী।”
“ভালোবাসি।”
শ্যামা ফিসফিস করে বললো,
“ইশ!এতো ভালোবাসেন কেনো?”
“জানিনা।এমন মিষ্টি পাখিকে বোধহয় ভালোবাসারই কথা।”
শ্যামা সুখের আবেশ নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।সারারাত ভর ফিরোজকে নিয়ে স্বপ্নে মজে থাকে।
পাশের বাড়ির মালেক মিয়ার মেয়ে রুবি এক ছেলের সাথে প্রেম করে।সবার ভাষ্যমতে ছেলেটা চুড়ান্ত বেয়াদব।রুবি ভালো ছাত্রী কিন্তু কিভাবে যেনো এই চালচুলোহীন ছেলের ক্ষপ্পড়ে পড়ে গেছে।মালেক মিয়া রুবিকে প্রথমে বুঝিয়েছেন কিন্তু কোনোভাবেই যখন মেয়ের মন ফিরাতে পারছিলো না তখন আরো কঠিন হয়েছে রুবি এসবের তোয়াক্কা করেনি সব বাধা ডিঙ্গিয়ে সে পালিয়ে গেছে।মালেক মিয়া মেয়ের এই স্বার্থপরের মতো কাজটা মানতে পারেনি আশেপাশের মানুষের কটু কথা শুনে আত্মহ,ত্যার চেষ্টা করেছেন।ভাগ্যভালো বিধায় এইবারের যাত্রায় বেঁচে ফিরেছেন।শ্যামার আম্মা ফাতেমা বেগম উনাকে দেখে আসলেন।সবাই বারান্দায় বসে মুড়িমাখা খাচ্ছিলো উনি সবার সাথে এসে খেতে বসে।খাওয়ার এক পর্যায়ে আক্ষেপ করে বললো,
“বাবা মা এতো কষ্ট করে ছেলে মেয়ে বড়ো করে কি এভাবে নাক কান কাটার জন্য?”
স্বপ্নন ইসলাম স্ত্রী দিকে তাকিয়ে বললো,
“সব মেয়ে কি এক নাকি?কিছু বেয়াদব আছে এমন।”
ফাতেমা বেগম মেয়ের দিকে একপলক তাকায়,
“কিভাবে বুঝবো?রুবি যে কেমন মেয়ে ছিলো তা কি আমাদের অজানা।ওই যেহেতু এতো নোংরা একটা কাজ করতে পেরেছে আর কি বলবো বলো।”
রিপন সায় দিয়ে বললো,
“খারাপ ছেলেদের পাল্লায় পড়লেই শেষ।তাছাড়া আজকাল গ্রামে এই মাতাল ছেলেদের আনাগোনা বেশী।”
“বাবা মা কতো কষ্ট করে ছেলে মেয়ে বড়ো করে তাদের কি উচিত না বাবা মায়ের সম্মান রেখে চলা?”
স্বপন ইসলাম শ্যামার মাথায় হাত ভুলিয়ে বললো,
“ছেলেকে তো বিয়ে সম্মানমতো বিয়ে করাতে পারলাম এখন আমার আম্মারে একটা রাজপুত্রর কাছে তুলে দিতে পারলেই হয়।”
রিপন বোনের দিকে তাকিয়ে বললো,
“দেখো তোমার মেয়েও কোনো নেশাখোরের পাল্লায় পড়েছে কিনা।”
স্বপন ইসলাম হতাশার গলায় বললো,
“এমন হলে মালেক মিয়ার মতো জানে বাঁচার আশা থাকবে না,আমি তখনি ম,রে যাবো।”
শ্যামার মাথায় হাত ভুলিয়ে বললো,
“এমন করবা নাকি আম্মা?”
শ্যামার বুকটা ধক করে উঠে অচেনা ভয়ে মনটা চিরবিরিয়ে উঠে।বাবার উজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হয় তারা এতোকষ্ট করে তাকে বড়ো করছে আর সে কিনা প্রেম করছে? হঠাৎ করেই শ্যামা নিজেকে নিজে ঘৃণা করলো,তার আব্বার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“না।”
মেয়ের মুখ থেকে এমন সুন্দর উত্তর শুনে স্বপন ইসলাম হইহই করে বললো,
“আমি জানি আমার আম্মা আমার সম্মান রাখবে।”
পরম আদরে স্বপন ইসলাম শ্যামাকে বুকে জড়িয়ে নেয়।আবেগে আপ্লুত হয়ে উনি কান্না করে দেয়।আর বিরবির করে বলে,
“মা রে আমার সম্মান রাখিস।মেয়েদের এই কাজটা যে বাবা মায়ের জন্য কতোটা কষ্টের তা বুঝানো যাবে না।”
কি থেকে কি হয়ে গেলো।হঠাৎ উনার কান্নায় পরিবেশ ভারী হয়ে যায়,এমন কাজে সবাই হতভম্ব।শ্যামা উঠে তার রুমে চলে যায়।বিছানায় শুয়ে ফুপিয়ে কাঁদে।এমন করে সে কখনো ভাবেনি,বাবা মায়ের কথা সে কখনোই ভাবেনি।কাঁদতে কাঁদতে এক পর্যায়ে সে সিদ্ধান্ত নেয়,হাত বাড়িয়ে ফোনটা এনে ফিরোজকে ফোন দেয়।ফোন রিসিভ হলে দম আটকে বললো,
“আমি আপনার সাথে আর কোনো সম্পর্ক রাখতে পারবো না।”
চলবে……
(অসুস্থতা,ঈদের ঝামেলা সব কিছু কাটিয়ে ফিরে এলাম।জানি খুব বেশী লেট করে ফেলেছি।দুঃখিত।)