#ফিজা_সিদ্দিকী
#পর্ব_৫(কেনো উড়তে দিলে!)
#বোনাস_পর্ব
“বিয়ের কথা তবে আজ পাকাপাকি করে নেওয়া যাক!”
বাবার কথা শুনে চমকায় নম্রমিতা। হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে বাবার দিকে। নম্রমিতার কাছে বাবা হল এমন একজন মানুষ, যার কথার পিঠে কোন কথা বলা যায় না। যাকে ঘিরে অভিযোগ সাজে না। মেয়ে বলে বাবা তাকে কখনো পরাধীনতার শিকলে বাঁধেননি। বরং একটু বেশি ছাড় দিয়েছেন। মুক্ত পাখির ন্যায় ওড়ার সাথে সাথে তাকে বাজপাখি হতে শিখিয়েছেন। সেই সময় সুউচ্চ আকাশে ওড়ার আনন্দে নম্রমিতা বাজপাখি হতেই বেশি পছন্দ করেছিল। নরম নয় বরং গরম আর কঠোর তার স্বভাব। অন্যায়ের কাছে আপোষ করতে না শেখা মেয়ে, আজ হুট করে মেনে নিতে পারছে না বাবার অরাজকতা। বিয়ে তো তার। বাবা কি পারত না একবারও তার পছন্দের কথা জিজ্ঞাসা করতে! পারত না কাছে টেনে তার মতামত জিজ্ঞাসা করতে! ভাবনার মাঝেই নম্রমিতার কোমল হাতে টান পড়ে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আদিল একটা স্বর্ণের আংটি পরিয়ে দেয় নম্রমিতার হাতে।
হতবিহ্বল দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে নম্রমিতা নিজের বাম হাতের অনামিকা আঙ্গুলের দিকে। সঙ্গত কিছু কারণে মনে করা হয় বাঁ হাতের অনামিকা আঙ্গুল সরাসরি হৃদপিন্ডের সাথে যুক্ত। যার কারণে এর নাম দেওয়া হয় ‘ভেনা আমোরিস’ বা ‘ভালোবাসার ধমনি’। অর্থাৎ প্রেমের শিরা অনামিকা হতে হৃৎপিণ্ড পৌঁছেছে। অথচ প্রেম তো দূর ঘৃণা হচ্ছে নম্রমিতার আদিলের প্রতি। ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে আদিলের স্বার্থপরতাকে। তার মনে অন্য কারো আনাগোনা শুনেও এই লোকটা কিভাবে বিয়ে করতে চায় তাকে! সামান্যতম পৌরুষত্ব অবশিষ্ট থাকলে এমনটা কখনোই করতোনা। মনে মনে আদিলকে কাপুরুষ বলে আখ্যায়িত করে নম্রমিতা।
৫.
বাবার রুমের সামনে দাড়িয়ে আছে নম্রমিতা। সাহসী নীডর মেয়েটা বাবাকে ভীষণ শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে। বাবার রুমের সামনে বার কয়েক পায়চারি করে নিজেকে ধাতস্থ করলো সে।
“বাবা, আসবো!”
“আরে নম্র মা যে! আয় আয়।”
বাবার আদুরে আমন্ত্রণে গোছানো কথাগুলোও অগোছালো হয়ে যাচ্ছে নম্রমিতার। গলা শুকিয়ে কাঠকাঠ। বাবার পাশে বিছানায় বসে নম্রমিতা। উশখুশ করে এদিকে ওদিকে তাকিয়ে কথা শুরু করার উপায় খুঁজছে সে। রায়হান সাহেব বোধহয় বুঝলেন মেয়ের মতিগতি। ভরসার হাত রাখলেন মেয়ের মাথায়। ইশারায় জিজ্ঞেস করলেন কি ব্যাপার! নম্রমিতা ঢোক গিলে গলা ভেজালো। জিভ দিয়ে ঠোঁটও ভিজিয়ে নিল খানিকটা। অতঃপর নরম কণ্ঠে বলে উঠলো,
“এখন বিয়ে করতে চাইনা বাবা।”
মেয়ের কথায় হাসলেন রায়হান সাহেব। মনে মনে ধরনা করলেন, মেয়ে নার্ভাস।
“ওরা ভীষণ ভালো নম্র। আদিল নামের ছেলেটাকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। বাবা তোর জন্য আজ পর্যন্ত কখনও কিছু ভুল ডিসিশন নেয়নি। আগেও নেবেনা।”
“বিয়ে তো আমি করবো বাবা। সেখানে কি আমার পছন্দের কোনো দাম নেই?”
চমকান রায়হান সাহেব। এতবছরে যে মেয়ে কখনও বাবার সিদ্ধান্তের বাইরে কোনো কথা বলেনি, আজ সে নিজের মতামত জারি করার উপর জোর দিচ্ছে! কোন কলেজ ভর্তি থেকে শুরু করে কোন জামা পরে বাহিরে যাবে সবটাই বাবার দায়িত্বে ছেড়ে দেওয়া মেয়েটা আজ হুট করেই কেমন যেনো পাল্টে গেলো! তবে কি তিনি ভুল করেছেন! তিনি ভুল করেছেন তার সিদ্ধান্তটাই নম্রমিতার সিদ্ধান্ত ভেবে! নাকি ভুল করেছেন নম্রমিতাকে ডানা ঝাপটে ওড়ার সুযোগ করে দিয়ে!
“তুমি যা বলতে এসেছ স্পষ্ট করে বলো।”
বাবার গম্ভীর কণ্ঠ শুনে বুক ধড়ফড় করে উঠছে নম্রমিতার। দুইদিন আগেই আদিলের পরিবার বিয়ের দিন পাকা করে গেছে। আগামী মাসের প্রথম দিকে বিয়ে ঠিক করা হয়েছে। রাফিদকে এ বিষয়ে এখনো কিছু জানায়নি নম্রমিতা। রাফিদ জানলে নিশ্চয়ই কেলেঙ্কারি কান্ড বাঁধিয়ে ফেলবে। এই ছেলেকে দিয়ে বিশ্বাস নেই। দুনিয়ার সকল প্রকার পাগলামি সে করতে পারে শুধুমাত্র নম্রমিতার জন্য। নম্রমিতাও কম ভালোবাসেনা তাকে। তবে নম্রর ভালোবাসা গভীর আর প্রকাশ কম। ভারী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে নম্রমিতা। বিয়ের আর মাত্র পনেরো দিন বাকি। এই মুহূর্তে বাবাকে না বললে আর কখনো বলা হবেনা। আদিলের সাথে বিয়েটা ভাঙ্গার সময় এখনও আছে। নয়তো কি মুখ দেখাবে সে রাফিদের সামনে! নিজের সাথে সাথে রাফিদের জীবনটাও যে শেষ হয়ে যাবে।
“একবারও কি আমার মতামত জানতে চাওয়া যেতনা বাবা! পারতেনা একবার আমার পছন্দের কথা জিজ্ঞাসা করতে!”
“তোমার পছন্দ! নম্র তুমি বোধহয় ভুলে যাচ্ছ, কলেজে কি ধরনের পোশাক পরে যাবে সেটাও তুমি আমার সিদ্ধান্তেই চলো। ওয়েস্টার্ন পছন্দ করা সত্ত্বেও আমার পছন্দ মেনে নিয়ে বাঙালিয়ানা পোশাক পরো তুমি। তবে আলাদা করে তোমার পছন্দ জিজ্ঞাসা করার কি কোনো মানে আছে?”
“আছে বাবা। এটা কোনো পোশাকের বিষয় নয়, যেটা পছন্দ না হলে আলমারিতে ফেলে রাখা যাবে। এটা আমার জীবনের প্রশ্ন। যে মানুষটার সাথে আমি জীবনের অধিকাংশ সময় পার করবো, সেই জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার অধিকার কি আমার নেই?”
“না নেই।”
“বাবা! তোমার খুশির জন্য আমি ওয়েস্টার্ন স্যাক্রিফাইস করেছি বলে নিজের ভবিষ্যৎও স্যাক্রিফাইস করবো, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। এই বিয়ে আমি করবোনা।”
“কারণ!”
“আমি কাউকে ভালোবাসি। আর তাকেই বিয়ে করতে চাই।”
“ওড়ার জন্য ডানা যেমন আমি দিয়েছি, সময়সাপেক্ষে সেই ডানা ছেটে ফেলার ক্ষমতাও কিন্তু আমার আছে।”
রায়হান সাহেবের কণ্ঠ স্পষ্ট রাগের আভাস। কণ্ঠ গম্ভীরও বটে। বুক ছ্যাত করে ওঠে নম্রমিতার। বাবার এমন ব্যবহারে সে অভ্যস্ত নয়। ভরা পূর্ণিমার রাতের সমুদ্রের থৈ থৈ করে জলের ন্যায় টইটুম্বুর নম্রমিতার আঁখিকোটর। ক্লান্তিভরা কণ্ঠে বলে ওঠে,
“ডানা যদি ছেটে ফেলারই ছিলো, তবে উড়তে দিলে কেনো! প্রখর উচ্চতা থেকে ধুম করে নিচে ফেলার জন্য ছিলো বুঝি এ আয়োজন! বাবা, এমনটা না করলেও পারতে! চাইলেই পারতে একটা সুস্থ সুন্দর জীবন উপহার দিতে।”
আর একমুহুর্ত দাড়ালোনা নম্রমিতা। এক ছুটে নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো সে। হুট করেই এ কোন দোটানায় পড়লো সে! আদিল নামক মানুষ কেনো এলো তার জীবনে! কেনো গোছানো জীবনটা তছনছ করে দিলো! আর বাবা! বাবা কেনো এতটা বদলে গেলো! আদিলের সাথে তার বিয়ে দেওয়া ছাড়া এই দুনিয়ায় আর কোনো কাজ যেনো তার অবশিষ্ট নেই।
৬.
আদিলের সাথে একটা রেস্টুরেন্টে সামনাসামনি বসে আছে নম্রমিতা। মূলত সে নিজেই আদিলকে দেখা করার জন্য বলেছে। বর্তমানে আদিলই তার শেষ ভরসা। আদিল নিজেই বিয়েটা ভেঙে দিলে আর কোনো সমস্যা হবেনা।
“হবু স্বামীকে দেখার জন্য বিয়ে পর্যন্ত তর সইছিলোনা বুঝি! এজন্যই এত জরুরি তলবে ডেকে পাঠানো!”
আদিলের লাগাম ছাড়া কথা শুনে বিরক্ত হয় নম্রমিতা। ভেতরে ভেতরে রাগের স্ফুলিঙ্গ আবির্ভূত হলেও, নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রাখে সে। কোনোভাবেই আদিলকে চটানো যাবেনা। নয়তো, শেষ আশাটাও ভেস্তে যাবে তার।
“আমাকে বিয়ে করে আপনার কি লাভ?”
“কোলবালিশ নিয়ে আর ঘুমাতে হবেনা। পাশে বউ থাকবে।”
“আই অ্যাম সিরিয়াস মিষ্টার আদিল আহসান।”
“আই অ্যাম আলসো, মাই হাফ ওয়াইফ।”
“কখনও কাউকে ভালোবেসেছেন?”
“নাহ প্রয়োজন পড়েনি। যখন যাকে চেয়েছি কিনে নিয়েছি।”
“মানে!”
“না মানে, যখন যে জিনিসটা পছন্দ হয়েছে কিনে নিয়েছি আরকি। তাই আলাদা করে ভালবাসার প্রয়োজন পড়েনি। তবে তুমি চাইলে বিয়ের পর ভালোবাসবো, একেবারে দিন রাত ভালোবাসবো।”
“আমি তাকে খুব ভালোবাসি আদিল। ভীষণভাবে আসক্ত আমি তারা প্রেমে। তিন বছরের সম্পর্ক আমাদের। তার মায়ায় এতটা বাজেভাবে জড়িত আমি, যে এ মায়াজাল ছেড়ে বেরোলেই আমার আত্মার মৃত্যু নিশ্চিত।”
“দেহ তো থাকবে। দেহ জীবিত থাকলে আত্মা একদিন ঠিকই দেহ খুঁজে নেবে। অপেক্ষা শুধু সময়ের।”
#চলবে!
যেহেতু বোনাস পর্ব তাই ছোটো হয়েছে কেউ বলবেন না। গতকাল অসুস্থ ছিলাম, তাই গল্প দিতে পারিনি। আজ রাতে আরো এক পর্ব দেবো ইন শা আল্লাহ। নাইস, নেক্সট কমেন্ট না করে গঠনমূলক মন্তব্য করার অনুরোধ রইল।