আমার সাথে আমার স্বামীর ঝগড়া কখনো জমে না। আমি নিতু । মফস্বলের একটা কলেজে পড়াই। আমার স্বামী রিয়াজ ইঞ্জিনিয়ার। সরকারি চাকুরে । আমাদের একমাত্র মেয়ে তুবাকে নিয়ে মফস্বলেই ছোট্ট কিচির মিচির সংসার । আমার শ্বশুর নেই। শাশুড়ি গ্রামেই থাকেন আমার দেবরের সাথে। ওনার এখানে ভালো লাগে না। তবে মাঝে মধ্যে বেড়াতে আসেন। উনি একটু অন্য রকম।
একবার আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছেন। তখনো আমার কলেজের চাকরিটা হয়নি।সকালে আমি ফ্রিজ থেকে মাছ বের করে রেখে মেয়েটাকে স্কুলে দিয়ে আসতে গেছি।
এসে মাছগুলো কুটে ধুয়ে রান্না করবো।
কিন্তু বাসায় এসে দেখি আম্মা মাছ কেঁটে ধুয়ে রেখেছেন। এমনকি সবজি, পেয়াজ, কাঁচামরিচ এগুলো ও কেঁটে রেখেছেন। আমি আম্মাকে বললাম, ” আপনি এগুলো কেন করতে গেলেন?”
আম্মা বললেন, ” তাতে কি হইছে? তুমি এখন এগুলা রান্ধো। তোমার হাতের রান্না মাশাআল্লাহ অনেক মজা”
আমি হেসে রান্না করতে গেলাম এক হৃদয় ভালো লাগা নিয়ে। আমার প্রতি ওনার এই স্নেহ বোধ আজকে নতুন নয়।
আমি ঢাকা শহরে বড় হওয়া মেয়ে। বিয়ে ঠিক হয় গ্রামে। রিয়াজের সাথে যখন বিয়ে ঠিক হয় তখন চিন্তায় তটস্থ ছিলাম। কি করে গ্রামে গিয়ে থাকবো। আর গ্রামতো গ্রাম বিদ্যুৎ পর্যন্ত ছিলো না। মোবাইল চার্জ করে আনা হতো বাজারে গিয়ে। লাকড়ির রান্না । এগুলো কিভাবে সামলাবো সেটাই ভেবে পাচ্ছিলাম ন।
কিন্তু বিয়ের পর আমার সমস্ত চিন্তা দূর হয়ে গেলো আমার শাশুড়ির কারণে। আমাকে উনি একদিনও রান্না করতে দেন নি । উনি বলতেন , ” তুমি শহরে মানুষ । লাকড়ি দিয়া রানতে পারবা না। ধোঁয়ায় তোমার অসুবিধা হবে। তাছাড়া কালিও লাগবে হাতে। আমি শাশুড়ি হইয়া তোমার অসুবিধা না দেখলে আর কে দেখবে কও?”
কিন্তু শাশুড়ি কাজ করবে আর আমি বসে থাকবো এটা মোটেও ভালো কথা নয়। তাছাড়া শহরের মেয়ে হলেও ছোট বেলা থেকেই আমার সাংসারিক কাজ করতে অনেক ভালো লাগে। তাই আমি রান্না না করলেও কাঁটা ধোয়ার কাজটা আমি এক প্রকার জোর করেই করতাম। তবে রান্নার হাড়ি গুলো আম্মা ধুতে দিতে চাইতেন না কালি লাগবে বলে। আমি জোর করেই এসব করতাম।
এসব নিয়ে গ্রামে বেশ সমালোচনাও হতো। একজন তো এও বলেছিলো , বউরে ভয় পায় এর জন্য এত সমীহ করে চলে। আম্মা এসব কথা গায়ে মাখতেন না। বলতেন, ” পরের কথায় ঘরের সুখ নষ্ট করতে নাই”।
এসব তো ওনার স্নেহের মামুলি পরিচয় দিলাম। এবার বলবো ওনার এমন একটা গুণের কথা যার কারণে আমার সংসারটা প্রকৃত সুখের সংসার হয়ে উঠেছিলো।
বিয়ের মাস ছয়েক পর স্বামীর সাথে একটা বিষয় নিয়ে কথা কাাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে সে উত্তেজিত হয়ে বেশে জোরে জোরে ধমক দিয়ে কথা বলতে থাকে । সে এতটাই জোরে চিৎকার করছিলো যে, আমি একেবারে হতভম্ভ হয়ে যাই। বাকরুদ্ধ হয়ে যাই।
এসময় আম্মা আমাদের ঘরে আসেন। এসে উনি আমার স্বামীকে বলেন, ” তোমাদের মধ্যে কি হইছে জানি না। জানতে চাইও না । যা হইছে দুইজনে মিল্ল্যা আপোসে মিটাইয়া ফালাও। আমি তোমারে শুধু একটা কথা বলি বউয়ের সাথে কোন সময় চিল্লাইয়্যা কথা বলবা না। খারাপ ব্যবহার করবা না। ঝগড়া করবা না। বউ হইলো সংসারের সৌন্দর্য। তোমার আচার ব্যবহারে যেনো সেই সৌন্দর্য নষ্ট না হয়” ।
এরপর রিয়াদে চুপ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর আমার সাথে মন্দ ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চায়। আমার মনে তখন আম্মার প্রতি শ্রদ্ধা আরো বেড়ে ।
এরপর যা বলছিলাম , আমাদের মধ্যে এই এতো গুলো বছরে সেই অর্থে কখনো ঝগড়া
হয়নি । মনোমালিন্য হয়েছে , দ্বিমত হয়েছে। দু চারটা কথা কাটাকাটি হয়েছে। তবে ও আর কখোনোই সেটাকে ঝগড়ার পর্যায়ে যেতে দেয় নি। আমি আর কি করি, একা একা তো আর ঝগড়া করা যায় না । তাই আমি ও চুপ হয়ে গেছি । আর এই অসম্ভব সুন্দর মনের মানুষটিকে মন থেকে শ্রদ্ধা করে গেছি।
মাঝে মাঝে মনে হয় আম্মাকে জড়িয়ে ধরে বলি, ” আম্মা সবাই কেন আপনার মত ভালো
হয় না?”
গল্পঃ আলোর পরশ মণি
লেখায়ঃ © জান্নাত আরা
৭ আগস্ট ২০২৩ ইং, ঢাকা।