#শারমিন আঁচল নিপা
আমার ভেতরটায় কেমন জানি বিষাদের সুর বেজে উঠছে। আপার কোনো অবৈধ সম্পর্ক আছে ভাবতেই কেমন যেন গা সিউরে উঠছে। আনহারি আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল
“অনন্যা তো অন্তঃসত্ত্বা ছিল তাই না? কিন্তু এ রিপোর্টে তো স্পষ্ট লেখা দীপক কখনও বাবা হতে পারবে না।”
আমার গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। শরীরটা কাঁপছে ভীষণ। অসাড় লাগছে একদম। ভাঙা গলায় জবাব দিলাম
“আপার পেটের বাচ্চা নষ্ট করেছিল। তবে আপার জীবনে দুলাভাই ছাড়া আর কেউ ছিল না। আপা কোনো খারাপ কাজে জড়িত ছিল এটা আমি মানতেই পারছি না। এ রিপোর্ট টা দেখার পর আমার ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে আপু৷ আমি নিজেকে সামলাতে পারছি না। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার। মনে হচ্ছে কোনো একটা পাথর আমার বুকে চেপে আছে।”
আনহারি আমার দিকে তাকাল। আমার চোখ বেয়ে সে সময়টায় পানি বাহিত হচ্ছিল। ভেতরের কষ্টটা চোখ বেয়ে জড়ছিল। আমার চোখ দুটো মুছে দিয়ে বলল
“হয় ময়না তদন্তের রিপোর্টে সমস্যা ছিল। নাহয় তোমার আপার সাথে এমন কিছু ঘটেছে যেটা আমাদের আড়ালে চলে যাচ্ছে।”
আমি এবার জোরে কেঁদে দিলাম। কাঁদতে কাঁদতেই বলে উঠলাম
“তাহলে কী আপা রেপের শিকার হয়েছে? আপার জীবনের আরও কষ্ট জানার বাকি আমাদের? আপার জীবনের কষ্টের দাবদাহ কি পরকালে কমেছে? শুনেছি আত্মহত্যা যারা করে তারা জান্নাত পায় না। তবে আল্লাহ যদি চান তার বান্দাকে ক্ষমা করবেন, তাহলে সে জান্নাত পাবে। আপাকে কী আল্লাহ জান্নাত দিয়েছে? আপা এত কষ্ট করে গেল দুনিয়ায়, পরকালে কী শান্তি পেয়েছে?”
আনহারি আমার কান্না আর কথা শুনে মুখ চেপে ধরে বলল
“আবেগে গা ভাসিও না। দেয়ালেরও কান আছে। চুপ থাকো প্লিজ। সব প্রশ্নের উত্তর সময় মতো পাওয়া যাবে। আপাতত নিজেকে সামলাও। তুমি ঘরে যাও। “
আমি ঘরে চলে আসলাম। তবে আমার মন থেকে বিষয়টিকে কোনোভাবেই সরাতে পারছি না। বারবার মনে হচ্ছে আপার কী তাহলে সত্যই চারিত্রিক কোনো সমস্যা ছিল? আমার চোখ বেয়ে অজোরে পানি বেয়েই চলেছে।
বাইরে আনহারি আনজুমানের স্বামীকে জটলা বলে সম্বোধন করে ডাকছে। নামটা বেশ ভালোই দিয়েছে। এখন থেকে নাহয় আনজুমানের স্বামীর সম্বোধন জটলা বলেই হবে। জটলা তড়িগড়ি করে আনহারির সামনে আসলো। আনহারি কোমরে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করল
“আমার পায়েস হয়েছে?”
আনহারির এ স্বভাবটাও বড়ো আপার মতো। আচ্ছা কোনোভাবে এমন তো নয় বারো বছর আগে যে মারা গেছে সে আনহারি। আর আনাহারি যেহেতু মর্ডান সুসাইটিতে জন্ম নিয়েছে তাই হয়তো কারও সাথে সম্পর্ক করে কনসিভ করেছিল আর সেটা এবরশনও করায়। হয়তো কোনোভাবে আনহারি আর অনন্যার মধ্যে উলট পালট হয়। আর এদিকে আনহারিকে অনন্যা ভেবে শত্রুপক্ষ খু’ন করে। আর অনন্যা বেঁচে যায়। আর অনন্যা সেখানে আনহারি হয়েই থেকে যায়।
এসব ভেবেও আমার ভাবনা আবার উল্টো মোড় নেয়। কারণ আনহারি অনন্যা হলে অন্তত আমাকে একটা বার হলেও বলত। আমাকে লুকিয়ে তার তো কোনো লাভ নেই। সকল প্রশ্ন, চিন্তা, রহস্য যেন আমাকে পাগল করে দিচ্ছে। চায়লেও আমি এগুলো থেকে বের হয়ে আসতে পারছি না। ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে আমার। গা টা বেশ গরম হয়ে গেছে মুহুর্তেই। জ্বর আসবে বলে মনে হচ্ছে।
এদিকে জটলা আনহারির কথা শুনে পায়েস নিয়ে আসলো। আর আনহারি জটলার পায়েস নিজে মুখে না দিয়ে জটলাকে বলল
“আমি তো মুখে পায়েস দিব না। তুই আগে দে। না জানি কী মিশিয়ে দিয়েছিস পায়েসে। আমি তো পরখ না করে খাব না।”
জটলা মুখ বাকিয়ে বলল
“রান্না করেছি এটাই অনেক। এখন আবার খেতে পারব না। খেলে খা, না খেলে না খা।”
আনহারি রেগে চটে গিয়ে বলল
“তুই খাবি না তোর ঘাড়ে খাবে। এ প্লেট এখন শেষ করবি। নাহয় পুলিশ এনে অভিযোগ দিব এ প্লেটে বিষ মিশিয়ে আমাকে খাওয়াতে চাচ্ছিস।”
জটলা একদম বেঁকে বসেছে যে খাবে না। সে এটা জেদ ধরেই করছে বুঝা যাচ্ছে৷ আনহারিও কম যায় না। অফিসার মাহিদকে আবার কল দিল। অফিসার মাহিদ আসবে শুনে আমার অস্থির মনটা একটু শান্ত হলো। একটু শীতলতা মনটায় স্পর্শ করে গেল।
জটলাকে সোফায় বসিয়ে রেখেছে। আনহারিও সোফায় বসে আছে। মিনেট বিশের মধ্যে অফিসার মাহিদ চলে আসলো। এসেই বেশ রসাত্মক সুরে বলল
“আমি তো আপনাদের পারিবারিক ড্রামায় পড়ে গেলাম। এত বার থানা থেকে এ বাসায় আসতে হচ্ছে কী আর বলব। এক কাজ করুন এ বাসায় আমাকে থাকার ব্যবস্থা করুন। আমি নহায় এ বাসায় থেকে আপনাদের পারিবারিক ড্রামা দেখি।”
অফিস মাহিদের কথা শুনে আমি একটু হাসলাম। এ মানুষটাকে দেখলে আমার ভীষণ আপন লাগে। মনে হয় আমার অস্থির মনটায় একটু সুখের ছন্দ হয়ে এ মানুষটায় আসতে পারে। আনহারি বেশ রেগে বলল
” এটা আপনার ডিউটি। দায়িত্ব তো আপনাকে পালন করতেই হবে। আর এই যে জটলা আমাকে বিষ খাইয়ে মারতে চায়ছে। তাই আপনাকে নিয়ে আসলাম।”
জটলা বেশ উচু গলায় বলল
“আমি একদম কিছু করিনি। এ মেয়েটা আমাকে ফাঁসাতে চাচ্ছে। আমাকে দিয়ে জোর করে পায়েস বানিয়েছে। এখন বলছে খেতে। যে সময় যাচ্ছে এখন পায়েস খাওয়ার রুচি আমার জাগছে না। এ জন্যই এত কাহিনি। আমি পায়েস বানিয়েছি আমাকে কেন খেতে হবে। তোর যদি সন্দেহ হয় তুই খাবি না। শুধু শুধু এত নাটকের তো দরকার নাই।”
অফিসার মাহিদের উপস্থিতিতে সবাই চলে আসলো ড্রইং রুমে। এবার আপার শ্বাশুড়ি রেগে গিয়ে বলল
“এই ডাইনিটা আসার পর থেকে জ্বালাচ্ছে। আমাদের জীবনটা খেতে এসেছে। জামাই বাবাজি পায়েস বানিয়ে দিয়েছে এটাই তো অনেক বড়ো বিষয়। অফিসার মাহিদ সাহেব একে দয়াকরে এ বাসা থেকে বের করার ব্যবস্থা করুন। টাকা পয়সা যা লাগে দিচ্ছি।”
অফিসার মাহিদ এবার একটু চটে গিয়ে বললেন
“আমি কী ঘুষ খাই নাকি? মুখ সামলে কথা বলুন। আইন যা বলে সেভাবেই কাজ করতে হবে। আর সবচেয়ে বড়ো কথা সন্দেহ এসেছে যেহেতু এত ঘুরিয় পেঁচিয়ে না নিয়ে একজন পায়েস খেলেই তো প্রমাণ হয়ে যায়। “
আপার শ্বাশুড়ি এবার রেগে গিয়েই পায়েসের বাটিটা নিয়ে কয়েক চামচ পায়েস খেয়ে নিল৷ তারপর গড়গড় করে বলল
“আমার কী কিছু হয়েছে? এ ডাইনি শুধু শুধু বদনাম করছে আমাদের।”
আমি প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলাম পায়েসে কিছু নেই। কারণ এত অল্প সময়ে পায়েসে কিছু মেশানোর মতো অবস্থায় তারা ছিল না৷ অফিসার মাহিদ এবার আনহারির দিকে তাকিয়ে বলল
“শুধু শুধু এসব ব্যাপারে পুলিশ কল দিবেন না। পুলিশের অনেক কাজ থাকে। আপনাদের পারিবারিক ড্রামা সব তে পুলিশ এসে মেটাবে না। স্বাভাবিক বিষয়গুলোকে এত বড়ো করবেন না।”
কথাগুলো শেষ করতেই আনহারি আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে আপার শ্বাশুড়িকে দেখাল। আপার শ্বাশুড়ি মাটিতে ঢলে পড়েছে। মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। জটলা এবার সেখানে আপার শ্বাশুড়ির কাছে গিয়ে চমকে গেল। জোর গলায় বলল
“এটা কী করে সম্ভব? আমি তো পায়েসে কিছু মেশায়নি। মেশালে তো আমি আম্মাকে খেতে দিতাম না। “
আনহারি এবার মাহিদের প্রশ্নের উত্তরে বলল
“আমি এমনি এমনি কাউকে ডাকি না যথেষ্ঠ কারণ ছাড়া। এবার প্রমাণ হলো তো?”
অফিসার মাহিদ জটলাকে জিজ্ঞেস করল
“আপনি যদি না মেশান আর কে মেশাতে পারে? পায়েসের বাটি রেখে কী কোথাও গিয়েছিলেন?”
“আমি এক নাগাড়ে দাঁড়িয়ে রান্না করে নিজ হাতে পায়েস নিয়ে আসি। কোথাও যাই নি। আমার হাতে বাটি রেখে পায়েসে কী কেউ কিছু মেশাতে পারবে। এ অনন্যা নয় এ অনন্যার ভূত। হয়তো ভূত হয়ে সে কিছু মিশিয়েছে।”
ধরাধরি করে আপার শ্বাশুড়িকে হাসপাতালে নেওয়া হলো। আর পায়েসটা নেওয়া হলো ল্যাবে টেস্ট করার জন্য।
আমি শুধু ভাবছিলাম হচ্ছেটা কী? সবকিছুর বাইরে কিছু একটা ঘটছে যেটা আমার চোখকেও আড়াল করে নিচ্ছে। কারণ আনহারি রান্না ঘরে এর মধ্যে যায়নি যে, পায়েসে কিছু মেশাবে। আর জটলার পক্ষেও এত তাড়াতাড়ি কিছু মেশানো সম্ভব নয়।
আমি ক্লান্ত মনে বসে আছি। প্রশ্নরা সব আমাকে ঘিরে ধরেছে। কখন যে সময় কেটে গেল বুঝতে পারিনি।
সকাল ১১ টা বাজে। হাসপাতাল থেকে খবর আসে আপার শ্বাশুড়ি কোমায় চলে গিয়েছে। আর ল্যাব থেকে যা খবর আসে তা শুনে আমি একদম চমকে উঠি। সত্যিই কী এটা সম্ভব?
কপি করা নিষেধ
শারমিন নিপা
শারমিন আক্তার