#চেম্বার কথন
পর্ব ৪১
রোগি দেখা শেষ। তবু বসে আছি। বাইরে নিম্নচাপ। ৫নং সতর্ক সংকেত পড়েছে। মেজাজটা খারাপ। বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করছে না।
যেই ছেলেটা রোগির সিরিয়াল দেয় তাকে ডেকে বললাম, ‘জয়নাল, রাততো বেশ হল! তুমি যেতে চাও?’
আমি জানি সে কি উত্তর দেবে তবুও তার মুখ থেকে শুনতে চাইলাম। নাইট স্কুল থেকে বিএ পাশ করে সকালে হাসপাতালে কাজ করে, আর বিকেলে আমার এখানে। কখনো রাত বেশি হলে চেম্বারেই থেকে যায়।
জয়নাল, ‘ম্যডাম চা খাবেন? আমি আজ বাসায় যাব না। খিচুড়ি বসাবো’।
আগ্রহ নিয়ে আমার দিকে তাকাল, ‘ম্যডাম খিচুড়ি খাবেন?’
আমি বললাম, ‘হুম’।
সামনে ফেসবুক খোলা, কেউ কেউ নক করছে, কিন্তু কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। ইউ টিউবে গান শুনছি।
জয়নাল চা রেখে বলল, ‘ম্যাডাম রুগি এসেছে’।
আমি বেশ বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘ধুর! আর সময় পেল না……পাঠাও’।
বাইরে অঝোরে বৃষ্টি। এক মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা ঢুকলেন।
সমস্যা হল শুচিবাই। এক মেঝে দিনে ১০ বার পরিষ্কার করেন। আগে বাসার লোকজন খালি পায়ে হাটলেও হত। এখন ওনার তাও অসহ্য লাগে। বাসায় ইউনিভারসিটি পড়ুয়া ২ ছেলেমেয়ে, শাশুড়ি, স্বামী, কাজের লোক। মহিলা বাড়ীর সবার উপর তো বটেই নিজেই নিজের উপর ও তিতিবিরক্ত।
ভদ্রমহিলা, ‘আগে আপনার কাছ থেকে হাতে পায়ের পানি ঘেটে ঘেটে যে হাজা হয়েছে তার ঔষধ নিতাম, এখন আর পারি না, ১০৫ ডিগ্রী জর নিয়েও আমি ঘর মুছি। আগে ঝুঁকে মুছতাম, এখন ডান্ডা দিয়ে মুছি। কি করি।।আমাকে বাচান…………………।’
বললাম, ‘বলুন মেঝেতে দাগ না থাকলে কি হয়?’
মহিলা, ‘আমি বেচে যাই’।
আমি হাসলাম, ‘বেশ, দাগগুলি কে করে?’
মহিলা, ‘বাসার সবাই, কিছুতেই শোনে না, আমার যে কি কস্ট হয়! কেউ আমাকে বুঝে না’।
আমি, ‘বেশ, কি করলে বাসায় দাগ থাকবে না?’
মহিলা একটু ভেবে বললেন, ‘কেউ বাসায় ঘুরাঘুরি না করলে’।
আমি, ‘কল্পনা করুন তো বাসায় কেউ নেই, আপনার কেমন লাগবে?
মহিলা অনেকক্ষন চুপ করে থেকে বললেন, ‘কেউ বাসায় ঘুরাঘুরি না করলে আমি শুন্য বাসায় থাকতে পারবো না’।
আমি, ‘যদি বলি দাগগুলি ঘুরাঘুরি থেকে হয়?’
মহিলা, ‘হয়ই তো!’ বলেই মহিলা আমার দিকে ঝট করে তাকালেন।
মৃদু হেসে বললাম, ‘কি ভাবছেন?’
ভদ্রমহিলা ঝিম মেরে থেকে একটু পরে বললেন, ‘দাগ মানেই মানুষ, মানুষ মানেই উষ্ণতা, দাগহীন মেঝে মানে মানুষহীন ঘর, মানুষহীন ঘর মনে নিঃসঙ্গতা, নিঃসঙ্গতা মানে মনুষ্য সম্পর্কহীন মানুষ, বেশ এই বার থেকে আমি প্রতি বার দাগের মাঝেই উষ্ণতা খুজবো’।
আমার মেজাজ খারাপ চট করে গায়েব হয়ে গেল, তাই তো মানুষ মানেই আন্তসম্পর্ক, আর আন্তঃসম্পর্কের জটিলতা মানে মেজাজ খারাপ। কিন্তু আমি একজন সম্পর্কহীন মানুষ হয়ে থাকতে পারব না। হাক দিলাম, ‘জয়নাল, আমার বাসায় চল, ড্রাইভারের ঘরে আজ থাকবে, বাসায় খিচুড়ী খাবো’।
পুনশ্চ:
* এখানে ওসিডি আলোচ্য নয়! আন্তঃসম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা আমাদের জন্য কতটুকু দরকার যেটা আপাতদৃষ্টিতে বিরক্তি করলেও বন্ধ হয়ে গেলে আমরা মনে করি নাই মামার থেকে কানা মামা ভাল।
*এটা বহু পুরানো লেখা। তখন সবে কাউন্সেলিং থেকে মোড় ঘুরিয়ে সাইকোথেরাপির গভীরে রসাস্বাদন শুরু করেছি।
অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া
চিকিৎসক, কাউন্সিলর, সাইকোথেরাপি প্র্যাকটিশনার