#গল্প___ফিরতি উপহার পর্ব ২
মনে হলো মা আমার কথায় গুরুত্ব দিলো না। আসলেই যে জনম বাঁকা সে কোনদিন শোধরাবে না। শুধু শুধু বৃথা চেষ্টা করে কোন লাভ নেই।
সাত ঘণ্টার রাস্তা পাড়ি দিয়ে বাসায় আসতে সকাল হয়ে গেলো। ভাবছি ঈদের দিন, এভাবে বাপের বাড়ি থেকে চলে আসতে হলো। (স্বামী) শাহিন জানলে কি ভাববে? সেও বাড়িতে গিয়েছে শাশুড়ির সঙ্গে ঈদ করার জন্য। কথা ছিল ঈদের দুদিন পর এসে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাবে।
সব ভাবনা চিন্তা বাদ দিয়ে তাড়াতাড়ি করে সেমাই পায়েস চুলায় বসিয়ে খিচুড়িটা রাইস কুকারে বসালাম। সকালের নাস্তা শেষ করে ভাই ভাবিকে বললাম এবার তোমরা একটু ঘুমিয়ে নাও ততক্ষণে আমি দুপুরে রান্নাটা বসিয়ে দেই।
ভাবী বললো লিজাআপা আমি হাতে হাতে একটু করে দেই। বললাম না তুমি ঘুমাও তোমার অনেকটা ধকল গেছে। ভাবি প্রথম থেকেই আমাকে লিজাআপা বলেই ডাকে। প্রথম প্রথম অনেকবার নিষেধ করেছি, আরে আমি তোমার বয়সে বড় হলেও তোমার স্বামীর তো ছোট। আমাকে নাম ধরে ডেকো আপা টাপা বলতে হবে না। না এতে তার ভালো লাগে।
শাহিন ফোন করেছে। বাচ্চারা বাবার সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় শেষে আমাকে দিল, আমি শাশুড়ি ননদ জা”দের সঙ্গে কথা শেষ করার পর শাহিন ফোনটা নিয়ে বললো আম্মাকে দাও সালাম দেই।
ভাবছি কি বলবো?
সত্যি বলবো না মিথ্যা বলবো? সত্যিটাই বলে দেই না হলে একটা সত্যে ঢাকতে যেয়ে হাজারটা মিথ্যা বলতে হবে।
বললাম আমি তো বাসায় চলে এসেছি, তারপর ঘটে যাওয়া ঘটনাটা খুলে বললাম। সে বললো ঠিক আছে আমি কালকে চলে আসতেছি বলে ফোনটা রেখে দিল।
দুপুরবেলা সবাই খাচ্ছি আর ভাইয়া বলতেছে মা কি করে এতো পাষান হলো রে? বললাম ভাইয়া এটা কি তোর কাছে নতুন মনে হচ্ছে, মা তো সারাজীবনই এরকম। আমাদের কপালটাই খারাপ রে। সবচেয়ে বেশি কষ্ট লাগতেছে একটা বিষয় ভেবে সেটা হলো মা এই পর্যন্ত একটিবারও ফোন দিল না। তাছাড়া মা তো রাস্তায় থাকাকালীন সময়ে ফোন দিয়ে বলতে পারতো তোরা যাস না, ফিরে আয়। আসলে আমাদের মা বরাবরই পাষান টাইপের, শুধু আমরা মায়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারিনা তাই।
ঈদের চার দিন পর,
ভাইয়া বললো আমি যাই একটা বাসা খুঁজে বের করি।
এরমধ্যেই শাহিন বললো ভাইয়া, আপাতত আপনার বাসা ঠিক করার কোন দরকার নেই। ভাবি আমাদের বাসায় থাকুক। কারণ মিরপুর থেকে গাজীপুর অনেক দূরের পথ লিজা সচরাচর যাওয়া-আসা করতে পারবে না। তাছাড়া ভাবির তো বোধহয় ডেলিভারির সময়ও বেশী নেই, এর মধ্যে একটা নতুন বাসায় যেয়ে কিভাবে কি করবে অসুস্থ মানুষটা।
আমি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম
আমিও এটাই চাইছিলাম কিন্তু সাহস করে মুখে বলতে পারছিলাম না। সেই কথাটা স্বামীর মুখ থেকে বের হওয়ায়, তার প্রতি আরো অনেক বেশি শ্রদ্ধা বেড়ে গেলো।
এমনিতেই সে আমাকে অনেক বোঝে।
কয়েকদিন পর ভাবিকে নিয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হলাম। ভাইয়া দুই তিনদিন পর পর আসে।
এবারও ছেলে হয়েছে ভাবির। তবে বাচ্চা পুষ্টিহীনতায় ভুগছে।বাচ্চার ওজন অনেক কম।।
ভাইয়া মাকে ফোন করে বলেছে মা আমার ছেলে হয়েছে।
মা খুশি হলো না, বেজার ও হলো না!
ভাবি একটু সুস্থ হলে ভাইয়া নতুন বাসায় নিয়ে গেল।
আমি মাঝে মাঝে যাই। আবার ভাইয়া ও ভাবিকে এসে রেখে যায়, এভাবে যাতায়াত চলে।
মাসখানেক পর,-মা তো কথা না বলে পারা যায় না। মা যখন কল দেয় শতচেষ্টা করে মনকে আঁটকে রাখা যায় না। আবার কথা বলা শুরু হয়। কিন্তু কথা বললেও সেইদিনের ব্যাপারে কোন ভুল স্বীকার করেনি মা। তখন মনকে সান্ত্বনা দিয়েছি মা তো সারাজীবনই এরকম যাকগে।
একদিন এক আত্মীয়ের মুখে শুনলাম শিলার স্বামী নাকি বিয়ে করেছে। তাই নিয়ে মা-মেয়ের মধ্যে গন্ডগোল হচ্ছে।
একজন আরেকজনকে দোষারোপ করছে।
মনে মনে ভাবলাম মার সঙ্গে তো কাল রাতেও কথা হলো। কই মা বলল না তো! মা শিলার বিষয়টা পুরোই এড়িয়ে গেছে আমার থেকে, কিছুই বললো না আমাকে! বললে যে আমি উচিত কথা শুনিয়ে দিতাম সেইটা উনার শুনতে ভালো লাগতো না, সেজন্য বলেনি।
লোকটা বিয়ে করবে বা না কেন? সারাবছর যদি বউ বাপের বাড়ি পড়ে থাকে, তাকে তো বিয়ে করতেই হবে।
ঘরে বয়স্ক মা আছে, ফসলআদি আছে, বিয়ে না করলে তার সংসারের হাল ধরবে কে।
তাছাড়া শিলার যেকোনো বিষয় উনি আড়াল করতে চায়! উনার নিয়ম টা এমন যে পৃথিবীর সবাই জানে জানুক, কিন্তু আমি যেন না জানি।
আরো অনেক কথা যেগুলো উনি আমাদের কারো কাছেই বলে না। মা মিসকল দিলেই আমি সবসময়ই কেঁটে দিয়ে ব্যাক করি। তারপর উনার সাথে আমার কথা হয় এরকম, জানিস আজকে আমাদের এখানে যে অ্যাক্সিডেন্ট হইছে না, আজকে অমুক জায়গায় বিশাল গন্ডগোল লাগছে, অমুকের বউ কি সুন্দর একটি বাচ্চা রেখে অন্যর সাথে চলে গেছে!
অসহ্য লাগলেও যতক্ষণ ভালো লাগে শুনে তারপর লাইনটা কেঁটে দেই। কার ভালো লাগে টাকা খরচ করে এসব হাবিজাবি কথা শুনতে?
শিলা এখন পার্মানেন্টলি আমাদের বাড়িতেই গেড়ে বসেছে।
তার ছেলেদের বাড়তি খরচ আছে সেগুলো দেবে কে? তার বাপ বলেছে এখানে থাকলে এক টাকাও দেবে না।
আর ভাইয়া যে বেতন পায় দুই বাচ্চা সংসার নিয়ে তারই হিমশিম খেতে হয়। তার দেওয়ার মতো অবস্থান নাই।
মেয়ে ও নাতিদের দায়ভার মা আমার উপরে চাপাতে চায়।
দেনায় নাকি জর্জরিত হয়ে গেছে।
কি করবো মা তো।
টুকটুক করে যে টাকাগুলো জমাই আর শাহিনের থেকে কিছু সেগুলো মাসে মাসে পাঠিয়ে দেই।
এভাবে চলতে থাকলো দিন মাস বছর।
***************।
চার-পাঁচ বছর পর,
মা শুধু বলে তোরা একবারেই আসিস না, নানুদের নিয়ে আয় ওরা একটু গ্রামের পরিবেশ দেখুক।
সেই যে ভাইয়ের সাথে আসছি আর যায়নি। মনটাও কেমন জ্বলে কতদিন যাইনা। সিদ্ধান্ত নিলাম বাচ্চাদের পরীক্ষা শেষ হলে এবার যাবো। ভাবি শুনে বললো আমিও যাব কিন্তু ভাইয়ার ধমকে ভাবি চুপসে গেল। ভাবীকে বললাম মা যেদিন তোমাকে আদর করে ঘরে নেবে তুমি সেদিন যাবা।
বাচ্চাদের পরীক্ষা শেষ হলে অনেক উৎফুল্লতা নিয়ে ছেলে মেয়েকে নিয়ে মায়ের কাছে গেলাম। বাড়ি তো না যেন জঙ্গলে এসেছি! বাচ্চাদের মন টিকছে না।
কোন কিছুই আর আগের মত নেই।
যাওয়ার ছয়দিনের দিন রাতে শিলার সাথে সামান্য কথা নিয়ে তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে ঝগড়া লেগে যায়।
ও আমাকে বকাঝকা করতে লাগলো। একটা বিশ্রী বকা দেওয়ায় আমি ওঁর গালে কষে এক থাপ্পর মারি।
ও থাপ্পরের প্রতিশোধ নিতে সে ধারালো দা নিয়ে আসে আমাকে কুপিয়ে জখম করার জন্য।
অবস্থা বেগতিক দেখে আমি চুপ করে খাটের উপর বসে থাকলাম। তবুও সে আমাকে দূর থেকে কোপ মারে। কয়েকবার কোপ ছাড়লেও আমার গায়ে লাগেনি, আমার ছেলে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে তাকে। তখন রাগে ও আমার ছেলেকে ও মারে। তখন আমার ছেলে কেঁদে উঠলো আম্মু চল আমরা এখানে আর থাকবো না।
রাত তখন দুইটা বাঁজে। বের হওয়ার কোন উপায় নেই গেটের চাবি মা হাতে ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বেরোতে দেবে না।
ভাবলাম এখান থেকে আমার বেঁচে ফিরতে হলে কারও সাহায্য নিতে হবে। কারণ আমার মা দাঁড়িয়ে, হেঁটে হেঁটে নীরব ভূমিকা পালন করছে, মেয়েকে কিছুই বলছে না! সম্ভবত মা এইটাকে সার্কাসের বিনোদন হিসেবে উপভোগ করছে।
ভাবছি এতো রাতে আমি কার সাহায্য নিব? তড়িঘড়ি করে ভাইয়াকে ফোন দেই, সাথে সাথেই ভাবি ফোনটা ধরে।
তারপর ভাইয়ার কাছে সবকিছু বলাতে ভাইয়া আমাদের থানায় যোগাযোগ করে।
পনের বিশ মিনিটের মধ্যে পুলিশ এসে হাজির হয় বাড়িতে।
তারা আমাকে বের করে আনে। তারপর ঘটনার বর্ণনা শুনে
পুলিশ মাকে বললো, আপনি মা হয় দুই চোখ করেন কেন? যে মেয়ে আপনার জন্য এত কিছু করে আপনার সংসার চালায় সেই মেয়েকেই মারার জন্য অন্য মেয়েকে উৎসাহিত করলেন কাজটা কি আপনি ঠিক করলেন?
দেখলাম মা আরো পুলিশের সঙ্গে আমার বিরুদ্ধাচার করতেছে। তখন পুলিশ বললো আপনার এখানে থাকা নিরাপদ নয় আপনি বরং আত্মীয়-স্বজন কাউকে ডাকেন আমরা তাঁর কাছে আপনাকে তুলে দিয়ে যাই। তখন আমি মামাকে ফোন করি কয়েকবার ফোন বাজার পরে মামা ফোন ধরলো। আসলে অনেক রাত তো সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।
তারপর মামা আসলে বাচ্চাদের নিয়ে মামার বাড়িতে চলে যাই। মামা বাড়ি যেয়ে বসতেই ফজরের আযান দেয়।
তারপর সকাল দশটার দিকে একটা গাড়ি ঠিক করে বাচ্চাদের নিয়ে চলে আসলাম।
যে উৎফুল্লতা নিয়ে গেলাম, ফিরে আসলাম একরাশ বেদনা অপমান আর যন্ত্রণা বুকে নিয়ে।
গাড়িতে বসে বসে ভাবতেছিলাম কেন তারা আমার প্রতি এতো ক্ষিপ্ত? আমি তাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করি এটাই আমার অপরাধ?
মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম এদের সাথে আর কোনদিন যোগাযোগ করবোনা। যেখানে অধিকার ফলিয়ে কথা বলা যায়না, শাসন করা যায় না তাদের সাথে কিসের সম্পর্ক? ছোট বোন আমাকে আঘাত করতে আসলো মা কিছু বললো না,এই যন্ত্রণাটা আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারতেছিলাম না।
এই ঘটনার পর আমার একটা কথাই বারবার মনে হচ্ছিলো,
বিধাতার দেওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার মা হলেও সব মা এক হয় না। আর মায়ের চোখে সব সন্তানরাও একরকম হয়না মায়ের চোখও ভিন্ন হয়।
পরে জানতে পারলাম শিলা ভাবিকে ও অনেকবার মেরেছে তখনো মা শীলা কে কিছু বলেনি।
অনেকদিন কারও সঙ্গে যোগাযোগ হয় না। সেদিন মামা ফোন করে বললো শিলার ছেলে নাকি শিলাকে মেরে নাক ফাটিয়ে দিছে, নাক দিয়ে অনেক ব্লাড বের হয়েছে। আর মা এসেছিল ঠেকাতে মাকেও ঘুষি মেরেছে। মা’র চোখের নিচে রক্ত জমাট হয়ে নীল হয়ে ফুলে আছে।
আমি যে এতে খুব খুশি হয়েছি তা কিন্তু না। শুধু মনে মনে বললাম এটা তোমার ফিরতি উপহার মা। সবে তো মাত্র শুরু আরো অনেক উপহার তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।
কিন্তু আফসোস তুমি কাউকে পাশে পাবে না।
শুরু করেছিলাম ভাবিকে নিয়ে,, আর শেষটা হলো আমাকে দিয়ে।
সমাপ্ত___।
((আমি জানিনা আমার লেখাটা কার কাছে কেমন লাগবে যেহেতু ফ্যাক্টর হলো মা”। ব্যক্তিগতভাবে একবার মনে হচ্ছে মা তো ভুল করতেই পারে, আরেকবার মনে হচ্ছে বারবার একই ভুল একজন মা কিভাবে করতে পারে সন্তানদের ক্ষেত্রে? যদিও মা সবার ঊর্ধ্বে”। মায়ের উপর কষ্ট পুষে রাখা ঠিক হবে কিনা জানিনা। আপনাদের মতামত অবশ্যই জানাবেন। তবে এই গল্পের কিছু কাহিনী কারো জীবন থেকে শুনেছি। ভুল ত্রুটি মার্জনীয়। ))
#Rozina ড়সে
চার আনার জীবন গল্পের লিংক
https://kobitor.com/category/uponas/four/
নীলার শাশুড়ী গল্পের লিংক
https://kobitor.com/category/uponas/nila/
ভাবির সংসার গল্পের লিংক