যেদিন তুমি এসেছিলে সিজন ২ পর্ব ৩৫
মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
________________
বৃষ্টির ফোটা ক্ষান্ত না হয়ে আরও বেশি অগ্রসর হচ্ছে। ধীরে ধীরে বৃষ্টি বাড়তে থাকে। অর্ষা নিশ্চল তেজি দৃষ্টিতে তোফায়েলের দিকে তাকিয়ে
রয়েছে। তার সর্বাঙ্গ রাগে থরথর করে কাঁপছে। তোফায়েল কুটিল হেসে বলে,
“তোমার এই তেজের জন্যই তোমাকে আমার এত ভালো লাগে।”
বৃষ্টিতে সম্পূর্ণ ভিজে গেছে তোফায়েল। চোখের পাতায় ভারী বর্ষণ বিন্দু আছড়ে পড়ছে বিধায় সে ঠিকমতো তাকাতেও পারছে না। মুখের ওপর থেকে পানি মুছে বলে,
“চলো বাকি কথা পরে বলব।”
“চলো মানে? কোথায় যাব?” অস্ফুটস্বরে বলল অর্ষা।
“আমার সাথে যাবে আমার বাসায়। তুমি তো ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে আছো। আমি এভাবে কতক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজব?”
“আপনাকে কে বলল বৃষ্টিতে ভিজতে? আমি আপনার সাথে কোথাও যাব না।”
“সবসময় জেদ করলে চলে বলো? কেন যাবে না?”
“কেন যাব? আশ্চর্য!”
“কথা বলব একান্তে তাই।”
অর্ষা অসহায়ের মতো আশেপাশে তাকায়। বৃষ্টির জন্য বাইরে মানুষজন তেমন নেই। কিন্তু যারাই বা আছে তারা কি কখনও তোফায়েলের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলতে পারবে? সবাই জানে তোফায়েলের বাবা ক্ষমতাশীল ব্যক্তি। কে-ই যেচে নিজের বিপদ ডেকে আনতে যাবে? অর্ষা মনে মনে ভয় পেলেও বাইরে সেটা প্রকাশ পেতে দিল না। সে পূর্বের তেজীয়ান স্বরে বলে উঠল,
“আপনার কথামতো আমি আপনার সঙ্গে চলে যাব এটা আপনি আশা করেন কীভাবে? আমি কোথাও যাব না।”
“যাবে। বাজারের মধ্যে জোরজবরদস্তি করি এটা চাও? দেখো, আমার কিন্তু কিছুই হবে না। মান-সম্মান গেলে তোমারই যাবে। তাই ভালোভাবে বলছি, আপোষে আমার সঙ্গে চলো।”
“বললাম তো যাব না।”
বলে অর্ষা পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়। নাছোড়বান্দা তোফায়েল এবার আর পথরোধ করে দাঁড়ায় না। অর্ষার হাত টেনে ধরে শক্ত করে। অর্ষাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সে হিরহির করে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে। ব্যথায় আর্তনাদ করে অর্ষা। বারংবার বলছে,
“আমার হাত ছাড়েন। কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?”
এবার আর তোফায়েল অর্ষার কথার কোনো প্রত্যুত্তর করল না। সে নির্বাক ভঙ্গিতে অর্ষাকে সিএনজি স্টেশনে এনে বলল,
“ওঠো!”
“আমি উঠব না!”
ছাতাটা টেনে নিয়ে নিচে ফেলে দিল তোফায়েল। অর্ষাকে জোরপূর্বক সিএনজিতে তুলে দিয়ে নিজেও একপাশে বসল। ড্রাইভারকে বলল,
“আমার বাড়িতে চলো।”
ভয়ে আর নিজেকে স্থির রাখতে পারছিল না অর্ষা। কতক্ষণ নিজেকে স্বাভাবিক দেখাতে পারবে সেটা সে নিজেও বুঝতে পারছে না। ফোন ভাইব্রেট হচ্ছে। নিশ্চয়ই আহনাফ ফোন করছে। চেয়েও সে ফোন রিসিভ করতে পারছে না। অন্তত তোফায়েল তো আর কথা বলার সেই সুযোগটুকু দেবে না। তার নিরবতা, চপলতা দুটোই তোফায়েল লক্ষ্য করে। হেলান দিয়ে বসে বলে,
“কী ভাবছ?”
অর্ষা মনে মনে সাহস সঞ্চয় করল। ভয়কে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বলল,
“আপনি কী চান? কেন এমন করছেন?”
“চাই তো আমি তোমাকে।”
“বুঝতে কেন চাইছেন না? আমি তো আপনাকে চাই না।”
তোফায়েল চুপ করে রইল। অর্ষা তাকে কনভিন্স করার জন্য শান্তকণ্ঠে বলল,
“দেখুন, আপনি হয়তো আমাকে পছন্দ করতে পারেন। অথবা ভালোও বাসতে পারেন। কিন্তু আপনার তো এটাও বুঝতে হবে যে, আমি তো আপনাকে ভালোবাসি না।”
তোফায়েল এবার ক্ষিপ্ত হয়ে অর্ষার গাল শক্ত করে চেপে ধরে বলে,
“তোর কী মনে হয় তোকে আর তোর ভাইকে আমি এত সহজেই ছেড়ে দিতাম? তোরে কিছু করতে না পারলেও তোর ভাইরে আমি এত সহজে ছাড়তাম না কখনও-ই। এখন সুযোগ যখন নিজে এসে ধরা দিয়েছে, তখন তোর ভাইয়ের বদলে তুই-ই আমার শিকার। আমি তোরে ভালোবাসি ভালো লাগে না? অন্য কারও বউ কেন হবি তুই?”
ব্যথায় অর্ষার দু’চোখ থেকে পানি বেরিয়ে যায়। তোফায়েল সেটা লক্ষ্য করে অর্ষাকে ছেড়ে দেয়। নরমস্বরে বলে,
“সরি, সরি সোনা! বেশি ব্যথা পেয়েছ? আসো। আদর করে দেই।”
অর্ষা একদম কিনারে গিয়ে বসে। তোফায়েল এগিয়ে গিয়ে অর্ষাকে কাছে টেনে আনার চেষ্টা করে। সে তার ওষ্ঠদ্বয় এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে অর্ষার মুখের দিকে। অর্ষা নানানভাবে তাকে আটকানোর চেষ্টা করছে। সেই মুহূর্তে সিএনজি থেমে যায়।
তোফায়েল বিরক্ত হয়ে ড্রাইভারকে সুধায়,
“কী হয়েছে?”
“বুঝতাছি না বাবা। মনে হয় তেল শেষ।”
তোফায়েল বিরক্তির সঙ্গে বলে উঠল,
“ধুর!”
এরপর ফের ড্রাইভারকে বলল,
“যাও একটা সিএনজি ডেকে আনো।”
অর্ষা খেয়াল করল, ড্রাইভার তোফায়েলের দিকের গেটের দরজা না খুলে অর্ষা যেই পাশে বসেছে, সেদিকের দরজা খুলেছে। লুকিং গ্লাসে তাকাতেই অর্ষার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যায়। তার দৃষ্টি ভীষণ করুণ। সচকিত হয়ে যায় অর্ষা। লোকটা কি তাকে সাহায্য করছে? হতেই পারে। বয়সে সে অর্ষার বাবার বয়সী-ই হবে। হয়তো প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করার সাহস নেই বলে পরোক্ষভাবে সাহায্য করছে। ড্রাইভার সিএনজি থেকে নামার সময় সামনের দরজা খোলার সাথে সাথে পেছনের দরজাটাও আলগোছে খুলে দেয়। তোফায়েল সেটা লক্ষ্য করেনি। সে অর্ষার চুলের ঘ্রাণ নিতে ব্যস্ত। ড্রাইভার নেমে যাওয়ার পূর্বে চোখ দ্বারা ইশারা করল অর্ষাকে। সেও সুযোগ পেয়ে আর সময় নষ্ট করল না। এক ধাক্কা দিয়ে তোফায়েলকে দূরে সরিয়ে সে সিএনজি থেকে নেমে দৌঁড়ানো শুরু করে। ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে যায় তোফায়েল। কী থেকে কী হলো বোঝার পূর্বেই সে নিজেও অর্ষার পিছু ধাওয়া শুরু করে।
শাড়ি পরে কাদাপানির মধ্যে দৌঁড়াতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে অর্ষাকে। তবুও সে প্রাণপণে দৌঁড়াচ্ছে। পেছন থেকে তোফায়েলের কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। সে বারবার চিৎকার করে থামতে বলছে। অর্ষা পায়ের গতি বাড়ায়। সোজা রাস্তা রেখে চিপা গলিতে ঢুকে পড়ে। এটা কোন জায়গা সেটাও সে চিনতে পারছে না। সামনে একের পর এক গলি। সে আন্দাজেই একটা একটা করে গলি পার হচ্ছে। পা আর চলতে চাইছে না। হাঁপিয়ে পড়েছে। এক জায়গায় স্থির হতে চাইছে। একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্য থামতেই অন্য গলির শেষপ্রান্তে তোফায়েলকে দেখতে পায়। তোফায়েল অবশ্য তাকে দেখেনি। থামার আর সুযোগ নেই অর্ষার। সে প্রাণপণে আবারও ছুটতে শুরু করেছে। কিছুদূর দৌঁড়ে এগিয়ে যাওয়ার পর হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে যায়। কাদায় মাখামাখি হয়ে যায় তার শাড়ি, হাত-পা। তারচেয়েও বেশি আঘাত পেয়েছে পায়ে। তার মনে হচ্ছিল এই বুঝি সে ম’রে যাবে। না চাইতেও সে কেঁদে ফেলে। ব্যথায় কাতরাচ্ছে। মনের ভেতর ভয়ও হচ্ছে। কখন না জানি আবার তোফায়েল এসে পড়ে। সে কোনো রকমে উঠে দাঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে সামনে একটা বাড়ির ভেতর ঢুকে যায়। দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়ে সেখানে। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে কাঁপা কাঁপা হাতে সে আহনাফের নাম্বারে ডায়াল করে। ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ করেই আহনাফ উদ্বিগ্ন হয়ে বলে ওঠে,
“কখন থেকে ফোন করছি। ফোন রিসিভ করছ না কেন?”
অর্ষা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। আহনাফের উদ্বিগ্নতা আরও বেড়ে যায়। সে ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কী হয়েছে অর্ষা? কাঁদছ কেন তুমি? এই? তুমি ঠিক আছো তো? কোথায় আছো তুমি?”
অর্ষা চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে ক্রন্দনরত স্বরে বলে,
“আমি জানিনা আমি কোথায় আছি। একটা বাড়ির ভেতর লুকিয়ে আছি এখন।”
“লুকিয়ে আছো মানে? কী হয়েছে?”
“রাস্তায় তোফায়েল….”
এতটুকু বলতেই তার কান্নার দমক বেড়ে যায়। আহনাফ ফের ব্যস্ত হয়ে বলে,
“আচ্ছা শোনো, আমার কথা ঠাণ্ডা মস্তিষ্কে শোনো, তুমি এখন যেখানে আছো সেখানেই থাকো। ফোনের লোকেশন অন রাখো। গুগল ম্যাপে গিয়ে একটা স্ক্রিনশট নিয়ে আমাকে হোয়াটসএপে পাঠাও। বুঝেছ? ভয় পাবে না একদম। আমি আসছি তোমার কাছে।”
অর্ষা কোনো প্রত্যুত্তর করে না। আহনাফ শীতল কণ্ঠে বলে,
“ডোন্ট বি এফ্রেইড মাই বাটারফ্লাই। আ’ম অলওয়েজ উইথ ইউ।”
অর্ষা এবারও কোনো উত্তর দিল না। সে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আহনাফ বলল,
“যা বলেছি তা তাড়াতাড়ি করো জান।”
অর্ষা কল কেটে আহনাফের কথামতো স্ক্রিনশট পাঠিয়ে দিল। আহনাফ হোয়াটসএপ চেক করে অর্ষাকে কল দিয়ে বলে,
“কল কাটবে না। আমি আসছি।”
অর্ষা ফোন হাতে নিয়ে হাঁটুর ওপর মাথা রেখে বসে আছে। ভেজা কাপড়ে প্রচণ্ড শীত করছে। তার ওপর এখনও সে বৃষ্টিতে ভিজছে। আহনাফ কখন আসবে? এর পূর্বেই আবার তোফায়েল এসে পড়বে না তো? সে ভয়ে ভয়ে অপেক্ষার প্রহর গুণছে আর আল্লাহ্-কে ডাকছে।
আহনাফের পৌঁছাতে প্রায় ত্রিশ মিনিট লেগে যায়। গাড়ি চিপাগলি দিয়ে ঢুকবে না বিধায় হাসিবকে গাড়িতে বসিয়ে সে একাই গলিতে ঢুকেছে। মাঝে মাঝে ফোনে আবার অর্ষাকেও বলছে, সে চলে এসেছে। ভয় পেতে বারণ করছে। আহনাফের সাদা শার্ট বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হয়ে গেছে। তার নিজের মনেও আশঙ্কা। অজানা কষ্ট হচ্ছে তার অর্ষার জন্য। একের পর এক গলি পাড়ি দিয়েও কাঙ্ক্ষিত বাড়ির গলিটা সে খুঁজে পাচ্ছে না। উদভ্রান্তের মতো এই গলি থেকে ঐ গলি, এই বাড়ি থেকে ঐ বাড়ি ঘুরে ঘুরে সে অর্ষাকে খুঁজছে। অবশেষে সে একটা বাড়ির ভেতর ঢুকে থমকে দাঁড়ায়। মুখ না দেখলেও জবুথবু হয়ে বসে বৃষ্টিতে ভেজা মেয়েটিকে চিনতে বেগ পেতে হয় না তাকে। ফোনটা পকেটে রেখে সে ধীরপায়ে এগিয়ে যায়। ক্ষীণস্বরে ডাকে,
“অর্ষা!”
অর্ষা চকিতে মাথা তুলে তাকায়। আহনাফকে দেখেই সে উঠে দাঁড়ায়। ঝড়ের বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ে আহনাফের বুকে। তার কান্নার গতি বেড়ে যায়। আষ্টেপৃষ্ঠে সে আহনাফকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে। আহনাফ তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“কাঁদে না জান! চলে এসেছি তো আমি।”
অর্ষার কান্না তবুও থামে না। হয়তো এতক্ষণ বাদে সে বিশ্বাসযোগ্য, ভরসার মানুষকে কাছে পেয়েছে তাই। আহনাফ আর কিছু না বলে শুধু শক্ত করে অর্ষাকে তার বাহুবন্ধনে আটকে রাখল।
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]