উইল ইউ ম্যারি মি? পর্ব ৯
রাতে প্রমথ সাহেব মেয়েদের জন্য বিরিয়ানী রান্না করেছিলেন। জেরিন আর প্রীতি দু’জনই বিরিয়ানী খুব পছন্দ করে। খাওয়া-দাওয়ার পর অনেক গল্প-গুজব হলো। তারপর প্রীতির সাথে জেরিন একইরুমে ঘুমাতে এলো। প্রীতি মোবাইল রেখে ওয়াশরুমে গেছে। জেরিন বিছানায় একা শুয়ে আছে। এমন সময় প্রীতির মোবাইলে একটা ম্যাসেজ এলো। জেরিন প্রীতিকে ডাকতে নিয়েও থেমে গেল। তার চোখ ফোনের স্ক্রিনে আটকে গেল। ম্যাসেজটা এসেছে একটা ছেলের নাম্বার থেকে। ছেলেটির নাম নওশাদ। ম্যাসেজে লেখা,” ম্যাডাম কি ঘুমিয়ে গেছেন?”
জেরিন ম্যাসেজটা দেখে চুপচাপ শুয়ে রইল। একটু পর প্রীতি ওয়াশরুম থেকে বের হলো। ফোন হাতে নিতেই দেখল নওশাদের ম্যাসেজ। একটু বিরক্ত লাগল। ছেলেটার কাজ হলো রাত হলেই ম্যাসেজ দেওয়া। প্রীতি খেয়েছে কি খায়নি, ঘুমিয়েছে কি ঘুমায়নি এইসব জেনে ওর কি কাজ? নেহায়েত প্রীতির জীবনে খুব বড় একটা সাহায্য করেছিল নওশাদ। তাই প্রীতি কখনও তার সাথে খারাপ ব্যবহার করতে পারেনি। নয়তো একটা ছেলের থেকে এমন আচরণ প্রীতি কখনোই সহ্য করতো না। জেরিন হঠাৎ বলল,” বয়ফ্রেন্ড নাকি?”
প্রীতি চমকে উঠল,” মানে?”
” কে ম্যাসেজ দিয়েছে তোকে?”
” নওশাদ, আমার ক্লাসমেট।”
” শুধু ক্লাসমেট?”
” না ফ্রেন্ড।”
” শুধু ফ্রেন্ড?”
” উফ, তুই কি শুনতে চাইছিস?”
” আর যাই হোক, বেস্টফ্রেন্ড হলেও রাতের বেলা এইভাবে ম্যাসেজ করার কথা না।”
” এজন্যই তো আমার বিরক্ত লাগে। ছয়মাস ধরে ছেলেটা পেছনে লেগে আছে। গলার কাটার মতো। গিলতেও পারছি না ফেলতেও পারছি না।”
” ফেলতে পারছিস না কেন? ব্লক করে দিলেই তো হয়।”
” আমাদের ভার্সিটির ছেলে। ব্লক মেরে লাভ কি? প্রতিদিন তো দেখা হবেই।”
” দেখা হলেও কি? ইগনোর করবি! তুই কি ভয় পাস নাকি?”
প্রীতি মাথা নিচু করে বলল,” ভয় না। আসলে ওর কাছে আমি একভাবে ঋণী। তাই ও যতকিছুই করুক আমি ওর সাথে রুড হতে পারবো না।”
” তাই? কিভাবে?”
প্রীতি ভার্সিটি এডমিশনের গল্পটা জেরিনকে সম্পূর্ণ বলল। জেরিন শুনে অবাক।
” তোর তো চমৎকার ভাগ্য। তোকে একটা সাজেশন দেই। এই ছেলের সাথে প্রেম কর। ভালো থাকবি।”
” ধ্যাত! সেইম এইজ রিলেশন আমার পছন্দ না।”
” কেন পছন্দ না? তোর তো ফ্যামিলিতে কোনো প্রবলেম নেই। মামাও কত ভালো মানুষ। তোকে কখনও কোনো ব্যাপারে ফোর্স করে না। তুই যার সাথে বলবি তার সাথেই তোকে বিয়ে দিবে। আর তুই গ্র্যাজুয়েশনের পরেই বিয়ে করবি। তোদের লেখাপড়াও একসাথে শেষ হবে। একসাথে চাকরি করবি। তারপর নিজেদের টাকায় বিয়ে! আমাদের দেশে তো এসবই হয়। কত কিউট রিলেশনশীপ! “
প্রীতি মলিন হেসে কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো কানে গুজল। জেরিন কত সহজভাবে সব চিন্তা করছে। কিন্তু প্রীতির জীবনটা কি আসলেই এতো সহজ?
জেরিন প্রীতির কাঁধে হাত রেখে বলল,” আচ্ছা বলতো, তুই নিউইয়র্ক যেতে চাইছিস না কেন? মায়ের জন্য তাই না? চিন্তা করিস না। এইবার নিউইয়র্কে গেলে তোকে আমাদের বাড়িতে উঠতে হবে না। আমি এখন নতুন একটা ফ্ল্যাট নিয়েছি।আমার ভার্সিটি থেকে বাসা খুব দূর হয়ে যায় সেজন্যই আলাদা ফ্ল্যাট। ওইখানে অবশ্য আমি একা থাকি না। আমার সাথে আতিফও থাকে। তুই গেলে আতিফ কয়েকদিন থাকবে না। আমরা ফাঁকা বাড়িতে অনেক মজা করবো।”
প্রীতি কাঁধ থেকে জেরিনের হাত সরিয়ে হতাশ কণ্ঠে বলল,” নারে, আমি আর কখনোই নিউইয়র্ক যাবো না।”
” কেন?”
” এমনি।”
” একটা মানুষ অসুস্থ। তোকে দেখার জন্য ছটফট করছে। তাও তুই যাবি না? এটলিস্ট তোর উচিৎ আশরাফ ভাইয়ের কনসোলেশনের জন্য হলেও সেখানে যাওয়া। তিনি ভাবছেন তুই গেলেই তার কাল্পনিক চরিত্র ফ্লোরার সমস্যাটা ঠিক হয়ে যাবে। তাছাড়া অসুস্থ মানুষ হিসেবে একবার অন্তত তাকে দেখতে যাওয়া উচিৎ। “
প্রীতি হঠাৎ ক্ষেপে উঠল,” এতো উচিৎ-অনুচিৎ আমি বুঝি না জেরিন। যাবো না মানে যাবো না। তুই কি আমাকে জোর করে নিয়ে যেতে পারবি?”
” এখানে জোর করার কথা আসছে কেন? তোকে শুধু আমি বোঝাচ্ছি।”
” আমাকে বোঝানোর কোনো প্রয়োজন নেই।”
জেরিন অবাক হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল,” তুই তো এমন নিষ্ঠুর ছিলি না প্রীতি। হঠাৎ তোর কি হয়ে গেল?”
প্রীতি জবাব দিল না। অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে রইল অন্যদিকে। জেরিন আধঘণ্টার মতো বকবক করে ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু প্রীতির চোখে ঘুম এলো না। নিউইয়র্ক থেকে আসার পর সে ইনসোমিয়ায় ভুগছে প্রায় ছয়মাস যাবৎ। রাত আসে কিন্তু চোখে ঘুম আসে না। চোখের নিচে দাগ পড়ে চেহারা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নওশাদ প্রায়ই বলে,” তোমার কিসের এতো টেনশন প্রীতি? প্লিজ শেয়ার উইদ মি!”
প্রীতির অন্য বন্ধুরাও বলে। কিন্তু প্রীতি নিজের মনের কথা কাউকে জানাতে পারে না। এই অনুভূতি একান্ত তার নিজের। এই কান্না তার ব্যক্তিগত। এই দুশ্চিন্তা, অস্থিরতা সবকিছুর সাক্ষী তার রুমের দেয়াল, বালিশ আর বিছানা। বারান্দার ওই জানালা, নীল আকাশ, একগুচ্ছ নীরবতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রীতি।
যে প্রতিদিন ফজরের আযান শুনে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে। কিছু মুহূর্তের জন্য তার হৃদয় শীতল হয়। দিনটা ভালোই কাটে। কিন্তু রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে কষ্টেরা পুনরায় এসে আঁকড়ে ধরে চারদিক থেকে। প্রীতি শুনতে পায় সেই আহাজারি,” প্রিটি, ফ্লোরার দুঃখগুলো মুছে দাও প্লিজ!” প্রীতি শব্দ করে কেঁদে ফেলে। আশরাফের সামনে সে কোনোদিনও যেতে পারবে না আর। যাকে মন-প্রাণ একাকার করে ভালোবাসে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর স্পর্ধাই নেই প্রীতির।
কারণ প্রীতি জানে, একবার যদি আশরাফের সামনে গিয়ে সে দাঁড়ায় তাহলে আর কোনোদিনও মানুষটিকে ছেড়ে আসা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। আবার আশরাফকে মেনে নিয়ে সারাজীবন তার সঙ্গে কাটিয়ে দেওয়াও সম্ভব নয়। যার হৃদয় জুড়ে অন্য এক নারীর রাজত্ব, যে প্রতিনিয়ত কষ্টের সমুদ্রে গোসল করে, প্রেমানলে জ্বলে-পুড়ে খাঁক হয়, তার সীমাহীন কষ্ট প্রীতি কিভাবে সহ্য করবে? সারাজীবন ভালোবাসার মানুষের কষ্ট দেখার চেয়ে নিজে বিষাদ-বেদনায় কাতরানো অনেক ভালো। প্রীতি কাতরাবে, কাঁদবে, অস্থির হবে কিন্তু কখনোই আশরাফের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে না। তার হাত ধরে সারাজীবন পাশে থাকার শপথ করতে পারবে না কখনোই! উফ, নিয়তির এমন নিষ্ঠুর চক্রান্তে আক্রান্ত মানুষগুলোর হৃদয়েই কেন এতো ভালোবাসা জন্মে?
জেরিন এক সপ্তাহ বাংলাদেশে অবস্থান করে। তারপর নিউইয়র্কে ফিরে যায়। প্রীতি লেখাপড়ায় মনোযোগী হয়। সময় কেটে যেতে থাকে। দিন,মাস, বছর পেরিয়ে যায়। নওশাদের সাথে প্রীতির দূরত্ব তৈরী হয়। চোখের আড়াল তো মনের আড়াল বলে একটা ব্যাপার আছে। কথাটাকে একশোভাগ সত্য করতেই বোধহয় নওশাদ ফ্রান্সে গিয়ে আর কোনো খোঁজ-খবর নেয়নি প্রীতির।
প্রীতিও নিজে থেকে যোগাযোগ করেনি। একসময় শিক্ষাজীবন শেষ হয়। প্রীতি কর্মজীবনে ব্যস্ত হয়ে উঠে। ভালো একটা জায়গায় চাকরি হয়ে যায়। বাবাকে নিয়ে বড় ফ্ল্যাটে থাকার স্বপ্ন এবার পূরণ হবে। বাপ-মেয়ে টাকা জমিয়ে দেশ-বিদেশে ঘুরতেও যাবে। পৃথিবীটা হবে স্বপ্নময়। তবুও মাঝে মাঝে ঘুমের সময় দুঃস্বপ্ন হয়ে ধরা দেবে পাঁচবছর আগের সেই অমোঘ বাস্তবতা। অতীতের সেই তুমুল আর্তনাদ,”প্রিটি, ফ্লোরা খুব কাঁদছে। তুমি কি আসবে না প্রিটি?”
একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। কোনো রিকশা, বাস, ট্যাক্সি পাওয়া যাচ্ছে না। ঝড়ের রাতে বিপদ বুঝে সবাই দ্বিগুণ দাম চাইছে। প্রীতিও নাছোড়বান্দা। এতো ভাড়া দিয়ে সে কিছুতেই যাবে না। প্রয়োজনে দাঁড়িয়ে থাকবে। যারা জীবনে কষ্ট করে পয়সা কামায় তারাই বোঝে জীবনে চলার পথে দুই পয়সারও কত মূল্য। হঠাৎ একটা প্রাইভেট কার এসে প্রীতি সামনে থামে। প্রীতি ভয়ে শিটিয়ে যায়। কার গাড়ি এটা? কালো গ্লাস নামিয়ে মাথা বের করে ভদ্রলোক বলে উঠল,” হাই প্রীতি, কেমন আছো?”
প্রীতি কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে। তারপর তার মুখ থেকে অস্ফুট আওয়াজ বের হয়,” নওশাদ!”
বহুদিন পর পুরনো বন্ধুকে কাছে পেয়ে রাজ্যের গল্প শুরু হয়। শুরু হয় স্মৃতিচারণ। কত মজার দিন ছিল। সবাই যে এখন কোথায় কোথায় হারিয়ে গেছে! কেউ বিদেশে আছে, কেউ শহরের বাহিরে, কেউ বিয়ে করে সংসারী হয়েছে৷ নওশাদ আনন্দের সাথে প্রীতিকে জানায়, সে দেশে ফিরেছে পাঁচদিন হয়। এখন থেকে এখানেই থাকবে বাবা-মায়ের সাথে। সতেরো তারিখ তার বাড়িতে একটা গেট টুগেদার আয়োজিত হবে। তাদের ব্যাচের অনেক বন্ধুরা আসবে। নওশাদ প্রীতিকেও আমন্ত্রণ করেছে। এমন নয় যে প্রীতির সাথে তার ঘটনাচক্রে দেখা হয়েছে বলেই প্রীতি ইনভাইটেশন পেয়েছে। নওশাদ দেখা না হলেও প্রীতিকে খুঁজে বের করতো। কারণ প্রীতির সাথে তার খুব জরুরী কথা আছে। কি এমন জরুরী কথা তা প্রীতি জানে না। নওশাদ বলেনি। সতেরো তারিখ এলেই নাকি বলবে।
সতেরো তারিখ ছিল শুক্রবার। সবার জন্য ছুটির দিন। নওশাদের অনুষ্ঠান সন্ধ্যায়। সকাল থেকেই প্রীতিকে ফোন করে জ্বালিয়ে মারছিল নওশাদ। কখন আসবে প্রীতি! একবার তো প্রীতির মনে সন্দেহ চাড়া দিল, নওশাদ কি এখনও আগের মতো আছে? প্রীতিকে নিয়ে কি সে এখনও ভাবে? পরক্ষণেই সন্দেহটা জোর করে মন থেকে তাড়িয়ে দেয় প্রীতি। নওশাদের ওইটা ছিল ছোটবেলার আবেগ। এখন তো তারা বড় হয়েছে। এখন নিশ্চয়ই নওশাদ আগের মতো পাগলামী করবে না। সময়ের সাথে অনেক কিছুই বদলায়। কেবল ভালোবাসা বদলায় না। হৃদকুঠুরিতে সারাজীবন অমলিন হয়ে থাকে দৃঢ় যত্নে।
পার্টিতে অনেক পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা হয়। প্রীতি সবার সাথে গল্পে মজে যায়। নওশাদের বাবা-মায়ের সাথে পরিচয় হয়। সবাই প্রীতিকে এমনভাবে ট্রিট করছে যেন প্রীতিই এই অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি! শুরুতে এসবের কারণ বুঝতে না পারলেও অনুষ্ঠানে শেষে গিয়ে প্রীতি সব বুঝতে পারল। নওশাদ তার পাগলামীর চূড়ান্ত দেখিয়ে ছাড়ল। প্রীতিকে সকলের সামনে গোল্ড রিং দিয়ে প্রপোজ করল। হাঁটু গেঁড়ে প্রীতির সামনে বসে নওশাদ ভালোবাসাময় কণ্ঠে বলল,” প্রীতি, উইল ইউ ম্যারি মি?”
চলবে
®Fareen Ahmed