#writer_Mousumi_Akter
সন্ধ্যার হলদেটে আলোয় প্রিয়তার ফর্সা মুখটা হলুদ বর্ণ ধারণ করেছে। কি যেন ভেবে বিয়ের পর আজ প্রথম সে গোলাপি রঙের একটা শাড়ি পরেছে। শাড়িটা এখান থেকেই কেনা। অন্ত তিন দিন আগেই ফিরে যাবে বলে ইচ্ছামত শপিং করে দিয়েছে। অন্ত ও মনে মনে চাইছিল প্রিয়তা শাড়ি পরুক কিন্তু বলার অধিকার টা দেখাতে পারছিল না। অদ্ভুত এক টানে প্রিয়তা সেখান থেকেই একটা শাড়ি আজ পরেছে।প্রিয়তার মলিন মুখটা হঠাৎ আজ সতেজ দেখাচ্ছে। সন্ধ্যার পরে তার বাইরে ঘুরতে ইচ্ছা হয়েছে। গায়ে বেশ জ্বর। তবুও বায়না ধরেছে। অন্ত সেই বায়নার আবদার রাখতেই প্রিয়তাকে নিয়ে সন্ধ্যায় বের হয়েছে।প্রিয়তা রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ফুসকা খাচ্ছে। অন্ত অপলক চোখে তাকিয়ে দেখছে।শখের নারীকে সব রূপেই যেন সুন্দর লাগে।এইযে ফুসকা খাচ্ছে অন্তর মনে হচ্ছে এত সুন্দর করে কেউ ফুসকা মুখে দিতে পারেনা।প্রিয়তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে থাকতে অন্তর শরীর কেমন যেন ঝিম ধরে গিয়েছে। সে নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে প্রিয়তার দিকে।হঠাৎ করে প্রিয়তার কপালে হাত রাখল।প্রিয়তা ফুচকা খেতে খেতে অন্তর দিকে তাকিয়ে চোখ ইশারা দিয়ে বলল, “কি?”
অন্তর হঠাৎ প্রিয়তাকে স্পর্শ করতে ইচ্ছা করছিলো।সে কথা বলার মত সাহস হলনা।শান্ত কন্ঠে বলল, ” রুমে চলো শরীরের তাপমাত্রা খুব বেড়ে গিয়েছে। জ্বর মাপছিলাম।”
“আপনি কি থার্মোমিটার?”
“মাঝে মাঝে থার্মোমিটার ও হতে হয় বুঝলে।”
“কই আমিতো বুঝতে পারছিনা।”
“আসলেই বুঝতে পারছোনা তোমার জ্বর?”
“উঁহু।”
“বাইরের বাতাস লাগানো যাবেনা। চলো রুমে।আমি দায়িত্ব নিয়ে এসছি তোমাকে সুস্থ করে নিয়ে যাবো। প্রান্তিক ভাই কে দেওয়া কথা আমাকে রাখতেই হবে।”
“হয়ত আমার শরীর সুস্থ করতে পেরেছেন কিন্তু আমার মন! তা কি আদেও কোনদিন সুস্থ করতে পারবেন।”
“হয়ত পারব আবার পারব না।সবটাই তোমার উপর নির্ভর করছে।তবে আমি তোমার শরীর আর মন দু’টোর ই সুস্থতা কামনা করি প্রিয়তা। যেখানে গেলে তোমার মন সুস্থ হবে আমি সেখানেই তোমাকে রেখে আসব।”
প্রিয়তার চোখের সামনে ভেষে উঠল শ্রাবণের ঘোলা চোখ দু’টো।এমন কত দিন গিয়েছে শ্রাবণ তাকে ফুসকা খাইয়ে দিয়েছে। সে হা করেছে শ্রাবণ ফুসকা খাইয়ে দিয়েছে।ঝাল লাগলে ফু দিয়ে ঝাল কমানোর চেষ্টা করেছে।শ্রাবণের হাসিমুখটা বারবার ভেষে ওঠে প্রিয়তার মুখের চোখের সামনে।যাতনায় হৃদয়টা পুড়ে যায়,ব্যাথায় বুক ভারী হয়ে আসে। শ্রাবণের সাথে কাটানো মুহুর্তগুলো সব শ্রাবণের অভিনয় ছিল ভেবেই প্রিয়তার আরো বেশী কষ্ট হয়।রুমে এসে প্রিয়তা মন খারাপ করে বসে আছে।আজ শ্রাবণের জন্মদিন। এই দিনে প্রিয়তা প্রতি বছর শ্রাবণ কে নিজ হাতে সেলাই করে পাঞ্জাবি বানিয়ে দিত। এক বছর ধরে পাঞ্জাবিতে নিঁখুত কারুকাজ করত। এই দিনটা প্রিয়তার জীবনের সব থেকে স্পেশাল দিন ছিল।আজ মনের দুঃখে চোখের পানি ফেলে বলছে, ” আমার দাফন হয়ে যাক তবুও আমাদের আর দেখা না হোক শ্রাবণ। তুমি একজন হ’ ত্যাকারী। আমার পবিত্র হৃদয় কে হ’ ত্যা করেছো। হৃদয় হ’ ত্যার বিচার থাকলে তোমার ফাঁ* সি সবার আগে হত।”
শ্রাবণ একটা নদীর তীরে বসে আছে। ফোন ভর্তি প্রিয়তা আর তার অসংখ্য ভাল মুহুর্তের ছবি।শ্রাবণ প্রিয়তার ছবির দিকে তাকিয়ে বলছে, ” এই পৃথিবীর শ্রেষ্ট অসহায়ত্ত্ব কি জানো প্রিয়তা? এইযে আমার তোমার সাথে কথা বলতে তীব্র ইচ্ছা করছে কিন্তু বলতে পারছি না। তুমি আমার অথচ আজ অন্য কারো পাশে।জানো সবাই বলে চোখের আড়াল হলে মানুষ মনের আড়াল হয়।কিন্তু আমি জানি আমাদের ভালবাসা সাত জন্মের।এই জন্মে কেনো সাত জন্ম বলে যদি কিছু থাকে সেই সাত জন্মেও তুমি আমাকে ভুলবে না।তোমার মনের দখল অন্য কেউ নিতে পারবে না।আমার বিশ্বাস, আমার ভালবাসা কোনটার প্রতি আমার আস্থা বিন্দুমাত্র কমেনি।মানুষ বলে নারীর মন সর্বদা পরিবর্তনশীল।কিন্তু আমিতো জানি আমার প্রিয়তার মন এমন নয়।আমাদের ভালবাসার শক্তি সম্পর্কে তো আমি জানি। আমি ভুল ছিলাম,তুমি ঠিক ছিলে, আমি খারাপ ছিলাম তুমি পবিত্র ছিলে কিন্তু আমার সব খারাপের মাঝে আমার ভালবাসা সত্য ছিল।আমি তো চাইলেই আর নিজের অতীত মুছে ফেলতে পারব না।কিন্তু আমি আর সিগারেট স্পর্শ করিনা, কোনো বাজে জিনিস স্পর্শ করিনা, কোনো মেয়ের দিকে তাকায় না।তুমি চাও বা না চাও আজন্মকাল আমি আমার ভুল শুধরাতে শুধু তোমাকেই দেখব।”
তখন গভীর রাত। প্রিয়তার হঠাৎ প্রচন্ড জ্বর। জ্বরে কাঁতরাচ্ছে।অন্ত ডিভানে ঘুমোচ্ছিলো।প্রিয়তাকে কাতরাতে শুনে তার ঘুম ভেঙে গেল। অন্ত দ্রুত ডিভান ছেড়ে উঠল।প্রিয়তার কাছে গিয়ে ওর কপালে হাত দিয়ে দেখল, জ্বরে সমস্ত শরীর পু’ ড়ে যাচ্ছে। হাত ছোঁয়ানো যাচ্ছেনা শরীরে।
অন্ত বেশ চিন্তিত হল। কেননা সে জ্বরের ওষুধ খাইয়ে দিয়েছিলো প্রিয়তাকে।তবুও এত জ্বর কেনো আসল?প্রিয়তা জ্বরের ঘোরে ভুলভাল বকছে।অন্ত একটা কাপড় ভিজিয়ে প্রিয়তার কপালে জলপট্টী দিয়ে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে পায়ের তালু কাপড় ভিজিয়ে মুছে দিচ্ছে। হঠাৎ প্রিয়তা অন্তর হাত নিজের কপালের সাথে চেপে ধরে বলল,
“শ্রাবণ তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে। তুমি জানোনা তোমাকে ছাড়া আমার কত কষ্ট হয়েছিলো। আমাকে ছেড়ে যেও না শ্রাবণ। আমি তোমাকে ভালবাসি শ্রাবণ। আমি তোমাকে ভালবাসি। “
অন্ত প্রিয়তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল প্রিয়তা নিজের মাঝে নেই।হঠাৎ ঠান্ডায় কাঁপছে।জ্বর এলে যে প্রচন্ড শীত করে অন্ত সেটা জানে। এখানে একটা কম্বল ছিল। কিন্তু এই কম্বলে শীত মানাচ্ছে।প্রিয়তা প্রচন্ড কাঁপছে।অন্ত প্রিয়তার হাতের তালু ঘষে গরম করার চেষ্টা করছে।প্রিয়তা জ্বরের ঘোরের অন্তর একটা হাত নিজের কাছে টেনে এনে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে বিড় বিড় করে বলল,
” আমার প্রচন্ড শীত করছে। “
অন্ত খেয়াল করল প্রিয়তার ঠোঁট দু’টো ও কাঁপছে। ঠান্ডায় অন্তর হাতটা জড়সড় করে জড়িয়ে ধরে কম্পিত ঠোঁটে কাঁতরিয়ে আবার ও উচ্চারণ করল, ” শীতে ম’ রে যাবো।”
অন্ত প্রিয়তার পাশে সুয়ে পড়ল।যেন তার উষ্ণতায় শীত একটু কম লাগে।প্রিয়তা অন্তকে পাশে পেয়ে অন্তর বুকে মাথা গুজে অন্তকে আলিঙ্গন করল।প্রিয় নারীর আলিঙ্গন একটা পুরুষের ভেতরে অস্থিরতা তৈরি করাটায় স্বাভাবিক। অন্ত তবুও স্বাভাবিক আছে। সে প্রিয়তার কপালে ওষ্ট ছোঁয়াল।প্রিয়তা আলিঙ্গনের মাত্রা ক্রমশ বাড়াচ্ছিল। অন্ত একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ। একটা সুস্থ মানব দেহে তার প্রিয় নারীর গভীর আলিঙ্গন নিজেকে ঠিক রাখা খুব বেশীক্ষণ সম্ভব হলনা অন্তর।নিজের অনিচ্ছায় অন্ত ও প্রিয়তাকে গভীর আলিঙ্গনে জড়ালো।দু’জনের অজান্তেই বড় সড় একটা অনর্থ ঘটে গেল।
পরের দিন ঘুম ভাঙতেই অন্ত দেখল প্রিয়তার জ্বর নেই।অন্তর বুকে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে।মুখটা কত স্নিগ্ধ, মায়াবী, আর নিষ্পাপ লাগছে।অন্তর হাসি মুখটা হঠাৎ বিলীন হয়ে গেল।গতরাতের ঘটনাটা মনে পড়ে।এটা তার উচিৎ হয়নি। সে-ও শ্রাবণের মত সুযোগ নিয়ে নিল।অন্ত প্রিয়তাকে রেখে বিছানা ছেড়ে ওয়াশ রুমে প্রবেশ করল। সাওয়ার ছেড়ে সাওয়ার এর নিচে দাঁড়াল।ওয়ালে কয়েক টা ঘুষি দিয়ে বলল, ” শীট এটা আমি কি করলাম। এটা আমি কি করলাম। শ্রাবণের মত সুযোগ নিয়ে নিলাম। প্রিয়তা অসুস্থ ছিল।ও জ্বরের ঘোরে আমার কাছে এসেছিলো।আর আমি? একটা অসুস্থ মেয়ের সাথে এসব করলাম।আমি কি অমানুষ যে নিজেকে সামলাতে পারলাম না।এই মুখ আমি কোনদিন প্রিয়তাকে দেখাতে পারব না। প্রিয়তা আমাকে সারাজীবনের মত ঘৃণা করবে।প্রিয়তা আবার ও কষ্ট পাবে।আবার ও বিশ্বাস ভাঙার কষ্ট পাবে।পুরুষ জাতির প্রতি ওর এক ঘৃণ্য ধারণা সৃষ্টি হবে।” চিন্তায় অন্ত পা-গ-ল হয়ে যাচ্ছে।অথচ কাল রাতে যা হয়েছিল তা প্রকৃতির নিয়মে হয়েছিলো।মাঝে মাঝে কিছু জিনিস আমাদের অনিচ্ছাতেও ঘটে যায়।আমরা যা ভাবি না তা-ও ঘটে যায়।
হঠাৎ রুমে কিছু একটা পড়ার শব্দ হল।কিছু একটা ফ্লোরে পড়ল।অন্ত দ্রুত ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে দেখল প্রিয়তা ওয়াশ রুমে আসার চেষ্টা করছিলো তখনি ওর হাতে বেঁধে ফুলদানি পড়ে গিয়েছে।অন্ত দ্রুত এসে প্রিয়তাকে ধরে বলল, ” স্ট্রেঞ্জ আমাকে ডাকলে না কেনো তুমি? যদি পড়ে কিছু হত?” অন্ত খুব রিয়্যাক্ট করে কথাটা বলল।
প্রিয়তা খেয়াল করল অন্ত খুব চিন্তিত।হঠাৎ অন্তর এমন ব্যবহারে প্রিয়তা বিস্ময়কর দৃষ্টিতে অন্তর দিকে তাকিয়ে রইল।অন্ত তার সাথে এমন ব্যবহার করবে এটা তার কল্পনার বাহিরে।প্রিয়তার অভিমান হল সে মুখ ভারী করে অন্তর হাত ছাড়িয়ে বলল, ” আমি কি বোঝা হয়ে আপনার ঘাড়ে বসে আছি অন্ত?”
অন্ত খেয়াল করল প্রিয়তা আজ আর ভাইয়া সম্মোধন করছেনা।বিষয় টা অবাক করা হলেও সত্য।প্রিয়তার কথায় অন্তর খারাপ লাগল। সে অতিরিক্ত দুঃচিন্তায় প্রিয়তার সাথে খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছে।বেশ অপরাধবোধ নিয়ে বলল, ” আই আম সরি প্রিয়তা। প্লিজ সরি। আমি বুঝতে পারিনি। চিন্তায় রিয়্যাক্ট করে ফেলেছি। আসলে আমার উচিৎ হয়নি।”
প্রিয়তা অভিমানি কন্ঠে বলল, ” আসলে আমি কপাল পোড়া অন্ত। এই দুনিয়াতে আমাকে ভালবাসার মত কেউ নেই। যাকে ভালবাসতাম সে-তো বেঈমানি করলোই। নিজের পরিবারের কাছেও বোঝা হয়ে গেছিলাম।আপনার কাধে তুলে দিয়েছে।”
“আমি, আমি সরি।প্লিজ সরি।”
“আপনার আসলে কোনো দোষ নেই। আপনি কেনোই বা আমার মত অসুস্থ মানুষকে টেনে বেড়াবেন?”
“আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই গতকাল রাতের ব্যাপারে। কেনো আমি দুঃচিন্তা করছি।”
” আমরা ফিরছি কখন?”
“আমার কথাটা শোনো।”
“আমরা ফিরছি কখন অন্ত?”
“তুমি না ঘুরতে চাও।”
“না আর চাইনা।আমি বাড়ি ফিরতে চাই।”
চলবে?