- নবনী.
- স্বামী যদি স্ত্রীকে ভালো না বাসে।
- স্ত্রীর প্রতি অবহেলার গল্প।
- স্বামীর প্রতি স্ত্রীর ভালোবাসার গল্প।
- স্বামি স্ত্রীর গল্প
১. নবনী পর্ব ১
বিয়ে করেছি তিনদিন হয়েছে। বউয়ের নাম ভুলে গেছি! নামটা কি যেন বলেছিল মনে পড়ছে না! বাসায় বড়ো খালা এসেছেন আমার বউ দেখতে তাই মা বললেন, বউমা কে ডেকে নিয়ে আয়। আমি রুমে এসে দেখি ও ঘুমাচ্ছে। ডাকতে গিয়ে খেয়াল করলাম ওর নাম আমার মনে নেই!
আমি মনে করার চেষ্টা করছি, কিন্তু নাম মনে করতে পারছি না। এই তিনদিনে কি ওর নাম ধরে আমি ডাকিনি!
ও বাচ্চাদের মতো গুটিশুটি মেরে ঘুমাচ্ছে। দেখতে খুব সুন্দর লাগছে! আমি ভাবছি কি করে ঘুম ভাঙানো যায়। পা টিপে দিবো? আমার এক দূরসম্পর্কের কাকা ছিলেন। উনি তাবলীগ করতেন। আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসলে। ভোরবেলা আমার ঘুম ভাঙাতেন পা টিপে! ঘুম ভেঙে দেখতাম উনি আমার পা টিপছেন! বড্ড বিরক্তি লাগত! একজন বড়ো মানুষ পা টিপলে অস্বস্তি লাগে। কিন্তু উনি প্রতিবার এমন কাজ করতেন।
আমি কি এ পদ্ধতি অবলম্বন করবো? না এটা করা যাবে না। মেয়েদের গায়ে অনুমতি ছাড়া হাত দেয়া যায় না।
আমি তিনদিনের ঘটনা মনে করার চেষ্টা করছি। বিয়ের সময় ওর নাম তো কাজী সাহেব বলেছেন নিশ্চয়। তখন কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। সেই সময়ের কিছুই মনে পড়ছে না।
ওদের বাড়ি থেকে বিদায় নেয়ার সময় ওর বাবা-মা কি ওর নাম বলেছিল? না নাম বলেছে বলে মনে হয় না। কান্নাকাটি করেছিল। ওর বাবা আমাকে বললেন, “আমার মেয়েকে দেখে রেখ বাবা। বড়ো আদরের মেয়েটা আমার।” না নামটা বলেনি তো।
গাড়িতে ওর সাথে তেমন কথা হয়নি। শুধু একবার পানি খাওয়ার কথা বলেছিল। গাড়ি থামিয়ে দোকান থেকে ঠান্ডা মাম পানির বোতল এনে দিলাম। পানির বোতল নিয়ে থ্যান্কস্ বলেছিল। এই জিনিসটা ওর মধ্যে আছে। কিছু হলেই থ্যান্কস বলে মিষ্টি করে হাসি দেয়।
আমাদের বাড়িতে এসে নানা ধরনের আজব কান্ড করেছে আমার আত্মীয় স্বজনরা। আশ্চর্য কেউই ওর নাম একবারও বলেনি!
কাবিননামায় ওর নাম পাওয়া যাবে। কাবিননামাটা এখনো হাতে পাইনি। এটা পেতে আরো সময় লাগবে।
আমি ওর পাশে বসে মুখের দিকে চেয়ে আছি। ঘুমন্ত মানুষ কে দেখতে বেশ ভালো লাগে। আমি মুগ্ধ হয়ে চেয়ে আছি।
বাসর রাত নিয়ে মেয়েদের নাকি অনেক পরিকল্পনা থাকে শুনেছি। আমারও একআধটু পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু কী হলো! বন্ধুদের আড্ডা থেকে ভাবি জোর করে যখন বাসর ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে গেল তখন ঘড়ির কাটা বারোটা ছুঁয়েছে।
ঘরে ঢুকতেই একটা কাঁচা ফুলের গন্ধ এসে নাকে লাগল! গেন্দা,রজনীগন্ধার, আর সাদা কী সব ফুল দিয়ে ঘরটা সাজানো হয়েছে। বিছানায় গোলাপের পাপড়ি ছিটানো তার মাঝে বসে আছে মেয়েটা। লম্বা ঘোমটা দিয়ে বসে থাকার কথা। কিন্তু এ মেয়ের কোনো ঘোমটা নেই!
আমাকে দেখে বলল,”বাসর রাত নিয়ে আপনার কোনো ফ্যান্টাসি নেই তো?”
কী সব আজব গল্প শুনেছি এ রাত নিয়ে মেয়েদের কত স্বপ্ন থাকে! আমার বউয়ের মুখে এ কী কথা? আমাকে চুপ থাকতে দেখে বলল,” আমার প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে, গত দুইদিন ঘুমাতে পারিনি!”
বলেই সে বাথরুমে ঢুকে গেল। আমি কিছু সময় বসে রইলাম। কত সময় এভাবে বসে থাকা যায়? ভাবলাম বারান্দায় গিয়ে বসি। আজকের আকাশটা বড্ড অন্ধকার! কোনো তাঁরা নাই। মনে হয় একটা ঝড় আসবে। বারান্দায় পাতা ইজি চেয়ারটায় শুয়ে পড়লাম।
সারাদিনের ক্লান্তিতে কখন যে চোখ লেগে এসেছে বুঝিনি। ঘুম ভাঙলো সকালে। দেখি আমার গায়ে একটা কাঁথা!
আমার বউ গোসল সেরে বেরিয়ে এসেছে। এক নজর দেখলাম দেখতে ওকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে! কী মায়াবী চেহারা! আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসি দিলো, সেই হাসিও অসাধারণ হাসি!
ঘুমন্ত বউয়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগছে! গভীরভাবে শ্বাস নিচ্ছে। দেখলাম গালের ওপর কিসের একটা দাঘ। একটু নিচু হয়ে ভালোভাবে দেখতে যাব। এ সময় হুট করে করে চোখ খুলে গেল ওর। আমার দিকে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকাল। ঠোঁট বাঁকিয়ে একটা বাঁকা হাসি দিয়ে উঠে পড়ল। আমি বললাম, “মা আপনাকে ডাকে।”
বাথরুমে ঢুকার আগে আবার ঠোঁট বাকিয়ে বলল, “অসভ্য! “
আমি বুঝতে পারলাম। আমি একটা বাজে কেস খেয়ে গেছি। এই মেয়ে কী ভেবে বসে আছে!
খালা ওকে দেখে বললেন, ” বাঃ! কী সুন্দর! কী নাম তোমার মা?”
আমার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে হালকা ঠোঁট বাকাল। কোমল কন্ঠে বলল, “নবনী।”
“খুব সুন্দর নাম!”
খালা মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,” রুবি খুব ভালো একটা বউ পেয়েছিস!”
যাক শেষমেশ নামটা জানা হলো নবনী। আসলেই সুন্দর নাম! নবনী দেখতেও বেশ! পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি লম্বা। উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের, হালকা-পাতলা দেহের গড়ন। সব মিলিয়ে দারুণ লাগে!
বিয়ের সাতদিন কেটে গেছে এখনো নবনীর কাছে যেতে পারিনি! মেয়েটা এমনিতে খুব ভালো কিন্তু কেন জানি দূরে দূরে থাকে। এমন সুন্দর একটা মেয়ে পাশে থাকলে তাকে না ছুঁয়ে থাকাটা বড্ড কঠিন! কঠিন কাজটাই আমি করছি!
মা বলল, “তোরা কোথা ঘুরে আয়। নতুন বউ নিয়ে ঘরে বসে আছিস কেন?”
আমারও ইচ্ছে হলো নবনী কে নিয়ে দার্জেলিং যাই। এ জায়গটা হানিমুনের জন্য খুব ভালো। এখানে সারা বছর শীত থাকে। যেহেতু আমাদের বিয়েটা গরমকালে হয়েছে। যদিও আমাদের দেশের বেশিরভাগ বিয়ে শীতকালে হয়।
নবনী কোথাও যেতে রাজি না! আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কী করব? কারো সাথে পরামর্শ করার উপায় নেই! আমার এত আপন কেউ নাই যাকে এ সমস্যার কথা বলা যায়। অবশ্য সমস্যা কি-না সেটাও বোঝা যাচ্ছে না।
নবনী পর্ব ১
চলবে–
® নাবিল মাহমুদ
সম্পূর্ণ গল্পের লিংক একসাথেত
https://kobitor.com/category/running/noboni/
২.স্বামী যদি স্ত্রীকে ভালো না বাসে
– মিরা চলো আমার ডির্ভোস নিয়ে ফেলি, এইসব ঝগড়া ঝামেলা আর ভালো লাগছে না। আমি সত্যিই ক্লান্ত।
ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি প্রথম রিয়ালাইজ করলাম, আমার ওর প্রতি আর কোন টান অনুভব হচ্ছে না। ওর এই কথায় আমি মোটেও কষ্ট পাচ্ছি না। কারণ আমি নিজেও অনেকবার ভেবেছি। আর পারা যাচ্ছে না।
রাতুল ভেবেছে আমি কোন বাঁকা উত্তর দেবো৷ কিন্তু হঠাৎ চুপ হয়ে সায় দেওয়াতে ও অবাক না হলেও স্বস্তি পেলো। দুইজনে মাথা নেড়ে সায় দিলাম। কাল এই ব্যাপারে ফ্যামিলির সাবাইকে জানাবো। ঘুমন্ত বাচ্চাদের দিকে আজকের মতো আমরা শান্ত হলাম।
দশবছরের সংসার। এরেঞ্জ ম্যারেজ। তাও বিয়ের আগে তিনমাস ভালোই প্রেম করেছি দুজন। বিয়ের পর ও ভালোই স্বাভাবিক ছিলাম। প্রথমে বড় মেয়েটা হওয়ার পর থেকে আমি মেয়ে নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পরি দুজনের মধ্যে দূরত্ব বাড়ে। মেয়ে নাকি বাবার ভাগ্য আনে, এই শুনিয়ে রাতুলেও বড় পোস্ট পেয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বাসায় ফিরলে মেজাজ থাকে তুঙ্গে। প্রথমে আমি চুপ থাকলেও সারাদিনে বাসায় মেয়ের পেছনে ঘুরে, ঘরের কাজ সামলে আমার মেজাজ ও সপ্তম আকাশে৷ বছর দুয়েক পর ছেলেও হলো। সব চাহিদা ঠিকঠাক পূরণ করলেও দুজনের মধ্যে প্রায় কথা কাটাকাটি, ঝগড়া, ঝামেলা লেগেই থাকে৷
বিশাল কোন কারণ লাগে না সামান্য বিষয়েই আমরা বিশাল ঝামেলা করে ফেলি। প্রথমে একজন চুপ থাকলেও অন্য জনের কথার খোটায় দুজনেরেই বাঁধ ভাঙ্গে। তখন থামানো যায় না কাউকেই।
এমন না যে কেউ অন্য কারো প্রতি আসাক্ত তাও নিজেদের মধ্যে কোন টানেই যেন আর নেই। আমাদের চেয়ে ভালো সম্পর্ক আমাদের সাথে কাজের লোকেদের।
এইটা ধীরে ধীরেই হয়েছে, একদিনে নয়। কারো থাকা না থাকা যেন মেটারেই করে না আমাদের কাছে।
দুইজনের রুম ও আলাদা হয়ে গেলো। তাও আমাদের ঝগড়া থামে না। মানসিক অশান্তির চাপ আমাদের ছাড়িয়ে বাচ্চাদের মধ্যেও পড়ছে আমরা ভালোই বুঝতে পারি।তবে রাগ হলে নিজেদের থামাতে পারি না। এই সমস্যা শুধু আমাদের নয়। এমন অনেকে ফ্যামিলিতেই আছে।
পরের দিন মা বাবার রুমে গিয়ে আমাদের ডির্ভোস এর কথা বলায়, মা তার উলের কাটা থামিয়ে আমাদের দিকে একবার তাকালো, বাবাও বইয়ে পাতা উল্টে একবার তাকিয়ে বলল-
– তোমারা দুজনেই প্রাপ্ত বয়স্ক৷ তোমাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নেওয়া পূর্ণ অধিকার আছে।
আমি আর রাতুল একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম। মা বাবার এমন ভাবলেশ কথায় আমরা যেন আহত হলাম কেন বুঝতে পারলাম না। আমি বললাম,
-আপনাদের কোন সমস্যা নেই?
দুজনেই একসাথে বলে উঠলো, আমাদের কি সমস্যা থাকবে?
বাবা বইয়ের পাতা উল্টে বললেন, তোমাদের জীবন, তোমাদের সিদ্ধান্ত। আর প্রতিদিন ঝামেলা হওয়ার থেকে এইটাই ভালো। আমরাও একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারবো রাতে৷ নয়েজ লেস।
আমরা বেশ লজ্জায় পেলাম। আসলে ঝগড়া করার সময় আমাদের খেয়াল থাকে না পাশে রুমে মা বাবার অসুবিধা হয়।
রাতুল বলে উঠল, আর বাচ্চারা?
মা উঠে উনার সুতার বক্সে কাটা রাখতে রাখতে বলে, ওরা কি? ওরা তো কোন সমস্যা না। সমস্যা তোমাদের মধ্যে। তোমরা সিদ্ধান্ত নেবে কার কাছে কত দিন রাখবে। ওদের উপর দায় চাপিয়ে নিজেদের জীবন নষ্ট করার কোন মানে হয় না। এইভাবে চলতে থাকলে ওদেরেই লাইফে বিরাট প্রভাব ফেলবে।
মা বাবার এমন কথায় আমরা অবাক না হয়ে পারছি না। মা আবার বলল-
-তবে তোমরা যদি আমাদের থেকে অনুমতি চাও। আমাদের একটা শর্ত তোমাদের পালন করতে হবে।
– কি শর্ত?
-তেমন কঠিন কিছু না৷ এক মাস তোমাদের এক ঘন্টা করে একটা রুমে কাটাতে হবে।
দুজনেই তাচ্ছিল্য একটা হাসি দিলাম যেন কোন ছেলেমানুষী আবদার। বাবা এইবার গম্ভীর গলায় বলে,
– উই আর সিরিয়াস।
বাবার কথার উপর কোন কথা হয় না। মা বলল-
-দশ বছর একঘরে এক বেডে কাটিয়েছো। আমাদের জন্য একটা ঘন্টা কাটাবে তোমরা একা। রুমে তোমরা কি করছো এইটা মেটার করে না। যে যার মতো থাকবে। কথা না বলে। জাস্ট একঘন্টা পর তোমরা বেড়িয়ে আসবে। এরপর যা ইচ্ছে কর।
রাতুল আট টায় ফিরে। তোমরা নয় টা থেকে দশটা একঘন্টা রুমে কাটাবে। এরপর যে যার রুমে।
-তখন রান্নাবান্না, বাচ্চাদের পড়ালেখা-
মা হাত তুলে থামিয়ে বলে, সন্ধ্যা থেকে এনাফ টাইম থাকে। রান্না শেষ করবে। না পারলে আমি আছি, আর বাচ্চাদের তো তোমাদের ছাড়া থাকতেই হবে।তোমাদের এক সাথে পাবে না। তাছাড়া তোমরা নতুন জীবন ও শুরু করবে। তখন ওদের তোমাদের ছাড়া থাকতে হবে, এখন অল্প অল্প করে অভ্যাস করালে তো তোমাদেরেই সুবিধা।
মা কথাটা সত্য বললেও, শুনতে খুব একটা ভালো লাগছে না। মা বাবার কথা অমান্য কেউ করি না। তাই অগত্য মাথা নেড়ে সায় দিলাম। নিত্য কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলাম, মায়ের শর্ত ভুলে গেলাম। রাতুল অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে বসার পর মা এসে বলল,
-যাও তোমাদের টাইম শুরু হচ্ছে এখন।
রাতুল খেলা দেখছিলো, বিরক্ত সুরে বলে, এইসব ছেলে মানুষীর কোন মানে হয় না মা। এইসবে আমাদের সর্ম্পকে কোন প্রভাব ফেলবে না। ইট জাস্ট ফিনিশ।
আমি রিধিকে হোমওয়ার্ক করাচ্ছিলাম। মা আমাকেও টেনে তুলে রুমে ডুকিয়ে দিলো। রাতুল কেও। রাতুল বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে উঠলো।
-আজীবন জ্বালিয়ে মারবে তোমরা আমাকে। খেলাটাও দেখতে দিচ্ছো না।
মা রিধির সামনে বসে হোম ওয়ার্কের খাতাটা টেনে নিয়ে বলে, ল্যাপটপে দেখো। আর হ্যাঁ কেউ কারো সাথে কথা বলবে না কিন্তু।
মা দরজা লক করে দিতেই রাতুল আমার দিকে বিরক্ত চোখের তাকিয়ে ল্যাপটপ খুলে খেলা দেখতে শুরু করলো।
আমি টুকটাক ঘর গুছিয়ে রাখলাম। কেউ কোন কথা বলছি না। যেন আমাদের কোন কথায় নেই বলার জন্য।
সময় টা যেন যাচ্ছে না। আমি বিছানায় শুয়ে পড়লাম। রাতুলের ল্যাপটপে খেলার শব্দে ঘুমাতে পারছি না।
মা কথা বলতে নিষেধ করেছে। জানি এখন ভলিউম ছোট করতে বললে, ঝগড়া হবে। তাই মাথায় বালিশ চাপা দিয়ে শুয়ে পড়লাম। কখন ঘুমিয়ে পড়লাম খেয়াল নেই। যখন মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙ্গল তখনও রাতুল খেলা দেখছে।
এইভাবে মা চার দিন টেনে ধরে আমাদের রুমে ডুকিয়ে দেয়, আমি ঘুমিয়ে পরি, রাতুল ল্যাপটপ খেলা দেখে কিংবা কাজ করে।
বাচ্চারা প্রথমে বিরক্ত করলেও কয়েক দিন ওরা নিজেদের মধ্যে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
আমি ঘুমিয়ে পড়তাম রুমে সে এক ঘন্টা। খেয়াল করলাম রাতুল ভলিউম ছোট করে দিতো আমি যখন বিছানায় যাই।
শরীর টা কেমন যেন ফ্রেশ মুডে থাকে এখন। খিটখিটে ভাবটা কিছুটা কমেছে। ঘুম আসছে না পরের দিন। তাই বইয়ের তাকে ধুলো জমা বইগুলো ঝেড়ে নিয়ে আবার পড়তে শুরু করলাম। একসময় রোজ বই পড়তে হতো। ভাত না খেলেও চলবে তবে বই যেন থাকে।
পাক্কা সাত আট বছর পর হাত পড়লো বইয়ে। বই ও কিনি না অনেক বছর৷ রাতুল তখন প্রতি জম্মদিন এক গাদা বই দিতো। এখন তো মনেই থাকে না৷
রাতুল আজ অফিসের কাজ নিয়ে বসেছে। আমি বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে বই পড়ছি।
কেউ কারো সাথে কথা বলি নি পাঁচ দিন।
মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছি। পাতা উল্টাতেই টুপ করে নিচে পড়লো একটা শুকনো গোলাপ আর চিরকুট। রাতুলেই দেওয়া, কোন এক জম্মদিনে।
আমি খুব উৎসাহ নিয়ে রাতুল কে ডাক দিলাম, এই দেখ -?
রাতুল কাজ করতে করতে বিরক্ত চোখে ফিরে তাকালো, গোলাপ আর চিরকুট টা দেখে উঠে আলতো হেসে হাতে নিলো।
– কবের এইটা?
চিরকুটের পাতা উল্টে দেখলাম লেখা আছে 2011, দুজনের মধ্যে একটা নস্টায়েলজিয়া ভাব এলো। বই গুলো উল্টে উল্টে দেখতে লাগতাম আমি। আরো অনেক গুলো চিরকুট বেড়িয়ে এলো।
আমি ব্যঙ্গ সুরে বললাম, কি বিশ্রী হাতের লেখা!
অন্য সময় হলে রাতুল রেগে যেতো, আজ বলল, এই বিচ্ছিরি হাতের লেখায় তো প্রেমে গদগদ হতে।
আমি ফিক করে হেসে দিলাম, রাতুল ও দাঁড়িয়ে হাসছে। আমি ওর দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখতে ও থেমে গেল। মনে হলো কত বছর আমাদের নিজেদের এক সাথে হাসাও হয় না।
আরো দুই চারদিন যাওয়ার পর, মাকে আর জোর করে আমাদের রুমে পাঠাতে হয় না। আমরাই চলে আসি রুমে। রাতুলের সাথে খুব যে কথা হচ্ছে তা কিন্তু না। তবে ওর ওখানে বসে থাকাটাও যেন ভালো লাগছে। তবে আমি মোটেও তা প্রকাশ করছি না।
খেয়াল করলাম আমাদের কথা না হলেও একটা টান অনুভব করছি। ও অফিস গেলে আমি ওকে মিস করছি।
অনেক বছর হলো মোবাইলে আমাদের দরকার ছাড়া কথা হয় না। তার ডিউরেশন মিনিট দুয়েকের বেশি হয় না।
দুপুরে রাতুল ফোন দিলো৷ খেয়েছি কিনা? বাচ্চারা খেয়েছে কিনা?
আর কোন কথা খুঁজে না পেয়ে রেখে দিলেও যেন ওর সাথে কথা বলার ইচ্ছে টা বাড়ছে।
সেদিন রাতুল অফিস থেকে যখন ফিরলো, বাসা ভর্তি গেস্ট, আর এক ঘন্টা কাটানোর সুযোগ নেই। আমি রান্না ঘরেই ছিলাম। মা গল্প করতে ব্যস্ত উনার মেয়ের সাথে। বাচ্চারা ব্যস্ত ননদের ছেলের মেয়ের সাথে।
রাতুল রান্না ঘরে এসে দাঁড়িয়ে আছে দেখে আমি হেসে বলি,
– এক ঘন্টার শাস্তি ভোগ করতে এসেছো?
রাতুল কিছু বলল না, মুচকি হেসে দাঁড়িয়ে রইলো, আমারো কেন যেন খুব ভালো লাগছে ওর এইভাবে আসাটা।যেন মনে মনে চাইছিলাম।
টুকটাক জিনিস পত্র এগিয়ে দিচ্ছে। এরমধ্যে কথাও হচ্ছে। কোন মজার কথা নেই তাও যেন ভালো লাগছে। হয়ত অনেক বছর পর এইভাবে ঝগড়া ছাড়া কথা হচ্ছে তাই।
দশ দিন পার হয়ে গেলো। আমরা ঘন্টা পার হওয়ার পর ও যেন রুম থেকে বের হতে চাই না। কাছাকাছি পাশাপাশি বসে নেই। তাও-
বই পড়তে পড়তে আমি বলে উঠি,
– কত বছর কোন মুভি দেখি না –
রাতুল ওর ল্যাপটপ সামনে এনে বলে,
– বাংলা দেখবে নাকি হিন্দি?
দুজনেই সার্চ দিয়ে ভালো একটা মুভি দেখা শুরু করলাম, মুভি শেষ হতে হতে অনেক রাত। দুজনেই জেগে রইলাম। মুভির নেশায় পেয়ে বসলো, পরের দিন আবারো একটা নতুন মুভি।
এখন পাশাপাশি ঘেষাঘেষি করতে বসতে যেন কোন বাধা নেই। আড়ষ্টতা নেই। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পরি একজন আরেক জনের গায়ে। রোমেন্টিক সিনে চোখে চোখে তাকিয়ে হেসে উঠি। সারাদিন অফিস শেষে রাতুল ক্লান্ত থাকে,চোখ লাল হয়ে যায়। আমারও। তাও আমারা সাথে জেগে থাকি। আর আলাদা রুমে যাওয়া হয় না ওর। মেয়ের পাশেই শুয়ে পরে।
এই একটা ঘন্টার জন্য যেন আমরা অপেক্ষা করা শুরু করলাম। পনের দিন শেষ, রাতুল রুমে থেকে বের মুভি দেখার জন্য ডাকলো, মা বলে উঠলো,
-পনের দিন শেষ , এখন আর শাস্তি ভোগ করার দরকার নেই।
রাতুল অবাক হয়েই বলল- শাস্তি?
– হ্যাঁ। তোদের একঘন্টা থাকার জন্য যে শাস্তি দিয়েছিলাম।
রাতুল বলল, তুমি এক মাস বলেছিলে।
– বলেছিলাম, তবে এখন কমিয়ে এনেছি। ভাবলাম অত্যাচার করে ফেলেছি। শুধু শুধু ছেলেমানুষী করছি। তোরা কাল গিয়ে ডির্ভোস ফাইল করতে পারিস।
রাতুল আর আমি চোখাচোখি হলাম, আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম আমরা কেন এইটা শুরু করেছিলাম।
মা আয়েশী ভঙ্গিতে সোফার উপর পা তুলে বলে,
– আর যাওয়া লাগবে না মিরার ঐ রুমে। যাও বৌমা আমার জন্য একটু ডিম ভুনা কর।।দুপুরে মাছে লবণ বেশি দিয়েছিলে খেতে পারি নি। রান্নায় তোমার মনোযোগ নেই আজকাল৷
আমি উঠতেই রাতুল আমার হাত ধরে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে
– তুমি এক মাস বলেছিলে কিন্তু, মিরা এখন রান্নাঘরে যাবে না। রুমে যাবে।
আমাকে টেনে রুমে নিয়ে গিয়ে দরজা লক করে দেয়, আমার নতুন বউ দের মতো লজ্জা লাগছে। বিয়ের পর জামাই রুমে ডাকলে নতুন বৌয়ের যেভাবে লজ্জায় মাথা কাটা যায় ঠিক সেভাবে। আমি হাসি চেপে রাগি রাগি মুখ করে বললাম,
– এইটা কি হলো?
– কি হলো? মুভি দেখতে আনলাম আর কি-?
-এইভাবে?
-তো কীভাবে আনবো? তোমার কি ইচ্ছে নেই মুভি দেখার?তাহলে যাও-
আমি হাসি চেপে দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই, রাতুল আবার হাত চেপে ধরে বলে উঠলো, খবরদার বের হবে না।
আমি অট্টহাসিতে গড়িয়ে পরি। রাতুল বোকা বোকা মুখ করে তাকিয়ে আছে।
পরের দিন বাবা একটা ফর্ম এনে বলে,
– এই নেয়, আজ একটা কাজে গিয়েছিলাম কোর্টে তাই ফরম টা নিয়ে এলাম পূরণ করে কাল পরশু জমা দিয়ে আসিস তোরা গিয়ে।
আমরা দুজনেই পড়ে দেখলাম বাবা ডির্ভোসের ফরম এনেছে। রাতুল আমার দিকে আহত চোখে তাকালো, যেন আমি কি বলি দেখতে চায় সে। দুজনেই চুপ করে আছি দেখে, বাবা বলে,
– কি রে কি সমস্যা?
আমি আর রাতুল প্রায় এক সাথেই বলে উঠলাম, আমার ডির্ভোস চাই না।
মা বাবা চোখাচোখি হলো, যেন ওরা হাসি চেপে রাখতে চাইছে। বাবা বেশ গম্ভীর মুখে বলল,
– তোমরাই তো বলেছিলে, আবার এখন উল্টে যাচ্ছো।
আমরা যেন কোন কথায় খুঁজে পাচ্ছি না। এখন আমর অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে। যেন কোন কিশোরীকে তার মা বলছে তার প্রিয় মানুষটিকে ভুলে যেতে। আমার ভীষণ মন খারাপ লাগছে। একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে বসেছে বুকে। মনে হচ্ছে আর একটা কথা বলতে হলে ছিটকে আমার কান্না বেরিয়ে আসবে।
বাবা আর কিছু বলল না, ফরম টা আবার হাতে তুলে নিয়ে বলল,
-আচ্ছা আর দুই তিন দিন সময় নাও, এরপর ভেবেচিন্তে পূরণ করবে।
আমি যেন পা চালাতেই পারছি না। ধীরে ধীরে রুমে যেতেই রাতুল বলে উঠে,
-তোমার ডির্ভোস চায়?
আমি চুপ করে আছি দেখে ও আমার কাছে এসে বলে, তোমার কি ডির্ভোস চায় এখন মিরা?
আমি কোন শব্দেই যেন বের করতে পারছি না। মুখ তুলে ওর দিকে তাকাতেই চোখের পানি গড়িয়ে পড়লো, রাতুলও কোন কথা না বলে গভীর চুমু দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। আমার তীব্র কাপুনি দিয়ে কান্না বেড়িয়ে আসছে।
রাতুল আরো জোরে জড়িয়ে ধরে আমাকে। মনে হতে থাকে এই মানুষ টা ছাড়া আমি এক মূহুর্তেও থাকতে পারবো না।
বাবাকে গিয়ে বললাম, আমাদের ডির্ভোস চাই না। আমরা এখন ঠিক আছি।
মা বলল, এত দ্রুত কীভাবে সব ঠিক হলো তোমাদের? পনের দিন আগেও একজন আরেক জন কে সহ্য করতে পারতে না।
আমরা মাথা নাড়লাম , জানি না।
মা আর বাবা উচ্চস্বরে হেসে উঠে। আমরা অবাক হয়ে বলি, কি হয়েছে?
মা হাসতে হাসতে বলে, আমরাও একবার ঠিক করেছিলাম আর থাকা যায় না এক সাথে এইবার ডির্ভোস নিবো। তখন আমার শ্বশুর শাশুড়ী ঠিক এইভাবে আমাদের একমাস এক ঘন্টা এক সাথে থাকার শাস্তি দিয়েছিলো। আমাদের অবশ্য এক সাপ্তাহেই সব ঠিক হয়ে গিয়েছিলো। বুঝতে পেরেছিলাম থাকা যাবে না একে ছাড়া।
আমি বসে পড়তেই মা আমার হাত ধরে বলে,
– বৌমা সবাই বলে, মা হওয়া অনেক কঠিন জিনিস মা হতে গেলে অনেক কিছু ত্যাগ করতে হয়। এইটা আসলে একটার ভুল কথা। এইটার মাধ্যমে আমাদের সমাজে একটা মেয়ের উপর একটা ভার চাপিয়ে দেওয়া হয়। মেয়েরা এইটা শুনেই বড় হয় মায়েদের সন্তানের জন্য সব করতে হয়। তাই যখন একটা সন্তান আসে আমরা মেয়েরা সব ভুলে সব ধ্যান জ্ঞান সন্তানের পেছনে লাগিয়ে ফেলি। কারো কোন দোষ থাকে না। তাও আমরা সে মানুষ টা থেকে অনেক দূরে চলে যাই যে মানুষটাকে সবচেয়ে বেশি কাছে রাখার দরকার। যখন একটু ফ্রি হয়, চোখ তুলে তাকাই তখন যেন তার কোন রাস্তায় থাকে না তার মনে যাওয়া, নিজেরাই অর্বজনা ফেলে রাস্তা ভরাট করে ফেলি । কেউ কাউকে বুঝতে পারি না। মনে হয় সে আমাকে আর ভালোবাসে না। কেয়ার করে না। অনুভূতি নেই। রাগারাগি, ভুল বুঝাবুঝি সবটা মিলিয়ে তিক্ততা চলে আসে।
কিন্তু যদি পুরো দিনে কিছুটা আমরা একে অপর কে দিই, বিশ্বাস কর নিজেকেই ভাগ্যবান মনে হবে। শুধু সামান্য কিছু সময়। চিন্তা কর তোমরা গত দশ বছরে একসাথে থেকেও এইভাবে টাইম কাটানো হয় নি। অবাক করা ব্যাপার কত গুলো দিন কত গুলো মাস একঘরে থেকেই একঘন্টা নিজের দাও নি তোমরা।
সন্তান গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু শেষ বয়সে এসে দেখ তোমাদের সাথে আমাদের কোন কথা নেই৷ তোমার মায়ের সাথে তোমার কথা নেই তুমি ব্যস্ত তোমার সংসারে। রাতুল ব্যস্ত ওর কাজে।
কিন্তু আমাদের শেষ সময়ে একজন আরেক জনের সাথেই থাকতে হচ্ছে। ছেলে মেয়েদের সময় দিতে গিয়ে আমরা নিজেরাই নিজেদের সময় দিতে ভুলে যাই। কিন্তু একটা ঘন্টায় কিন্তু তুমি বাচ্চা মানুষ করে ফেলছো না। কিংবা এরজন্য ওরা তোমাকে দোষী মানবে না। তোমাদের সর্ম্পক ভালো থাকলে ওদেরেই লাভ।
রাতুল আমার হাত চেপে ধরেছে আবার। মা আবার বলে,
– যে কোন সর্ম্পক একটা ছোট্ট গাছের মতো। একে যত্ন করতে হয়। পানি দিতে হয়, পরিচর্যা করতে হয়। যখন বড় হয়ে শেকড় গেড়ে ফেলে তখন রোজ পানি না দিলেও তাকে আর আলাদা করা যায় না। কিন্তু ছোট থাকতে না দিলে গাছ টা মারা যাবে। শেষ সময়ে গিয়ে যখন ফিরে তাকাবে দেখবে ভুল টা নিজেদেরই ছিলো। বিয়ের আগে সর্ম্পক গুলো ভীষণ ভালো থাকে কারণ তখন আমরা একজন আরেক জন টাইম দিই। কেয়ার করার চেষ্টা করি। বিয়ের পর যেন সব ভুলে যায়। যেন কেয়ার ব্যাপার টা থাকাই উচিত না। একটা সর্ম্পক আপনা আপনি চলে না। একে যত্ন করতে হয়।
এরপর পঁচিশ বছর পার হলো, আমাদের মধ্যে ছোট খাটো ঝামেলা হলেও কেউ কাউকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবি নি।
রিধির বিয়ে হলো। আমাদের ছেলে ও বিয়ে করলো, ওদের বিয়ের পাঁচ বছর পর ওরাও এক সকালে এসে বলল-
-ওরা ডির্ভোস নিবে।
আমি আর রাতুল একে অপরের দিকে তাকালাম, রাতুল বলে উঠলো,
-ঠিক আছে, তবে তোমাদের এক মাস এক ঘন্টা করে এক রুমে থাকার শর্ত মানতে হবে।
এক_ঘন্টার_শাস্তি
দোলনা বড়ুয়া তৃষা
৩.স্ত্রীর প্রতি অবহেলার গল্প
যেদিন আমার স্ত্রী অন্য জেলায় পোস্টিং হওয়ায় সরকারি চাকরি ছেড়ে এলো,সেই খবরটা শুনে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেলো, সেদিন ওকে খুব মেরেছিলাম।
এত এত মেরেছিলাম মন চেয়েছে ওকে খুন করে ফেলি।
মরেও যেতে পারত কিন্তু আমার ভাগ্য ভালো তাই এত মারের পরও ও মরেনি।
আসলে মরতে তো খুব বেশী চোট আঘাতের দরকার হয় না।কপাল খারাপ থাকলে ফুলদানির আঘাতেও মানুষ মরে যায়।দুই দিনের ডেঙ্গুতেও লোকে দুদিনেই নাই হয়ে যায়।
আমি সেই মারের পর ভেবেছিলাম ওর সম্বিত ফিরবে।
ও প্রকৃতিস্থ হবে।দুনিয়া কি সেটা বুঝবে।
এবার অন্তত আমার দিক থেকে ও মুখ ফেরাবে।একটু হলেও অভিমান করবে।
বাপ মাকে ডেকে দু চার দিনের জন্য হলেও বাপের বাড়ি যাবে।আমি একটু গা ছেড়ে হালকা হব।
আমি ওকে মেরে নাক মুখ ফাটিয়ে দিই।ঠিক কতগুলো ঘুষি লাথি মেরেছি নিজেরও মনে নেই।
মনে আছে চোর পেটানোর মতন অমন মার খেলে একটা পুরুষের ও সুস্থ হতে সপ্তাহখানেক সময় লাগবে।
সেদিন মারামারির পর রাগে আমি হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে একটা শার্ট গায়ে চড়িয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম।
ও মরল কি বাঁচল ফিরেও দেখলাম না।
অনেক রাতে বাড়ি ফিরে এলাম।
এক্সট্রা চাবি দিয়ে বাসায় ঢুকে দেখলাম সব ঠিক আছে।
টেবিলে আমার জন্য খাবার ঢাকা দেয়া আছে।
শুধু একটাই চেঞ্জ,আগের মতন দশবার বিশবার ফোন করে “কখন ফিরবা, কখন ফিরবা” বলে আজ বিরক্ত করেনি।কলিংবেল দেওয়া মাত্র লাফাতে লাফাতে গিয়ে দরজা খোলেনি।
আজ তো চাবি সাথেই ছিলো,বেল বাজাই ই নি। দেখলাম ও একটা কাঁথা মুড়ি দিয়ে খাটের এক কোনায় গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে।
আমার মাথা ঠান্ডা হলেও পুরোপুরি শীতল হয়নি।
ওকে ঘরে দেখে বরং বিরক্ত লাগছে।আমি কাপড় পাল্টে টেবিলে সাজিয়ে রাখা ভাত খেয়ে অন্য রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লাম।
ওর পাশে ঘুমালে আমার আবার বিরক্ত লাগবে।
বিরক্তি যখন যায়নি তখন যেকোন মূহুর্তে সেই বিরক্তি আবার রাগে পরিনত হতে পারে। তাই ঝুঁকি নিলাম না।নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতেই আলাদা রুমে ঘুমালাম। রাত বিরাতে প্রতিবেশীরা মারপিটের শব্দে চলে আসলে খুব খারাপ দেখাবে।
আমাদের বিয়েতে যে দু লাখ টাকা ওর বাপ যৌতুক দিয়েছিলো, ওর সরকারি চাকরি নিতে আমি ঐ টাকাটাই ঘুষের জন্য দিয়ে দিয়েছিলাম।
আর ও কিনা অন্য জেলায় থাকতে হবে বলে আমাকে না বলে চাকরি ছেড়ে এসেছে!
যদিও ও জানে আমাকে জানালে আমি চাকরি ছাড়তে দিতাম না।ওকে সেখানেই বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে বাধ্য করতাম।
কিন্তু ঐ পাগল নারী কিভাবে বুঝবে এই দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির যুগে সংসার একজনে চালানো কত কঠিন!
এটুকু বলে ভদ্রলোক থামলেন।
আমি আরও শোনার জন্য উনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি।
উনি সামনে থাকা গ্লাস থেকে একটু পানি খেলেন।
তারপর আবার বলতে শুরু করলেন।
আমার স্ত্রী ভালো মানুষ। বিয়ের পর থেকে ও কোনদিনই আমার কাছে কিছু আবদার করত না।
আমার কাছে এটা স্বাভাবিক ব্যাপার লাগত।
কোনদিন এসব নিয়ে ভাবিই নি।
ওর ছোট্ট একটা চাকরি ছিলো।সকাল সাতটায় যেত দুপুর বারোটার মধ্যে চলে আসত।
যে কয়টা টাকা বেতন পেত সেটা সংসারেই খরচ করে ফেলত।
আমি কোনদিনই ওর টাকা পয়সার খোঁজখবর রাখতাম না।
মাসের বাজার নিজের ইচ্ছেমাফিক করতাম।এরপর বাড়তি যা লাগত সব ও ই কিনত ওর টাকায়।
দু চার মাস পরপর টাকা জমিয়ে জমিয়ে ও সংসারের টুকটাক ফার্নিচার কিনত।
চোখেই দেখতাম ওর টাকা ঘুরেফিরে আমার সংসারেই খরচ হয়, তাই কখনও ওর বেতনের হিসেব চেয়ে ওর ছোট্ট স্বাধীন জগতটা নষ্ট করতে চাইতাম না।
নিজের জন্য কখনো শাড়ি, চুড়ি, জামা এসব কিনত না।
দুইটা তিনটা ড্রেস পরতে পরতে ফ্যাকাশে করে ফেলত।
নিজে কিনত তো নাই আবার আমাকেও কিনে দিতে বলত না।
এগুলো তখন খেয়াল করিনি কিন্তু এখন খুটিনাটি সব মনে পড়ে।
আমার জন্মদিন, আমাদের বিবাহবার্ষিকী এসব ও খুব আগ্রহের সাথে মনে রাখত।
সবসময়ই আমার প্রিয় ডেজার্ট রান্না করে ফ্রিজে রাখত।
ওর এতসব অতিরিক্ত যত্ন পেতে পেতে আমি এসব স্বাভাবিক ভাবে নিতে লাগলাম।ভাবলাম এইযত্ন আমার পাওনা,আমি এসব ডিজার্ভ করি।
আমার সাথে এমন আচরণ হওয়াই উচিত।
ভাবটা এমন, আমি ওর স্বামী হয়ে ওকে ধন্য করেছি।
শুরুর দিকে এত কেয়ারিং আমার ভালোই লাগত।
আমি নবাবের মতন ঘরে আচরণ করতাম।
আর ও দাসীর মতন ছিলো।
আমার মনের পাখা মেলা শুরু হলো।
কোন ভয়, কোন প্রশ্নের সম্মুখীন কোনদিনও হতে হবে না আমি বুঝতে পারলাম।
আমার বিয়ের আগের সম্পর্কগুলির খোঁজ খবর নিতে শুরু করলাম।
ওদেরও বিয়ে হয়ে গেছে ওরা কেউ আর আমার প্রতি আগ্রহী নয়।
বিষয়টা ইগোতে লাগলো।
আমি নিজের বেশভূষা, সাজগোজের দিকে মনোযোগ দিলাম।
নতুন প্রেমের প্রস্তুতি নিচ্ছি।
এদিকে ফোন হাতে দেখলেই আমার স্ত্রী কিড়মিড় করে।
ভয়ে সরাসরি কিছু বলে না।
কোন একদিন মোবাইল নিয়ে কিছু একটা বলেছিলো আমি ওকে চড় মেরেছিলাম।
কি বলেছিলো এতদিন পরে আর মনে করতে পারছি না।
এরপর থেকে নিয়মিত আমার মোবাইল নষ্ট হতে লাগলো।
মোবাইল সারাতে নিলে জানতাম মোবাইলে পানি ঢুকেছে।
প্রতিবারই এমন হত।
আমি সংসারের খরচ কমিয়ে মোবাইল কেনা ও সারানোতে মনোযোগ দিলাম।
এই কারণে বিভিন্ন উসিলায় আমি ওকে মারতাম।
আসলে একবার যার উপর বিরক্তি চলে আসে তাকে অসম্মান করতে কোন যৌক্তিক কারণ লাগে না।
বিয়ের চারবছর হয়ে গেছে। আমাদের কোন বাচ্চা আসেনি।
এটা নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই।
আমার স্ত্রীর ও বাচ্চার ব্যাপারে কোন আগ্রহ দেখি না।
আমার বাবা মা গত হয়েছেন তাই আমার ভালোমন্দ বলারও কেউ নেই।
আমার মনে হয় আমার স্ত্রীর কাছে আমিই তার বাচ্চা।
সকালে কখন উঠব,কখন কি খাব,আমার কাপড় ধবধবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা, কয়টায় ফিরব
এসব ছাড়া ওর জীবনে আর কিছু নেই।
কাজে গেলে দশবার ফোন দিত।ওর জন্য বাধ্য হয়ে ফোন সাইলেন্ট করা রাখতে হত।
শুরুর দিকে তো গুগল ম্যাপ থেকে লোকেশনের স্ক্রিনশট দিতে হত!
এরপর মারতে মারতে অত মাথায় উঠা বন্ধ হয়েছে।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় ও একটা রাতও কোথাও গিয়ে থাকত না।
বাপের বাড়ি আছে, বোনের বাড়ি আছে কোথাও গিয়ে রাতে থাকত না।
আমি না গেলে কোথাও যেতও না।
রাগ করে কত দাওয়াত যে বাদ দিয়েছি।
ওর ভাইয়ের বিয়েতে আমার কাজ ছিলো বলে আমি রাতে থাকিনি।
সবাই জোর করে ওকে রাতে রেখে দিয়েছিলো।
রাত চারটার সময় সে বাপের বাড়ি থেকে আমার কাছে চলে এসেছে।
আমি ওর এই একগুঁয়ে আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাম।
দমবন্ধ লাগত।হাসফাস লাগত।
ওর থেকে পালাতে চাইতাম।কিন্তু দুষ্ট গ্রহের মতন ও আমার পিছু লেগে থাকত।
কোন স্পেস রাখত না।
প্রায়ই আমি চেষ্টা করতাম কোন বন্ধু বান্ধবের বাসায় রাতটুকু থাকতে।
কিন্তু সার্কেলের সবাই অতদিনে বিয়ে-শাদি করে সংসারে থিতু হয়ে গেছে।
বিবাহিত লোক রাতে বন্ধুর বাসায় থাকা বন্ধুদের পরিবারের কাছে অশোভন দেখাত।
আমি খুব করে একটা প্রেমিকা পেতে চাইলাম।
এই শহরে পতিতা পাওয়া সহজ, প্রেমিকা নয়।
প্রেম হতে হলে সময় দেয়া লাগে কিন্তু আমার স্ত্রীর জন্য সেটিও সম্ভব নয়।
এত মারধোর করতাম
ও চেহারার ফোলা নিয়ে কাজে যেতে লজ্জা পেত।এ ছুতোয় ও ছুতোয় ছুটি নিত।তবু কোনদিনই ওর বাপমায়ের কাছে অভিযোগ জানাত না।
হঠাৎ একদিন অনেক গুলো ঘুমের ঔষধ খেয়ে ও সুইসাইড এটেম্পট করল।
সেবার অনেক টাকা লেগেছিল ওকে সুস্থ করতে।
ডাক্তারের পরামর্শে ওকে সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে নিয়ে গেলাম।
একে একে অনেক অন্ধকার দিক সামনে এলো।
আমি যা স্বাভাবিকভাবে নিয়েছিলাম এগুলো সবই সাইকিয়াট্রিস্ট এর ভাষায় অস্বাভাবিক।
এত যত্ন কোন স্বাভাবিক মানুষ কাউকে করতে পারেনা।
এত অবহেলা,অপমান সয়ে ভালোবেসে যাওয়া কোন কমন বিষয় নয়,এটা মনের অসুখ।
Obsessive love disorder
ওর বাবা মাকেও ওর অতীত জানতে সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে নিয়ে গেলাম।
জানা গেলো ছোটবেলায় ওর মা বিদেশে চলে গিয়েছিলেন।
সেটা ও মেনে নিতে পারেনি।
খুব ভালোবাসতেন যে দাদী, উনিও সে বছরই মারা গিয়েছিলেন।
সেই থেকে মনে বেধেছে এই অসুখ। ভালোবাসার মানুষকে ধরে রাখার অসুখ।
এ রোগ সহজে সারবার নয়।তবে ভালোবাসার মানুষ বিশ্বস্ত ভাবে শুশ্রূষা করলে সারতে পারে।
আমি আরও জানলাম, আমার স্ত্রী আমার পুরনো প্রেমের নতুন চারা গজানোর খবর জেনে গেছে।
সত্যিই
এরমধ্যে আমি পুরনো একজনের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করতাম।সেটা আরো নির্বিঘ্ন করতে ওর সরকারি চাকরির সুযোগটা কাজে লাগাতে চেয়েছিলাম।
আর আমার পরকীয়ার খবরের ধাক্কা ও নিতে পারেনি।সুইসাইড করতে চেয়েছিলো।
বাড়ি ফিরে আমি নিজেকে নিয়ে বসলাম।অনেক ভাবলাম।মন স্থির করলাম যে আমি আমার স্ত্রীর পাশে থাকব।
আমি আমূল বদলে গেলাম।অতটাই যত্ন কেয়ার করা শুরু করলাম যতটা ও আমাকে করত।
কিন্তু আমার স্ত্রী অস্বাভাবিক চুপচাপ হয়ে গেলো।
হু হা ছাড়া কিছুই বলত না।যে মানুষটা আমার সাথে একটু কথা বলার জন্য মুখিয়ে থাকত সে এখন পাথরের মতন নীরব।
নিয়মিত ডাক্তার দেখাই।ঔষধ বাড়ে কিন্তু রোগ সারে না।
একদিন ও মাথা ঘুরে পড়ে গেলো।বমিও হলো।মনে নতুন আশা উঁকি দিলো।
সুখবরের খুব আশা নিয়ে ডাক্তার দেখালাম।
আমাকে নির্বাক করে দিয়ে ওর ব্রেন ক্যান্সার ধরা পড়ল।
ডাক্তার বললেন সর্বোচ্চ পনেরো মাস বাঁচবে।
আমার দুনিয়াটা নড়ে গেলো।
এখন আর আমি ওর কাছ থেকে পালাতে চাই না।
আমার সারাজীবন ওর সাথেই কাটাতে চাই।
হলো না।
কথা বলতে পারত।কিন্তু ও আমার সাথে আর কথা বলে না।
ও একটা রহস্য হয়ে আমার সামনে স্থির হয়ে রইল।
আমি ওর অভিমান, শীতলতা দূর করতে পারলাম না।
ও একা একাই হাঁটতে যেত।
পথের কুকুর খাওয়াত।কুকুরের জন্য মায়া লাগলেও আমার উপর থেকে ওর অভিমান শেষ দিন পর্যন্ত অটুট ছিলো।
শেষের দুইমাস ওর যন্ত্রণা কমাতে ঘুম পারিয়ে রাখা হত।
আমি কপালে হাত রাখলে
ও বিড়বিড় করত।কিন্তু কথা বলত না।
পনেরো মাস পরেই ও মারা গেলো।
আমার মুক্তির স্বাদ পাওয়া উচিত ছিলো।
কিন্তু তা হলো না।
আমার কলিজার একটা অংশ যেন কেউ খাবলা মেরে নিয়ে গেছে।
ঐ অংশটায় প্রতিনিয়ত যন্ত্রণা হয়,রক্ত ঝরে।
মন্ত্র মুগ্ধের মতন আমি এতক্ষণ রোগী ভদ্রলোকের কথা শুনছিলাম।
এইবার প্রশ্ন করলাম উনি ঠিক কি সমস্যা নিয়ে আবার সাইকিয়াট্রিস্ট এর চেম্বারে এসেছেন।
উনি আবার বলতে শুরু করলেন।
ওর মৃত্যুর ধাক্কা সামলাতে আমার বছরখানেক সময় লেগেছে। আমি শুধু কাঁদতাম।
মাসখানেক ধরে ও আমার কাছে আসে।বসে।ধরা দেয়। হাসে।গল্প করে।
যাবতীয় প্রেম আমাদের ঘটে যায় মগজে,হৃদয়ে।
আমি ওর সাথে খিলখিল করে হাসি কিন্তু লোকে ভাবে আমি একা হাসি,কথা বলি।
সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে এসেছি এ আমার মনের অসুখ কিনা জানতে।
আচ্ছা বাবা মনের রোগ স্থায়ী করার কোন ঔষধ আছে?
মায়া
Farida Ali Khan
Narayanganj.
৪.স্বামীর প্রতি স্ত্রীর ভালোবাসার গল্প
আমি আমার পাঁচ মাসের প্রেগন্যান্ট স্ত্রী আরিশার শাড়ি ধুয়ে ছাদে দেওয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছিলাম।
আমার বোন ছায়া এসে চেচিয়ে উঠলো।
– বাচ্চা কি শুধু তোর বউয়ের একার হচ্ছে?দুনিয়ায় আর কারো হয় না? কি এমন নাবাবের মেয়ে যে তোর বউ জামাইকে দিয়ে কাপড় ধোয়াতে হচ্ছে।
আমি আপাকে বললাম,
– নাবাবের মেয়ে তো তুইও না তাও তো ভাইয়া তোর জন্য দুই টা কাজের মেয়ে রেখেছে। আমার যখন সে সামর্থ্য নাই আমিই করছি!
– যা যা। কর বউয়ের কাজ। বউকে শোকেসে তুলে রাখ।
আমি আবার হেসে বললাম,
– পারলে তো রাখতাম যেমন করে তোকে রেখেছিল মা। মা তো নেই। আর ওর মা ও নেই। তাহলে কে রাখবে বল। তোর ও সে সময় নেই।
– আমি কি তোর বউ কে কোন অপূর্ণ রাখছি। সব তো দিচ্ছি।
– তাইলে আপু ওর জন্য থাই স্যূপ টা বানিয়ে দেয় না আমি যাওয়ার আগে খাইয়ে দিয়ে যাই।
আমার কথা আপু রেগে স্যূপের প্যাকেট নিয়ে ওর কাজের মেয়েকে দিয়ে ওর রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো।
বন্ধ করা আগে বলল,
– আমরা যেন মা হই নি?এমন বেড রেস্ট আমাদের তো কোন ডাক্তারে দেয় নি
আমি শামীম। আমার মা বাবা নেই। আমার স্ত্রী আরিশার ও মা নেই। বাবা আছে তাও অনেক অসুস্থ। আমি বোনের সাথে থাকি। যেহেতু আমি সারাদিন বাইরে থাকি তাই বোনের কাছে রাখলাম।
আরিশার প্লাসেন্টা নিচের দিকে থাকার কারণে ওকে বেড রেস্ট দেওয়া হয়েছে। কোন ভারি কাজ করতে মানা করছে।
একেক জনের শরীর তো একেক রকম। কেউ খুব দুর্বল হয়, কেউ খেতে পারে না।
কারো বেশি কারো কম।
কিন্তু যে মেয়েরা এইসব ফিল করে যায় তারাই যেন আরেক জনের ব্যাপারে এইসব বুঝতে চায় না।
আমি রুমে যেতে আরিশা বলে উঠল,
– বোনের সামনে আমাকে ছোট বানিয়ে নিজে মহান সাজছো? আমি কিছু করতে পারি না। আমি খারাপ বউ এইটা বলছো? এইটা প্রমান করতে চাইছো?
বলতে বলতে কান্না শুরু করব দিলো আরিশা। আমি চুপ করে তাকিয়ে রইলাম।
আমি চুপ করে আছি দেখে আরিশা আবার বলল,
– তুমি আমার জন্য আপুর সাথে ঝগড়া করে এলে আর আমি তোমাকে কথা শোনাচ্ছি। আমি খুব খারাপ তাই না?
এই বলে আবার কান্না করতে লাগলো।
আমি জিব বের করে ওকে এক ভেঙচির মতো দিতে ওর আবার হেসে উঠলো।
– ডিম সিদ্ধ রেখে গিয়েছি।খেয়েছো?
আরিশা মুখ চেপে ধরে বাচ্চাদের মতো বলল,
আরিশা- না না না৷
আমি ওকে চেপে ধরে খাওয়াতে লাগলাম।
এইসময় মেয়েদের খুব মুড সুইং হয়। এই হাসে আর এই কাঁদে।
কেন কাঁদছে নিজেও জানে না। অনেক দিন ধরে নিজেকে বন্ধী রাখা বা হরমোন চেঞ্জের কারণে মেয়েদের মনে হয় তারা কিছু না এখন আর। তাদের সব যত্ন বেবির জন্য।
কিন্তু এদের এই ব্যাপার গুলো নিয়ে আপনি মন খারাপ করলে বা কথা শোনালে বা তাকে সামলাতে বললে কোন কাজ হবে না। উল্ট সে আরো ভেঙে যাবে।
এইগুলো তো ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু যে কষ্ট টা আপনি এখন দেবেন তা সারাজীবন দাগ কেটে থাকবে।
আমি অফিসের যাওয়ার আগে ওর ওষুধ আর সব কিছু গুছিয়ে দিয়ে অফিসে গেলাম।
সন্ধ্যায় যখন ফিরলাম দেখলাম ও ঘুমাচ্ছে৷ আমি ওকে জাগালাম না।
কারণ আমি যখন রাতে আরামে ঘুমাই সে দশ থেকে বারো বার উঠে উঠে ওয়াশরুমে যায়।
যে মেয়ের রাতে ঘুমালে কোন দিকে রাত যাচ্ছে খবর থাকতো না সে মেয়ে এখন একঘন্টাও টানা ঘুমাতে পারে না।
আমি চা বানিয়ে এনে বসলাম।
আপু এসে বলল,
– এই অবেলায় ঘুমাচ্ছে কেন ও?ডেকে দেয় না।
– ওর ঘুম যখন আসে সে ঘুমাক না। রাতে তো ঘুমাতে পারে না ও।
– তাই বলে ভর সন্ধ্যায় ঘুমাবে? বাচ্চার জন্য ভালো না।
– তুই ইকোনোমিকে মাস্টার্স করেও এখনো এইসব মানিস? ওর সুবিধা মতো ও যত ঘুমাবে বেবিও রেস্ট পাবে। এমন না যে ও সারাদিন ঘুমাচ্ছে৷
– আমরা তো মানছি। মানলে তো দোষের কিছু না। আমরা মানছি আমাদের তো কোন ক্ষতি হয় নাই।।
আমাদের কথা আরিশা উঠে গেল।
– আমার চোখ লেগে এসেছিল। রাতে ঘুম হয় না তো।
আমি ওর দিকে চায়ের কাপ টা এগিয়ে দিয়ে বললাম।
– ঠিক আছে। খাও।
আরিশা উঠে বসতেই আপু বলল-
– যে জন্য এসেছিলাম, কাল আমার জায়ের ভাইয়ে বিয়ে। অফিস থেকে তাড়াতাড়ি আসিস।
আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। আরিশা খুব খুশি হলো।
তারপর ও রান্নাঘরে রান্না করতে চলে গেল।
পরের দিন আমি অফিস থেকে ফিরে দেখি আরিশা অনেক গুলো শাড়ি নামিয়ে রেখেছে কোন টা পরবে না কোন টা পরবে। অনেক গুলো সেট আর চুড়ি।
তার মধ্যে লাল রং এর একটা শাড়ি নিলো।আমাকে দেখালো। আমি সায় দিতেই ও সেটা পরে নিলো। আমি জানি ওর প্রিয় রং লাল।
তারপর ও রেডি হয়ে নিলো।
আপু ডাক দিলো,
– কি রে রেডি তুই?
– হ্যাঁ আমরা রেডি আসছি। আরিশা চুড়ি পরবে শুধু।
আপু তাড়াতাড়ি রুমে ঢুকে বলল৷
– আমরা? মানে আরিশা রেডি হচ্ছে কেন?
– কেন ও যাবে না?
– এই অবস্থায়?
আমি হেসে বললাম, কি অবস্থায়?
– এই অসুস্থ অবস্থায় ও বিয়েতে যাবে এত মানুষের সামনে?
– প্রেগ্ন্যাসির কি অসুস্থতা নাকি? ওর ভারি কাজ করা বারণ বেড়াতে যাওয়া না।
আরিশা কান্না কান্না চোখে তাকিয়ে আছে। চুড়ি খুলে রেখে দিলো।
– মা নেই বলে কি বড় দের কোন নিয়ম মানবি না?। মানুষের চোখে পড়বে। ভালো না। তারপর লাল শাড়ি পরেছে। তোমাকে না আমি বলেছি এই সময় লাল রং এর কিছু পরতে নেই, বাচ্চার ক্ষতি হয়। আমাদের শেখানো হয়েছে।
আরিশা শাড়ি খুলতে নিলে আমি বললাম,
– শাড়ি খুলিও না তুমি। আর আপু, মানুষের চোখে পরবে মানে? আমাদের অফিসে তিন জন মাহিলা আসে প্রেগন্যান্ট। রোজ এত মানুষের সাথে তাদের দেখা হয় তাদের তো কিছু হয় না। দুজনে লাস্ট মাসে সুস্থ স্বাভাবিক বেবি হলো। কই কি হলো?
আর কাপড়ের সাথে বেবির ক্ষতির কোন কানেশন নেই৷ বরং আরিশা ওর পছন্দ মতো কাপড় পরতে পারলে ওর মন ও ভালো থাকবে বাচ্চার মন ও ভালো থাকবে । আর ও যে ডাক্তারে কাছে যায়৷ সব মেয়েই যায় তখন ওখানে এত মানুষে দেখে তখন তো কিছু হয় না।
কবে যে ছাড়বি আপু এইসব?
– আমরা তো বেবি হওয়ার আগে আর পরে দুই বছর এইসব অনুষ্টানের মুখ দেখি নাই।তোদের না যত ইচ্ছে?
– তুই দেখিস নাই, কিন্তু তোর কি ইচ্ছে হতো না? হতো কিনা বল?
– হতো। কিন্তু আমরা বাচ্চার কথা ভেবে সেক্রিফাইস করছি। একটায় তো বছর।
– কিন্তু তাও তোর ইচ্ছে হতো৷ তুই পারিস নি বলে কি সেও পারবে না। এইটাকে সেক্রিফাইজের নাম দিয়ে আর কত কাল মেয়েদের ইচ্ছে গুলো দমিয়ে রাখবি বল তো?
– থাক এত কথা বলার দরকার নাই। আমি যাব না।
– দরকার আছে। কত শখ করে সারাদিন খুশি মনে সেজেছো তুমি। খুলবা না কিছু৷ চল আমরা বের হই।
আপু তুই যা বিয়েতে আমি যাব না৷ আমি ওকে নিয়ে অন্য কোথায় ও ঘুরে আসি।
– আমি তো তোদের ভালোর জন্যেই বলেছি।
– জানি আপু। তবে ল্যান্ডফোনে ভালো কল কথা শোনা যেত বলে কি তুই এখন স্মার্ট ফোন উইস করিস না?
চলার পদ্ধতি যেমন চেঞ্জ হচ্ছে চিন্তাও চেঞ্জ করতে হবে।
এই বলে আমি আরিশা কে নিয়ে বের হয়ে গেলাম।
ওর চোখে মুখে যে হাসি ফুটে উঠেছে আমার মনে হলো ওর ভেতরের আমার সন্তান ও হাসছে৷
প্রেগ্ন্যাসির দারুন একটা জার্নি মেয়েদের জন্য। তাদের চেনা জানা পুরো জীবন উলটপালট হয়ে যায়। তাদের শরীর তাদের চিন্তা ভাবনা সব।
হাজারো সমস্যা ঘুমাতে না পারা৷ মুড সুইং।
এইসবে বিরক্ত না হয়ে তাদের বুঝার চেষ্টা করুন।
যে মেয়েটা তার পুরো শরীর বাজি রেখে আপনার সন্তান আনছে এই পৃথিবীতে। সব টা উজার করে। এত কষ্ট সহ্য করে সে মা হয়ে উঠছে।
আর আপনি যদি তাদের সামান্য ইচ্ছে পূরণ করতে না পারেন৷ যত্ন নিতে না পারেন, মুড সুইং সহ্য করতে না পারেন তাহলে আপনি বাবা হচ্ছেন কীভাবে?
শুধু নাম দিলে কি বাবা হওয়া যায়? বাবা হওয়াও একটা প্রক্রিয়া।
প্রেগ্ন্যাসির দুজনেরি মা বাবা হওয়ার সমান প্রক্রিয়া।
সমান জানিং।
#প্রেগ্ন্যাসি_যত্ন
#দোলনা_বড়ুয়া_তৃষা
৫.স্বামি স্ত্রীর গল্প
আজব সমস্যা
——————-
আমার স্ত্রী তমা মাঝে মধ্যেই আমাকে ঠিক রাত দুটোর সময় ঘুম থেকে ডেকে ওঠায়।কি ভাবছেন, রোমান্টিক কিছু ? জি না,প্রথম প্রথম আমিও তাই ভাবতাম।কিন্তু পরে দেখলাম,বিষয়টা হচ্ছে ঝগড়া করা।প্রকৃতপক্ষে ঝগড়া করার জন্য সে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে ওঠায়।সারাদিন যতই সমস্যা হোক,সে কোনো ঝগড়া করবে না।সে অপেক্ষায় থাকে মাঝরাতের।তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,এর কারণ কি ? সে কোনো উত্তর দেয়নি।তবে আমি এর দুটো কারণ খুঁজে পেয়েছি।এক,হঠাৎ কাঁচা ঘুম ভেঙে জেগে উঠলে ব্রেন ঠিক মতো কাজ করে না,কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না।যার কারণে ঘুম থেকে জেগে উঠা ব্যক্তি ঝগড়ায় বেশি সুবিধা করতে পারে না। দুই,গাঢ় ঘুম থেকে উঠিয়ে ঝগড়ার মাধ্যমে স্বামীকে বেশি মানসিক নির্যাতন করা যায়।তাই হয়তো সে এমনটা করে।তাকে এমনটা না করার জন্য অনেক বুঝিয়েছি,কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।ও আর একটা কথা,তার ঝগড়ার বিষয়গুলো খুবই হাস্যকর।বলতে পারেন,ছেলেমানুষীতে ভরা।
মধ্য রাত।আমি গভীর ঘুমে তলিয়ে আছি।হঠাৎ তমা আমাকে শরীর ঝাঁকিয়ে ধাক্কা দিয়ে বলল,
-উঠে বসো।
আমি চোখ না খুলেই বললাম,
-ভাইরে,সকালে আমার অফিস আছে।এখন ঘুমাও। কথা দিলাম, কাল অফিস থেকে এসেই ঝগড়া করব।
-না, আমি এখনই ঝগড়া করব।
-শোনো ঝগড়া করার দরকার নাই। তুমি যে বিষয়ে ঝগড়া করবে বলে ঠিক করেছ,তাতে তুমিই জয়লাভ করেছ।আমি পরাজয় বরণ করেছি।এখন ঘুমাও।
-তোমাকে আমি উঠে বসতে বলেছি।
-সব সময় উঠে বসে ঝগড়া করতে হবে কেন ? ঝগড়া তো শুয়ে শুয়েও করা যায়।আমার এ ব্যাপারে একটা কোর্স করা আছে।আমি পারব।তুমি ঝগড়া শুরু করে দাও।
-তুমি কি উঠবা,নাকে আমি বিছানায় পানি ঢেলে দেব ?
কি আর করা। বাধ্য হয়ে উঠে বসলাম।আমি উঠে বসতেই দেখলাম সে তার ফোন কে বিছানার একপাশে ট্রাইপডে সেট করছে।আমি অবাক হয়ে তাকে প্রশ্ন করলাম,
-কি করছ !
-পুরো ঝগড়ার সেশনটা রেকর্ড করব।তাই ফোনটাকে সেট করছি।
-কেন ? ঝগড়া রেকর্ড করতে হবে কেন ?
-তুমি যদি ঝগড়ার সময় উচ্চবাচ্য করো,বা খারাপ শব্দ ব্যবহার করো, তাহলে এই ভিডিও আমি নেটে ছেড়ে ভাইরাল করে দেব।
-আচ্ছা তোমার পাগলামি কি কখনো কমবে না ? এইভাবে ব্লাকমেইল করলে ঝগড়া করব কিভাবে ? এখন তো তুমি আমারে মাইর দিলেও আমাকে হাসি-মুখে হজম করতে হবে।
-আমি স্বামীর গায়ে হাত দেব কেন ? আমি কি অশিক্ষিত ? আমি কি অভদ্র ?
আমি মুখে কিছু বললাম না।তবে মনে মনে বললাম,তুমি অভদ্র, অশিক্ষিত না,সেটা আমি জানি।সমস্যা হচ্ছে তুমি ছিটগ্রস্থ। ভয় তো ওখানেই।
সে ফোনে রেকডিং অন করে দিয়ে সরাসরি ঝগড়া শুরু করে দিল,
-তুমি ফেসবুকে এসব ফালতু কি লেখ ?
-ও মাইগড,তুমি ফেসবুকে আমার লেখা গল্প পড় ? জেনে ভালো লাগল ।
-ওগুলোকে গল্প বলে নাকি ! শোনো আজ থেকে তুমি ওসব ফালতু লেখা আর লিখবে না।
-তুমি আমার লেখা গল্পকে ফালতু বলছ কেন ?
-ফালতুকে ফালতু বলব না তো কি বলব ?ওখানে শিক্ষণীয় কিছু কি আছে ? দুনিয়ার সবাই তোমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে।আজ আমার বান্ধবী লিজা ফোন করে হাসতে হাসতে বলল,ওমা তোর হাসব্যান্ড কি ফানি !
-আরে বোকা ওটা তো প্রশংসা। তোমার তো খুশি হওয়া উচিত।
-শোনো আমি আমার বান্ধবীকে ভালো করে চিনি।ও আমার কাছে বলেছে ফানি,আর মানুষের কাছে গিয়ে বলবে,তমার জামাই একটা পার্টসলেস ফালতু জোকার মানুষ।আর তাছাড়া ওকে বলতে হবে কেন ? আমি তো নিজেই দেখছি, সবাই তোমার গল্পের মন্তব্যে হাহা, হিহি,হুহু লিখছে।
-শোনো,আমি তো রম্য গল্প লিখি।পাঠক ঐ গল্প পড়ে মজা পায়। সে কারণে তারা হাসাহাসি করে আর মন্তব্যে হা হা হি হি লেখে। মনে রাখবে রম্য গল্প একটা শিল্প।মানুষকে হাসানো অনেক বড় কাজ।
-এটা শিল্প না বাণিজ্য তা আমার জানার কোনো দরকার নাই।আর পাবলিক কে হাসানোর দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকার তোমাকে দেয়নি।তাই এখন থেকে এসব হাহা হিহি লেখা বাদ।তোমার যদি খুব লিখতে ইচ্ছে হয়,তাহলে এখন থেকে প্রেমের গল্প লিখবে।তাতে এটলিস্ট সবাই বলবে, আমার স্বামী একজন রোমান্টিক লেখক।
-ওকে।তোমার ঝগড়া কি শেষ ? তাহলে এখন একটু ঘুমাই ?
তমার কঠোর নির্দেশনার পর,রম্য গল্প লেখা বন্ধ করে প্রেমের গল্প লেখা শুরু করলাম।কিছুদিন পর আবার একদিন মধ্যরাতে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে উঠাল।আমি চোখ খুলে দেখলাম,যথারীতি ফোনে রেকডিং হচ্ছে।আর দেখলাম, তমা ব্যাগ গোছাচ্ছে।আমি অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
-কি ব্যাপার ব্যাগ গোছাচ্ছ কেন ? আমরা কি কাল সকালে কোথাও বেড়াতে যাচ্ছি?
-না,আমরা কোথাও যাচ্ছি না।শুধু তুমি যাচ্ছ।
-আমি যাচ্ছি ! কোথায় ?
-সেই সিদ্ধান্ত তুমি নেবে।আমি শুধু জানি, এ বাসায় তোমার আর থাকা হচ্ছে না।
-কেন ? আমি কেন এই বাসায় থাকতে পারব না !
-কারণ,তোমার সাথে আমি আর সংসার করব না।
-এমন সহজ সরল স্বামীকে নিয়ে সংসার করবে না, কেন ? সেটা তো বুঝতে পারছি না।
-বুঝতে পারছ না ? ওকে,মেঘলা কে ?
-কোন মেঘলা ? আমি তো এই নামে কাউকে চিনি না।
-তুমি মেঘলাকে চিনো না, না ?
-কেন, উনাকে আমার চেনার কথা নাকি ?
-ন্যাকামো করবে না।মনে হচ্ছে তুমি আকাশ থেকে পড়েছ।আমি সেই মেঘলার কথা বলছি, যাকে নিয়ে গল্প লিখে আজ ফেসবুকে দিয়েছ।
-ও তাই বলো।হা হা হা…..
-হাসি দিয়ে বিষয়টি হাল্কা করার চেষ্টা করবে না।বল,এই মেয়ের সাথে তোমার কতদিনের সম্পর্ক ?
-আরে বাবা এ নামের কাউকে আমি চিনি না।
-না চিনলে, ঐ মেয়ের কোমরে যে তিল আছে, সেটা তুমি জানলে কিভাবে ?
-আরে ওটা তো যাস্ট কল্পনা করে লেখা।
-আচ্ছা তুমি কি জানো, আমার কোথায় কোথায় তিল আছে ?
-না,সবগুলো বলতে পারব না।
-আমি তোমার স্ত্রী,তুমি আমার তিলের খবর জানোনা।অথচ কল্পনায় তুমি ঐ মেয়ের কোমরের তিল দেখে ফেললে ? তোমার কি ধারণা আমি ফিডার খাই ? ব্যাটা বদমাস, ব্যাটা লুইচ্চা।
-দেখ ঐ লুইচ্চা শব্দটা ব্যবহার করবা না।ব্যক্তিত্বে লাগে।তুমি যে আমাকে লুইচ্চা বলে গালি দিচ্ছ,তুমি কি জানো, লুইচ্চা ব্যক্তিরা দেখতে কেমন হয়,আর তারা কি কি করে ?
-জানব না কেন ? অবশ্যই জানি।লুইচ্চা ব্যক্তিরা দেখতে অবিকল তোর মতো হয়।আর এখন তুই যা করতেছিস,লুইচ্চা ব্যক্তিরাও তাই তাই করে।নিজের বউ বাদ দিয়ে অন্য নারীর কোমরের তিল খুঁজে বেড়ায়।
-আচ্ছা সরাসরি বলত,তুমি আসলে কি চাও ? তুমি কি চাওনা আমি লেখা-লেখি করি ? তুমি কি আমাকে লিখতে মানা করতেছ?
-না,আমি তোমাকে লিখতে মানা করছি না।
-মানা করছ না।কিন্তু আমি যাই লিখি তাতেই তো তোমার সমস্যা।তাহলে আমি এখন কি লিখব ?
-তুমি এখন থেকে শুধু কবিতা লিখবে।তোমার গল্প লেখা বন্ধ।
এরপর থেকে আমি গল্প লেখা বাদ দিয়ে কবিতা লেখা শুরু করেছি।
আজ আমার শ্বশুর-শাশুড়ির বিবাহবার্ষিকী।সে উপলক্ষে আমার শ্বশুর বাড়িতে এক পার্টির আয়োজন করা হয়েছে।বাসার ছাদে অনুষ্ঠান চলছে।মোটামুটি অনেক আত্মীয়-স্বজন উপস্থিত হয়েছেন।খাওয়া-দাওয়া পর্ব শেষে এখন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছে।কেউ নাচ,কেউ গান, কেউ কৌতুক,সবাই কিছু না কিছু করছে।আমি আমার লেখা একটা কবিতা আবৃত্তি করার জন্য দাঁড়ালাম।স্টেজের সামনে সবাই চেয়ারে বসে আছে।আমি গলাটা একটু পরিষ্কার করে আবৃত্তি শুরু করলাম।
“ইটের খাঁচায় বন্দী এই জীবন
বুক ভরে শ্বাস নিতে পারিনা,
মেঘের আড়াল থেকে কে যেন ডেকে বলে,
সব ছেড়ে ছুঁড়ে তুই বনবাসে যা চলে।
শহুরে এই পাথুরে জীবনে,
তুই বোধহয় বাঁচবি না।”
এতটুকু আবৃত্তি করতেই দেখলাম তমা বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল।তারপর দাঁত কিটমিট করে বলল,
-ঐ বদমাস তোর কি আবার বিয়া করার খায়েশ হইছে ?
সবাই অবাক হয়ে তমার দিকে ঘুরে তাকাল।তমার পাশে বসা আমার শ্বাশুড়ি তমাকে হাত ধরে বসাতে চেষ্টা করতে করতে বলল,
-এই,তুই এসব কি বলিছস ?
-শোনো মা,আমি যা বলছি,সত্য বলছি।তোমরা ভাবছ,সে কবিতা পড়ছে ? না মা, সে তার মনের খায়েশ ঘোষণা করছে।তোমরা কি মনে কর,এই বদমাস বনবাসে গেলে একা যাবে ? প্রশ্নই আসে না।যেই বজ্জাত মহিলা ওরে মেঘের আড়াল থেকে ডাকতেছে, ঐ মহিলাকে সাথে নিয়েই সে বনবাসে যাবে।
একথা বলেই তমা দ্রুতবেগে স্টেজের কাছে এসে আমাকে পাকড়াও করল। তারপর হাত ধরে টেনে নিতে নিতে বলল,
-চলো,তোমার পার্টি শেষ।
সারা রাস্তা সে কোনো কথা বলল না।বাসায় ঢুকেও সে কিছু বলল না।কিন্তু মাঝরাতে সে ঠিকই ঘুম থেকে ডেকে উঠাল।
-সত্যি করে বলো,যে মেয়ে তোমারে মেঘের আড়াল থেকে ডাকে, সে কে ?
-বিশ্বাস করো এমন কোনো মেয়ে নাই। এগুলো সবই কল্পনা।
-ঐ ব্যাটা দুনিয়ায় আর কেউ লেখা-লেখি করে না ? তুই কি একা লিখছ ? তুই কি একা কল্পনা করোস ? তোর কল্পনায় সবসময় শুধু মেয়ে মানুষ আসে ক্যান।কোনো পুরুষ মানুষ আসতে পারে না ? শোন এখন থেকে তোর কবিতা লেখাও বন্ধ।
-এটা কি বললা ?
-হ্যা ,এখন থেকে তুই ছোটদের জন্য রূপকথার গল্প লিখবি।আর কবিতা লিখতে পারবি না।
আমি এরপর ছোটদের জন্য রূপকথার গল্প লেখা শুরু করলাম।ভাবলাম এবার হয়তো নিশ্চিন্তে সাহিত্য চর্চা করতে পারব।কিন্তু না,এখানেও সমস্যা।
সেদিন ছিল তমার জন্মদিন। অনেক চিন্তা করে তমার জন্মদিনে আনকমন একটা কিউট গিফট কিনলাম।জন্মদিনে উপহার হিসেবে কাঁটাবনের পশু-পাখি মার্কেট থেকে একটা ময়না পাখি কিনে আনলাম।পাখিটা বাসায় এনে লুকিয়ে রাখলাম। ঠিক করলাম রাত বারটা এক মিনিটে তাকে সারপ্রাইজ দেব। কিন্তু আমার কপাল খারাপ। কখন জানি ঘুমিয়ে পড়লাম।তমা মাঝরাতে যথারিতী আমাকে ডেকে উঠাল।ঝগড়ার মেজাজে বলল,
-তোমার কি মনে আছে, আজ আমার জন্মদিন।
-শোনো, আজ ঝগড়া করার কোনো সুযোগ তুমি পাবে না। কারণ তোমার জন্মদিন আমার মনে আছে।আর শুধু তাই না,আমি তোমার জন্য গিফটও নিয়ে এসেছি।
-তাই ! কই দাও।
আমি পাখিটা নিয়ে রুমে ঢুকতেই চোখ-মুখ কুঁচকে বলল,
-এটা কি আনছ ?
-তোমার জন্মদিনের গিফট।
-আমি কি তোমার কাছে ময়না পাখি গিফট চাইছি ?
-না, তা চাওনি।আমিই পছন্দ করে আনছি।
-দুনিয়ায় আর কোনো গিফট পাও নাই ?
-এই গিফটে সমস্যা কি ? কি সুন্দর ময়না পাখি।জানো এটি কিন্তু কথা বলতে পারে।
-তাতো পারবেই।কারণ এটা তো পাখি না। এটা তো তোমার প্রেমিকা।
-মানে কি ! কি উল্টা-পাল্টা কথা বলছ ?
-আমি উল্টা-পাল্টা বলছি ? এই তুমি না কয়েকদিন আগে একটা গল্প লিখছিলা ? এক রাজকন্যা,দরবেশের অভিশাপে ময়না পাখি হয়ে গিয়েছে।ঐ রাজকন্যা দিনের বেলা পাখি থাকে,আর সূর্য ডুবলে হয় সুন্দরী রাজকন্যা ।
-হ্যা লিখছিলাম । তো কি হয়েছে ?
-কি হয়েছে মানে ? এইটা তো সেই ময়না,তাই না ? এখন প্রতি রাতে আমি ঘুমালে এই পাখি মেয়ে হয়ে যাবে,তারপর তোরা দুইটা মিলে ফুর্তি করবি,তাই না ?
-ভাইরে আল্লাহ তোমারে কি দিয়া বানাইছে ? তুমি এসব উদ্ভট কথাবার্তা কোথা থেকে আমদানি করো ? পাগলামির তো একটা সীমা থাকে,তাই না ?
-আমি পাগলামি করি ? আমি পাগল ? ঠিক আছে,এখন দেখ পাগলামি কাকে বলে।
একথা বলেই সে খাঁচার দরজা খুলে পাখিটিকে ছেড়ে দিল।তারপর আমার সামনে এসে বলল,
– শোনো এখন থেকে তোমার রূপকথার গল্প লেখা বন্ধ।
-আমিও তাই ভাবছি।এখন থেকে শুধু রূপকথার গল্পই না,আমি আর কোনো কিছুই লিখব না।
-কেন লিখবে না। অবশ্যই লিখবে।পরে তুমি মানুষের কাছে বলে বেড়াবে,স্ত্রীর কারণে তোমার প্রতিভা নষ্ট হয়েছে।আমি তো এই অপবাদ মাথায় নেব না।
-আরে বাবা,তুমি তো আমার রম্য গল্প, রোমান্টিক গল্প, রূপকথার গল্প, কবিতা সব লেখাই বন্ধ করে দিয়েছ। তাহলে আমি এখন লিখব কি ? লেখার তো আর কিছু বাকি নাই।
-হামদ-নাত।এখন থেকে তুমি হামদ-নাত লিখবা।
-কি লিখব ?
-হামদ-নাত লিখবে। শোনো এতে সাহিত্য চর্চাও হবে, আবার চরিত্রও ঠিক থাকবে।
কিছুই বললাম না। অবাক দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
জি,আমি এখন হামদ-নাত লিখছি। জানিনা,কয়দিন লিখতে পারব। আমি শিওর এখানেও সে কিছু একটা বের করে ফেলবে।তার সেই প্রতিভা আছে।
বি.দ্রষ্টব্য :
তমার পাগলামিতে মাঝে মাঝে হয়তো কিছুটা বিরক্ত হয়ে উঠি।তবে ওকে কিছু বলি না।কারণ ও যেমন পাগলামি করে, তেমন পাগলের মতোই আমাকে ভালোবাসে।ভালোবাসার মানুষ একটু পাগলামি করবে না তো কে করবে বলেন ?