শব্দরের পা দুটো নিজের থেকেই চলতে শুরু করে সুফিয়ানের ঘরের দিকে। সুফিয়ান প্রায়শই দুঃস্বপ্নের কবলে পড়ে চিৎকার করেন, যা তার স্বাস্থ্যের অবনতির প্রধান কারণ।
সুফিয়ানের ঘরের সামনে এসে শব্দর থমকে দাঁড়ায়। দরজায় কড়া নাড়বে কি না, এই দোটানায় পড়ে গেল সে। কিছুক্ষণ ইতস্তত করার পর আস্তে করে দরজায় টোকা দিল। অবাক হয়ে দেখল, দরজাটা আগে থেকেই খোলা ছিল।
ঘরের ভেতরটা অন্ধকারে ডুবে আছে। কোনোমতে চোখ সয়ে এলে শব্দর দেখতে পায়, সুফিয়ান বিছানায় উঠে বসে আছে। তার মুখে গভীর উদ্বেগের ছাপ। চোখ দুটো ভয়ে বিস্ফারিত।
শব্দর দ্রুত ঘরে ঢুকে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “ভাইজান, কী হয়েছে? আপনি ঠিক আছেন তো?”
সুফিয়ান কাঁপা হাতে শব্দরকে কাছে টেনে নিলেন। তার চোখে তখনও ভয়ের ছায়া। কষ্টে বললেন, “শব্দর, আমি… আমি কিছু দেখেছি। একটা ছায়ামূর্তি… এই ঘরেই পায়চারি করছিল।”
শব্দর ভাইয়ের হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে বলল, “ভাইজান, হয়তো আপনি দুঃস্বপ্ন দেখেছেন। চিন্তা করবেন না, আমি এখানে আছি, আপনার পাশে আছি। ভাবি… ভাবি কোথায়?”
ঠিক তখনই হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকল ললিতা। সে শৌচাগারে ছিল, তাই সুফিয়ানের চিৎকার শুনেও সঙ্গে সঙ্গে আসতে পারেনি। অনেকদিন পর স্বামীর এমন আর্তনাদ শুনে সেও বিচলিত হয়ে পড়েছে।
ললিতা স্বামীর দিকে ঝুঁকে করুণ স্বরে জিজ্ঞেস করল, “আবার কি দুঃস্বপ্ন দেখলেন?”
সুফিয়ান তখনও কাঁপছিলেন। তিনি স্ত্রী ও ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “দুঃস্বপ্ন নয় ললিতা। আমি জেগে ছিলাম। সত্যিই দেখেছি… একটা ছায়ামূর্তি… এই ঘরেই ঘুরছিল।”
শব্দর ও ললিতা পরস্পরের দিকে তাকাল। তাদের চোখেও উদ্বেগের ছায়া। সুফিয়ানের মানসিক অবস্থা নিয়ে তারা চিন্তিত। কীভাবে তাকে সান্ত্বনা দেবে বুঝতে পারছিল না।
ললিতা স্বামীর পাশে বসে তার কপালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, “আপনার জ্বর আছে?”
শব্দর ঘরের হারিকেনের আগুন জ্বালায়। আলোর ঝলকানিতে সবাই একটু স্বস্তি পায়। সে বলল, “ভাইজান, চলুন একটু বারান্দায় বসি। তাজা হাওয়া লাগলে ভালো লাগবে।”
সুফিয়ান আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন। তিনি তখনো ভয়ে কাঁপছিলেন। ভাই ও স্ত্রীর উপস্থিতিতে একটু সাহস পেয়েছেন বলে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন।
তিনজন মিলে বারান্দায় এসে বসল। চাঁদের আলোয় বারান্দাটা আলোকিত হয়ে আছে। দূরে গাছপালার মাথায় হাওয়া লেগে মৃদু শনশন শব্দ হচ্ছে। এই প্রাকৃতিক পরিবেশে সুফিয়ানের মনে একটু শান্তি নেমে এল।
শব্দর ভাইয়ের পাশে বসে বলল, “ভাইজান, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমরা আপনার পাশে আছি। কাল সকালে ডাক্তার দেখাব। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
ললিতা স্বামীর হাত ধরে বলল, “আপনি এখন একটু ঘুমাবেন? আমি আপনার পাশেই থাকব।”
সুফিয়ানের হাতের কম্পন কমেছে। চোখে এখনো সেই অজানা আতঙ্কের ছায়া। তিনি গভীর শ্বাস নিয়ে শব্দরের দিকে তাকালেন, “শব্দর, তুমি এখন যাও। রাত অনেক হয়েছে।”
শব্দর দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে বলল, “কিন্তু ভাইজান, আপনি…”
সুফিয়ান হাত তুলে শব্দরকে থামালেন। ধীর স্বরে বললেন, “তোমার চিন্তার কিছু নেই। আমি ঠিক আছি। ললিতা তো আছেই আমার পাশে। তুমি যাও, নতুন বউ একা ঘরে।”
শব্দরের মনে জুলফার কথা খেলে যেতেই তার শরীরের প্রতিটি স্নায়ু টান টান হয়ে উঠে। সে আর দাঁড়াল না, দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতেই তার চোখে পড়ল জুলফাকে। জুলফার শাড়ির আঁচলটি হালকা বাতাসে দুলছে, তার ভাঁজের ভেতর কিছু একটা আছে৷ শব্দরকে দেখে সে প্রথমে একটু অবাক হলো, তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করল, “আপনি… আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”
শব্দর এগিয়ে এল জুলফার দিকে। তার চোখে একসাথে রাগ আর উদ্বেগ। সে প্রশ্ন করল, “কোথায় ছিলে এতক্ষণ?”
জুলফা তার আঁচল খুলে দেখাল। সেখানে নানা রঙের বসন্তের ফুল। সে একটু লজ্জিত হয়ে বলল, “ফুল তুলতে গিয়েছিলাম। কী যে সুন্দর গন্ধ… মাথা ঘুরে যায়।”
শব্দরের মুখ লাল হয়ে উঠল রাগে। সে ধমক দিয়ে বলল, “এই মাঝরাতে ফুল তুলতে যেতে হবে? সকালে পারতে না? কী দরকার ছিল?”
জুলফা মাথা নত করে, প্রায় নিজের সঙ্গে কথা বলার মতো মৃদু স্বরে বলল, “ঘুম আসছিল না। তাই…”
শব্দর আজ প্রথমবারের মতো লক্ষ্য করেছে জুলফার চোখে এক অপরূপ দীপ্তি, যা তার দিকে সুপ্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। এই অনাবিল দৃষ্টি শব্দরের হৃদয়ের গভীরে কোমল অনুভূতি এনে দিয়েছে। তাই সে আজ জুলফাকে বকাঝকা করতে চায় না। শব্দর ধীরে ধীরে জুলফার হাত ধরল। তার স্পর্শে ছিল একটা অব্যক্ত ভালোবাসা, যা কথার চেয়েও বেশি প্রকাশ পেল। সে মৃদু স্বরে বলল, “ঘরে চলো।”
তারা দুজনে ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগল। জুলফার আঁচল থেকে কয়েকটি ফুল খসে পড়ে সিঁড়িতে। সেই মুহূর্তে, বাড়ির গ্রিল ভেদ করে আসা চাঁদের রুপালি আলোয় সেই ফুলগুলো জীবন্ত হয়ে উঠে। ঠিক তখনই নাভেদ এসে পড়ল সেখানে। সে এসেছিল পানি খাওয়ার জন্য। হঠাৎ করেই তার নাকে এসে লাগল একটা তীব্র সুগন্ধ। সে থমকে দাঁড়ায়। চারপাশে তাকিয়ে দেখে সিঁড়িতে ছড়ানো ফুলগুলোকে। সে ধীরে ধীরে নিচু হয়ে ফুলগুলো কুড়িয়ে নিতে লাগল।
জাওয়াদের ঘুমন্ত মনে সুফিয়ানের আর্তনাদ ছুরির মতো বিঁধতেই সে চোখ মেলে ধীরে ধীরে বিছানায় উঠে বসে। কয়েক মুহূর্ত দ্বিধাগ্রস্ত থেকে, অবশেষে পা টিপে টিপে বাবা-মায়ের ঘরের দরজার দিকে এগিয়ে যায়। দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে সে দেখে বাবা, মা আর চাচাকে। সুফিয়ানের মুখজুড়ে যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট। জাওয়াদের অন্তরাত্মা চাইছিল ছুটে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরতে, কিন্তু এক অদৃশ্য শক্তি তাকে পিছনে টেনে ধরে। সে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে দরজার আড়ালে, একটি নিঃশব্দ প্রতিমূর্তির মতো।
শব্দরকে বেরিয়ে যেতে দেখে সে আরও গভীর আড়ালে সরে যায়। আরও কিছুক্ষণ লুকিয়ে থেকে বাবা-মা’র অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে ধীরে ধীরে ফিরে এল নিজের ঘরে। তার শরীরটা সীসার মতো ভারী হয়ে উঠেছে। মনের ওজন তো আরও বেশি। সে আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল। এপাশ-ওপাশ করেও ঘুমাতে পারল না। ঘুম তার থেকে হাজার মাইল দূরে পালিয়ে গেছে।
আকাশের কালো চাদরে ঢাকা রাতের অন্ধকার ধীরে ধীরে ফিকে হতে শুরু করেছে। প্রকৃতি নিঃশব্দে প্রস্তুতি নিচ্ছে নতুন দিনের আগমনের। কিন্তু তার মনের গহীন অন্ধকার আরও গাঢ় হয়ে উঠছে প্রতি মুহূর্তে। রাতের নিস্তব্ধতা তার অশান্ত মনকে আরও অস্থির করে তুলছে। একটা অস্বস্তি তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। এর পেছনে একটা বিশেষ কারণ রয়েছে। আজ অজান্তে, অবুঝের মতো সে গুলনূরের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে। সেই মুহূর্তের কথা মনে পড়তেই তার বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল। বিছানায় শুয়ে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠল। ধীরে ধীরে সে উঠে বসল। তারপর নিঃশব্দ পদক্ষেপে এগিয়ে গেল জানালার দিকে। জানালা খুলে বাইরের দিকে তাকাতেই চোখ চলে যায় দাসীদের ঘরের দিকে। আজ বারান্দায় গুলনূরের দেখা নেই। মেয়েটার অনুপস্থিতি তার মনকে আরও বিষণ্ণ করে তুলে। তার মন ভরে উঠল অনুশোচনায়।
সন্ধ্যার মুহূর্তটা ছবির মতো ভেসে উঠল তার চোখের সামনে। আলো-আঁধারিতে গুলনূরের মুখের সেই ব্যথিত অভিব্যক্তি, তার চোখের কোণে জমা হওয়া অশ্রুর কণা, সবকিছু আবার নতুন করে অনুভব করতে থাকে সে।
তখন সন্ধ্যার আবছা আলোয় ডুবে যাচ্ছিল গ্রামের পথঘাট। আকাশে সোনালি রঙের আভা ছড়িয়ে পড়েছে। এমন সময় জমিদার বাড়ির বড় দরজা থেকে বেরিয়ে এল মনির, তার পরনে সাদা ধুতি আর পাঞ্জাবি। সে তখন গ্রামের মানুষদের কাছে খবর পৌঁছে দেওয়ার জন্য বের হচ্ছিল। হঠাৎ করেই শোনা গেল একটা গাড়ির হর্নের আওয়াজ। মনির চমকে উঠে পিছন ফিরে তাকায়। একটা নীল রঙের অস্টিন কার তার দিকে এগিয়ে আসছে। গাড়িটা ধীরে ধীরে এসে তার পাশে থামল। জানালা দিয়ে উঁকি দিল জাওয়াদের মুখ।
“মনির, কোথায় যাচ্ছিস?” জাওয়াদের কণ্ঠ।
মনির সম্মানের সঙ্গে মাথা নত করে বলল, “হুজুর, গ্রামের মানুষদের কাছে খবর দিতে যাচ্ছি। ছোট হুজুরের যাত্রার কথা জানাতে হবে।”
জাওয়াদ শান্ত স্বরে বলল, “তাহলে তো আমাদের পথ এক। চল, গাড়িতে উঠে পড়। আমিও একটু ঘুরে আসব।”
মনিরের মুখে ফুটে উঠল একটা অস্বস্তির ছায়া। সে ইতস্তত করতে লাগল, “না হুজুর, আপনি যান। আমি হেঁটেই চলে যাব।”
জাওয়াদ তখন গাড়ির দরজা খুলে বলল, “এত পথ হাঁটবি কেন? উঠে পড়।”
মনির আর কোনো কথা না বলে ধীরে ধীরে গাড়িতে উঠল। তার মুখে তখনও সংকোচের ছাপ। গাড়ির মখমলের আসনে বসতে গিয়ে সে অস্বস্তি বোধ করছিল।
গাড়িটা চলতে শুরু করল গ্রাম্য কাঁচা রাস্তা ধরে। দুপাশে সারি সারি তালগাছ, মাঝে মাঝে ধানের ক্ষেত। সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে গ্রামের প্রকৃতি এক অপরূপ রূপ ধারণ করেছে। গাড়ি চলছে গ্রামের ধূলিমাখা পথে। সন্ধ্যার আবছা আলোয় গাছপালার ছায়া পড়েছে রাস্তায়। জাওয়াদ স্টিয়ারিং হুইল ঘুরাতে ঘুরাতে ডাকল, “মনির,” তার গলায় একটা অস্বাভাবিক উষ্ণতা, “গুলনূর কোথায়? সারাদিন দেখিনি কেন?”
মনির প্রথমে একটু হকচকিয়ে গেল। তারপর সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “রেণু?”
জাওয়াদের চোখে একটা বিরক্তির ছায়া পড়ল, “হ্যাঁ, ওটাই। মেয়েটার দুটো নাম কেন? রেণু খালার নামে ওর নাম, কী কাকতালীয় ব্যাপার!”
মনির একটু ইতস্তত করল। তারপর ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল, “হুজুর, বছরখানেক আগে রেণু খালা কলেরায় মারা যান। সেই থেকে গুলনূর এসেছে। বড় বেগম সাহেবা তাকে রেণু বলে ডাকেন।”
জাওয়াদের মুখের ভাব পাল্টে গেল। তার চোখে মুহূর্তের জন্য একটা বেদনার ছায়া নেমে এল। “ওহ্,” সে আস্তে করে বলল।
গাড়িটা একটা বাঁক নিল। জাওয়াদের মনে অতীতের স্মৃতি ভেসে ওঠে। তার মা যখন নববধূ হয়ে এসেছিল, তখন থেকেই রেণু ছিল তার মায়ের অন্তরঙ্গ বান্ধবী, খাস দাসী, সব কিছু। হয়তো সেই কারণেই মা নতুন দাসীর নাম রেণু রেখেছেন।
জাওয়াদ গলা পরিষ্কার করে একটু হেসে বলল, “এতক্ষণে পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হলো। মা বলছিল রেণু, আর বাবা বলছিলেন গুলনূর। বুঝতে পারছিলাম না ব্যাপারটা!” তারপর একটু থেমে, চোখে কৌতূহলের ঝিলিক নিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল, “গুলনূর কোন গ্রামের মেয়ে?”
মনির একটু সময় নিয়ে উত্তর দেওয়ার প্রস্তুতি নিল। তার চোখে মুখে ফুটে উঠল পুরনো স্মৃতির ছায়া। সে ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল, “হুজুর, আসলে গুলনূরের কথা বলতে গেলে জয়নাল চাচার কথা না বলে উপায় নেই…”
জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “জয়নাল চাচা? এ আবার কে?”
মনির আন্তরিকতার সঙ্গে বলল, “মনে নেই আপনার? ওইযে জয়নাল চাচা আমাদের আগের মালি ছিলেন। দীর্ঘদিন এই বাড়ির সেবা করেছেন। তার সঙ্গেই গুলনূরের আত্মীয়তার সূত্র।”
জাওয়াদের চোখে তখন জেনে নেওয়ার তীব্র আগ্রহ।
মনিরের চোখে করুণার ছায়া নেমে এল। সে একটু বিষণ্ন স্বরে বলল, “হায়রে! মেয়েটার জীবনে দুঃখের শেষ নেই। মা-বাবা কেউই বেঁচে নেই। ছোটবেলা থেকেই মামার বাড়িতে মানুষ হয়েছে। বছর দেড়েক আগে বিয়ে ঠিক হয়৷ কিন্তু বিয়ের দিক নৌকা… হঠাৎ করেই ডুবে গেল। বরের মৃত্যু হলো সেখানেই। গুলনূরের জীবনের সব স্বপ্ন সেদিনই নদীর জলে মিলিয়ে যায়।”
জাওয়াদের চোখে মুখে ফুটে উঠল বিস্ময় আর বেদনা, “তারপর? “
মনির মাথা নেড়ে বলল, “সেই থেকে মেয়েটার জীবন থমকে গেছে। গ্রামের লোকজন তাকে অলুক্ষণে বলে একঘরে করে দেয়। কোথাও থেকে আর বিয়ের সম্বন্ধ আসছিল না।”
জাওয়াদের চোখে মুখের করুণা গভীর হলো, “তারপর কী হলো? গুলনূরের জীবনের গল্প শেষ হয়ে গেল নাকি?”
মনির ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল, “না হুজুর, গল্প শেষ হয়নি। বরং সেখান থেকেই শুরু হলো গুলনূরের নতুন জীবন।”
সে একটু সময় নিয়ে আবার বলা শুরু করল, “জয়নাল চাচা…রেণু খালার পরিবর্তে বড় বেগমের খাস দাসী হিসেবে গুলনূরকে এখানে নিয়ে এলেন। জয়নাল চাচা জানতেন, এই বাড়িতে এলে গুলনূরের জীবনটা বদলে যাবে। গ্রামের কুৎসা থেকে মুক্তি পাবে। আর সত্যি বলতে কী, মেয়েটার প্রতিভা দেখে উনি মুগ্ধ হয়েছিলেন।”
“প্রতিভা?” জাওয়াদের কণ্ঠে বিস্ময়।
মনির উৎসাহিত হয়ে বলল, “হ্যাঁ হুজুর! গুলনূরের হাতের কাজ দেখলে আপনিও অবাক হয়ে যাবেন। তার সেলাইয়ের কাজ, কাঁথা সেলাই, এমনকি ফুল তোলার কৌশল সবই অসাধারণ। বড় বেগম সাহেবা তো প্রায়ই বলেন, গুলনূরের হাতে জাদু আছে।”
জাওয়াদের চোখে তখন এক অদ্ভুত চমক। আজ সারাদিন সে গুলনূরকে দেখেনি। সে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে আবারও জিজ্ঞেস করল, “আজ সারাদিন গুলনূরকে দেখিনি কেন? সে কোথায়?”
মনিরের চোখে মুখে বিস্ময়। জমিদার পুত্রের এই আগ্রহ তাকে একটু অবাক করেছে। সে কিছুটা সংকোচের সঙ্গে বলল, “হুজুর, আসলে… জয়নাল চাচার শরীরটা খুব খারাপ। গুলনূর তাকে দেখতে গেছে।”
গাড়িটা এগিয়ে চলছে গ্রামের অন্ধকার পথে। চারদিকে জোনাকির আলো জ্বলছে। দূরে শেয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে।
হঠাৎ জাওয়াদ গাড়ি থামিয়ে মনিরের দিকে ফিরল। তার চোখে দৃঢ়তা, “মনির,” সে বলল, “তুই জয়নাল চাচার বাড়ি চিনিস?”
মনির অবাক হয়ে তাকাল। “জি হুজুর, চিনি।”
“চল, সেখানে যাই।” জাওয়াদের গলায় এমন একটা সুর যে মনির প্রতিবাদ করার সাহস পেল না।
গাঢ় অন্ধকারে ডুবে থাকা পথ বেয়ে গাড়িটা আবার চলতে শুরু করল। এবার তার গতি অন্য দিকে। রাতের নিস্তব্ধতায় গাড়ির চাকার শব্দ আরও স্পষ্ট শোনাচ্ছিল। চারপাশে ঘন বৃক্ষরাজির ছায়া, আর মাঝে মাঝে জোনাকির ক্ষণিক আলোর ঝলকানি রহস্যময় পরিবেশ সৃষ্টি করছে।
হঠাৎ করে দূরে একটি অস্পষ্ট আকৃতি জাওয়াদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। গাড়ির তীব্র হেডলাইটের আলোয় ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠে দুটি মানুষের চেহারা।
“ওটা কি সিদ্দিক?” জাওয়াদ কৌতূহলী কণ্ঠে মনিরকে জিজ্ঞাসা করে।
মনির সামনের দিকে ঝুঁকে মনোযোগ সহকারে তাকাল। “হ্যাঁ হুজুর, সিদ্দিকই তো। আর সঙ্গে…” তার কথা অসমাপ্ত রয়ে গেল।
জাওয়াদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকাল। “গুলনূর!” তার কণ্ঠে একসঙ্গে বিস্ময় আর উত্তেজনার রেশ।
গাড়িটা ধীরে ধীরে থেমে গেল ওদের সামনে। সিদ্দিক আর গুলনূর দুজনেই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল। গুলনূরের সুন্দর মুখমণ্ডলে ভয়ের ছায়া। সে তাড়াতাড়ি ওড়নাটা টেনে মুখ ঢাকার ব্যর্থ প্রয়াস করে।
জাওয়াদ ধীর পদক্ষেপে গাড়ি থেকে নামে। তার চোখে মুখে কৌতুক আর কৌতূহলের মিশ্রণ। “কী ব্যাপার সিদ্দিক? এত রাতে তোমরা কোথায় যাচ্ছো?” তার প্রশ্নে একটু তীক্ষ্ণতা।
সিদ্দিক আর গুলনূর একসঙ্গে কুর্নিশ করল। সিদ্দিক কম্পিত কণ্ঠে বলল, “হুজুর, জয়নাল চাচার অসুখ। গুলনূর দেখতে গিয়েছিল। এখন ফিরছি।”
জাওয়াদের দৃষ্টি এবার গুলনূরের দিকে নিবদ্ধ হয়। মেয়েটি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সে নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে চায়। চাঁদের কোমল আলোয় তার মুখের একাংশ আলোকিত, যা তার সৌন্দর্যকে আরও রহস্যময় করে তুলেছে।
জাওয়াদ একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় “মনির,” সে ডাকল, তার কণ্ঠে দৃঢ়তা।
মনির বিস্ময়াভিভূত হয়ে গাড়ি থেকে নামল। জাওয়াদ তার দিকে তাকিয়ে নির্দেশ দিল, “তুই সিদ্দিকের সঙ্গে যা। আমি গুলনূরকে নিয়ে বাড়ি যাচ্ছি।”
এই কথা শুনে সিদ্দিক আর মনির দুজনেই পাথর হয়ে যায়। গুলনূর ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল, তার চোখে মুখে আতঙ্কের ছায়া।
জাওয়াদ ধীরে ধীরে গুলনূরের দিকে এগিয়ে গেল। “চলো,” সে অপ্রত্যাশিতভাবে নরম সুরে বলল, “আর হেঁটে যেতে হবে না।”
গুলনূর স্বাভাবিকভাবেই পিছু হটার চেষ্টা করে একটি ভীত পাখির মতো।
জাওয়াদ আশ্বস্ত করার সুরে বলল, “কোনো ভয় নেই, আমি তোমাকে নিরাপদে নিয়ে যাব।” তার কথায় আন্তরিকতা। সেইসাথে তার চোখে একটা অদ্ভুত আগ্রহও লক্ষণীয়।
গুলনূর অসহায়ের মতো সিদ্দিকের দিকে তাকায়, সে সাহায্য চাইছে। সিদ্দিক নিজেই এখন অসহায়। জমিদারের ছেলের কথা অমান্য করার কোনো উপায় নেই। জাওয়াদ গুলনূরকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। গাড়ির ইঞ্জিনের গুঞ্জন রাতের নীরবতা ভঙ্গ করে দেয়। পিছনে দাঁড়িয়ে থাকে সিদ্দিক আর মনির, তাদের চোখে উদ্বেগ আর বিস্ময়।
গাড়ির অন্ধকার কোণে গুলনূর ভয়ে কুঁকড়ে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করছে। জাওয়াদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার ওপর বারবার আঘাত হানছে। মেয়েটির ভীত চোখে এক টুকরো আশ্বাস ছুঁড়ে দিতে চাইল সে।
“ভয় পেও না,” জাওয়াদের কণ্ঠস্বর নরম হওয়ার চেষ্টা করল, “আমি তোমাকে কোনো ক্ষতি করব না।”
গুলনূরের হৃদয় তখনো দুরন্ত ছন্দে কাঁপছে। তার আঙুলগুলো অস্থিরভাবে একে অপরকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে।
জাওয়াদ লক্ষ্য করল মেয়েটির অস্বস্তি। সে আরও একটু নরম সুরে বলল, “আরামে বসো। তোমার পুরো নাম কী?”
নীরবতা। শুধু গাড়ির চাকার শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। জাওয়াদের ধৈর্য ক্ষীণ হতে লাগল।
“কী ব্যাপার, উত্তর দিচ্ছো না কেন? পুরো নাম কী?” তার কণ্ঠস্বরে এবার একটু কাঁটা ঢুকল।
গুলনূর তখনও নিঃশব্দ। তার চোখে ভয় আর অসহায়তার ছায়া।
জমিদার পুত্র জাওয়াদের রক্তে অহংকারের নদী বয়ে যায়। তার চোখে মুখে ফুটে উঠে অহমিকার ছাপ। দাসী গুলনূরের নীরবতা তার সেই অহংকারে তীব্র আঘাত হানল। ক্ষণিকের মধ্যে জাওয়াদের চোখে জ্বলে উঠল ক্রোধের আগুন। তার ঠোঁট কুঁচকে গেল বিরক্তিতে, যেন কোনো তিক্ত স্বাদ লেগেছে জিভে।
“তুমি কি বোবা নাকি?” জাওয়াদের কণ্ঠস্বর এবার কঠোর পাথরের মতো, “নাকি আমাকে অপমান করার চেষ্টা করছ?”
তার কথা চাবুকের আঘাত লাগল গুলনূরের কোমল হৃদয়ে। তার চোখে জল এসে গেল। দুটি তারার মতো ঝলমল করে উঠে সেই অশ্রুবিন্দু।
জাওয়াদের চোখে মুখে ফুটে উঠেছে অসহিষ্ণুতার ছাপ। তার শরীরের প্রতিটি শিরায় প্রবাহিত হচ্ছে ক্রোধের উত্তাপ। গুলনূরের নীরবতা তার অহংকারে আঘাত করে চলেছে প্রতি মুহূর্তে।
“শোনো,” জাওয়াদের কণ্ঠস্বর এবার আরও কঠোর, “আমি তোমাকে শেষবারের মতো জিজ্ঞেস করছি। তোমার পুরো নাম কী?”
গুলনূর তখনও নিঃশব্দ। তার চোখে ভয় আর অসহায়তার ছায়া আরও গাঢ় হয়ে ওঠে। আতঙ্কে সে এমনভাবে জমে গেছে যে হাতে ইশারা করার শক্তিও পাচ্ছে না।
জাওয়াদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে পড়ল। তার চোখে জ্বলে উঠল প্রচণ্ড ক্রোধের আগুন। সে হঠাৎ করেই চিৎকার করে উঠল, “তুমি কি বুঝতে পারছ না আমি কে? আমি জমিদার পুত্র! তোমার মতো এক তুচ্ছ দাসী আমার সামনে এভাবে চুপ করে থাকবে? এটা কী ধরনের বেয়াদবি?”
তার কণ্ঠস্বর এতটাই উচ্চ ছিল যে পাশ কেটে যাওয়া এক পথিকও চমকে ওঠে। গুলনূরের শরীর কাঁপতে লাগল ভয়ে।
জাওয়াদ আরও উত্তেজিত হয়ে উঠল। তার মুখমণ্ডল লাল হয়ে গেল রাগে। সে গর্জন করে উঠল, “তোমার এই অবাধ্যতার শাস্তি তুমি পাবেই! আমার একটা কথায় তোমার চাকরি যেতে পারে।”
গুলনূরের চোখের কোণে জমা হওয়া অশ্রু গড়িয়ে পড়ে গালে।
হঠাৎ করে গাড়ি থেমে গেল একটা ঝাঁকুনি দিয়ে। জাওয়াদ গর্জন করে উঠল, “নেমে যাও এখান থেকে! এখনই!” তার চোখে তখন উন্মত্ততার ছায়া।
গুলনূর অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় জাওয়াদের দিকে। জাওয়াদের হৃদয়ে তখন দয়ার লেশমাত্রও নেই।
“শুনতে পাচ্ছো না? বললাম নেমে যাও!” সে প্রায় হিংস্র স্বরে চিৎকার করল। নিজেই খুলে ফেলল গাড়ির দরজা।
গুলনূর কাঁপা কাঁপা হাতে নিজের ওড়না সামলায়। তার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। সে ধীরে ধীরে নামল গাড়ি থেকে। চারদিকে ঘন অন্ধকার। গুলনূর ভয়ে সিঁটিয়ে যায়। জাওয়াদের চোখে তখনও জ্বলছে ক্রোধের আগুন।
“যাও, হেঁটে বাড়ি যাও!” জাওয়াদ প্রায় হুংকার দিয়ে উঠল।
গাড়ি সামনে চলতে শুরু করল। গুলনূর দাঁড়িয়ে রইল রাস্তার পাশে, অসহায়ের মতো। তার চোখের সামনে দিয়ে মিলিয়ে গেল গাড়ির পিছনের লাল আলো।
চলবে…
~ ইলমা বেহরোজ