জাওয়াদের গাড়ি নীরব রাতের বুকে এগিয়ে চলছে। কিছুদূর যেতে না যেতেই তার মনে একটা অস্বস্তি দানা বাঁধতে শুরু করে। গুলনূরকে এভাবে নির্জন পথে একা ফেলে আসা কি ঠিক হলো? যদি মেয়েটার কিছু হয়ে যায়! চিন্তাটা তাকে কুরে কুরে খেতে থাকে। একা একটি মেয়ে, সন্ধ্যার আঁধারে কীভাবে নিরাপদে বাড়ি ফিরবে? জাওয়াদের মনে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। একদিকে নিজের রাগ, অন্যদিকে গুলনূরের নিরাপত্তার চিন্তা। শেষ পর্যন্ত বিবেকের জয় হয়। সে গাড়ির স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে নেয়।
নির্জন এক জায়গায় এসে থামে জাওয়াদের গাড়ি। সেখান থেকে জমিদার বাড়ি পর্যন্ত লম্বা পথটা চোখে পড়ে। ততক্ষণে চারদিকে নেমে এসেছে গাঢ় রাতের কালো চাদর। আকাশে তারাদের মিটমিট। নিচে জোনাকিদের নীরব নাচ।
গুলনূর ধীরে ধীরে এগোচ্ছে জমিদার বাড়ির দিকে। একদিকে উঁচু পাহাড়ের কালো ছায়া, অন্যদিকে নীরব গাছপালা। তার চোখে মুখে অসহায়তা। নিস্তব্ধ রাতের বুকে হঠাৎ একটি চামচিকা ডানা ঝাপটে গুলনূরের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল, ছুঁয়ে গেল ভয়ের শিহরণ। গুলনূরের চোখ দুটি বন্ধ হয়ে আসে নিমেষে। তার ঠোঁট দুটি নীরব, কিন্তু সারা শরীর কাঁপছিল পাতার মতো। থরথর, অবিরাম।
দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে জাওয়াদের বুকের ভেতর ধক করে উঠল। হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠল বুকের খাঁচা ভেঙে। সে প্রায় গাড়ি থেকে নেমে পড়তে যাচ্ছিল, ছুটে যাবে গুলনূরের কাছে। শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নেয়। গুলনূর আবার হাঁটা শুরু করেছে। তার পায়ের শব্দ ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে রাতের নীরবতায়। জাওয়াদ নিঃশ্বাস রোধ করে দেখতে লাগল, গুলনূর কীভাবে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে জমিদার বাড়ির দিকে। যেন একটি ক্ষীণ আলোর রেখা অন্ধকারের বুক চিরে এগিয়ে চলেছে।
তখনই আকাশে দেখা দিল চাঁদ। তার আবছা আলোয় গুলনূরের লম্বা ছায়া পড়ে মাটিতে। যখন গুলনূর জমিদার বাড়ির বিশাল লোহার গেটের কাছে পৌঁছায়, জাওয়াদের চোখে তাকে একটি ছোট্ট পিঁপড়ার মতো দেখাচ্ছিল। এতটাই দূরে ছিল সেই প্রাসাদোপম অট্টালিকা। জাওয়াদ তখন একটা দীর্ঘ, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বুকের ওপর থেকে একটা বিশাল পাথর নেমে গেছে।
আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে সে কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক ঘুরে। মনির আর সিদ্দিককে নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে জানতে পারল এক অবাক সত্য – গুলনূর বোবা। সেই মুহূর্ত থেকে একটা তীব্র অনুশোচনা তাকে গ্রাস করে রেখেছে। শেষ রাতে সে সবার অগোচরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়৷
ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই গ্রামের মানুষজন জড়ো হতে শুরু করে জমিদার বাড়ির সামনে। সুফিয়ানের নির্দেশে মনির রাতারাতি খবর পৌঁছে দিয়েছে গ্রামের প্রতিটি ঘরে। আজ শব্দর যাবে শহরে, মাত্র দুই সপ্তাহের জন্য, কিন্তু তার এই যাত্রা শুধু তার নিজের নয়, পুরো গ্রামের ভবিষ্যৎকে প্রভাবিত করতে পারে। জমিদার বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে আছেন সুফিয়ান। তার চোখে মুখে গর্ব আর আশার আলো।শব্দর আজ একটা বড় দায়িত্ব নিয়ে যাচ্ছে, সরিষার ব্যবসায়িক চুক্তি। এই চুক্তি শুধু জমিদার পরিবারের নয়, পুরো গ্রামের সমৃদ্ধির চাবিকাঠি হতে পারে।
শব্দর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল, পরনে সাদা পাঞ্জাবি আর ধুতি। হাতে একটি ছোট্ট অ্যাটাচি কেস। সেই কেসের মধ্যে লুকিয়ে আছে গ্রামের ভবিষ্যৎ, গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র। তার চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে দৃঢ় সংকল্পের ছাপ।
সুফিয়ান এগিয়ে এসে শব্দরের কাঁধে হাত রাখলেন। তার কণ্ঠস্বরে উদ্বেগ আর আশার মিশ্রণ, “শব্দর, এই যাত্রা শুধু তোমার একার নয়, এ আমাদের সবার। মনে রেখো, এই সরিষার চুক্তি আমাদের গ্রামের ভাগ্য পাল্টে দিতে পারে। আমাদের চাষীদের স্বপ্ন, তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ, সবই নির্ভর করছে তোমার উপর।”
শব্দরের চোখে উদ্বেগের ছায়া। সে বলল, “ভাইজান, আজই যেতে হবে? আপনার শরীরটা ভালো না, একটু সুস্থ হয়ে নিলে…”
সুফিয়ান হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলেন, “না শব্দর, তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করো। আমার জন্য চিন্তা করো না। আমি মনিরকে সঙ্গে নিয়ে কবিরাজের কাছে যাব। তুমি নিশ্চিন্তে যাও।”
শব্দর সুফিয়ানের পায়ের কাছে ঝুঁকে সালাম করল। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, বাড়ির দাসীরা কৌতূহলী চোখে উঁকি দিচ্ছে। ললিতা আর জুলফা দাঁড়িয়ে আছে একটু দূরে। শব্দর ললিতার কাছে গিয়ে বিদায় নিল। তারপর জুলফার সামনে এসে দাঁড়াল। তার কণ্ঠস্বরে একটু কম্পন, “আমার জন্য রোজ দোয়া করবে। আর নিজের যত্ন নিবে।”
জুলফার বুকের ভেতর অদ্ভুত এক অনুভূতি দোলা দেয়। রাতে জেগে ওঠা সেই তীক্ষ্ণ, সূক্ষ্ম ব্যথা আবার ফিরে এসেছে। বোধহয় শব্দরের প্রতি একটা অজানা টান জন্মেছে তার মনে। সে নিজেকে বোঝায়, এটা শুধুই সহানুভূতি। এই মানুষকে সে কখনো ভালোবাসতে পারে না। সে মাথা নাড়িয়ে বলল, “আপনিও সাবধানে থাকবেন। ফিরে আসার পথে দেরি করবেন না।”
শব্দরের চোখে একটু আর্দ্রতা ফুটে ওঠে। সে আর কিছু না বলে, ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় গেইটের কাছে। পিছনে রেখে যায় তার গ্রাম, তার পরিবার, আর জুলফার উদ্বেগমিশ্রিত চাহনি। যা তাকে আকর্ষণ করছে ফিরে যেতে, কিন্তু দায়িত্বের টান তাকে এগিয়ে যেতে বাধ্য করে। গ্রামবাসীদের উষ্ণ বিদায় সম্ভাষণের মাঝে শব্দর একবার পিছন ফিরে তাকায়।। সে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে, “আপনাদের দোয়া আর ভরসাই আমার সম্বল। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আমাদের গ্রামের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিয়েই ফিরব।”
ধীরে ধীরে শব্দর ঘোড়া গাড়িতে উঠে বসে। হঠাৎ তার মনে পড়ে জাওয়াদের কথা। ছেলেটাকে সকাল থেকে দেখা যাচ্ছে না। বোধহয় ইচ্ছে করেই কোথাও লুকিয়েছে, যাতে তার সঙ্গে দেখা না হয়। “কী যে হয়েছে ওর!” – ভাবতে ভাবতে শব্দরের কপাল কুঁচকে গেল। গাড়ি চলতে শুরু করে সামনের দিকে।
গ্রামবাসীরা দূর থেকে হাত নেড়ে বিদায় জানায়। জুলফার চোখের উদ্বেগ গভীর হয়।
শব্দরের আকৃতি ক্রমশ মিলিয়ে যেতে লাগল দূর দিগন্তের কোলে। গ্রামের মানুষজন নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে দেখছে তাদের আশার প্রতীক ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে সকালের কুয়াশার আড়ালে। পূর্ব আকাশে সূর্যের প্রথম রশ্মি ছড়িয়ে পড়ল। ঠিক তখনই, যেন কোনো নাটকের চমকপ্রদ মুহূর্তে, নাভেদের আবির্ভাব ঘটে। সে আলো ফোটার পূর্বেই দৌড়াতে বের হয়েছিল। এখন ছুটে আসছে বাড়ির দিকে, তার দেহ থেকে ঝরছে ঘামের ধারা, শ্বাস-প্রশ্বাস হাপরের মতো চলছে।
জুলফার চোখ স্বতঃস্ফূর্তভাবে নাভেদের দিকে আকর্ষিত হয়। তার দৃষ্টিতে যে উদ্বেগ ছিল শব্দরের জন্য, তা মুহূর্তেই মিলিয়ে যায়। সেখানে জেগে উঠে মুগ্ধতার ঢেউ। নাভেদের প্রতি তার এই তাকানো নির্মল আকাশের ছবির দিকে তাকানোর মতো অসীম। জুলফা হঠাৎ সচেতন হয়ে উঠে চারপাশের লোকজনের উপস্থিতি সম্পর্কে। লজ্জা আর সংকোচে তার মুখ লাল হয়ে যায়। সে দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে খাসমহলে চলে যায়।
দুইদিন পর। আকাশের গায়ে সূর্যের হেলে পড়া রাঙা আভা ছড়িয়ে পড়েছে জমিদার বাড়ির প্রাঙ্গণে। বিকেলের নরম আলোয় সোনালি হয়ে উঠেছে চারপাশ। এই মায়াবী পরিবেশে, জুলফা তার ঘরে নিমগ্ন রয়েছে এক গভীর সাধনায়। হাতে তার একটি সাদা রুমাল, আর পাশে সাজানো রঙিন সুতোর নানান গোছা। জুলফার আঙুলগুলো চলছে অসাধারণ নৈপুণ্যে। ধীরে ধীরে রুমালের বুকে ফুটে উঠছে একটি বেহালার আকৃতি, নাভেদের প্রিয় বাদ্যযন্ত্র। প্রতিটি সেলাইয়ে মিশে আছে তার অন্তরের গভীর অনুভূতি। কাজ শেষে জুলফা রুমালটি তুলে ধরল আলোর দিকে। তার চোখে ফুটে উঠল এক গভীর সন্তুষ্টির হাসি। এই ছোট্ট রুমালে সে বুনে দিয়েছে তার হৃদয়ের সব অব্যক্ত কথা। এখন শুধু বাকি এটা নাভেদের হাতে তুলে দেওয়া। তার বুকের ভেতর দুরুদুরু করছে। লজ্জা আর সংকোচ তাকে গ্রাস করছে। সময় যে আর বেশি নেই। মাত্র পাঁচ দিন পর নাভেদ চলে যাবে, হয়তো চিরতরে। এই ভাবনায় জুলফার চোখ ছলছল করে ওঠে।
সে চারপাশে তাকায়। বাড়িতে থমথমে নীরবতা। দুপুরের গরমে সবাই বিশ্রাম করছে। জাওয়াদ দুইদিন ধরে নিখোঁজ। সুফিয়ান গিয়েছেন কবিরাজের কাছে। ললিতা পাগলের মতো হয়ে গেছে। রাইহার অবস্থা শোচনীয়। ললিতা বারবার জেরা করছে তাকে, অথচ সে টু শব্দও করছে না।
এই সুযোগে জুলফা ধীরে ধীরে নিজের ঘর থেকে বের হয়। তার পা চলতে শুরু করে অতিথি ভবনের দিকে। প্রতি পদক্ষেপে তার হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠছে।
সে অতিথি ভবনের সামনে এসে থমকে দাঁড়ায়। তার চোখ চঞ্চল হয়ে ওঠে। চারপাশে তাকিয়ে নিশ্চিত হয়, কেউ তাকে দেখছে কি না। বুকের ভেতরটা তখন ঢাকের মতো বাজছে। মনে মনে বলল, “হে আল্লাহ, এখন কী করব? কীভাবে এই রুমাল উনাকে দেব? কী ভাববেন উনি?”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জুলফা নিজেকে সান্ত্বনা দিল, “যা ইচ্ছে ভাবুক। কয়েকদিন পরই তো সব শেষ। তারপর আর কখনো দেখাই হবে না।”
সাহস সঞ্চয় করে সে আঙুলের ডগায় ভর দিয়ে দরজায় মৃদু আঘাত করল। প্রথমে কোনো সাড়া এল না। আবার টোকা দিতে যাবে, এমন সময় ভেতর থেকে নাভেদের গলা ভেসে এল, “কে?”
সেই কণ্ঠস্বর শুনে জুলফার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায়। গায়ের লোম খাড়া হয়ে ওঠে। কান দিয়ে যেন ধোঁয়া বের হচ্ছে। একই সঙ্গে একটা অদ্ভুত উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল সারা শরীরে। নাভেদ কি এই রুমাল পছন্দ করবে? নাকি ভীষণ অবহেলায় কোথাও ফেলে রাখবে?
এমন সময় দরজা খুলে গেল। নাভেদ বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে তাকাল জুলফার দিকে। তার চোখে মৃদু কৌতুক ফুটে উঠল, “এই সময়ে আপনি? “
জুলফা লজ্জায় লাল হয়ে মাথা নিচু করল। তার কণ্ঠ কাঁপতে লাগল, “হ্যাঁ… আসলে… আমি…” কথা আটকে যায় গলায়।
নাভেদ জুলফার অস্বস্তি বুঝতে পেরে নরম সুরে বলল, ” আসুন, ভেতরে আসুন।” সে পাশে সরে দাঁড়াল।
জুলফা ধীর পায়ে ঘরে ঢুকে। নাভেদ একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলল, “বসুন।”
জুলফা চেয়ারে বসল বটে, কিন্তু তার সারা শরীর তখনও কাঁপছে। ডান পা অনবরত নড়ছে। সে কোনোমতে কাঁপা হাতে রুমালটি সামনে ধরে বলল, “এটা… এটা আপনার জন্য।”
নাভেদ অবাক হয়ে তাকাল রুমালের দিকে। তারপর ধীরে ধীরে সেটা হাতে নিয়ে বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আমার জন্য?”
জুলফা গলা পরিষ্কার করে বলল, “শুনেছি আপনি চলে যাচ্ছেন। তাই ভাবলাম… একটা ছোট্ট স্মৃতি…”
নাভেদ রুমালটি হাতে নিয়ে আলোর দিকে তুলে ধরল। তার চোখে বিস্ময় ও মুগ্ধতার ছায়া। ধীরে ধীরে আঙুল বুলিয়ে সেলাইয়ের সূক্ষ্ম কারুকাজ অনুভব করল সে। তারপর জুলফার দিকে তাকিয়ে গভীর কণ্ঠে বলল, “আপনার হাতের কাজ অবিশ্বাস্য সুন্দর। এই বেহালাটা জীবন্ত লাগছে! আপনি কীভাবে এমন অসাধারণ কাজ করলেন?”
জুলফার মুখ লজ্জায় টকটকে লাল হয়ে উঠল। সে চোখ নামিয়ে নেয়। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল একটু হাসি। সাহস সঞ্চয় করে আবার তাকাল নাভেদের দিকে, “আসলে… আপনার বেহালার সুর আমার খুব পছন্দ হয়েছে। তাই…” একটু থেমে, জুলফা আকুল হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, আপনি দিনের বেলা বেহালা বাজাতে পারেন না?”
নাভেদ জুলফার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকায়। তাদের চার চোখ এক হয়ে যায়। নাভেদ জুলফার চোখে এমন আকুলতা আর আগ্রহ দেখল, যা সে আর কারও মধ্যে দেখেনি। তার নিজের পরিবারও কখনো তার বেহালা বাজানোকে এতটা গুরুত্ব দেয়নি। এই প্রথম কেউ তার সুরের জন্য এত আগ্রহী হলো। নাভেদ গলায় অনুভূতির ঢেউ নিয়ে ধীরে ধীরে বলল, “আমি আপনার জন্য বাজাব। আমি ছাড়া আর কেউ এই বেহালার জন্য এতটা আগ্রহ দেখায়নি।” সে হাত বাড়িয়ে বেহালাটা স্পর্শ করল। তারপর জুলফার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, “যদি চান… এখনই বাজাতে পারি।”
জুলফার মুখে হাসি ফুটে উঠল। তার চোখে আনন্দের ঝিলিক। সে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল, “সত্যি? আপনি এখন বাজাবেন?”
নাভেদ হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। সে উঠে গিয়ে বেহালাটা হাতে তুলে নেয়। জুলফার দিকে ফিরে একটু হেসে বলল, “আপনার জন্য একটা বিশেষ সুর বাজাব। এই সুরটা আমি কখনো কাউকে শোনাইনি।”
জুলফার বুক আনন্দে ভরে ওঠে। নাভেদ তার পছন্দকে শুধু প্রশ্রয় দিচ্ছে না, তার জন্য একটা বিশেষ সুরও বাজাচ্ছে। সে মনে মনে বলল, “এই মুহূর্তটা চিরকালের জন্য থেমে যাক।’
নাভেদ বেহালাটা কাঁধে তুলে নিল। তারপর চোখ বন্ধ করে একটা গভীর শ্বাস নিয়ে বাজাতে শুরু করল। প্রথমে একটা করুণ সুর ভেসে এল। সেই সুরে বহু যুগের বিরহ ও বেদনা মূর্ত হয়ে ওঠে। জুলফার চোখ ছলছল করছে। তারপর ধীরে ধীরে সেই সুর বদলে গেল। এক অপূর্ব মিলনের সুর ভেসে এল। যেন দুটি আত্মা খুঁজে পেয়েছে একে অপরকে। জুলফা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে। তার চোখ দিয়ে অজান্তে জল গড়িয়ে পড়ে। নাভেদের আঙুলের যাদুতে বেহালা কথা বলছে। সেই কথায় অনেক অব্যক্ত আবেগ, অনেক অজানা আকাঙ্ক্ষা।
বেহালার শেষ সুরটি বাতাসে মিলিয়ে যেতে যেতেই একটি চিৎকার ভেসে এল। “নাভেদ! নাভেদ!” – রাইহার উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর ভেঙে পড়ল নীরবতার বুকে।
নাভেদ চমকে উঠল। তার হাত থেকে ছিটকে পড়তে চাইল বেহালাটা, কিন্তু শেষ মুহূর্তে সামলে নিল। জুলফার দিকে একবার তাকিয়ে সে তাড়াতাড়ি বেহালাটা নামিয়ে রাখল পালঙ্কে।
পায়ের শব্দ ক্রমশ কাছে আসছে। নাভেদ দ্রুত উঠে দাঁড়ায়, তার চোখে বিভ্রান্তি আর উদ্বেগের ছায়া। সেই মুহূর্তে দরজা খুলে গেল ঝড়ের বেগে।
রাইহা ছুটে এল ঘরের মধ্যে। তার চুল এলোমেলো, চোখে জল, মুখে উদ্বেগের ছাপ। সে একেবারে সোজা এসে জড়িয়ে ধরল নাভেদকে। নাভেদ হকচকিয়ে যায়। সে ধীরে ধীরে হাত তুলল রাইহার পিঠে, “কী হয়েছে? তুমি এত উত্তেজিত কেন?” জিজ্ঞেস করল সে, চেষ্টা করল নিজের গলার স্বর শান্ত রাখতে।
জুলফা যেন বাজ পড়ার শব্দে জেগে উঠল স্বপ্নের জগৎ থেকে। সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল চেয়ার থেকে। তার দু’চোখ বিস্ফারিত, অবিশ্বাসে ভরা। এই তো কয়েক মুহূর্ত আগেও সে ছিল এক স্বর্গীয় অনুভূতির মধ্যে, আর এখন…
চলবে…
~ ইলমা বেহরোজ