রবিবার সকালে নাস্তা খেয়ে বিছানায় একটু চোখ বুজতেই আমার নরওয়েজিয়ান বন্ধুর ফোন- মামা কী করো?
– শুইলাম খালু…
– সকাল এগারোটায় শুইলি মানে?
– সেকেন্ড শো। তোর ভাবি ট্রে-তে নাস্তা নিয়ে সাড়ে দশটায় ঘুম থেকে তুলল। বিছানায় বসেই তিনটা পরোটা, এক বাটি ছাগলের ভুঁড়ি আর কড়কড়া আলু ভাজি…
– তোর কাছে জানতে চাইসি কী আইটেম?
– আহা শোন না… ঢাকনা দেওয়া চা, পানি আর প্রেশারের ওষুধও…
– তুই দেখি পুরাই বেহেস্তে!
– বিছানাতেই হাত ধুয়ায়ে মুখ মুছায়ে দিলো…
– দাঁত মাজায়ে দেয় নাই?
– গামলায় কুলি করসি
– ব্যাপার আছে গো মামা… ভাইবো না এমনি এমনি…
– আরে নাহ… তুই কী করিস?
– কটকটি খাই
– কোনে পাইলি?
– বানাইসি খালু… আটার মধ্যে বেকিং সোডা মিশায়ে খামির বানায়ে ধাড়ি ইঁদুরের ল্যাজের মতো লম্বা দড়ি বানায়ে তিন ইঞ্চি কইরি কাইটি তেলে ভাইজে চিনির রসে চুবায়ে শুকাইছি। সেই স্বাদ গো মামা! ইস্কুলে জ্যামবা খাইতি শ্যামবা!
– আবার কবে আসবি দোস্ত?
– মামা, এইবার আসলে আমি টরন্টো থেকে দশ কেজি ভুঁড়ি বাইন্ধে নিবোই। কাস্টমস ধইরলে কবো তোমরা ট্রোমসো-তে এই জিনিসের ব্যবস্থা করো না ক্যা? জিনিসের ব্যাবস্থা করবা না, আবার নিতিও দিবা না; উডা হবি নানে। শালার কোন শহরে থাকি গো… রাতের বেলায় সূর্য ঠিক মাথার চান্দির উপর… এতো আলোর মধ্যে ঘুম হয়?
.
.
গিন্নি এসে বলল- চান্দু, ফ্রিজে আমার কুলফি ছিল…
– কুলফি আইসক্রিম ফ্রিজে এক মাস বেওয়ারিশ লাশের মতো পড়ে থাকবে তুমি কেমনে ভাবলা?
– অসুবিধা নাই, তুমি খাবা না কে খাবে? সবই তো আমাদের দুইজনের তাই না? খুব ভালো হইসে। জিনিসটা নষ্ট হচ্ছিল…
**[হাবিব ব্যাটা ঠিকই বলছে। ঘটনা আসলেই সুবিধার না, ব্যাপার আছে। তার আইসক্রিম খেলে আমাকে বাজারে ছুটতে হয় কাফ্ফারা দিতে। যা খাই তার চারগুন ফেরৎ দেওয়া লাগে। আর আজকে সূর্য পশ্বিম দিকে উঠলো না কি!]
.
.
দুপুরে খেয়ে আবার ঘুমের ভাণ ধরে শুয়ে থাকি। বিকালবেলা গিন্নি যদি কিছু ভেজে আনে; এই আশায়।
সৃষ্টিকর্তার কী লীলা! হলোও তাই!
সন্ধ্যা ছয়টার দিকে গিন্নি ট্রে-তে করে এক গাদা মসুরের ডালের পেঁয়াজু নিয়ে হাজির। সাথে সেমাই। অনেক করে পিঁয়াজ, ডাল বাটা, কাঁচামরিচ দিয়ে বানানো। আমার সবচাইতে প্রিয় স্নাক্স। সে শেষ পিঁয়াজুটা জোর করে আমার মুখে পুরে দিয়ে বলল, একটা কথা বললে রাগ করবা?
– না বলো
– সত্যি?
– তিন সত্যি
– আমি তোমার ক্যামেরা ভাঙসি…
– কী ভাঙসো!
– ক্যামেরা…
– [পেঁয়াজুটা আমার গলায় নলির ঠিক মিডিলে আটকে গেলো; গেলাও যাচ্ছে না, আবার উগড়ানোও যাচ্ছে না]
– কবে?
– লাস্ট উইকে। তুমি কি ক্যামেরাটা চালায়ে দেখসো?
– হা চালাইসি
– ছোট লেন্সটা দিয়ে ছবি তুলসো?
– না
– দেইখো তো কী অবস্থা?
– [আমি বাকরুদ্ধ হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি তার দিকে]
– আমার হেলথ কার্ডটা খুঁজতে গিয়ে লেন্সটা ড্রয়ার থেকে যেই উঠাইসি, ওমনি টুপ্ করে নিচে পড়ে গেলো
– মেঝেতে?
– পড়ার আগে পাশের সুটকেসের উপর একটা ড্রপ খাইসিলো
– তারপর?
– মেঝেতে পড়লো? কিন্তু কোনো আওয়াজ হয় নাই। আর…
– আর!
– তোমার আগের ক্যামেরার লেন্সটাও আমার হাত থেকে পড়সিলো
– তিন বছর আগে?
– আরো বেশি… ছয় বছর আগে
– [আমি শুধু বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি]
– তখন অবশ্য লেন্সের সাথে ক্যামেরাটাও লাগানো ছিল…
– কী!
– যাগগে। অতো অতীত নিয়ে ভাবা ভালো না। আরও ভালো হলো; এখন নতুনটা কিনবা। এর চাইতেও ভালো লেন্স দরকার তোমার তাই না?
আমি পানি দিয়ে গিলেই ফেললাম পেঁয়াজুটা। সেই গরু চুরির মতো; মালিককে দুঃসংবাদ দেওয়া হলো যে তার দড়ি চুরি হয়েছে; তবে দড়ির মাথায় তার গরুটাও বাঁধা ছিল…
সে ঠান্ডা তরমুজের বাটিটা হাতে নিয়ে কাটা চামুচ দিয়ে আমাকে খাইয়ে দিতে থাকে। চান্দু, তুমি তরমুজ খুব ভালো কিনতে পারো
– থাঙ্কস
– সবাই পারে না… এবারেরটা মেইড ইন কানাডা কিনসো। এদেশের জিনিস ভালো। ওন্টারিওতে এবার বাম্পার ফলন। কি চিনির মতো মিষ্টি দেখসো?
রাতে খাওয়ার পরে ক্যামেরার ঘটনাটা বললে কী ক্ষতি ছিল? বিরিয়ানি খাওয়ায়ে একবারে দুঃসংবাদটা দিলে কিছুটা উসুলও হতো? আমি বিছানার বসে চায়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। আধা ঘন্টা হয়ে যাবার পরও আসার কোনো লক্ষণ না দেখে সন্দেহ হয়। চেঁচিয়ে বললাম, তুমি কি চা বানাচ্চো?
– চান্দু, ইকটু কষ্ট করে বানায়ে খাও। আমি বিজি… বারান্দা থেকে চেঁচিয়ে বলে।
আমি আবারও ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকি বারান্দার দিকে…
.
.
.
.
জাভেদ ইকবাল