অনির কলমে আদ্রিয়ান পর্ব ১০
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
.
তাকে অল্প কাছে ডাকছি
আর আগলে আগলে রাখছি,
তবু অল্পেই হারাচ্ছি আবার।
আমার জীবনে একজন মানুষ আছে। যাকে আমি আমার কাছে ডাকি। খুব গোপনে। কোন শব্দ, ইশারা ছাড়াই আমি তাকে ডাকি। বারবার ডাকি। আমার সেই শব্দহীন, ইশারাহীন ডাকে সেও প্রতিবার নিঃশব্দেই ছুটে আসে। কোন শব্দ ছাড়াই হাজারটা প্রেমের কবিতা শুনিয়ে যায়। কোন ইশারা ছাড়াই হাজারবার বুঝিয়ে দিয়ে যায় ‘বড্ড ভালোবাসি শ্যামবতী’। অপরদিকে আমার জীবনে শুধুমাত্র এই অব্যক্ত প্রেমটুকুই আছে যা বারবার আমায় ভয়ানক বিষাদময় প্রহরে ঠেলে দেয়।
আরও একটা নির্ঘুম রাত পার করার পর মাথাটা বেশ ভারী লাগতে শুরু করল আমার, চোখেও জ্বালা করছে। ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে ভাবলাম শরীর টিকিয়ে রাখতে হলেও একটু ঘুমের প্রয়োজন। কিন্তু টানা এক ঘন্টা যাবত চেষ্টা করার পরেও ঘুম নামক বস্তুটি যখন চোখে ধরা দিল না, তখন মোটামুটি নিশ্চিত হলাম যে আজকেও নির্ঘুম অবস্থাতেই থাকতে হবে আমায়। তাই উঠে ফ্রেশ হয়ে সোজা চলে গেলাম কিচেনে। খোলা এলোমেলো চুলগুলো খোপা করে নিলাম। গ্যাসটা অন করে চা চড়িয়ে দিলাম। চা করতে করতে আম্মুও উঠে পড়ল। আমায় এতো ভোরে জেগে থাকতে দেখে আর চা বানাতে দেখে বেশ অবাক-ই হয়েছে সেটা বোঝা গেল। আমি আম্মুর অবাক দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে বললাম,
‘ আব্বু উঠে পড়েছে?’
‘ হ্যাঁ উঠে গেছে। কিন্তু..’
আম্মুর কথা শেষ হওয়ার আগেই আমি নির্লিপ্ত গলায় বললাম,
‘ তুমি গিয়ে বস। আমি চা নিয়ে আসছি। ‘
আম্মু আমার দিকে কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে চলে গেল। আমি চা কাপে ঢেলে হাফপ্লেটে বিস্কিট নিয়ে ট্রে তে রাখলাম। ওনাদের সামনে গিয়ে চা রেখে নিজের কাপটা নিয়ে রুমে যেতে নেব তখনই আব্বু বলল,
‘ অনি! এখানে বসো।’
আমি চুপচাপ গিয়ে ওনাদের দুজনের মাঝে অবশিষ্ট জায়গাটায় গিয়ে বসলাম। আব্বু মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘ রাতে ঘুমাও নি? চোখ লাল হয়ে গেছে তো।’
আম্মু বিরক্তি নিয়ে বাঁকা হয়ে আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তারপর বলল,
‘ সারারাত ফোন আর ল্যাপটপে ডুবে থাকলে চোখের আর কী দোষ?’
আম্মুর কথাকে উপেক্ষা করে আব্বু বলল,
‘ এডমিশন নিয়ে টেনশন করছো?’
আমি একটু হেসে বললাম,
‘ না আব্বু। আসলে রাতে ঘুম কম হয়েছে তাই।’
‘ চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। যাও রুমে যাও।’
আমি চুপচাপ রুমে চলে এলাম। মন খারাপ থাকলে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা আমার অভ্যাস। আর সেটা যদি হয় মেঘলা আকাশ তাহলেতো কথাই নেই। এমন মনে হয় আকাশ আমার মনের সাথে কথা বলছে। অতি গোপনে, নিঃশব্দে। আজও চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সেটাই করছি। আকাশের কাছেই নিঃশব্দে বলে যাচ্ছি আমার একঝুড়ি অভিযোগ আর অভিমান।
সেদিনের বেলাটা কীভাবে কেটে গেল বুঝে উঠতে পারলাম না। বেলা তিনটে কী চারটা হবে হয়তো। দুপুরের খাওয়াটাও হয়ে ওঠেনি এখনো আমার। রুমে বসেই বুঝতে পারলাম মানিক আঙ্কেল এসেছেন। আমি আজ ইচ্ছে করেই গেলাম না ওনাদের সামনে। কেনো জানিনা মন টানলো না। কিচেন থেকে পানি খেতে খেতে ওনাদের কিছু কথোপকথন কানে এলো। মানিক আঙ্কেল বলছেন,
‘ মেয়ে ভালো-ই। আমি আর বাবা দেখেছি। বাবার বেশ পছন্দ হয়েছে। আদ্রিয়ানের জন্যে অবশ্যই ঠিক আছে। বাবাতো বলেই দিয়েছে এটাই নাকি ফাইনাল। ওদের দেখে আসাটা নাকি জাস্ট ফর্মালিটি।’
আব্বু বলল,
‘ আদ্রিয়ান কী বলেছে? যতই হোক বিয়েটাতো ও করবে। কাকা এতো তাড়হুড়ো কেন করছে আমি বুঝতে পারছিনা।’
‘ তোকেতো বলেছি বাবার শরীর ভালো না। আদ্রিয়ান কলিজার টুকরা ওনার। ছোট থেকে খুব আদরে বড় করেছে। তাই মরার আগে ওর বউ দেখে যেতে চায়। আর এতে তো অন্যায় দেখছি না। আর আদ্রিয়ানকে__’
ব্যস এইটুকুই শুনতে পেলাম আমি। কারণ ততক্ষণে আমি রুমে চলে এসছি। কেন জানিনা সব অসহ্যকর লাগতে শুরু করল। প্রচন্ড গরম লাগছে বলে মনে হল। ফুল স্পিডে ফ্যান চালিয়ে দেওয়ার পরেও মনে হল আমার শরীর জ্বলে যাচ্ছে। ভাত খেয়ে একটা ঘুমের ঔষধ খেতে খুব ইচ্ছে করছে এখন। ঘুমটা ভীষণ প্রয়োজন আমার। স্বাভাবিকভাবে তো আসছেনা ঘুম।
পরেরদিন ছিল জুলাই মাসের আঠাশ তারিখ, বুধবার। বেলা দশটার মতো বাজে। আমি আর আম্মু পায়ে হেঁটেই পুরাণ বাজার থেকে টিএনটি গেলাম। আম্মুর কিছু কেনাকাটা আছে আর আমিও ভার্সিটির জন্যে এপ্লিকেশন ফর্ম সাবমিট করব। প্রথমেই মুক্তার ভাইয়ের কম্পিউটার সেন্টারে ঢুকলাম ফর্ম সাবমিট করার জন্যে। কিন্তু ওখানে গিয়ে এভাবে চমকে যাব সেটা ভাবতে পারিনি। মুক্তার ভাইয়ের ঠিক পাশের চেয়ারেই আদ্রিয়ান ভাই পায়ের ওপর এক পা তুলে বসে ফোন স্ক্রোল করে যাচ্ছে। মুক্তার ভাই হেসে বলল,
‘ কী ব্যপার অনিমা? ফর্ম সাবমিট করতে এসছো? বসো বসো। আন্টি বসেন। ভালো আছেন?’
আম্মু হেসে বলল,
‘ আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি।’
আমি আর আম্মু বসলাম। কিন্তু আমিতো শুধু অবাক হয়ে আদ্রিয়ান ভাইকেই দেখছি। উনি এখানে কী করছেন? আদ্রিয়ান ভাই এবার ফোন থেকে চোখ তুলে বলল,
‘ মামণি কোথায় কোথায় করেছে?’
আম্মু বলার সাথে সাথেই উনি আমার হাত থেকে আমার একাডেমিক ডকুমেন্টস এর ফাইল টা নিয়ে নিলেন। এরপর মুক্তার ভাইয়ের সাথে কীসব কথাবার্তা বলছেন। আমার কানে কোন কথা যাচ্ছেনা। আমি শুধু ওনাকেই দেখছি অবাক চোখে। আমি অবাক হওয়ার রেশ কাটিয়ে ওঠার আগেই এপ্লাই করা শেষ হয়ে গেল। উঠে আসার সময় মুক্তার ভাই বলল,
‘ আদ্রিয়ান জাজিরাতে একটু বেশিই আসছো আজকাল? সদরে আর মন টেকেনা নাকি?’
আদ্রিয়ান ভাই হেসে ফোনটা পকেটে রাখতে রাখতে বলল,
‘ মনটা সদরে আর নিতে পারলাম কই মুক্তার ভাই? মনের মালকিন তো জাজিরাতেই পড়ে আছে। আর মন তার মালকিনকে ছেড়ে যেতে নারাজ।’
আমি শুধু এক তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম ওনার দিকে। আমি আমার ফাইলটা ওনার হাত থেকে নিতে গেলেই উনি হাত সরিয়ে বললেন,
‘ পিচ্চি মানুষ এতো ভার নিতে পারবিনা। যা বের হ।’
আমি রাগে একপ্রকার কাঁপতে কাঁপতে বের হলাম সেন্টার থেকে। রাস্তায় কিনার দিয়ে হাঁটছি আম্মু আমি আর আদ্রিয়ান ভাই। বুঝতে পারলাম আম্মু জানতো উনি আসবেন। কিন্তু কেন? এপ্লাইটা কী আমি নিজে করতে পারতাম না? আমার সবকিছুতেই ওনার আধিপত্য কেন থাকবে? কই আমিতো কখনও যাইনি তার জীবনে নাক গলাতে। হাঁটতে হাঁটতে জাজিরা মহর আলী স্কুলের সামনের মারিয়া স্টোরের গিয়ে আমরা থামলাম। আম্মু ওখান থেকে কিছু কেনাকাটা করলেন। আম্মুর নিষেধ সত্ত্বেও সব প্যাকেটের ভার সাহেব নিজেই নিলেন। তবে এরমধ্যে একবারের জন্যেও ওনার দিকে তাকাই নি আমি। ওনার চেহারা দেখার মিনিমাম ইচ্ছেটুকুও আমার আর নেই। এমনিতেই এতো হাঁটাহাঁটি করে ক্ষিদে পেয়েছে আমার। এরমধ্যে এসব রংঢং আর সহ্য হচ্ছেনা। আদ্রিয়ান ভাই আম্মুকে বলল,
‘ মামণি কিছু খেয়ে নেই আমরা? অনেক্ষণ তো হলো?’
আম্মু একবার মোবাইলে সময় দেখে বলল,
‘ তোর ক্ষিদে পেয়েছে?’
আদ্রিয়ান ভাই একপলক আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ হ্যাঁ একটুখানি।’
আম্মু সম্মতি দিতেই আদ্রিয়ান ভাই মারিয়া স্টোরের পাশেই ‘মারিয়া ফার্স্টফুড’ দোকানে গেল। সেখান থেকে স্যান্ডউইচ খেয়ে বের হওয়ার সময় আমার হাতে ছোট একটা কোকের বোতল আর চকলেট ধরিয়ে দিল আদ্রিয়ান ভাই। বোতল আর চকলেটটা বাধ্য হয়ে নিলেও যথারীতি ওনার দিকে তাকাইনি আমি।
ঐ এলাকাতেই দুই তালাতে রতন ডাক্তারের বাড়ি আছে। নিচে শপিং মল। মাঝে ওঠার যে সিঁড়িটা আছে ওখানটা বেশিরভাগ সময়ই নির্জন থাকে। আমায় আর আদ্রিয়ান ভাইকে সিঁড়ির নিচে দাঁড় করিয়ে রেখে আম্মু সেই ডাক্তারের কাছে গেল। আমি চেয়েও কিছু বলতে পারলাম না। উনি পাশে তাই আমি হাত ভাঁজ করে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। না তাকিয়েও কীভাবে যেন বুঝতে পারছি আদ্রিয়ান ভাই আমাকেই দেখছেন। প্রায় দু-তিন মিনিট পর উনি ব্যাগগুলো নিচে রেখে এগিয়ে এসে আমার ডান হাতের বাহু ধরে নিজের দিকে ঘোরালেন। আমি তবুও চোখ রাখলাম না ওনার দিকে। উনি বাহু হালকা শক্ত করে ধরে বললেন,
‘ সেদিন মেসেজে বললাম, কথা আছে আসলে নক করিস। সময়মতো সিন করিসনি। পরে ওভাবে রামধমক খাওয়ার পরেও তো একবার অন্তত জিজ্ঞেস করতে পারতি কী কারণে মেসেজ করেছি। এতো জেদ কেন তোর?’
আমি এবার ওনার মুখের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালাম। হয়তো সেই দৃষ্টিতে ছিল অসংখ্য অভিযোগ আর অভিমান। ওনার হাত সরিয়ে যেতে নিলেই উনি আমার দুই বাহুই ধরলেন। আমি ছাড়নোর চেষ্টা করতে করতে বললাম,
‘ আপনিতো বলেছিলেন পরেরবার আপনার সামনে না আসতে। আসলে নাকি আমার অবস্থা খারাপ করে দেবেন। আমি কিন্তু আসিনি। আমার আপনার সামনে আসার কোন শখও নেই। আপনি নিজেই এসছেন।’
উনি কিছুক্ষণ আমার মুখটার দিকে খুব গভীরভাবে তাকিয়ে থেকে বললেন,
‘ মেসেজের রিপ্লে করিসনি কেন?’
‘ আমি কেন আপনার মেসেজের রিপ্লে করতে যাবো বলুনতো? আর আপনি আমাকে মেসেজ-ই বা করবেন কেন? করতে হলে নিজের হবু বউকে গিয়ে করুন না। রোমান্টিক, রোমান্টিক মেসেজ।’
‘ ম্যাডামের জ্বলছে নাকি?’
বলে আমাকে নিজের আরেকটু কাছে টেনে নিলেন। ক্রোধে এবার গা ফেটে পড়ার অবস্থা হল আমার। অতিরিক্ত রেগে গেল আমি কেঁদে ফেলি। এবারও তাই হল। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। নাচতে নাচতে বিয়ে করছে। আবার আমার ওপরেও গায়ের জোর দেখাচ্ছে। অসভ্য লোক। আমি পুনরায় ওনার হস্তবন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করতে করতে কাঁদোকাঁদো গলায় বললাম,
‘ আমার জ্বলার কোন কারণ নেই। ছাড়ুন আমাকে। আমি কিন্তু আপনার বউকে বলে দেব। যে আপনার চরিত্র খারাপ। বিয়ে ঠিক হওয়ার পরেও অন্য মেয়ের ওপর গায়ের জোর দেখান।’
উনি আমার হাত আলগা করে বললেন,
‘ বোকার মতো কাঁদছিস কেন? আচ্ছা আমার কথাটা শোন__’
উনি ওনার বাক্য সম্পূর্ণ করার আগেই কারো সিঁড়ি দিয়ে নামার আওয়াজ পেয়ে ছেড়ে দিলেন আমাকে। আমিও দ্রুত চোখ মুছে স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ালাম। আম্মু নেমে এসেছে। আম্মু নেমে ওড়না দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে বলল,
‘ উফ! কাজ সব শেষ হল। চল, চল।’
আমি একপলক আদ্রিয়ান ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আম্মুকে অনুসরণ করে বেরিয়ে এলাম। আদ্রিয়ান ভাইও এলেন পেছন পেছন। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দাঁড় করিয়ে দিল একটা অটো। অটো থামতেই কোনদিকে না তাকিয়ে আমি উঠে বসলাম। আম্মু এসে বসার পর আদ্রিয়ান ভাই ব্যাগগুলো ভেতরে রেখে ঝুঁকে অটোওয়ালাকে ভাড়া দিয়ে বলল,
‘ চাচা, পুরানবাজার কোতয়াল বাড়ি চেনো তো? বাড়ির সামনে নামিয়ে দিও।’
অটোওয়ালা মাথা নাড়লো। আম্মু বলল,
‘ তুই কোথায় যাচ্ছিস? বাড়ি চল। দুপুরে খেয়ে যাবি।’
উনি একপলক আমার দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বলল,
‘ আজ না মামণি, কাজ আছে আরও। অন্য একদিন আসব।’
অটো ছেড়ে দিল। আর আমি লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে দেখলাম, কেমন উদাস দৃষ্টিতে নিজের কাছ থেকে দূরে যেতে থাকা অটোটার দিকে একনজরে তাকিয়ে আছেন উনি। আমার ভেতর থেকেও বেরিয়ে এলো এক চাঁপা দীর্ঘশ্বাস।
ঐদিনটাও কোরকমে কেটে গেল। পরেরদিন বিকেলবেলা বসে বসে ম্যাথ সলভ করছিলাম। কাল কোচিং এ পরীক্ষা আছে। রেসাল্ট ডিরেক্ট আব্বুর নাম্বারে মেসেজ আকারে এনাউন্স করা হয় তাই না চাইতেও হালকা-পাতলা পড়তে হয়। টেবিলে রাখা ফোনটা বাজতেই স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলাম মামণির নাম্বার। আমি কলমের ক্যাপ লাগিয়ে ফোনটা রিসিভ করে সালাম দিলাম। ওপাশ থেকে সালামের জবাব দিয়ে মামণি বলল,
‘ কেমন আছিস অনু?’
‘ ভালো আছি মামণি, তুমি কেমন আছো?’
‘ আলহামদুলিল্লাহ্।’
‘ আঙ্কেল, জাবিন-সারা ভালো আছে?’
‘ হ্যাঁ সবাই ভালো আছে। বলছি শোননা? কাল শুক্রবার আদ্রির জন্যে মেয়ে দেখতে যাচ্ছি সেটাতো জানিস?’
আমি কিছুক্ষণ চুপ রইলাম। এরপর মৃদু কন্ঠে বললাম,
‘ জানি মামণি।’
‘ ভাবি কিন্তু যাচ্ছে। তুই ভুলেও না করবিনা। সাথে জাবিনও যাবে, তোর একা লাগবেনা। বাবাতো আদ্রিয়ানের বউ দেখার জন্যে পাগল। ও কখন আবার ইউকে দৌড় দেয় ঠিক আছে বল? এইজন্যই তো তাড়া! তোদেরই তো ভাই। তোরাইতো গিয়ে মেয়ের ছবি-টবি তুলবি নাকি? আমরা ওসব করলে কেমন দেখাবে?’
আমার হঠাৎ কেমন মাথা ধরে এল। মামণির মিষ্টি কন্ঠস্বরও বিষাক্ত লাগতে শুরু করল। নিজেকে যথাসম্ভব সামলে বললাম,
‘ আমি না গেলে হয়না মামণি? সবাই তো যাচ্ছে।’
মামণি একটু চুপ থেকে অসহায় কন্ঠে বলল,
‘ তুই কী আমাদের ওপর রেগে আছিস?’
আমি চমকে গিয়ে বললাম,
‘ না রাগ করবো কেন? আসলে আমার শরীর ভালো নেই তাই..’
‘ তোকে কী আমি রোজ রোজ বলি বল? একটা দিনেরই ব্যাপার। জাবিন ছাড়া তোর বয়সী যাওয়ার মতো আর কেউই নেই। আর ও একা যেতে চাইবেনা। চল না সোনা আম্মু আমার।’
এবার না করাটা বেয়াদবি হবে। মামণিতো কিছু করেনি। ওনাকে অহেতুক কষ্ট দেওয়াটা ঠিক হবেনা। তাছাড়াও কেউই কিছু করেনি। বাবা এই বয়সে কোনদিনও আমার বিয়ে দেবেনা। দুনিয়া উল্টে গেলেও, কোন যুক্তি তর্কই এক্ষেত্রে খাটবেনা, সেটা আদ্রিয়ান ভাই খুব ভালো করে জানে। আর উনি ওনার দাদাভাইকে ভীষণ ভালোবাসে। ওনার জন্যে যদি বিয়েতে রাজি হয়েও থাকে তাতে দোষ কোথায়? একমাত্র আমার জন্যে তো আর নিজের গোটা পরিবারকে ফেলে দেবেন না। দেওয়া উচিত ও না। এমনিতেও, অজুহাত দিয়ে পাত্রি দেখতে না হয় গেলাম না কিন্তু বাকি অনুষ্ঠান যখন হবে তখনতো আমি থাকতে বাধ্য। অজুহাত কতক্ষণ দেব? কেনই না দেব? আমি থাকলে বাকিরাতো খুশি হবে। ক্ষতি কী? আমি নির্লিপ্ত কন্ঠে বললাম,
‘ আচ্ছা, যাবো আমি।’
মামণি মনে হয় ভীষণ খুশি হলেন। আনন্দিত কন্ঠে বললেন,
‘ তাহলে জাবিনকে বলছি আমি?’
‘ হ্যাঁ বলো।’
‘ আচ্ছা তা..’
আর কিছু বলার আগেই লাইন কেটে গেল। হয়তো ব্যালন্স শেষ মামণির। আমার ফোনেও নেই। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার অংকে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলাম। খুব সহজ বেসিকের একটা অংক। কিন্তু কিছুতেই মেলাতে পারছিনা। ফলাফল বারবার ভুল আসছে। সঠিক সুত্র বসাতে পারছিনা কিছুতেই। কাটতে কাটতে পাঁচ-ছয় পৃষ্ঠা শেষ করে ফেললাম কিন্তু অংক মিলল না। এতো সহজ অংক মিলছে না? কেন মিলছে না? এবার আমার কান্না পাচ্ছে। ভয়াবহ কান্না। পৃষ্ঠাগুলো ছিঁড়ে দুমড়ে-মুচড়ে ফেলে দিলাম ফ্লোরে। দু-হাত দিয়ে কপালের চুল উল্টে ধরে টেবিলে কনুইয়ের ভর রাখলাম। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললাম আমি। অংক না মেলার অনুভূতি বুঝি এতো যন্ত্রণার হয়?
.
.
[ যদি পারি তো রাতে ছোট্ট করে আরও কিছু অংশ লিখে দেব। ]