#তুমি অন্য কারো সঙ্গে বেঁধো ঘর
পর্ব ১০
খারাপ সময় দেরিতে যায়।নবনীর মনে হলো তার ও তেমন অবস্থা। দিন কাটছে না কিছুতেই যেনো।সারাদিন মা’কে টুকটাক সাহায্য করে,দুই বোনের স্কুলের পড়ায় সাহায্য করে কিছুটা।
কিন্তু এসবের মধ্যে ও নবনীর মধ্যে অস্থিরতা কাজ করে। বুকের ভেতর একটা ব্যথা ক্ষণে ক্ষণে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে।
মায়া কি একেই বলে? কার প্রতি মায়া?যারা তাকে দিনের পর দিন এভাবে কষ্ট দিয়েছে তাদের জন্য কেনো এতো মায়া লাগছে?
আচ্ছা,ওদের ও কি নবনীর জন্য এরকম লাগে?
জানা নেই নবনীর।
অবশেষে নবনীর ডিভোর্স হয়ে গেলো। বুকের ভেতর চুরমার হয়ে যাওয়ার মতো ব্যথা নিয়ে নবনীর সেদিন কাটলো কোনোমতে। নবনী অবাক হলো হামিদুর রহমান তারপর থেকে একবার ও নবনীর খোঁজ নেয় নি দেখে।নবনী বুঝে উঠতে পারছে না কেনো হামিদুর রহমান নবনীর সাথে একবার ও কথা বললো না।নবনী ও ফোনে পাচ্ছে না তাকে।
বৃহস্পতিবার বিকেল বেলা।নবনী বসে ফাল্গুনীর চুল বেঁধে দিচ্ছিলো। পাশে চৈতালী বসে আছে। তার চুল বাঁধা শেষ। নবনী আজকে রঙিন ফিতা দিয়ে দুই বোনের চুলে বিনুনি করে দিচ্ছে।
এমন সময় হাশেম আলী বাড়ি ফিরলেন।নবনী উঠে গিয়ে বাবার জন্য এক গ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে এলো। হাশেম আলী চৌকিতে বসে রইলেন কিছুক্ষণ চুপ করে।
নবনী ফাল্গুনীর চুল বাঁধা শেষ করে বাবার পাশে গিয়ে বসলো। বাবার কাঁধে হাত রেখে বললো,”কি হয়েছে বাবা?”
হাশেম আলী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,”তোর জন্য একটা বিয়ের সম্বন্ধ আসছে।”
রাবেয়া বারান্দায় বসে শাকের পোকা বেঁছে রাখছেন,রাতে রান্না করার জন্য শুঁটকি দিয়ে। রাবেয়ার হাত ও থেমে গেলো এই কথা শুনে।
নবনী অবাক হলো। তার ডিভোর্স হয়েছে সবে ৩ দিন হয়েছে।
রাবেয়া বেগম উঠে এলেন স্বামীর পাশে।হাশেম আলী কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর বললো,”আমাকে আজ এক ঘটক কল দিয়েছে। নবনীর ননদ লুবনাকে ওনারা না-কি একবার দেখতে গেছে।তখন ওনাদের লুবনাকে পছন্দ হয় নি।নবনীকে হয়েছে।এখন যখন শুনেছে নবনীর সাথে তামিমের ডিভোর্স হয়েছে তাই তারা নবনীকে বউ করে নিতে চাচ্ছে।”
নবনী শোনার পর অট্টহাসিতে ভেঙে পড়লো। তারপর হেসে বললো,”তুমি কি বলেছ?”
হাশেম আলী বললো,”আমি নিষেধ কইরা দিছি।সোজাসাপ্টা কইছি আমি যেমন গরীব আমার মেয়েরেও তেমন গরীব ঘরে বিয়ে দিবো।বড় ঘরে বিয়ে দেওনের শখ মিটে গেছে আমার। তাছাড়া আমার মেয়েরে এখনো বিয়ে দেওনের কথা আমি ভাবি নাই।আরো সময় যাক,আমার মাইয়া নিজেরে সামলাইয়া নেক নিজে।”
শুনে নবনী স্বস্তি পেলো। বাবা মা যে মেয়ের মনের অবস্থা বুঝতে পারছে এটাই তার জন্য স্বস্তির। হাশেম আলী মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো পরম আদরে।এক অজানা কারণে তার দুই চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে গেলো।
কান্নাভেজা গলায় বললেন,”কোনো চিন্তা করবি না মা।তোর বাপ মা বাঁইচা আছে এখনো। তোর মাথা গুঁজার জায়গা আছে।নিজেরে ছোট মনে করবি না।আল্লাহ ভরসা।”
রাতে নবনীর বড় ফুফু হাবিবা বানু এলো নবনীদের বাসায়।নবনীকে দেখে কিছুটা অবাক হলেন।কুশলাদি জিজ্ঞেস করার পর জিজ্ঞেস করলেন,”কবে আইলি বাপের বাড়ি? “
নবনী হেসে বললো,”৩ মাসের বেশি ফুফু।”
হাবিবা ভ্রু কুঁচকে তাকালো।তারপর বললো,”এতোদিন বাপের বাড়ি আছস যে এবার?তোর শ্বশুর বাড়ির লোকেরা তো তোরে বেশি থাকতে দেয় না এই বাড়িতে। “
নবনী কিছু বললো না।
হাবিবা বুঝতে পারলেন কিছু একটা ঝামেলা হয়েছে। হাবিবা নবনীকে তার মেজো ছেলে বাবুলের বউ করতে চেয়েছিলো কিন্তু হাশেম আলী আত্মীয়ের সাথে নতুন করে আত্মীয়তা করতে রাজি ছিলেন না।
বাবুল নবনীর জন্য পাগলের মতো ছিলো।নবনীর বিয়ের দিন বাবুল বাড়িতে মহাপ্রলয় ঘটিয়েছে। দা দিয়ে ঘরের সব বেড়ার টিন কেটে দিয়েছে।ঘরের শোকেস,আলমারি ভেঙে ফেলেছে।এসব নিয়ে ভাইয়ের সাথে দীর্ঘদিন হাবিবা কথা বলে নি।
কৌতূহলী হয়ে হাবিবা জিজ্ঞেস করলেন,”কি অইছে,হাছা কইরা কইবি।”
রাবেয়া বেগম নিজের ননদদের চিনেন।তিন ননদ সুযোগ পেলে তাকে কথা শুনিয়ে দেয়।হাশেম আলী বললেন,”নবনীর লগে তামিমের ছাড়াছাড়ি হইয়া গেছে। “
হাবিবা ঠোঁট বাঁকা করে হাসলো।তারপর বললো,”ক্যান,ছাড়াছাড়ি হইলো ক্যান?”
হাশেম আলী বললেন,”আমি গরীব,আমার মাইয়ার গরীবের ঘরে জন্ম অইছে এইজন্য। “
হাবিবা সুযোগ পেয়ে বললো,”গরীব দেইখাই তো ওরা বিয়া করাইছে।তাইলে আইজ এই অবস্থা ক্যান?কিছু একটা অইছে,তোর মাইয়ারে আমি ভালা কইরা চিনি,আমার বাবুলের মাথা এই মাইয়া নষ্ট করছে।আমার পোলা আইজ ও সংসারি অইলো না।বিয়া করাইছি তাও বউরে দেখতে পারে না। “
হাশেম আলী রেগে গেলেন এসব শুনে।বোনের মুখোমুখি হয়ে বললেন,”হাবিবা,আমার মাইয়া ভালা কাম করছে না-কি খারাপ কাম করছে তার বিচার করনের দায়িত্ব আমার।মাথা ঘামানোর দায়িত্ব আমার।তুই ভাইয়ের বাড়িতে বেড়াইতে আইছস,বেড়া।আমার মাইয়ার জীবন লইয়া চিন্তা করনের দরকার নাই।আমার মাইয়ারে নিয়া কেও একটা খারাপ কথা কইবো আমি হাশেম আলী তারে ছাইড়া কথা কমু না।আমার মাইয়া আমার কলিজার টুকরা, আমার কলিজায় আঘাত লাগলে আমি কাউরে ছাইড়া দিমু না।”
হাবিবা ভাইয়ের এরকম নিষ্ঠুর কথা শুনে কাঁদতে লাগলেন।কাঁদতে কাঁদতে ঘরের থেকে বাহির হয়ে গেলেন।নবনী পিছনে পিছনে গেলো।সাব্বির এসে বোনের হাত চেপে ধরে বললো,”যাবি না আপা,কোনো দরকার নাই ওনার পিছন পিছন গিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করার।”
নবনী ভাইয়ের কথা শুনলো না।দৌড়ে গিয়ে ফুফুকে জড়িয়ে ধরে ঘরে নিয়ে এলো। তারপর বললো,”রাগ কইরেন না ফুফু।কই যাচ্ছেন এতো রাতে আপনি?খাওয়া দাওয়া করেন,বেড়াতে আসছেন বেড়াবেন আমাদের সাথে।”
সাব্বিরের প্রচন্ড রাগ হলো বোনের এতো ভালোমানুষি দেখে,প্রচন্ড রেগে গেলো সাব্বির।ফুফুর সামনে এসে বললো,”যতোদিন খুশি বেড়ান ফুফু,কিন্তু শুধু একটা কথা মনে রাইখেন,আমার আপারে লইয়া আর একটা কথাও কইবেন না।আমার বোইনের ভালো মন্দ আমরা বুঝমু।আপারে লইয়া একটা মন্দ কথা যে কইবো আমি তার জিহ্বা কইট্টা দিমু।আমার আপা কেমন মানুষ আমার আল্লাহ জানলেই হইবো।”
হাবিবা বানুর কান্নার বেগ আরো বেড়ে গেলো। বিলাপ করে বললেন,”আমার বাপ মা মইরা গেছে,বাপের ভিটায় আইছি কইলজা একটু ঠান্ডা করনের লাইগা।আর আমার ভাই, ভাইয়ের পুতে কি-না আমারে ধমক দিয়া কথা কয়।এই ঘরে আমি থাকমু না।ও আল্লাহ, বাপ মা মরলে ভাই এতো পাষাণ অইয়া যায় ক্যান?”
হাবিবা বানুকে কেউ আটকে রাখতে পারলো না।হাবিবা বানু কাঁদতে কাঁদতে নবনীদের পাশের বাড়িতে গিয়ে উঠলেন।
নবনী সাব্বিরকে ধমক দিয়ে বললো,”তোকে এতো কথা বলতে বলছে কে?বড় হয়ে গেছস না-কি খুব?ফুফুর সাথে এইরকম ব্যবহার করা কেমন ভদ্রতা?”
হাশেম আলী নবনীকে থামিয়ে দিয়ে বললো,”আমার পোলা একটা ভুল কথাও কয় নাই।যা কইছে ঠিক কইছে।যা সবাই,খাইতে দিতে বল তোর মা’কে। “
একটা থমথমে পরিবেশে সবাই খেতে বসলো। পাশের বাড়ি থেকে হাবিবার বিলাপ শোনা যাচ্ছে। খেয়ে সবাই শুয়ে পড়লো আজ।নবনী সারারাত চটপট করতে লাগলো।
সকালের সূর্য উঠার আগে পুরো এলাকার মানুষ জেনে গেলো নবনীকে নবনীর স্বামী তালাক দিয়েছে নবনীর খারাপ স্বভাবের জন্য।সকাল ১০ টার মধ্যে নবনীর বাকি দুই ফুফুও চলে এলো নবনীদের বাড়িতে।
চলবে…….
রাজিয়া রহমান