অন্তর্হিত কালকূট
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
২৫.
বেশিক্ষণ ঘুমানোর ভাগ্য হলোনা রুদ্রর। সন্ধ্যা হতে না হতেই ডাক পড়ল রাশেদ আমেরের। বৈঠক ঘরে উপস্থিত হওয়ার হুকুম এসেছে, দশ মিনিটের মধ্যে। রুদ্র আমেরকে হুকুম করার ক্ষমতা একমাত্র রাশেদ আমের-ই আছে। আর এক্ষেত্রে রাশেদ তার ক্ষমতার সৎ ব্যবহার করতে কোনরকম ত্রুটি করে না। ফ্রেশ হয়ে বের হওয়ার পর রুদ্রর ভীষণ ইচ্ছে করল একটা সিগারেট জ্বালাতে। কিন্তু রাশেদের হুকুম তামিল করাটা বেশি জরুরি। তাই ইচ্ছেটাকে মনে চেপে রেখে একটা শার্ট গায়ে জড়িয়ে বোতাম লাগাতে লাগাতে রুদ্র এগিয়ে গেল বৈঠক ঘরের দিকে। করিডরে থাকা দুই প্রহরী সালাম ঠুকলো নতজানু হয়ে। রুদ্র দরজা ঠেলে অর্ধেক মেলে দিয়ে বলল, ‘বাবা আসব?’
‘ এসো।’ বরাবরের মতই সেই বজ্রকন্ঠে আদেশ করলেন রাশেদ।
রুদ্র ভেতরে গিয়ে দেখে ঘরে রাশেদ, জাফর, ইকবাল আর উচ্ছ্বাস আছে। সঙ্গে দলের আরও কিছু বিশ্বস্ত লোকজন। সকলের হাতেই একটা করে চায়ের কাপ। উচ্ছ্বাসের দিকে চোখ পড়তেই দেখল সে নিজের বরাদ্দকৃত চেয়ারে আরামে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। চোখ-মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে আজ বেশ আমদে আছে ছোকরা। রুদ্র রাশেদের ডান পাশে নিজের চেয়ারটাতে গিয়ে বসল। রাশেদ ধীরেসুস্হে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে টেবিলে রাখল কাপটা। কিছু বলল না। বাকিরাও চুপ করে আছে রাশেদের কিছু বলার অপেক্ষায়। রাশেদ কথা বলার পরেই সবাই কথা বলবে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে রাশেদ বলল, ‘যখন গিয়েছিলে তখন তোমার পরিকল্পনাটা আমি জানতে চাইনি। কারণ মিশনটা তোমার ছিল। আমার দায়িত্ব ছিল তোমার কাজ বুঝিয়ে দেওয়া। কাজটা কীভাবে করবে সেটা সম্পূর্ণই তোমার ব্যপার ছিল। কিন্তু নিরাপদে কাজ সম্পূর্ণ করে যখন ফিরতে পেরেছো তখন কীভাবে কী করলে সেটা আমাদের জানা প্রয়োজন। ওদের গতিবিধি, ক্ষমতা, পদ্ধতি সম্পর্কে নিশ্চয়ই যথেষ্ট ধারণা হয়েছে তোমার। আমাদেরও দাও।’
এরকম বিপদজনক একটা কাজ করে, গু’লির আঘাতে আহত হয়ে, নির্দিষ্ট সময়ের একদিন পর বাড়ি ফেরার পর সাধারণত যেকোন বাবার প্রথম প্রশ্ন হয়, কেমন আছো, কোন ক্ষতি হয়েছে কি-না, দেরী হলো কেন ইত্যাদি। কিন্তু রাশেদের করা প্রশ্ন শুনে মনে হচ্ছে রুদ্রর ব্যপারে তার কোন আগ্রহ নেই। সে কাজে বিশ্বাসী। তার কাছে কাজটাই সবার আগে। ব্যপারটায় ঘরে উপস্থিত কেউ অবাক হলোনা, এমনকি রুদ্রও না। রাশেদের এই সত্ত্বার সাথে ভালোভাবেই পরিচিত ওরা। রুদ্র একটা কাপে চা ঢালতে ঢালতে বলল, ‘বাবা, ইন্ডিয়া থেকে পেনড্রাইভটা যে চোরাই পথে বাংলাদেশে আসছে এবং সেটা আমাদের কাছেই আসছে সেটা ব্লাকহোল জানতে পেরেছিল আরও দু মাস আগে। সবুজ, খোকন আর স্বপনের খু’ নের পর ওরা বেশ সতর্ক হয়ে যায়। তাই তপুর কাছ থেকে অনেক ইনফরমেশন ফোনেই নিয়ে নিয়েছিল। আর সেখান থেকেই জেনে যায় ব্যপারটা। যেহুতু কোনদিক দিয়ে আসছে সেটা ওরা আগে থেকেই জানতো তাই মাঝপথেই ওরা চুরি_’
রুদ্রর কথা শেষ হওবার আগেই রাশেদ আবার চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিয়ে বলল, ‘এইটুকু আমিও জানি। পরে?’
রুদ্র চায়ের কাপে চুমুক দিল। সেই ফাঁকে উচ্ছ্বাস বলল, ‘ব্লাক হোলের লিডার করিম তাজওয়ারের নিজের কাছে নিয়ে নেয় পেনড্রাইভটা। আর সে থাকতো চট্টগ্রাম। সুতরাং পেনড্রাইভ উদ্ধারে আমাদের চট্টগ্রাম যেতেই হতো। কারণ ঐ পেনড্রাইভের মধ্যে ছিল আমাদের কয়েক কোটি টাকার ভবিষ্যৎ।’
‘ প্লানটা কী ছিল?’ কৌতূহলী কন্ঠে জানতে চাইল জাফর।
রুদ্র এবার সরাসরি রাশেদ আমেরের দিকে তাকাল। বলল, ‘ওরা জানতো যে পেনড্রাইভটা নিতে আমরা যাব। আর আমার যাওয়ার সম্ভাবনা নাইনটি নাইন পার্সেন্ট এর চেয়েও বেশি। আমি একা যাচ্ছি সেটা ওরা জেনেছে আমি রওনা দেওয়ার পরেই। আশেপাশে লোক রাখাই ছিল। আর আমিও চাইছিলাম ওরা জানুক আমি একা যাচ্ছি। তাই খবরটা পৌঁছতে আমিও কোন বাঁধা দেইনি।’
রুদ্র থামল। চার-পাঁচ সেকেন্ডের নীরবতার পর রাশেদ প্রশ্ন করল, ‘ওদের ডেরায় পৌঁছলে কীকরে?’
রুদ্র চুপ মেরে গেল। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে একবার উচ্ছ্বাসের দিকে তাকাল। উচ্ছ্বাস ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে চোখে হাসছে। ব্যঙ্গাত্বক হাসি। যেন এই হাসি দিয়েই বলছে, নাও বাছাধন, এবার বলো কীভাবে পৌঁছেছো। ‘শালা হারামী’ মনে মনে উচ্ছ্বাসকে গালি দিয়ে রুদ্র তাকাল জাফরের দিকে। অর্থাৎ ‘কাকা’ এবার তুমিই বাঁচাও। রুদ্রর অবস্থা বুঝতে পেরে জাফর একটু গলা ঝেড়ে সোজা হয়ে বসল। রাশেদের উদ্দেশ্যে বলল, ‘ভাইজান, ওখানে পৌঁছলো কীকরে সেটা শুনে কী হবে? তারচেয়ে বরং ওখানে গিয়ে কী হল সেটাই বলুক।’
জাফরের কথাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে রাশেদ থমথমে গলায় বলল, ‘ কীভাবে পৌঁছলে রুদ্র?’
উপস্থিত সবাই হতাশ হল। না বলা অবধি যে রুদ্র নিস্তার পাবেনা সেটা সবাই বুঝেছে, রুদ্র নিজেও। রুদ্র হতাশ ভঙ্গিতে চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে দিল। মনে মনে কথাগুলো সাজিয়ে নিয়ে বলল, ‘ওখানে পৌঁছনোর কোন প্লান তৈরী ছিলোনা আমার। ওদের একশনের ওপর ছেড়ে দিয়েছিলাম আমি। অন দ্য স্পট প্লান বানানো ছাড়া আর কোন উপায় ছিলোনা। হোটেলে ওঠার পরেই বুঝতে পারছিলাম কয়েকজন আমাকে ফলো করছে। একটু খেয়াল করেই বুঝেছিলাম কে কে নজর রাখছে আমার ওপর। রাতের বেলা যখন বারে গিয়ে পৌঁছলাম তখনও ওদের দেখেছি। আর ওদেরই দুজনকে একটা মেয়ের সাথে কথা বলতে দেখে এসছিলাম বাইরে। কিন্তু ঐসময় ওরা খেয়াল করেনি যে আমি দেখছিলাম। আমার ধারণা ছিল ঐ মেয়েটা আমার কাছে আসবে। বারের টেবিলে বসে আমি ওর জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম। আমার সেই সন্দেহ বিশ্বাসে পরিণত হয় যখন মেয়েটা সত্যিই আমার কাছে আসে। তারপর_’
রুদ্র আবার থামল। উচ্ছ্বাস টিটকারি মেরে বলল, ‘তারপর?’
রুদ্র দাঁতে দাঁত চেপে তাকাল উচ্ছ্বাসের দিকে। উচ্ছ্বাস দুই হাত একত্রিত করে থুতনির নিচে রেখে ভ্রু নাচালো। উচ্ছ্বাসের উদ্দেশ্যে মনে মনে অকথ্য ভাষায় কয়েকটা গালি ছাড়ল রুদ্র। শালা মজা নিচ্ছে! এ ঘর থেকে বের হয়ে বোঝাবে তারপর কী হয়েছিল। রুদ্র ইতস্তত করে রাশেদকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই রাশেদ বলল, ‘বুঝেছি, আর বলতে হবেনা। আমার সব কথা মানলেও কিছু কিছু কথা মানার অভ্যেস তোমার একেবারেই নেই। যাই হোক, ওখানে একদিন থেকে গেল কেন হঠাৎ? কাজ তো শেষ হয়ে গিয়েছিল।’
রাশেদকে মিথ্যা বলার অভ্যেস নেই রুদ্রর। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে সত্যিটাও বলতে পারবেনা। তাই কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে এক অর্ধসত্যি বলল, ‘অন্য এক গ্রুপ হঠাৎই অ্যাটাক করেছিল বাবা।’
কথাটা মিথ্যা নয়। কিন্তু পুরোপুরি সত্যিও নয়। রাশেদ কোন প্রশ্ন করল না। কেউ অবাকও হলোনা। কারণ এরকম দু একটা অ্যাটাক মাঝেমাঝে হয়েই থাকে। এসব ওদের জন্যে স্বাভাবিক ঘটনা। পাল্টা কোন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে না হওয়ায় রুদ্র স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এবার ইকবাল বলল, ‘রাশেদ বাবা, পেনড্রাইভটা যখন হাতে চলে এসছে আমাদের কাজ শুরু করে দেওয়া উচিত। যদি ব্লাক হোল_’
রুদ্র বাধা দিয়ে বলল, ‘ব্লাক হোল আপাতত বিশেষ কিছু করতে পারবেনা ইকবাল ভাই। কয়েক কোটি লোকসান হয়ে গেছে ওদের। সেটা কভার আপ করতে যথেষ্ট সময় লাগবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ডার্ক নাইট। গতকাল ওরাই কিডন্যাপ করতে চেয়েছিল আমাকে। আর আমার খটকা এখানেই লাগছে।’
‘ কেমন?’ উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর জাফরের।
‘ পেনড্রাইভটা ব্লাকহোলের কাছে চট্টগ্রামে আছে, ওখান থেকে সেটা উদ্ধার করতে আমিও ওখানে গিয়েছি সেটা ডার্ক নাইট কীকরে জানল? এগুলো তো সব টপ সিক্রেট।’
জাফর খানিকটা ভেবে বলল, ‘ তার মানে তো এটাই দাঁড়াচ্ছে যে ডার্ক নাইটও আমাদের ওপর নজর রাখছে। হয় সেটা দূর থেকে নয়তো আমাদের দলের মধ্যেই।’
ইকবাল আপত্তি জানিয়ে বলল, ‘আমার মনে হয়না দলের মধ্যে কেউ। কারণ দলের মধ্যকার কারো সাথেই আমরা এই ব্যপারে আলোচনা করিনা। এই বিষয়ে যতটুকু আলোচনা হতো সবটাই এই বৈঠক ঘরে হতো। আর এখানে আসার অনুমতি সবার নেই। আর আমাদের মধ্যকার কেউ নিশ্চয়ই এরকম কাজ করবেনা।’
কয়েক সেকেন্ডের নিরবতা চলল পুরো ঘরটায়। জাফর এবার জিজ্ঞেস করল, ‘শরীর কেমন আছে তোর? হাতে গুলি লেগেছে দেখছি। আর কোথাও লেগেছে নাকি? সব ঠিক আছে?’
‘ একদম ফিট আছি।’ মৃদু হেসে বলল রুদ্র।
আরও কিছুক্ষণ আলোচনা চলল এরপরের গতিবিধি আর কাজকর্ম নিয়ে। রুদ্র কীভাবে পেনড্রাইভটা নিয়ে বেরিয়ে এলো সে কথাও খুলে বলল। সকলেই প্রশংসা করল রুদ্রর উপস্থিত বুদ্ধি আর সাহসের। একমাত্র রাশেদ আমেরই চুপ রইলেন, ভালোমন্দ কিছুই বললেন না। আলোচনা শেষে সবাই বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। রুদ্র উঠে চলে যেতে নিলেই রাশেদ ডেকে উঠল। রুদ্র ঘুরে দাঁড়াতেই রাশেদ কন্ঠস্বর গম্ভীর রেখেই বলল, ‘ডাক্তার দেখিয়েছিলে?’
‘ হ্যাঁ বাবা।’ মৃদু আওয়াজে বলল রুদ্র।
‘ ঔষধ ঠিকভাবে খেও। আর ড্রেসিং করো টাইমলি।’
রুদ্র মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিল। রাশেদ আবার বলল, ‘সামনে অনেক কাজ আছে। এমন সময় শরীরে কোথাও ইনফেকশন বাঁধিয়ে বসলে সমস্যা, সে কারণেই বলছি।’
জাফর আর ইকবাল একে ওপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল কিন্তু তাদের মনোভাব মুখ দেখে বোঝা গেল না। উচ্ছ্বাস হালকা গলা ঝেড়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। রুদ্র আগের মতোই মৃদু গলায় বলল, ‘বুঝেছি বাবা।’
*
বৈঠক ঘর থেকে বেরিয়ে রুদ্র সোজা ছাদে চলে গেল। গিয়ে দেখে উচ্ছ্বাস রেলিং এ পা ঝুলিয়ে বসে আছে। রুদ্রকে দেখে উচ্ছ্বাস চমৎকারভাবে হাসল। রুদ্র বুকের ওপর হাত ভাঁজ করে ছাদের দরজার সাথে হেলান দিয়ে চোখ ছোট ছোট করে তাকাল উচ্ছ্বাসের দিকে। উচ্ছ্বাস ভ্রু নাচিয়ে বলল, ‘তারপর কী করেছিলে বললে না, বস?’
‘শালা’ রুদ্র দাঁত নিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে টি-শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে এগিয়ে গেল উচ্ছ্বাসের দিকে। উচ্ছ্বাস কিছু বুঝে ওঠার আগেই রুদ্রর বলিষ্ঠ হাতে ধাক্কা পড়ল ওর বুকে। ধাক্কার ফলে ছাদ থেকে পরে যেতে নিলেই রুদ্র ধরে ফেলল ওর হাত। উচ্ছ্বাসের শরীরের অর্ধেকর বেশি অংশ এখন ছাদের বাইরে। রুদ্র এক হাতে ধরে রেখেছে ওকে। হাত ছাড়লেই সোজা নিচে পড়ে যাবে। উচ্ছ্বাস হকচকিয়ে তাকাল রুদ্রর দিকে। রুদ্র মেকি হাসি দিয়ে বলল, ‘কী ব্যপার বৎস, তারপর কী হল শুনবেনা?’
উচ্ছ্বাস প্রায় তোতলাতে তোতলাতে বলল, ‘ তারপর! তারপর কী হয়েছিল সেটা জেনে আমার কী হবে? আমি ওসব বাজে জিনিসের খবর রাখিনা। আমি ভদ্র ছেলে।’
‘ তাই না? চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে তো খুব মজা লুটছিলে। আর এখন ভদ্র? শালা!’
অশ্রাব্য ভাষায় আরও দুটো গালি ছাড়ল রুদ্র। উচ্ছ্বাস ঘাড় ঘুরিয়ে একবার নিচের দিকে তাকিয়ে তারপর রুদ্রর দিকে তাকাল। বলল, ‘দেখ ভাই, নাজিফা আজ সকালেই নাম্বারটা দিয়েছে। প্রেমটা এখনো শুরু হয়নি। এভাবে শেষ করে দিবি?’
রুদ্র অলস ভঙ্গিতে বলল, ‘ চিন্তা নেই। ডুপ্লেক্স বাড়ির ছাদ থেকে পড়ে সাধারণত কেউ মরেনা। তোর বেলায় সে নিয়ম বদলাবে না। তবে কপাল খারাপ থাকলে হোচট খেয়েও মানুষ পটল তোলে। চল, আজ তোর কপাল পরীক্ষা করে দেখি।’
‘ রাখ তোর কপাল। ওটা জন্ম থেকেই পোড়া। ওটা কথা না। কথা হল, এখান থেকে পড়লে মরার চান্স তেমন নেই জানি। কিন্তু হাত-পা তো ভাঙবে। এই জন্যেই টেনশন বেশি। তুই আমাকে খু’ন করতে পারবিনা সে ব্যপারে আমি নিশ্চিত। কিন্তু হাত-পা ভাঙতেই পারিস। এ ব্যপারে তোকে বিশ্বাস করা যায় না।’
রুদ্র ডান পাশের ভ্রুটা উঁচু করে বলল, ‘এতো কনফিডেন্স? আমি তোকে খু’ ন করব না? এরকম কোন গ্যারান্টি তো আমি নিজেও দিতে পারছিনা।’
‘ আমি পারছি। লোকে যতই তোকে আয়রন হার্ট বলুক। ঐ হার্ট বাস্তবে কতটা আয়রনের সেটা আমার চেয়ে ভালো কে জানে?’
রুদ্র কিছু না বলে টেনে উঠিয়ে আনলো উচ্ছ্বাসকে। পিঠে চটাস করে এক চাপড় বসিয়ে দিয়ে বলল, ‘গাধা!’
উচ্ছ্বাস হাসল। রুদ্র উল্টো ঘুরে রেলিং এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট বের করল। ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই ভয়ানক সিগারেটের তেষ্টা পেয়েছিল। রুদ্রর থেকে এক হাত গ্যাপে দাঁড়িয়ে উচ্ছ্বাসও একটা সিগারেট মুখে নিয়ে বলল, ‘নাজিফা আজ নাম্বার দিয়েছে।’
রুদ্র খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ তো এবার কী প্রেম করবি না-কি?’
উচ্ছ্বাস চুপ থাকল কয়েক সেকেন্ড। তাচ্ছিল্যের এক হাসি হেসে বলল, ‘আমাদের আবার প্রেম। প্রেম করতে হলে গ্রুপ ছাড়তে হবে। আর গ্রুপ ছাড়া মানেই রাশেদ বাবাকে ছেড়ে দেওয়া। বেঁচে থাকতে রাশেদ বাবাকে ছাড়তে পারব না। এমনিতে এসবতো মজা করে বলি। কিন্তু বাস্তবটা তুইও জানিস আর আমিও।’
‘বাবা কিন্তু বাঁধা দেবেনা।’ স্হির কন্ঠে বলল রুদ্র।
উচ্ছ্বাস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ‘আমি জানি। রাশেদ বাবা কোনদিন আমাকে আটকে রাখবে না। কিন্তু সমস্যা হলো আমি আমার রাশেদ বাবাকে ছাড়তে পারব না। তাই ওসব প্রেম-টেমের চিন্তা করছিনা আমি। ঐ একটু যোগাযোগ আর চোখের দেখাটুকু হলেই হবে।’
‘আর যদি নাজিফা তোর প্রেমে পড়ে যায়?’
উচ্ছ্বাস হেসে ফেলল। ব্যথিত কন্ঠে বলল, ‘ পড়বেনা। তুই বলেছিলে না আমাকে পছন্দ করার কোন কারণ নেই।’
মিথ্যে বলেছিলাম, কথাটা মনে মনে বলল রুদ্র। উচ্ছ্বাস বলে চলল, ‘তাছাড়া ওকে আমি তেমন কোন ইশারা, আশা বা প্রতিশ্রুতি দেই নি। আর না ভবিষ্যতে কখনও দেব। আমরা আজ আছি, কাল নেই। নিষ্পাপ প্রাণগুলোকে নিজেদের সঙ্গে জড়িয়ে কী লাভ?’ একটু হেসে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল, ‘ছাড় এসব। তুই একদিন থেকে গেলি কেন? রাশেদ বাবাকে পুরো সত্যি বলিস নি তুই। ঘটনা কী?’
রুদ্র খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। উচ্ছ্বাসের কথা শুনে ধ্যান ভাঙল। প্রিয়তার ঘটনাটা খুলে বলল উচ্ছ্বাসকে। সবটা শুনে উচ্ছ্বাস স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইল প্রায় আধ মিনিট। বিস্মিত কন্ঠে বলল, ‘ বাপরে! মেয়েটাকে সোজা এখানে নিয়ে এলি? কোন ঝামেলা হয়নি? ওর বাড়ির লোক বা_’
উচ্ছ্বাসকে থামিয়ে দিয়ে রুদ্র বলল, ‘কেউ নেই বলেই তো নিয়ে আসতে হলো। বাড়ির লোক থাকলেতো তাদের কাছেই রেখে আসতাম। ছোটবেলা থেকে অনাথ আশ্রমে ছিল। আর বড় হয়ে এক বান্ধবীর সাথে বাসা ভাড়া করে থাকছে।’
উচ্ছ্বাস বিজ্ঞের মতো মাথা ঝাঁকালো। কিছু একটা ভেবে হঠাৎ বলে উঠল, ‘একটা মেয়ের জন্যে এতোকিছু করলে গুরু? তোমাকেও আবার প্রেমরোগে ধরে বসেনি তো?’
রুদ্র ঠোঁট থেকে সিগারেট নামিয়ে হাসল। বলল, ‘এসব রোগ আমাদের জন্যে হারাম। লক্ষণ দেখা দিলেই ঔষধ খেয়ে নেওয়া জরুরি। একটু আগে নিজেই তো বললি।’
উচ্ছ্বাস ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলল। মনটা খারাপ হয়ে গেল হঠাৎ। মন খারাপ হয়ে গেছে রুদ্রেরও। উচ্ছ্বাসের মন খারাপের কারণটা স্পষ্ট হলেও রুদ্রর মন খারাপের কারণটা স্পষ্ট নয়। কনকনে শীতে, নিস্তব্ধ ছাদে নিকোটিনের বিষাক্ত ধোঁয়া টানতে টানতে দুই যুবক হয়তো নিজেদের বিষাক্ত জীবনের বিষাক্ততা মাপতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। জীবন তো নয় আস্ত এক সমুদ্র কালকূট।
*
রুদ্র বনানীর ফ্লাটে গিয়ে পৌঁছলো সকাল দশটায়। চাবি থাকায় আর বেল বাজাতে হলোনা ওকে। ভেতরে ঢুকে দেখল বসার ঘর ফাঁকা। ডাইনিং রুমেও কেউ নেই। তারমানে প্রিয়তা এখনো বেডরুমে আছে। খাবারের প্যাকেটগুলো ডাইনিং টেবিলে রেখে দিয়ে রুদ্র বেডরুমের দিকে গেল। প্রথমে হালকা করে উঁকি দিয়ে দেখল প্রিয়তা বেডরুমেও নেই। চমকে উঠল রুদ্র। কোথায় গেল মেয়েটা? কিছু হলোনা তো! রুদ্রর মনে হল জীবনে প্রথমবার ও ভয় পেয়েছে। তখনই ওর বারান্দার কথা মাথায় আসল। রুদ্র দ্রুতপদে এগিয়ে গেল ব্যালকনির দিকে। ব্যালকনিতে পা রাখতেই থেমে গেল রুদ্র। চঞ্চল তীক্ষ্ম চোখ দুটো স্হির হয়ে গেল। বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে প্রিয়তা। কোমর ছোঁয়া ভেজা চুল, পরনে বাদামি রঙের লম্বা কুর্তি। বোঝা যাচ্ছে কিছুক্ষণ আগেই গোসল করে বেরিয়েছে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে ইট পাথরের যান্ত্রিক শহরটাকে। স্নিগ্ধ পরীর মতো লাগছে একদম। ধীর পায়ে প্রিয়তার দিকে দু কদম এগিয়ে গিয়েও থেমে গেল রুদ্র। না, এই মেয়ের মায়ার জড়ানো যাবেনা। নিজেকে আটকাতে হবে। অনুভূতিতে লাগাম টানতে হবে। কিন্তু সেটা কী আদোও সম্ভব? রুদ্র একটা ঢোক গিলে নিজেকে সামলে নিল। গলার স্বর খানিকটা উঁচু করে বলল, ‘এখানে কী করছো?’
হঠাৎ এভাবে কেউ কথা বলে ওঠাতে প্রিয়তা চমকে উঠল। ভয় পেয়ে গেছে মেয়েটা। একমনে বাইরের দৃশ্যটা উপভোগ করছিল তাই আশেপাশে খেয়াল ছিলোনা। প্রিয়তা আতঙ্কিত দৃষ্টিতে চার পাঁচ সেকেন্ড রুদ্রর দিকে তাকিয়ে থেকে বুকে হাত দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মাথা নিচু করে বলল, ‘ভ-ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আস্তে ডাকলে কী হতো?’
রুদ্রর কানে পৌঁছালেও মস্তিষ্কে প্রিয়তার কথাগুলো পৌঁছালো না। প্রিয়তার আতঙ্কগ্রস্ত চোখের দৃষ্টিতে আরও একবার আহত হয়েছে এই পুরুষ। কিন্তু নিজেকে সামলাতেও বেশিক্ষণ সময় নিলোনা রুদ্র। গম্ভীর কন্ঠে আবার প্রশ্ন করল, ‘কী করছিলে এখানে?’
প্রিয়তা মিনমিনে গলায় বলল, ‘সময় কাটছিল না তাই এখানে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম বাইরেটা।’
‘ সকালে কিছু খেয়েছো? খিদে পায়নি?’
‘ কফি বানিয়েছিলাম, আর বিস্কুট।’
‘ ব্রেকফাস্ট এনেছি। এসে সার্ভ করো। খিদে পেয়েছে আমার।’
কথাটা বলে রুদ্র ভেতরে সোজা ডাইনিং রুমে চলে এলো। প্রিয়তাও এলো পেছন পেছন। রুদ্র একটা চেয়ার টেনে বসল টেবিলে। প্রিয়তা কোন কথা না বলে দুটো প্লেট নিয়ে এলো। স্যান্ডউইচ, চিকেন টোস্ট, জুসের প্যাকেট রাখা আছে। প্রিয়তা খাবারগুলো সার্ভ করে নিজের ওপরপাশে রুদ্রর মুখোমুখি একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল। রুদ্র ততক্ষণে খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। প্রিয়তার দিকে তাকাচ্ছেনা ও। কারণ মেয়েটার ওপর দৃষ্টি পড়লে তা ফিরিয়ে নেওয়া মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। প্রিয়তা হাতে একটা স্যান্ডউইচ নিয়ে ইতস্তত কন্ঠে বলল, ‘আমি ভেবেছিলাম আপনি আসবেন না।’
রুদ্র স্যান্ডউইচে কামড় বসিয়ে ভ্রু তুলে তাকিয়ে জানতে চাইল, ‘কেন?’
‘কালকে রাতে ফোন না করে শুধু একটা মেসেজ করে খোঁজ নিলেন তাই।’
রুদ্র জবাব দিলো না। রাতে উচ্ছ্বাস নাজিফাকে কল করার পর রুদ্রেরও কেন জানি ইচ্ছে করছিল প্রিয়তাকে ফোন করে খবর নিতে। কিন্তু ও তা করেনি। প্রিয়তার প্রতি নিজের দুর্বলতা আর বাড়াতে চায়না ও। যতটা সম্ভব মেয়েটাকে দূরেই রাখতে চায় রুদ্র নামক বিষ থেকে। এই বিষাক্ত জগৎ থেকে। তাই শুধু একটা মেসেজ পাঠিয়েছিল সব ঠিক আছে কি-না জানার জন্যে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? যেখানে প্রিয়তাকে দেখলেই রুদ্রর সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে সেখানে কতদিন এড়িয়ে চলতে পারবে এই অনুভূতিকে। কীকরে থামাবে নিজেকে? কিন্তু থামা তো প্রয়োজন। না হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। ভয়ানক সর্বনাশ!
#চলবে…
[ অন্নেএএএক ঘুম আসতেছে। তাই আর রি-চেইক দেইনি। সবাইকে শুভ রাত্রি ]