#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
৩৮.
পরশু বিয়ে হবে রুদ্র-প্রিয়তার। বিয়ের অনুষ্ঠান আমের ভিলায় হচ্ছেনা। আলাদা একটা বাড়ি ভাড়া করেছেন রাশেদ। ঝাঁকজমক করে সাজানো হচ্ছে বাড়িটা। অনুষ্ঠানের পুরো ব্যপারটায় সন্তুষ্ট নয় রুদ্র। ও চেয়েছিল ঘরোয়াভাবে বিয়েটা সেরে ফেলতে। লুকিয়ে আঘাত করার জন্যে ভীড় মোক্ষম জায়গা। ভালো সুযোগ। যেই সুযোগটা কাউকে দিতে চায়না ও। রাশেদকে নিজের আপত্তির কথা জানিয়েছিল রুদ্র। রাশেদ থমথমে গলায় জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমার একমাত্র ছেলের বিয়ে আমি কারো ভয়ে লুকিয়ে দেবনা। কাপুরুষদের মোকাবেলা করার ক্ষমতা আমার আছে। তোমারও থাকা উচিত।’
উত্তরে কিছু বলতে পারেনি রুদ্র। ও নিজেকে নিয়ে ভাবছেনা। কোনদিন ভাবেও নি। অন্ধকার জগতের ভয়ংকর খেলা এটা। সে খেলায় অভ্যস্ত এবং দক্ষ রুদ্র। কিন্তু প্রিয়তা? নির্দোষ মেয়েটার কোন ক্ষতি হয়ে গেলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেনা রুদ্র। যেখানে একপ্রকার জোর করে, নিজের প্রয়োজনে প্রিয়তাকে বিয়ে করছে ও।
সন্ধ্যায় বৈঠক বসল আমের ভিলায়। মাগরিবের আজানের ঠিক আধ ঘন্টা পরে। বৈঠকে আছে রাশেদ, রুদ্র, জাফর, ইকবাল, উচ্ছ্বাস। সবাই নিজেদের নির্ধারিত চেয়ারে বসে আছে। আজ বৈঠকঘরের পরিবেশ ভিন্ন। বরাবরের মতো সবার কপালে চিন্তার ছাপ নেই। চেহারায় গাম্ভীর্য নেই। মুক্ত, ঝরঝরে পরিবেশ। প্রথম কিছুক্ষণ অতিথি, ডেকোরেশন, খাবারের ব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হল। ইকবাল সব আয়োজনের হিসেব দিল রাশেদকে। রাশেদ কাগজগুলোয় চোখ বোলালেন। এরপর চোখ তুলে বললেন, ‘এবার আসল কাজের কথায় আসা যাক।’
সিগারেট ধরালেন রাশেদ। রুদ্রর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ অতিথি অনেক আসবে। ভীড় হবে অনেক। সুতরাং নিরাপত্তার ব্যবস্থাও কঠোর হওয়া প্রয়োজন। তোমার এ বিষয়ে কী মত?’
রুদ্র এতক্ষণ চুপ ছিল। কারণ বিয়ের আয়োজনের কথাবার্তায় ও থাকতে চায়না। রাশেদ প্রশ্ন করায় এবার বলল, ‘এখানে মতামতের কিছুই নেই। বর্তমান পরিস্থিতিতে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতেই হবে। কোন বিকল্প নেই।’
ইকবাল বলল, ‘ কিন্তু গুলশানে ঢুকে আঘাত করার মতো সাহস কেউ করবে? নিরাপত্তা যে কঠোর হবে ঐটুকু ধারণা ওদের থাকবে না?’
ইকবালের যুক্তিকে খণ্ডন করে জাফর বলল, ‘ শত্রুকে দুর্বল ভাবাটা বোকামি। ওরা হয়তো আমাদের এমনই কোন এক বোকামির অপেক্ষায় থাকবে। হু নোজ্? সাবধানের মার নেই।’
রুদ্র সোজা রাশেদের দিকে তাকাল। গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘নিরাপত্তা প্রয়োজন। এ বিষয়ে তর্কের কোন অবকাশই নেই। আলোচ্য বিষয় এটাই কীভাবে আর কতটা।’
মাথা ঝাঁকালেন রাশেদ। গালভর্তি ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ‘যেহেতু আমি একজন ব্যবসায়ী। আমার প্রাণের পেছনে অনেকেই পড়ে আছে। ব্যবসায়ীক দ্বন্দ্ব, ব্যক্তিগত আক্রোশ ইত্যাদি ইত্যাদি। সেক্ষেত্রে আইনি নিরাপত্তা পাওয়া আমার অধিকার। কমিশনারের সঙ্গে কথা বলছি আমি। উনিই ব্যবস্থা করবেন।’
রুদ্র কিছুটা চিন্তা করে বলল, ‘ কমিশনারের দেওয়া নিরাপত্তা যথেষ্ট হবেনা। উনি অসাধু ব্যবসায়ীদের ক্ষমতার দৌড় জানেন। ততটুকুই নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু ভয়ানক কিছু আন্ডারওয়ার্ল্ডের দলের ক্ষমতা এবং তৎপরতা তারচেয়েও কয়েকগুন বেশি। তার ওপর দায়িত্ব দিয়ে শতভাগ নিশ্চিন্ত হওয়া যাবেনা। আমাদের নিজস্ব লোকদের কাজে লাগাতে হবে।’
জাফর ব্যস্ত কন্ঠে বলল, ‘কীভাবে? বিয়েটা খোলা জায়গায়, ওপেনলি হচ্ছে। সেখানে আমাদের ইলিগাল অস্ত্রগুলো দিয়ে কোনরকম নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব হবেনা। জবাবদিহি করতে হবে। আমাদের হাতে গোনা কয়েকজন লোক ছাড়া বাকি কারো কাছেই পিস্তল রাখার লিগাল রাইট নেই।’
‘ পুলিশ প্রটেকশন তাদের মতো থাকবে। কিন্তু গোটা বাংলো জুড়ে আমাদের লোক থাকবে। খাবার সার্ভ করার লোক থেকে শুরু করে দরজার কাছের প্রহরী, সবার কাছে সাইলেন্সার লাগানো পিস্তল থাকবে। লুকানো। শুধুমাত্র প্রয়োজন পড়লেই ব্যবহার করা হবে সেগুলো।’
থামল রুদ্র। কিছু একটা চিন্তা করে আবার বলল, ‘আর হ্যাঁ! ঐ বাংলোর আশেপাশের যতগুলো বিল্ডিং আছে। যেখান থেকে রাইফেল সাইটে রেখে টার্গেট করা সম্ভব। সে সকল বিল্ডিং এ আমাদের লোক থাকবে। সাইলেন্সার লাগানো পিস্তলসহ।’
ঘরের কেউ কোন কথা বলল না। সবাই তাকিয়ে আছে রাশেদের দিকে। রাশেদ একমনে সিগারেট টানছেন। ভাবছেন কিছু। হঠাৎই সোজা হয়ে বসে অ্যাশট্রেতে ছাই ঝেড়ে বললেন, ‘সবদিক দিয়ে ভেবে দেখলাম এটাই সবচেয়ে ভালো উপায়। এভাবেই প্লান করা হবে সব।’
এতক্ষণ খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা ভাবছিলো উচ্ছ্বাস। অন্য জগতে হারিয়ে গিয়েছিল যেন। হঠাৎই নিজেকে সামলে বলল, ‘ কিন্তু ব্যপারটা রিস্কি হবেনা? যদি পুলিশ কোনভাবে টের পেয়ে যায়?’
রুদ্র আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল, ‘ টের পাওয়ার তেমন সম্ভাবনা নেই। আর যদি পেয়েও যায়, আমি বুঝে নেব।’
সোজা হয়ে বসলেন রাশেদ। সিগারেট অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে বললেন, ‘তাহলে সে কথাই রইল। আমি কমিশনারের সঙ্গে কথা বলছি। তোমরা বাকিটা দেখ।’
মৌনতা দিয়েই সম্মতি জানালো সকলে। রুদ্র বলল, ‘তাহলে উঠব আমি?’
রাশেদ বললেন, ‘দাঁড়াও। তোমার সিদ্ধান্তে তুমি অটল? কোন ফাংশন করতে চাইছো না?’
রুদ্র স্পষ্ট গলায় বলল, ‘ না বাবা। তবে প্রিয়তার জন্যে সবরকম ফাংশনই করা হবে। যা যা হয় আরকি।’
রাশেদ কিছু বললেন না। এসবে মাথাব্যথা নেই তার। জাফর আর ইকবাল কিছু বলতে নিয়েও বললেন না। সবাই মিলে অনেকবার বুঝিয়েছে রুদ্রকে। কোন লাভ হয়নি। ওর একটাই কথা, এসব আমার দ্বারা হবে না। অর্থাৎ হবেনা।
*
রুদ্রর ঘুমটা আজ একটু বেলা করে ভাঙল। বেশ ভালো ঘুম হয়েছে আজ তার। লম্বা সময় শাওয়ার নিল। একদম হালকা করে ফেলল নিজেকে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে উচ্ছ্বাস, জ্যোতি আর রঞ্জুকে দেখল। ওর বিছানায় একগাদা জিনিস বিছিয়ে রেখেছে। নেড়েচেড়ে কীসব করছে তিনজন। ভ্রু কুঁচকে গেল রুদ্রর। চুল মুছতে মুছতে এগিয়ে এসে বলল, ‘এগুলো কী?’
জ্যোতি উত্তর দিলোনা। নিজের মতো দেখছে জিনিসগুলো। উচ্ছ্বাস শেরওয়ানিটা হাতে নিল। এগিয়ে গিয়ে রুদ্রর সামনে ধরে দেখে বলল, ‘পার্ফেক্ট আছে।’
রুদ্র হাত দিয়ে সরিয়ে দিল ওটা। পাশ কাটিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। চুল ঝাড়তে ঝাড়তে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সাইজ অনুযায়ী-ই অর্ডার করা হয়েছে।’
‘ তবুও দেখে নিতে সমস্যা কোথায়?’
রুদ্র জবাব দিলোনা। তোয়ালে রেখে শার্ট পরতে পরতে জ্যোতিকে বলল, ‘ব্রেকফাস্টটা রুমে নিয়ে আয়। নিচে যাব না এখন আর।’
জ্যোতি এবারেও কোন উত্তর দিলোনা। নিরুৎসুক ভঙ্গিতে চুপচাপ বেরিয়ে গেল। উচ্ছ্বাস রুদ্রর দিকে তাকাল। একটু ভেবে কোনরকম ইতস্তত করে বলল, ‘বেশি কিছু না। জাস্ট হলুদের অনুষ্ঠানটা..’
নিজের বাক্য শেষ করতে পারল না উচ্ছ্বাস। রুদ্র এমনভাবে তাকাল যে আপনাআপনি চুপ হয়ে গেল। মেকি হেসে বলল, ‘এমনিই বলছিলাম আরকি। তোর বিয়ে, তোর ইচ্ছে। আমার কী?’
‘ বিছানা থেকে এগুলো সরিয়ে ভাগ। আমার দেখার কিছু নেই।’ বিরক্ত হয়ে বলল রুদ্র। বিয়েই তো করবে। এতো বাড়তি ঝামেলা করার কী আছে!
উচ্ছ্বাস বলল, ‘প্রিয়তার জিনিসগুলোও সরিয়ে রাখব? এখান থেকেই শাড়ি, গহনা কসমেটিকস্ সব বাছাই করে বিকেলে পাঠানোর কথা। রাশেদ বাবা তোকে দিয়েই সিলেক্ট করতে বলেছিল। কিন্তু তোর যখন বিরক্ত লাগছে তখন_। রঞ্জু সরিয়ে ফেলতো দ্রুত।’
রঞ্জু হকচকিয়ে গেল। কোনমতে ‘জ্বি ভাই’ বলে ব্যস্তহাতে জিনিসগুলো সরাতে গেল। রুদ্র গলা ঝেড়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘প্রিয়তার জিনিসগুলো রেখে বাকিগুলো সরিয়ে রাখ। ওগুলো থেকে আমি সিলেক্ট করে রাখছি।’
রুদ্রর কথা শুনে উচ্ছ্বাস ঠোঁট চেপে হাসল। রঞ্জুও মিটমিটিয়ে হাসছে। ধমকের ভয়ে জোরে হাসতে পারছে না। তাই কোনরকমে বাকি জিনিসগুলো তুলে কেটে পড়ল।
*
বিকেল চারটা বাজে। আধঘন্টা আগে বনানী থেকে বাংলোতে এসে পৌঁছেছে ওরা। মীরা মেহেদী পরিয়ে দিচ্ছে প্রিয়তার হাতে। জ্যোতি লাগেজে করে রুদ্রের দেওয়া জিনিসগুলো নিয়ে এসেছে। কুহু নেড়েচেড়ে দেখছে সেগুলো। জ্যোতি প্রিয়তাকে বলল, ‘কী ব্যপার প্রিয়তা? তোমার বর কী কী পাঠালো দেখবেনা?’
প্রিয়তা হাতের মেহেদী দেখতে দেখতেই লাজুক হেসে বলল, ‘পরার সময়তো দেখতে পাবো আপু। এখন তোমরা দেখো।’
কুহু মলিন মুখ করে ইশারায় কিছু বলল। প্রিয়তা হেসে ফেলল। খালি হাতটা কুহুর গালে রেখে জ্যোতিকে বলল, ‘আমার মিষ্টি ননদিনী গাল ফুলিয়ে কী বলছে?
জ্যোতিও এবার হেসে ফেলল। বিছানায় বসে বলল, ‘তোমার বর কোন রিচুয়ালই মানবেন না। সেইজন্যই মন খারাপ সবার। বড্ড ঘাড়বাঁকা সে।’
প্রিয়তা হতাশ হলো। সকাল থেকে তিনবার ফোন করে অনুরোধ করেছে রুদ্রকে। কিন্তু রুদ্র মানতে নারাজ। মনে মনে রাগও হচ্ছে। একটাদিনও নিজের ইগো ছাড়তে পারে না লোকটা! তবে প্রিয়তাও ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নয়। কিছু একটা ভেবে কুহুর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল প্রিয়তা। বলল, ‘আমার বিয়ের দিন আমার মিষ্টি ননদের মন খারাপ থাকবে? হতেই পারেনা।’
মীরা চোখ তুলে বলল, ‘ কী করবি?’
প্রিয়তা আয়েশ করে বসে বলল, ‘ ব্রহ্মাস্ত্র ছুড়বো।’
জ্যোতি, কুহু, মীরা কেউ কিছুই বুঝলো না। বোকার মতো তাকিয়ে রইল প্রিয়তার দিকে।
লাঞ্চ রুদ্র আর উচ্ছ্বাস একসঙ্গেই করেছে। রুদ্রর ঘরে। সারাদিনে আজ ঘর থেকে বের হয়নি রুদ্র। দরকার পড়েনি। উচ্ছ্বাস যদিও সারাদিন-ই ব্যস্ত ছিল আজ। বিকেলের দিকে করিডরের জয়েন্ট ব্যালকনিতে গিয়ে বসল রুদ্র। সঙ্গে উচ্ছ্বাসও এলো। বাড়ির গমগমে পরিবেশে এটাই নিরিবিলি জায়গা। রেলিং এ বসে সিগারেট ধরালো রুদ্র। গম্ভীরভাবে কিছু একটা ভাবছে। উচ্ছ্বাসও একটা সিগারেট জ্বালিয়ে বলল, ‘কাল তোর বিয়ে। আজকেও মুখটা বাংলার পাঁচ না করে রাখলে হচ্ছেনা?’
রুদ্র ঠোঁটের মাঝে জ্বলন্ত সিগারেট চেপে রেখেই বলল, ‘প্রিয়তারা ওখানে পৌঁছাবে কখন?’
‘পৌঁছে গেছে। কেন?’
‘ তুই কখন যাচ্ছিস?’
‘ আটটার দিকে। চিন্তা করিস না। আজকে থেকেই গার্ড দেওয়া হচ্ছে। এতক্ষণে সবাই যার যার পজিশন নিয়ে নিয়েছে। আমি চেক করে এসেছি। ইকবাল ভাই আছেন ওখানে।’
রুদ্র কিছু বলতে যাচ্ছিল। তখনই ওর ফোন বেজে উঠল। প্রিয়তার কল। রুদ্র জানে ও কেন কল করেছে। এই নিয়ে চারবার। অযথাই চেষ্টা করছে মেয়েটা। লম্বা একটা শ্বাস ফেলে কল রিসিভ করে বলল, ‘ হ্যাঁ বলো। কোন সমস্যা হয়েছে?’
ওপাশ থেকে ঝাঁঝালো গলায় প্রিয়তা বলল, ‘আপনিই নিজেই তো আস্ত একটা সমস্যা। এই সত্যি করে বলুন তো নিজের ইচ্ছেতে বিয়ে করছেন? নাকি বাবা আপনার মাথায় ব’ন্দু’ক ধরে করাচ্ছেন?’
রুদ্র বুঝতে পারল প্রিয়র রাগের কারণ। কিন্তু সেটাতে পাত্তা দিল না। নির্বিকারভাবে বলল, ‘দুটোই।’
প্রিয়তা অস্হির কন্ঠে বলল, ‘মজা করছিনা আমি।’
রুদ্র গম্ভীর গলায় বলল, ‘প্রিয়, সকাল থেকে একই কথা বলে যাচ্ছো। বারবার এক কথা বলতে ভালো লাগেনা আমার। কাল রেডি হয়ে যাচ্ছিতো। কিন্তু বারবার এভাবে সং সেজে বসে থাকতে পারব না আমি। জেদ করোনা।’
‘ অদ্ভুত! বিয়ে কী রোজ রোজ করব নাকি? আমার শখ আহ্লাদ থাকতে নেই?’
‘ তোমাকে তো কিছুতে বাঁধা দিচ্ছিনা আমি। তুমি যা যা করতে চাও সব করা হবে। করা হচ্ছেও। কিছু বাদ গিয়ে থাকলে বলো। আমি ব্যবস্থা করছি। কিন্তু আমি এসবে নেই।’
‘ কিন্তু..’
‘ জেদ করোনা, প্রিয়তা।’ অনেকটা ধমকের মতো শোনালো রুদ্রর গলা।
প্রিয়তার অভিমান হলো। অসহায় মুখ করে তাকাল ওর কানে ফোন ধরে রাখা মীরার দিকে। কুহু আর জ্যোতি হতাশ হল। বুঝল চিড়ে ভিজবে না। প্রিয়তা কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, ‘বেশ বুঝেছি, কিছু পেয়ে গেলে তার মূল্য থাকেনা। যে লোক বিয়ের আগের দিনই আমার ছোট্ট একটা ইচ্ছের মূল্য দেয়না, বিয়ের পর যখন পুরোনো হয়ে যাব তখন কী করবে বোঝা হয়ে গেছে আমার। কিচ্ছু করতে হবেনা আপনাকে। আমিও করবোনা।’
‘ এসব কেমন বাচ্চামো কথা? আমি..হ্যালো? প্রিয়? প্রিয়?’
সাড়া পেলোনা রুদ্র। প্রিয়তা কল কেটে দিয়েছে। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে নামিয়ে রাখল ফোনটা। উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে দেখল, মিটমিটিয়ে হাসছে সে। রুদ্র বিরক্ত হয়ে বলল, ‘এতো হাসার মতো কিছুই হয়নি। বিদেয় হ।’
উচ্ছ্বাস উঠে দাঁড়াল। সকৌতুকে বলল, ‘ যত বিশাল সিংহই হও বাছা। বউয়ের সামনে বেড়াল হয়েই থাকতে হবে। গোটা দেশ শাসন করে রাজা। কিন্তু রাজাকে শাসন করে রাণী। ইতিহাস, বর্তমান তাই বলে। ভবিষ্যতও একই কথা বলবে বলে আমার ধারণা। এ নিয়ম চিরন্তন। বিয়েটা হোক। সব ক্রমশ প্রকাশ্য। ‘
রুদ্র চোখ পাকিয়ে তাকাতেই উচ্ছ্বাস কেটে পড়ল। অনেক কথা বলে ফেলেছে। এখন এর সামনে থাকা মানেই বিপদ। বারান্দা থেকে এক ধাক্কায় নিচে ফেলে দিলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
*
কিছুক্ষণ আগে গায়ে হলুদ হয়েছে রুদ্রের। হ্যাঁ, প্রিয়তার জেদের কাছে হার মেনেছে সে। আপন বলতে কেউ নেই প্রিয়তার। বিয়ে উপলক্ষ্যে হবু বরের কাছে এটুকু আবদার করতেই পারে। সবসময় জেদ চলেনা। বউয়ের জন্যে একটা দিন না হয় করল কম্প্রোমাইজ। এই বলেই নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছে সে।
তবে ব্যপারটাতে বিরক্ত হয়েছে ও। রুদ্র রাজি হয়েছে শুনে কুহু, জ্যোতি, মীরা এসেছিল হলুদ মাখাতে। উচ্ছ্বাস একটু ক্ষেপাতে চেয়েছিল। কিন্তু এইমুহূর্তে রুদ্রকে না ঘাটানোই ভালো মনে করল সে। রুদ্র ওদের স্পষ্ট বলে দিয়েছে, যা করার দশ মিনিটের মধ্যে করতে। রুদ্রকে যমের মতো ভয় পায় সবাই। তাই ওকে বিরক্ত করার সাহস করেনি কেউ। কোনরকমে স্টেজ সাজিয়ে অনুষ্ঠান শেষ করেছে। যদিও দশ মিনিটে কিছুই হয়নি। আধ ঘন্টা লেগে গেছে। রুদ্রর গায়ে হলুদ ছোঁয়াতে গিয়ে হাত কাঁপছিল কর্মচারীদের। এমনও দিন আসবে কোনদিন কল্পনাও করেনি তারা। ব্যপারটা সিংহের মাথায় হাত বুলিয়ে আসার মতোই ছিল। এমন অসাধ্য সাধনের জন্যে প্রিয়তার প্রশংসার গুঞ্জনে মুখরিত হল আমের ভিলা।
গালে, কপালে অসহ্যকর হলুদ নিয়ে বিরক্ত হয়ে রুমে যাওয়ার সময় করিডরে দেখা হল জ্যোতির সঙ্গে। ওকে দেখেই হাসল জ্যোতি। তাচ্ছিল্য মিশে ছিল সেই হাসিতে। হাসতে হাসতেই বলল, ‘ বাড়িতে বউ না আসতেই দেখি তার গোলাম হয়ে গেছো। এখনই আঙ্গুলের ইশারায় নাচাচ্ছে তোমাকে।’
রুদ্র জবাব দিলোনা। পাশ কাটিয়ে চলে গেল রুমে। মেয়েটা ইদানিং প্রায়ই খোঁচা দিয়ে কথা বলছে। ঠাট্টার ছলে। রুদ্র বুঝেও কিছু বলেনা। তাতেই সাহসটা আরও বেশি পাচ্ছে। জ্যোতির মানসিক অবস্থার কথা চিন্তা করে ছাড় দেয় রুদ্র। এড়িয়ে যায়। কিন্তু সবকিছুর- ই একটা সীমা আছে। সীমা পার হলে ছাড় দিতে পারবে কি-না জানেনা রুদ্র।
রুদ্রর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল জ্যোতি। এই ভালোবাসা, এই আনুগত্য, প্রশংসার গুঞ্জনতো শুধু ওর পাওনা ছিল। এটা ওর অধিকার। যা রুদ্র অন্যায়ভাবে অন্যকে দিয়ে দিচ্ছে। জ্যোতির এমনটাই ধারণা। চারপাশে প্রিয়তার এতো গুনগান শুনে অস্বস্তি হচ্ছে ওর। চেষ্টা করে স্হির রাখতে পারছেনা নিজেকে। কিন্তু এখন ওর স্হির থাকা ভীষণ প্রয়োজন। না চাইলেও সবটা মেনে নিতে হবে।
রুদ্রের গায়ে হলুদের কাজ শেষ করে, সবকিছু নিয়ে ভাড়া করা বাংলোতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আটটা বেজে গেল ওদের। প্রিয়তাকে সাজিয়ে, সব গোছগাছ করে রাত নয়টায় হলুদ শুরু করা হল। হলুদে বাহিরের কোন অতিথি নেই। কেবল আমের ভিলার সদস্য, সার্ভেন্ট আর কর্মচারী। তবে এলাহী আয়োজন। নাচ, গান, খাওয়াদাওয়া যতরকমের ব্যবস্থা করা যায় সব করা আছে। কোথাও কোন ত্রুটি নেই। হলুদে নাজিফাকে দেখে অবাক হল উচ্ছ্বাস। আজ ওর উপস্থিতি আশা করেনি। কাল আসার কথা ছিল। পরে জানতে পারল রাশেদ নিজেই ডেকেছেন ওকে আজ। সাহায্যের জন্যে।
অনুষ্ঠানের মাঝেই ওখানে উপস্থিত হলেন স্বয়ং রাশেদ আমের। ওনার উপস্থিতিতে হকচকিয়ে গেল সবাই। কেউ আশা করেনি এই মুহূর্তে তাকে। স্টেজে বসে থাকা প্রিয়তাও থমকে গেছে। রাশেদ বসলেন ওর পাশে। হলুদের বাটি থেকে হালকা হলুদ নিয়ে ওর গালে ছুঁইয়ে দিলেন। সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে আছে। একি দৃশ্য! প্রিয়তা দ্বিধান্বিত চোখে তাকাল রাশেদের দিকে। রাশেদ ওর মাথায় আলতো করে হাত রেখে বললেন, ‘তোমার বাবা-মা থাকলে এটা তারাই করতেন। মেয়ে বলেছি তোমাকে। তাই বাবার দায়িত্ব পালন করে গেলাম। তোমার উপহার কাল আমের ভিলায় প্রবেশের সময় পাবে।’
বলে চামচে খানিকটা মিষ্টি তুলে এগিয়ে দিল প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা মৃদু হাসল। চোখের কোণে হঠাৎই জল জমা হল। অনেক কষ্টে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে মুখে নিল মিষ্টিটা।
আরও একবার অবাক হলো আমের ভিলার সঙ্গে জড়িত সকল মানুষ। প্রিয়তার আগমনে আরেক পরিবর্তনের সাক্ষী হলো তারা।
রাশেদ বেশিক্ষণ থাকলেন না। চারপাশটা ঘুরে সব ঠিকঠাক আছে কিনা দেখলেন একবার। এরপর চলে এলেন।
পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিল উচ্ছ্বাস নাজিফা। এই দৃশ্য দেখে নাজিফা বলল, ‘ রাশেদ বাবার মতো শ্বশুর ভাগ্য করে পাওয়া যায়।’
হাসল উচ্ছ্বাস। বলল, ‘ সে ভাগ্য বউমণি দখল করে নিয়েছে।’
‘ আরেকজনও পাবে সেই সৌভাগ্য।’
উচ্ছ্বাস ভ্রু কোঁচকালো। বুঝতে না পেরে বলল, ‘কে?’
নাজিফা উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার বউ। উনি তোমাকে নিজের ছেলের মতোই দেখেন। আর তোমার বউকে প্রিয়তা ভাবির চেয়ে কম ভালোবাসবেন না উনি। সে হিসেবে তোমার বউও ভাগ্যবতী হবে।’
কথাটা বলে চোখ সরিয়ে ফেলল নাজিফা। উচ্ছ্বাস অপলক চোখে তাকিয়ে রইল ওর দিকে।
লোকদের কাজ বুঝিয়ে দিয়ে সন্তুষ্ট হয়নি রুদ্র। নিরাপত্তার ব্যবস্থা ঠিক ওর নির্দেশনা মতো করা হয়েছে কি-না নিজ চোখে না দেখে শান্তি পাবেনা ও। তাই রাত বারোটার দিকে নিজেই চলে এসেছে। পুরো এরিয়াটা নিজে হেঁটে হেঁটে সবটা দেখে তবেই সন্তুষ্ট হলো। সবার মুখে মুখে রাশেদের এখানে এসে প্রিয়তাকে হলুদ ছোঁয়ানোর কথাটাও শুনলো। আপন মনেই হাসল রুদ্র। প্রিয়তার কথা মনে পড়ল। এসেছে যখন একবার দেখা করে যাবে কি-না ভাবছে। তখনই ভয়ানক এক কাণ্ড ঘটল। হঠাৎই সব আলো নিভে গেল। পুরো বাংলোসহ এরিয়াটা অন্ধকার হয়ে গেল। সকলের চেঁচামেচি, গুঞ্জন কয়েকগুন বেড়ে গেল আকস্মিক ঘটনায়।
অজানা আশঙ্কায় হঠাৎ কেঁপে উঠল রুদ্রর বুক। বিপদের গন্ধ পাচ্ছে ও। অস্হির হয়ে ছুট লাগালো প্রিয়তার ঘরের উদ্দেশ্যে। অন্ধকারে দুবার হোঁচট খেয়ে পড়তে গিয়েও পড়ল না। প্রিয়তার ঘরের আগে কুহুর ঘর পড়ে। কী মনে করে আগে কুহুর ঘরেই উঁকি দিল রুদ্র। ফোনের টর্চ অন করে দেখল কুহু ঘুমোচ্ছে। স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলল সে। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল প্রিয়তার রুমের দিকে। দরজা ঠেলতেই খুলে গেল। রুদ্র খেয়াল করল ওর গলা শুকিয়ে গেছে। হাতের তালু ঘামে ভিজে উঠেছে। এরকম অনুভূতি ওর জন্যে একদম নতুন। টর্চ জ্বালানোর সাহস হচ্ছেনা ওর। ইতস্তত করে ডাকল, ‘ প্রিয়? প্রি_”
দ্বিতীয়বার ডাকার আগেই কেউ ঝাঁপিয়ে পড়ল রুদ্রর বুকে। রুদ্র চমকে উঠল। অসম্ভব কাঁপছে প্রিয়তা। রুদ্র দুহাতে প্রিয়তাকে আগলে নিয়ে বলল, ‘কী হয়েছে?’
‘ কেউ ছিলো ওখানে_’
আঙুল দিয়ে করিডরের দিকে দেখাল প্রিয়তা। রুদ্র একবার তাকাল করিডরে। দু সেকেন্ড চিন্তা করে প্রিয়তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘এইমাত্র ঐ পথ দিয়েই এসেছি আমি প্রিয়। কেউ ছিলোনা। রিল্যাক্স।’
‘ আমি দেখেছি।’
‘ অন্ধকারে ভুল দেখেছো হয়তো।’
লাইট জ্বলে উঠল। কিন্তু প্রিয়তা ছাড়ল না রুদ্রকে। রুদ্র নিজেই আস্তে করে ছাড়িয়ে নিল ওকে। ওর দু গালে হাত রাখল। যত্ন নিয়ে চোখের জল মুছে দিল। এখনো কাঁপছে মেয়েটা। রুদ্র শক্ত করে প্রিয়তার বাহু ধরে বলল, ‘ ভয় নেই। আমি আছিতো।’
এরমধ্যেই জ্যোতি আর মীরা একসঙ্গে ভেতরে এলো। রুদ্রকে দেখে দুজনেই চমকে উঠল। কয়েক সেকেন্ড বোকার মত তাকিয়ে থাকার পর মীরা হেসে দিয়ে বলল, ‘কী ব্যপার দুলাভাই! কাল থেকেতো সবসময় তোমার ঘরেই থাকবে। একটা রাত বউকে ছাড়া থাকা গেলোনা?’
মীরার রসিকতায় হাসি পেলোনা রুদ্রর। রেগে আছে ও। শক্ত কন্ঠে বলল, ‘ কোথায় ছিলে দুজন?’
রুদ্রর কন্ঠস্বর শুনে ঘাবড়ে গেল মীরা। নিজের চশমা ঠিক করে ইতস্তত করে বলল, ‘আমিতো স্টেজের ফুলগুলো সব গোছাচ্ছিলাম। করিডরে আসার সময় জ্যোতি আপুর সাথে দেখা হল।’
রুদ্র ধমকের সুরে বলল, ‘সবগুলোকে একসঙ্গেই কাজে যেতে হলো? মেয়েটাকে এখানে একা রেখে চলে গেলে!’
জ্যোতি ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘ আমাদের কী তোমার বউয়ের গার্ড হিসেবে অ্যাপোয়েন্ট করেছো নাকি?’
রুদ্রর ধৈর্য্যর বাধ ভেঙ্গে গেল। জ্যোতির দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘ আর একবার একটা ত্যাড়া কথা বললে আমি ভুলে যাব তুই কে। তুই ভালো করেই জানিস ওর সাথে কেউ একজন থাকা কেন প্রয়োজন।’
জ্যোতি কিছু না বলে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। মীরা মাথা নিচু করে বলল, ‘ আমি করিডরে আছি।’
মীরা বেরিয়ে যেতেই প্রিয়তা তাকাল রুদ্রর দিকে। এতক্ষণ নিজেকে সামলে নিয়েছে। দরজার দিকে একবার তাকিয়ে বলল, ‘ জ্যোতি আপুর সঙ্গে এভাবে কথা না বললে হতো না? আমিতো বাচ্চা না। অন্ধকারে উল্টাপাল্টা ভেবে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এতে ওদের কী দোষ?’
রুদ্র কঠোর গলায় বলল, ‘শুরুটা ও করেছে। আর আমার চিন্তার কারণটা তুমি বুঝবেনা, প্রিয়।’
রুদ্রের দিকে ভালোভাবে তাকাল প্রিয়তা। ঘামে সারা শরীর ভেজা। সাদা পাঞ্জাবীটা লেপটে আছে গায়ে। চোখে-মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। সাথে রেগেও আছে। প্রিয়তা রুদ্রর হাত ধরে নিজের দিকে ঘোরালো। নরম গলায় বলল, ‘আপনি থাকতে কেউ আমার কোন ক্ষতি করতে পারবেনা।’
রুদ্রের রাগ কমল। শান্ত চোখে তাকাল প্রিয়তার দিকে। এতক্ষণে লক্ষ্য করল প্রিয়তাকে আজ বেশ লাগছে। লাল পাড়ের হলুদ শাড়ি, খোলা চুল। চোখের জলে কাজল কিছুটা লেপ্টে গেলেও মন্দ লাগছে না। এই দুটো চোখের ওপর শুরু থেকেই মারাত্মক দুর্বল রুদ্র। রুদ্রর তাকানোতে লজ্জা পেল প্রিয়তা। মাথা নিচু করে বলল, ‘এখন যান। বাকি সবাই জেনে গেলে লজ্জায় পড়তে হবে। যা দেখেছে তাতেই সারারাত জ্বালিয়ে মারবে মীরা।’
রুদ্র প্রিয়তার দিকে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘আমার বউয়ের কাছে আমি এসেছি। লজ্জা কীসের?’
‘ এখনো বউ হইনি। কাল হব। যান প্লিজ।’
রুদ্র ঘড়ি দেখল। সত্যিই রাত হয়েছে অনেক। যাওয়ার সময় করিডর, আর বাড়ির আশপাশটা আরেকবার চেক করে নিতে হবে ওকে। প্রিয়তাকে কেউ ছিলোনা বলে সান্ত্বনা দিয়েছে। কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় ও নিজেও করিডরে কারো উপস্থিতি টের পেয়েছিল। কিছুতো একটা ঘটেছে। সেটা কী?
*
পরেরদিন দুপুরের পরেই প্রচন্ড ভীড় হলো সেই বাংলোয়। উৎসবের কোলাহলে কান পাতা দায় হয়েছে। অতিথি আসতে শুরু করেছে। খাওয়া-দাওয়া চলছে। রাশেদ আমের ভীষণ ব্যস্ত এখন। প্যান্ডেল টানানো আলাদা বিশেষ জায়গায় বসে আছেন। কিন্তু তবুও ভীষণ ব্যস্ত সে। অতিথিরা ওখানে গিয়েই আলাপ করছে তার সঙ্গে। এক মুহুর্তের জন্যেও ওঠার অবকাশ নেই তার। তার পাশে বসে আছেন জাফর। উচ্ছ্বাস আর ইকবাল খাবার, অতিথি আর পাহারার ব্যপারগুলো ভাগে ভাগে দেখছে। ব্যস্ত সকলেই।
এমনিতে স্বাভাবিক মনে হলেও মোটেও স্বাভাবিক বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছেনা এখানে। কমিশনার মোটামুটি একটা সিকিউরিটির ব্যবস্থা করেছেন। কয়েকজন পুলিশ আছে পাহারায়। কিন্তু রুদ্রর পরিকল্পনা মোতাবেক এখানে উপস্থিত ওর দেড়শ সশস্ত্র লোক আছে। প্রত্যেকেই লুকিয়ে রেখেছে নিজেদের পিস্তল। সতর্ক দৃষ্টি রাখছে চারপাশে। রাইফেল সাইটে রেখে টার্গেট করা সম্ভব, আশেপাশের এরকম সবকটা বিল্ডিং এ ওদের লোক দাঁড়িয়ে আছে। এতো কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার পরেও মানসিক শান্তি পাচ্ছেনা রুদ্র। মনের ভেতর খচখচ করছে কাল রাত থেকেই। তাইতো এক জায়গায় স্হির হয়ে বসেনি ও। হেঁটে হেঁটে নিজেও নজর বোলাচ্ছে চারপাশে। ওর পেছন পেছন দুজন লোক হাঁটছে। পাহারা দেওয়ার ভঙ্গিতে। রুদ্র বলেনি। নিজ তাগিদেই করছে ওরা।
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সামনে পড়ল ইন্সপেক্টর আজিজ। দাঁড়িয়ে পড়ল রুদ্র। আজিজও দাঁড়াল। দুজনেই কৃত্রিম হেসে হাত মেলালো। রুদ্র হাসিমুখে বলল, ‘খাওয়া শেষ? রান্না ভালো ছিল?’
মেকি হাসল ইন্সপেক্টর আজিজ। বলল, ‘ অসাধারণ ছিল। বোঝাই যাচ্ছিল তোমার বিয়ের ভোজ। ভরপেট খেয়েছি।’
‘ প্রশংসা করলেন নাকি নিন্দা? আমার সম্পর্কে খুব বেশি ভালো ধারণা নেই আপনার। অন্তত আমি তাই জানি।’
উত্তর দিলো না আজিজ। চারপাশে চোখ বুলিয়ে বলল, ‘ক্রিমিনালদের নিরাপত্তার ব্যবস্থাও আজকাল পুলিশকে করতে হচ্ছে। কলি যুগ! তাইনা?’
রুদ্র ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল, ‘এই গোটা নিরাপত্তা আমার স্ত্রীর জন্য। সে ক্রিমিনাল নয়।’
‘ কিন্তু তার বিপদের আশঙ্কা আছে কেন? তুমি ক্রিমিনাল বলে। তবে একটা কথা ভাবছি। পুলিশের এইটুকু নিরাপত্তা তোমার শত্রুদের ঠেকানোর জন্যে যথেষ্ট?’
রুদ্র আজিজের একদম কাছাকাছি দাঁড়াল। অনেকটা ফিসফিসিয়ে বলল, ‘যদি বলি আরও কঠিন নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে রেখেছি আমি, তাহলে? বিশ্বাস করবেন?’
মাথা ঝাঁকালো আজিজ। বলল, ‘ করে ফেললাম। না করার কিছু নেই। মানতে হবে। আইনি ভাবে কীকরে বেআইনি কাজ করা যায় সেটা তোমার কাছে শেখা উচিত।’
রুদ্র কৌতুকের স্বরে বলল, ‘ একটা কোচিং সেন্টার খুলব, স্যার? চলবে? মনে হয়?’
হেসে ফেলল আজিজ। গোঁফে আঙ্গুল বুলিয়ে বলল, ‘দৌঁড়াবে।’ একটু থেমে বললেন, ‘বাপ ছেলে দুজনেই একরকম। জিভের ডগায় উত্তর সাজানো থাকে।’
এরমধ্যেই ডাক পড়ল রুদ্রর। কাজি তৈরী আছেন। বিয়ে পড়ানো হবে। রুদ্র আজিজের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে গিয়েও বলল না। রাশেদের দ্বিতীয় ডাক শুনল। লম্বা কদমে এগিয়ে গেল প্যান্ডেলের দিকে।
বিয়ের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হল। কোনরকম বাধা আসেনি। কিংবা এতো কঠোর নিরাপত্তার কারণে আসতে পারেনি। বিয়ে পড়ানোর পর যখন রুদ্র আর প্রিয়তাকে একসঙ্গে বসানো হলো। প্রিয়তাকে বধুরূপে দেখে কয়েক সেকেন্ডের জন্যে থমকে গিয়েছিল রুদ্র। অপূর্ব লাগছিল মেয়েটাকে। তবে বেশিক্ষণ তাকায়নি। ওর একটা ব্যক্তিত্ব আছে। সকলের সামনে বউয়ের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকার মতো ব্যক্তিত্ব ওর নয়। শুধু সকলের অলক্ষ্যে প্রিয়তার কানে কানে বলেছিল, ‘ আজ চাঁদও লজ্জা পাবে।’
সব নিয়মকানুন, কাজকর্ম সাড়তে সাড়তে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। বাকি গোছগাছের দায়িত্ব কর্মচারীদের হাতে দিয়ে সবাই বেরিয়ে পড়ল আমের ভিলার উদ্দেশ্যে। পনেরো মিনিট পর আমের ভিলায় গাড়িগুলো পৌঁছালো। রুদ্র গাড়ি থেকে নেমে হাত বাড়িয়ে দিল নিজের স্ত্রীর দিকে। প্রিয়তার বুকের ভেতর টিপটিপ করছে। এতোদিন শুধু নাম শুনেছে। কিন্তু আজ আমের ভিলায় পা রাখবে ও। তাও বাড়ির একজন সদস্য হয়ে, বউ হয়ে। ইতস্তত করে রুদ্রর হাতে হাত রাখল। ওর হাতে মৃদু চাপ দিল রুদ্র। ধীরে ধীরে চোখ তুলে তাকাল প্রিয়তা। আজ সারাদিনে প্রথম তাকাল রুদ্রর দিকে। পুরোটা সময় চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে ছিল। রুদ্র এমনিতেই অসম্ভব সুন্দর। ঘিয়ে রঙের শেরওয়ানিতে একদম রাজপুত্র লাগছে ওকে। রুদ্রের চোখে চোখ পড়তেই চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করল প্রিয়তাকে। প্রিয়তা মুচকি হাসল। রুদ্রর হাত ধরে নেমে এলো গাড়ি থেকে।
রাশেদ আমের ইতিমধ্যে ভেতরে চলে গেছেন। সদর দরজার কাছে যেতেই রাশেদের দৃঢ় কন্ঠস্বরে থেমে গেল সবাই। রাশেদ সোজা এসে দাঁড়াল প্রিয়তার সামনে। প্রিয়তা মাথা নিচু করে আছে। রাশেদ গম্ভীর গলায় বললেন, ‘হাত দাও।’
একটু ইতস্তত করল প্রিয়তা। আস্তে করে বাড়িয়ে দিল নিজের হাত। পেছন থেকে হাত সামনে আনলেন রাশেদ। একটা বালা পরিয়ে দিলেন প্রিয়তার হাতে। প্রিয়তা অবাক হল। রাশেদ কন্ঠস্বর গম্ভীর রেখেই বললেন, ‘তোমার শাশুড়ির ছিল এটা। আজ থেকে তোমার। আমের ভিলার সৌভাগ্য হয়ে প্রবেশ করো।’
প্রিয়তা তাকিয়ে রইল রাশেদের দিকে। লোকটাকে যত দেখছে মুগ্ধ হচ্ছে ও। এমনও ব্যক্তিত্ব হয়! রাশেদ ইশারা করতেই রুদ্র আবার ধরল প্রিয়তার হাত। রুদ্রর হাত ধরেই আমের ভিলায় পা রাখল প্রিয়তা।
‘ আমের সাহেব।’
ইন্সপেক্টর আজিজের কন্ঠস্বরে থমকে গেল সকলে। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন উনি। সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, ‘ নতুন বউ সবে ঘরে ঢুকলো। এমন সময় ডিসটার্ব করার জন্যে দুঃখিত। কিন্তু কিছু করার ছিলোনা।’
রাশেদ আমের এগিয়ে এলেন। নির্বিকারভাবে বললেন, ‘ কী হয়েছে?’
‘ ঐ বাংলোতে একজন মহিলার লা’শ পাওয়া গেছে। লাশটা একটা ঘরের বাথরুমে পড়ে ছিল। আপনাদের একজন কর্মচারীই সবার আগে দেখেছে লা’শটা। লা’শ নিয়ে আসা হয়েছে। আপনারা কষ্ট করে একটু আইডেন্টিফাই করে দিন।’
এইসময় এরকম একটা সংবাদে বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সকলে। কয়েক সেকেন্ড কোন কথা বের হলোনা কারো মুখ থেকে।
#চলবে…
[ পর্বটা ৩৬০০+ শব্দের। রি-চেইক করিনি। সকলের রেসপন্স আর গঠনমূলক মন্তব্য করবেন। এই পর্বটা কয়েকবার এডিট করতে হয়েছে। বারবার কাটতে হয়েছে। সাজাতে সময় লেগেছে বলে দেরী হলো। পরের পর্ব তাড়াতাড়ি আসবে, ইনশাআল্লাহ।]