- অনুপ্রেরনার সেরা গল্প।
- সফলতা ও অনুপ্রেরণার গল্প।
- ব্যর্থদের সফলতার গল্প।
- একজন আত্মবিশ্বাসী মানুষের সফলতার গল্প।
১.অনুপ্রেরনার সেরা গল্প
আনিস ভাই আমার কাছে ব্যর্থ একজন মানুষ। যেই মানুষের বউ তাকে ছেড়ে তার বন্ধুর সঙ্গে চলে যায় তিনি ব্যর্থ না হওয়ার কোন কারণ নেই। উনার দুই সন্তানও তাদের মায়ের সঙ্গে আছে। জুয়েল ভাই সন্তানসহ ভাবীকে গ্রহণ করেছে এবং আমার জানামতে উনারা বেশ ভালো আছেন। জুয়েল ভাই ব্যবসায়ী হিসেবে বেশ প্রতিষ্ঠিত। অন্যদিকে আনিস ভাই আমার চোখে উড়নচণ্ডী মানুষ।
তিনি প্রায় মানুষের কাজে দৌড়াদৌড়ি করেন। একবার উনাকে দেখলাম মন খারাপ করে বসে আছেন। তখন ভাবী এবং বাচ্চারা উনার সঙ্গে থাকতেন। আমি উনাকে জিজ্ঞেস করলাম
কি ব্যাপার আনিস ভাই? আপনার মন খারাপ কেন?
ভাই জানেন আমার উপর তালায় একজনের ক্যান্সার। উনাকে দ্রুত উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নেয়া উচিত। দেশের ডাক্তাররা হাল ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু লোকটার বাঁচার বড় ইচ্ছে। আমার সঙ্গে দেখা হলেই বলে
আনিস আমার মনে হয় দেশের বাইরে গেলে আমি সুস্থ হয়ে যাবো।
টাকা পয়সা থাকলেতো পরিবারের সদস্যরা উনাকে দেশের বাইরে নিয়ে যেতেই পারে। আমি বললাম।
টাকা পয়সাতো আছে। দুই ছেলে কানাডাতে থাকে। আর মেয়ে থাকে দুবাইতে । কিন্তু সবচাইতে সমস্যা কি জানেন কারোই সময় নেই। সবাই বেশ ব্যস্ত। উনাকে দেখলে এত মন খারাপ হয়। মনে হয় আমি উনাকে দেশের বাইরে নিয়ে যাই। লোকটার মনের আশা পূরণ হউক।
আমি অবাক হয়ে দেখলাম আনিস ভাইয়ের চোখ ছলছল করছে। এর কিছুদিন পর দেখি উনি ইন্ডিয়া থেকে আমাকে ফোন দিয়েছেন।
ভাইজান চাচার জন্য খাস দিলে দোয়া করবেন। আজকে উনার একটা অপারেশন আছে।
আমি অবাক হয়ে বললাম
আনিস ভাই আপনার বাবাতো একমাত্র ছেলে জানতাম। চাচা আসলো কোথা থেকে?
আরে ভাই আমার উপর তালার সেই চাচা। উনাকে নিয়ে ইন্ডিয়াতে আসছি। অনেক কষ্টে অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি। চাকরি থাকে কিনা সন্দেহ। তবুও চাচার আশা পূর্ণ হউক।
সেই আনিস ভাই কয়েকদিন ধরে আমাকে নক করছে।
ভাই আপনার বাসা চেক করে দেখবেন। কোন পুরাতন শীত বস্ত্র আছে কিনা? এই দেশের কত মানুষ যে শীতে কষ্ট পাচ্ছে তার হিসেব নেই। কত বাচ্চা শিশু এই শীত বস্ত্রের অভাবে রাতের বেলায় ঠাণ্ডায় কাপতে কাপতে ঘুমাতে পারছে না। অথচ আমাদের ঘরের আলমিরাতে কত শীত বস্ত্র অবহেলায় পরে আছে।
আমি আনিস ভাই কথার সঙ্গে একমত হই। কিন্তু সেগুলো আর বের করা হয় না। একদিন তিনি নিজে এসে হাজির।
আমি কিঞ্চিত বিরক্ত হই। মানুষ এতো নাছোড়বান্দা হলে মুশকিল। উনি আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন
ভাই আপনি যখন নিজের হাতে আপনার একটা সুয়েটার শীতের রাত্রিতে কাঁপতে থাকা কোন মানুষকে দিবেন। সে যখন আপনার দিকে তাকিয়ে স্বর্গীয় হাসি দিবে তখন আপনার কাছে মনে হবে আপনি বুঝি বেঁচে আছেন এই মুহূর্তটির জন্য।
আমি তবুও আমার বিরক্ত গোপন করে আলমিরা থেকে আমার পুরাতন শীতবস্ত্র তাকে বের করে দিলাম।
আমার মনে মনে হাসি পায়। এই লোকটার কাণ্ড কারখানা দেখে। উনার বউ উনাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। ছেলেমেয়েরা উনার সঙ্গে নেই। লোকটার তেমন টাকা পয়সা নেই। আমি শুনেছি উনি যেই ডিপার্ট্ম্যান্টে কাজ করে সেটাতে টাকা বানানোর অনেক সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সততার কারণে উনার জীবনে প্রাচুর্যতা নেই। খুব সাধারণ জীবন উনার।
উনি আমাকে রীতিমত জোর করে শীতের রাত্রিতে বের করে নিয়ে এসেছেন। হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন যে শীত বস্ত্র সংগ্রহে আমার বাসায় চলে আসাতে আমি বিরক্ত হয়েছিলাম। এখন কোনভাবে সেই ঘটনাকে ব্যালেন্স করার চেষ্টা করছেন। ঢাকায় বেশ শীত পড়েছে। আমি শার্ট, ভেতরে গঞ্জি, তার উপর জাম্পার, এবং একটা জ্যাকেট দিয়ে ঠাণ্ডা থেকে বাঁচার চেষ্টা করছি। কানে কান টুপি। আমরা মালিবাগের রাস্তা দিয়ে হাটছি। এদিক সেদিক অনেক মানুষ, অনেক বাচ্চা ছেলে, মেয়েকে দেখতে পাচ্ছি যে শীতে কাঁপছে। কেউ কেউ আগুন ধরানোর চেষ্টা করছে। তাদের পড়নের পোশাক দেখে আমার নিজের কাছেই লজ্জাই লাগছে। মনে হচ্ছে এতদিন এদের দেইনি কেন। আনিস ভাই একটা ভ্যান গাড়ি ভাড়া করেছে। ভ্যান গাড়ি ভর্তি শীত বস্ত্র। যাকেই পাচ্ছেন তাকেই সুয়েটার, জ্যাকেট, শার্ট দিচ্ছেন।
সেইসব মানুষের হাসি দেখে, তাদের চোখের জল দেখে আমার সত্যি বেশ ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে ভালো খাওয়া, সুন্দর জায়গায় ঘুরা, এইসবের চাইতে বড় আত্মতৃপ্তি একজন মানুষকে যদি খুশী করা যায়। তার প্রয়োজনে যদি পাশে দাঁড়ানো যায়। কিছুক্ষণ পর দেখি একটা গাড়ি থেকে দুইজন ছেলেমেয়ে এবং একজন মহিলা নেমেছে। ছেলে মেয়ে গুলো অনেক শীতবস্ত্র নিয়ে এসে আনিস ভাইয়ের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। তারা প্রবল উৎসাহ নিয়ে বিতরণ করছে।
মহিলাটি আমার সঙ্গে হাঁটছে।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম
আপনারা কি কোন এন জি ও থেকে এসেছেন?
জি না আমি ওর স্ত্রী ছিলাম। এবং এই দুইজন ছেলে মেয়ে হচ্ছে আমাদের ছেলে মেয়ে।
আমার সঙ্গে আনিস ভাই এর অনেক দিনের পরিচয় থাকলেও উনি আমাকে কখনো বউ বাচ্চার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন নি। তাই আমার চেনার কথাও না। কিন্তু উনাদেরকে এখানে দেখে আমার অবাক লাগছে। আনিস ভাই কিছুক্ষণ পর পর বাচ্চা দুটোকে জড়িয়ে ধরছেন।
ভাবি ভালো আছেন?
মহিলাটি হেসে ফেললেন। ভাই আমি একসময় ভাবী ছিলাম কিন্তু এখন নেই। কিন্তু এখনো ও যেখানে কোন চ্যারিটি করতে যায় আমাদের জানায় আমরা ওর সঙ্গে যুক্ত হই। আমাদের ছেলে মেয়েরা ওর জন্য পাগল বলতে পারেন।
আমি বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছি।
ভাই সত্যি কথা কি জানেন আমার সন্তানেরা আনিসকে ভীষণ ভালোবাসে। তারা তাকেই তাদের রোল মডেল হিসেবে চিন্তা করে। আমার ছেলে, মেয়েরা আমার মতো লোভী হয়নি। আমার কাছেও আনিস খুব ভালো একজন মানুষ। বলতে পারেন আমি তার জীবনে নেই কিন্তু সে আমাদের জীবনে প্রবলভাবে আছে। তবে আমার ও উপায় ছিল না। ভালো একজন মানুষ হওয়া এবং একজন ভালো স্বামী হওয়ার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। সংসার জীবনের ভালো থাকা অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। সেখানে শুধু ভালোমানুষি দিয়ে চলে না।
আমি মাথা নাড়লাম।
আপনি কি উল্টা দিকে একজন মানুষকে দেখতে পাচ্ছেন। সিগারেট টানছে।
জি।
উনি আমার বর্তমান স্বামী জুয়েল। ও আমাকে সবকিছু দিয়েছে। প্রাচুর্যতা, আলিশান লাইফ, আমাদের বাচ্চাদের জন্য উন্নত পড়াশুনা, তাদের জন্য অভিজ্ঞ টিচার। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার কি জানেন। আমার বাচ্চারা সেসব সুবিধে প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা খুব সাধারণ জীবন যাপন করে আনিসের মতো।
তাদের স্কুলে এইম ইন লাইফ রচনায় তারা লিখেছে যে তারা তাদের জন্মদাতা পিতার মতো পরোপকারী হতে চায়। তারা আনিসের মতো হতে চায়। মাঝে মাঝে খুব দুঃখ পাই, কষ্ট পাই কিন্তু আবার কখনো আমার সন্তানদের নিয়ে খুব গর্বও হয়। ওরা আমার মত হয়নি। ভালো মানুষ হয়েছে। জানেন আজ তাদের আপনি যেই আনন্দ দেখতে পাচ্ছেন কিন্তু বাসায় তারা সারাক্ষন মনমরা হয়ে থাকে। আমি তাদের সবকিছু দিতে চেষ্টা করার পরেও তাদের আনন্দ দিতে পারিনি। জানেন জুয়েলের কোনদিন সন্তান হবে না। ও কিন্তু এদের নিজ সন্তানের মতো ভালোবাসে। জুয়েল আনিসকে খুব ঈর্ষা করতো তার জীবনের সবসময়। সে আমাকে নিয়ে আনিসকে পরাজিত করতে চেয়েছে। সে আমাকে ঠিকই পেয়েছে। কিন্তু আনিসকে পরাজিত করতে যেয়ে আমি এবং জুয়েল দুইজনই পরাজিত হয়ে বসে আছি।
আমি দেখতে পাচ্ছি চাঁদের আলোয় এক বাবা, তার সন্তানদের মানবতা শিখাচ্ছে। ভালোবাসা, মায়া ছড়িয়ে দিতে হয় তা শিখাচ্ছে। বাচ্চাগুলোর চোখ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। তাদের মুখে আনন্দের, উচ্ছ্বাসের হাসি।
আমি ভাবছি মানব জীবন কত অদ্ভুত হয়। মানুষের কত ধরনের প্রাপ্তি হয়। এই আপাদমস্তক অতি সাধারন মানুষটা আমার কাছে ব্যর্থ একজন মানুষ কিন্তু আজকে তাকে আমার চাইতেও সফল মানুষ মনে হচ্ছে।
#আনন্দের_ফেরিওয়ালা
#আমিনুলের_গল্প_সমগ্র
২. সফলতা ও অনুপ্রেরণার গল্প
-আচ্ছা,মানুষ কেন বিদেশে সেটেল্ড হয়, বল্ তো?
বড় আপার ছুড়ে দেয়া প্রশ্নে আমি আর মৌলি কিছু বলার আগেই জেবিনের মুখ গম্ভীর হয়ে গেলো।
গুনে গুনে সাড়ে আট বছর পর বোনেরা একসাথে হয়েছি। বড় মামা,মেঝ মামা ও ছোট মামার মেয়ে যাথাক্রমে- বড় আপা, জেবিন ও মৌলি। আমার মা,আমার এই তিন মামার একমাত্র বোন। আর আমি স্নেহা,মামাদের ভীষণ আদরের একমাত্র ভাগনী। জেবিন আর আমি সমবয়সী।
জেবিনের ছোট ভাই জাহিদ পড়াশোনা শেষ করে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে জব করছে। জাহিদ,জাহিদের বৌ খেয়া আর একমাত্র মেয়ে জারিন মেঝ মামা-মামীর সাথেই উনাদের মিরপুর কাজীপাড়ার বাড়িতে থাকে।
সেখানেই আজ একসাথে হয়েছি আমরা।
গল্প আড্ডা খাওয়া-দাওয়া ভালোই চলছিলো। মুরুব্বিরা পাশের রুমে বসেছেন। খেয়া আর জাহিদ উনাদের তদারকিতে ব্যস্ত। জেবিনের রুমে বসেছি আমরা চারজন। এরই মাঝে কথা উঠলো।
গম্ভীর মুখে জেবিন উত্তর দিলো –
-কেন বড় আপা? দেশের যা অবস্থা তাতে মানুষ সুযোগ পেলে বিদেশ যাবে না কেন? কোন সিকিউরিটি আছে?বাচ্চাদের কথা চিন্তা করেই তো এতো কষ্ট করে মানুষ বিদেশ থাকে। নয়তো এতো আরাম ছেড়ে ঐ কষ্টের জীবনে কেউ যেতো? দেশেই পায়ের উপর পা তুলে আরাম করে থাকতো সবাই।
-তোর কমপ্লেইনগুলো অবশ্যই ফেলে দেয়ার মতো নয়,জেবিন। কিন্তু, দেশে সবাই আরাম করে পায়ের উপর পা তুলে বসে খায় না। কষ্ট করেই খেতে হয়।
-কি কষ্ট তোমাদের শুনি? চাইলে কাজের মানুষ পাচ্ছো, ঘরে মুরুব্বিরা আছেন তোমাদের হেল্প করতে। আমাদের মতো একা একা তোমাদের সব সামলাতে হলে বুঝতে।
-সেজন্যই তো বললাম,বিদেশ সেটেল্ড হতে চাস কেন?দেশে যদি এতোই সুবিধা মনে হয়।
-বাচ্চা-কাচ্চার ভবিষ্যতের কথা ভেবে।
-আর মা-বাবা?
-সেটাই তো বলছি।কত কষ্ট হয়,তাদের কাছে পাই না। তোমাদের তো রাজকপাল! বাপ-মা কে কাছে পাও আবার সেই বাপ-মা তোমাদের বাচ্চাদেরও দেখে রাখেন। আর আমরা একা একা কষ্ট করি!! দেখ না জাহিদকে,রাজার হালে থাকে। আম্মু আব্বু জারিনকে দেখাশোনা করে,খেয়ার কত আরাম!!
-জেবিন,তুই শুধু তখন থেকে পাওয়ার হিসেব করে যাচ্ছিস। কখনও চিন্তা করে দেখেছিস যে, মেঝ চাচা-চাচীও তোকে মিস করে? মা-বাবার কাছ থেকে শুধু পাওয়ার কথা বলে যাচ্ছিস,একবার ভেবেছিস উনাদের জন্যও কিছু করার আছে? এই যে গত বছর মেঝ চাচা অসুস্থ হলেন- ডাক্তার দেখানো, টেস্ট, রিপোর্ট, চাচার এখনও নিয়ম করে চলা, চাচীর ডায়াবেটিসের ইনসুলিন নেয়া,কোমরের ব্যথার জন্য গরম পানির সেঁক দিতে হট ওয়াটার ব্যাগটা পর্যন্ত রেডি করে দেয় কে? ঐ জাহিদ আর খেয়া।
-আহ,আপা থাক এসব কথা..
আগ বাড়িয়ে বলতে গেলাম আমি। আমাকে থামিয়ে দিয়ে জেবিন বললো-
-কেন রে স্নেহা, বলুক না বড় আপা, আমি কি কখনও জাহিদ করে নাই এসব বলেছি নাকি? ও ছেলে- আমাদের সামাজিক ব্যবস্থায় ওর করাটাই স্বাভাবিক। আমিতো বলি এটা জাহিদের আরও সৌভাগ্য মা বাবার জন্য করতে পারাটা। করবে না-ই বা কেন, বাবা মা কি ওর জন্য কম করছে নাকি?
-জেবিন,তুই আবারও তুলনা দিচ্ছিস। মেঝ চাচা-চাচী তো তোর জন্যও কম করে নি। তুই বলতেই পারিস যে জাহিদ ছেলে,সে হিসেবে তোদের বাবা-মা ওর কাছে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। সেটা তাদের ইচ্ছা। কিন্তু এজন্য তুই জাহিদের দায়িত্বগুলোকে ছোট করে দেখতে পারিস না।
-ছোট করে দেখলাম কই?
-এই যে তুই এতো কথা বললি,জাহিদের কত আরাম,দেশে যারা থাকে তাদের কত আরাম! এই-সেই। তাদের কত দায়িত্ব সেটা জানিস? শুধু তো মা-বাবা না, তিনকুলের কত আত্মীয়-স্বজন আছে তাদের খোঁজ রাখা,দরকারে যতটা পারা যায় এগিয়ে যাওয়া। চাকুরি, নিজের পরিবার,ছেলেমেয়েদের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি কত দিকে নজর রাখতে হয়!
-কে কত দায়িত্ব পালন করে দেখেছি তো। আব্বুর অসুস্থতার সময় সেই তো জাহিদকেই একা দৌড়াতে হয়েছে! কোথায় ছিলে তোমরা তখন?
-আমার বাসায় তখন ননদের বিয়ের ডেট ফাইনাল করতে দুই পক্ষ মিলে বসেছিলো। বললাম না,সব দিক খেয়াল রাখতে হয়। আসতে পারি নি ঠিকই কিন্তু ফোনে সবসময়ই খোঁজ নিয়েছি। তুই নিজেও তো ফোনেই শুধু খোঁজ নিয়েছিস।
জেবিনের মুখ টকটকে লাল হয়ে গেলো।
-আচ্ছা,তোমাদের আর এসব বলে কি লাভ,বিদেশে থাকার কষ্ট বুঝবানা উল্টো এমন সব কথা বলবা যে মন খারাপ হবে শুধু।
– মন তো আমাদেরও খারাপ হয়,জেবিন। কাজের মানুষ পাওয়া যায়,এই এক অজুহাতে বাকি সব কাজ,দায়িত্ব, ব্যস্ততা কি তুচ্ছ করে দেখার মতো! কাজের মানুষ দিয়ে কি এগুলো হয়? এই শহরে এক কাজে বের হলে জ্যামে আটকে থাকতে হয় ঘন্টার পর ঘন্টা। নিরাপত্তার কথা তো তুই নিজেই বললি। এসবের ভীড়ে- ‘দেশে আছো, তোমাদের তো আরাম, বিদেশের লাইফ কষ্ট, এসব শুনতে ভালো লাগে??
– আপা, একা একা দিনের পর দিন কাছের মানুষদের মুখ না দেখে থাকলে বুঝতে। তোমরাও তো অনেক সময় বলো,বিদেশের লাইফে আর কি কষ্ট! অথচ, একটা কিছু খেতে মন চাইলে নিজেকে বানিয়ে খেতে হয়। অসুস্থ হলে একটু হাত বাড়ানোর কেউ নাই! দূরে থাকার কষ্ট তোমরা বুঝবে না,তোমাদের এসব বলে কোন লাভ নেই।
-এজন্য গত আট বছরে দেশে এসেছিস মাত্র একবার? যেমন বললি যে জাহিদ ছেলে,ও করবে না! তো, তোর হাজব্যান্ডও তো তার বাবা-মায়ের ছেলে। ছেলে হিসেবে তার দায়িত্ব পালন করতে হয় না?
-ওকে,ওকে। তোমাদের বিতর্কের এবার পরিসমাপ্তি ঘটাও। দুই দেশেই কষ্টও আছে,সুখও আছে। প্রাপ্তিও আছে, অপ্রাপ্তিও আছে। যার যেটা পছন্দ সেদিকে যাও। পৃথিবীর কোন জায়গাই শতভাগ স্বাচ্ছন্দ্যের না।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য আমি বেশ জোর দিয়ে বলে উঠলাম।
আমার কথা শুনে সাহস পেয়ে মৌলিও দৃঢ় গলায় বললো- আরেকটা কথা,ছেলে কি আর মেয়ে কি? বাবা-মায়ের জন্য সব সন্তানেরই দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে। সেটা পালন করতে পারাটা সবার জন্যই সৌভাগ্যের।
আমি আর মৌলিই শুধু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছি।
ওদিকে বড় আপা আর জেবিন দু’জনেই দু’দিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। কী একটা অবস্থা!
এমন সময় খেয়া এলো রুমে। প্রসংগ বদলে অন্য কথায় ব্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করলাম আমরা।
বড় আপা আর জেবিন কিন্তু পরস্পরের সাথে সহজ হলো না। বড় আপা সেদিন তড়িঘড়ি করে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। জেবিনও চুপ রইলো।
এমনকি এরপর কয়েকবার আমি আর মৌলি ওদের মান-অভিমান ভাঙানোর চেষ্টা চালিয়েছি,একসাথে কফি খাওয়া কিংবা শপিংয়ে বের হওয়ার প্ল্যান করেছি কিন্তু, দু’জনকে আনতে পারিনি কোনভাবে।
বাধ্য হয়ে হাল ছেড়েছি। প্রায় একমাস কেটে যাওয়ার পর জেবিন যখন চলে যাবে ওকে বিদায় জানাতে গেলাম। বড় আপাকে অনেক বুঝিয়েও সাথে নিয়ে আসতে পারিনি। মন নরম হয়েছে ঠিকই কিন্তু, উনার একই কথা উনি বড়,উনাকে কেন আগে যেতে হবে! জেবিন তো একবার যেতেও বললো না।
এদিকে জেবিনও বলে-বড় আপাকে কেন বলতে হবে! ইচ্ছে থাকলে উনি তো নিজে থেকে এসে ওকে বিদায় জানাতে পারেন।
এয়ারপোর্টে বসে আছি। একটু পরে ভেতরে ঢুকে যাবে জেবিন আর ওর পরিবার। টুং করে আমার ফোনে বড় আপার মেসেজ এলো,জেবিন ভেতরে ঢুকে গেছে?
জেবিন আমার পাশেই মন খারাপ করে গম্ভীর মুখে বসে আছে।
আর কিছু না ভেবে সরাসরি বড় আপার কাছে কল দিলাম,রিসিভ হতেই স্পিকার অন করে জেবিনের সামনে ফোন এগিয়ে দিয়ে বললাম, বড় আপা..
একটু দ্বিধা করে জেবিন বললো-
-হ্যালো আপা,
জেবিনের কন্ঠ শুনে বড় আপা একটু চমকে গেছেন মনে হয়। ওপাশ থেকে ভেজা গলায় উত্তর এলো,
-হ্যাঁ বুনু। সব নিয়েছিস ঠিকঠাক মতো?
-হুম।
-সাবধানে যাস বুনু,একা একা থাকিস,নিজের দিকে খেয়াল রাখিস কিন্তু। কিছু হলে যে একটু চোখের দেখা দেখতে যাবো সে উপায়ও নেই..আপার উপরে রাগ পুষে রাখিস না মানিক..
হু হু করে ফোনের ওপাশে কাঁদছেন আপা।
এপাশে আমার ফোনের স্ক্রিনে জেবিনের চোখ থেকে ফোটায় ফোটায় অশ্রু ঝরে পড়ছে।
-তুমিও সাবধানে থেকো আপা। খাওয়া-দাওয়ার দিকে তো খেয়াল রাখো না কোন। খালি মানুষের জন্য করলে হবে,নিজের শরীরের দিকেও তো খেয়াল রাখতে হবে, তাই না?
আরও কি কি যেন বলছিলো ওরা। জেবিনের হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে আমি একটু এদিকে উঠে এসেছি।
অগোছালো হাঁটতে হাঁটতে ভাবছি- বাংলাদেশিরা পৃথিবীর যে প্রান্তেই যাক না কেন, আবেগ সাথে নিয়েই যাবে।
আচ্ছা থাক গা….এই হানাহানি,টানাটানি, খোচাখুচির পৃথিবীতে থাকুক না হয় কিছু আবেগ মায়া হয়ে,ভালোবাসা হয়ে কিংবা বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা হয়ে!!
এটাই বা কম কি!
‘এখানে কিংবা,ওখানে’
(ছোট গল্প)
সৈয়দা সাবা-ই-জান্নাত