# এক মুঠো রোদ .
# writer :নৌশিন আহমেদ রোদেলা
# পর্ব -২৬
রোজা দাঁতে দাঁত চেপে নিজের রাগটা সামলে নিয়ে বলে,
— কেন? হানিমুনে এসেই ঘুরে বেড়াতে হবে কেন? সিলেটের দেয়ালে দেয়ালে কি লেখা আছে যে, হানিমুন ছাড়া সিলেট শহর ঘুরে বেড়ানো যাবে না?
কথাটা বলেই মুখ বাঁকালো রোজা। রাগে রোজার উজ্জল মুখটাই লাল আভা ফুটে । মৃন্ময় ওদের নজরের অগোচরে মুচকি হাসে। খাওয়া থামিয়ে শান্ত গলায় বলে,
— না। তা নয়। তবে, একটা শহর ঘুরে দেখার জন্য অবশ্যই আপনার একজন বডিগার্ডের প্রয়োজন হবে। হাজার হলেও মেয়ে মানুষ! হানিমুনে এলে হাজবেন্ড থাকবে। আর তার কাজই থাকবে আপনার পেছন পেছন বলদের মতো ঘুরে বেড়ানো যা আমি বা তীর্থ কেউ-ই করতে পারবো না। তাই সিলেট ঘুরে দেখার জন্য হানিমুনটাই আপনার জন্য বেস্ট অপশন। তাছাড়া, আমরা কাজে এসেছি ঘুরতে নয়।
মৃন্ময়ের কথায় রোজার রাগটা যেন সপ্ত আকাশ পাড়ি দিলো। অপমান! এই মুহূর্তে, মৃন্ময়ের বলা প্রতিটি কথাকে রোজার কাছে আস্ত অপমানের ঢিবি বলে মনে হচ্ছে। মৃন্ময়কে প্লেটে নিয়ে চাকু আর কাঁটা চামচ দিয়ে কেটেকুটে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে তার। অসভ্য ছেলে! মৃন্ময় হয়তো রোজার মনোভাব বুঝতে পারলো। তাই খাবারে হাত চালাতে চালাতে মৃদু হাসতে লাগলো সে। সেই হাসি দেখে রাগটা আরো কয়েকগুন বেড়ে গেলো রোজার। খাবার শেষে হোটেল রুমের দিকে এগিয়ে যেতেই তীর্থের শার্টের কলার চেপে ধরলো রোজা। তীর্থ হতভম্ব গলায় বলে,
— কিচ্ছে? টানোস কেন?
রোজা চাপা গলায় বলে,
— কি হয়েছে? শালা হারামখোর। তুই আমার ফ্রেন্ড নাকি ওই ব্যাটার?
তীর্থ অবাক চোখে তাকিয়ে বলে,
— অবশ্যই তোর। তুই তো আমার জন্মগত দোস্ত।
রোজা চাপা ধমক দেয়,
—- চুপ! একদম ভং ধরবি না। ওই মিষ্টার. জিরো আমাকে অপমান করছিলো আর তুই বসে বসে কেলাচ্ছিলি? এই তুই আমার দোস্ত? মৃগী রোগীর চামচা কোথাকার।
তীর্থ অসহায় চোখে তাকিয়ে বলে,
— কখন কেলাইলাম?
— কখন? দুইটা থাপ্পড় লাগাইলেই মনে পড়বো কখন কেলাইছিস। দিবো দুইডা?
তীর্থ ভয় পাওয়া চোখে তাকায়। রোজার বিশ্বাস নেই। এখনই ইচ্ছেমতো চড়-ঘুষি লাগিয়ে মান-ইজ্জতের ফালুদা বানিয়ে দিতে পারে সে। খান্নাস মহিলা একখান! তীর্থ খানিক বিরবির করে ঢোক গিলে। আহত প্রাণীর গোঙানির মতো করে বলে,
— আমার কি দোষ ক? দু’দিন যাবৎ দাঁতের সিস্টেমে সমস্যা দেখা দিছে। আপনা আপনি হাসি সিস্টেম চালু হয়ে যায়। না চাইতেও দাঁত বের হয়ে যায়। এই দেখ….
তীর্থ দাঁত বের করে দেখায়। রোজা কপাল কুঁচকে তাকায়। হাঁটা থামিয়ে কোমরে হাত রেখে বলে,
— তাই নাকি? এই হাত দেখছিস? এক ঘুষিতে তোর চোখের সিস্টেমও আউলায় দিমু। তখন আর দাঁত বের হবো না ডিরেক্ট কান্দন বের হবো। ডাফার!
মৃন্ময় রোজাদের সামনে সামনে হাঁটছিলো। রোজা-তীর্থ নিচু গলায় কথা বললেও সবটাই কানে এলো তার। সেই সাথে পেট ফাঁটা হাসিও পেলো। রোজা-তীর্থের আড়ালে মুখ টিপে হেসে নিজের রুমে ঢুকে গেলো সে। যাওয়ার সময় ওদের দিকে না তাকিয়েই বললো,
— সাতটায় বের হচ্ছি আমরা। গেট রেডি গাইস…
৪৮.
আরমান সাহেবকে অটিতে ঢুকানো হয়েছে প্রায় তিন ঘন্টা হলো। আরু দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে চুপচাপ। আরিফ এদিক ওদিক পায়চারি করছে। লিনা একদৃষ্টিতে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটের কোণের রক্ত শুকিয়ে গেছে। ডান গালে আঙ্গুলের ছাপ। ছাপগুলো দেখেই শরীর কাঁপিয়ে কান্না আসছে লিনার। আজ প্রথম আরুর প্রতি রাগ লাগছে তার। এইজন্য নয় যে রাফিন আরুর পরিচিত। এইজন্য যে, আরিফকে মারার পরও চুপ ছিলো আরু। রাফিনের দেওয়া আঘাতগুলো তো কিছুই না। এর থেকেও হাজারগুণ আঘাত সহ্য করেছে আরিফ। কিন্তু এতোগুলো মানুষের সামনে নিজের ছোট বোনের জন্য মার খাওয়াটা কি সত্যিই মেনে নেওয়া যায়? লিনা জানে আরিফ ভাঙছে। মনের দিক থেকে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। আর সেই চুরমারের শব্দটা লিনার কানে যেন অভিশাপের মতো আঘাত করছে। আরু কি পারতো না রাফিনকে কিছু কড়া কথা শুনাতে? যে ভাই বোনের শরীরে মশা কামড় দিবে বলেও সারারাত জেগে থাকতো সেই ভাইয়ের জন্য এতোটুকু দুঃসাহস কি দেখাতে পারতো না আরু? অভিমান আর ক্ষোভে বুকটা ভার হয়ে আসে লিনার। দু’হাতে মুখ ঢেকে স্বামীর মুখটা মনে করেই চাপা গলায় ডুকরে উঠে সে। লিনার কান্নার আওয়াজে চমকে উঠে আরিফ। দৌড়ে পাশে এসে বসে। মাথায় হাত বুলিয়ে নরম গলায় বলে,
— তোমার শরীর কি খুব খারাপ লাগছে লিনা? কি সমস্যা হচ্ছে বলো। প্লিজ কেঁদো না। বাবার জন্য চিন্তা করছো? বাবা একদম ঠিক হয়ে যাবে পাগলী। ঠিক তো হতেই হবে। আল্লাহ কি এতোটা নিষ্ঠুর হতে পারেন বলো?
লিনা চোখ তুলে তাকায়। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে। আরিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে হালকা হাসে। হাজারও কষ্টমাখা সেই হাসিটা লিনাকে আবারও ভাঙে। ভেঙে ঘুরিয়ে দেয়। আরিফ লিনাকে বুকে টেনে নিতেই আবারও ফুঁপিয়ে উঠে সে। প্রতিটি স্ত্রীর কাছেই তার স্বামী অসাধারণ এক মানুষ। লিনার কাছেও তাই। এতোবছরের সংসার জীবনে আরিফকে হাজারও কষ্টে ঝুঁঝতে দেখেছে। কষ্টেও হাসতে দেখেছে। সবাইকে একা হাতে আগলে রাখতে দেখেছে। কিন্তু কখনো ভাঙতে দেখে নি। হেরে যেতে দেখে নি। কিন্তু আজ আরিফের চোখে পরাজয়ের ঘ্লানি। বোনের কাছে ভালোবাসার যুদ্ধে পরাজিত এক মানব সে।
৪৯.
গাড়িতে বসে আছে তীর্থ,রোজা আর মৃন্ময়। গাড়ি চালাচ্ছে আলী। তীর্থ নিচু গলায় ফোনে কথা বলছে। রোজা রাতের সিলেট দেখতে মগ্ন। দূরে অন্ধকারাচ্ছন্ন কালো পাহাড়। চাঁদের আলোয় কোন কোনটা কালো তো কোনটা গাঢ় নীল। যেন মস্ত এক দৈত্য পাহাড়া দিয়ে চলেছে এই অসম্ভব মায়াবী শহর। গাড়ির গ্লাস নামানো বলে রোজার চুলেরাও বাতাসে মত্ত হয়েছে। মৃন্ময় সিটে গা এলিয়ে সামনের গ্লাসটিতে তাকিয়ে আছে। রোজার উড়ন্তচুলগুলোও যেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে সে। মৃন্ময়ের ধারনা ছিলো রোজাকে শাড়ি আর স্কার্টেই সবচেয়ে সুন্দর লাগে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় বেমানান লাগবে তাকে। কিন্তু মৃন্ময়ের ধারনা সম্পূর্ণই ভুল প্রমাণ হলো আজ। রোজার গায়ে হোয়াট লেডিস শার্ট আর ব্লু জিন্স যে এতোটা মানিয়ে যাবে চিন্তায় করতে পারে নি সে। তারসাথে খোলা চুল! মৃন্ময় চোখ বুজলো। বুকটা ধরফর করছে তার। রোজা মৃন্ময়ের আশেপাশে থাকলেই অস্থিরতাটা চরম আকার ধারণ করে। গলা শুকিয়ে আসে। শ্বাস নেওয়াটাও দায় হয়ে দাঁড়ায় তবু বাইরে থেকে কতোটা স্বাভাবিক সে। ভেতরে বয়ে যাওয়া ঝড়ের সাথে বাইরের চেহারাটার কোনো যুগ নেই। দুটো যেন দুই জগতের বাসিন্দা। একদম অচেনা! মৃন্ময় দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আলী বেশকিছুক্ষন ধরে উসখুস করছিলো। গাড়িতে বসার পর থেকে একটা কথা বলারও সুযোগ পায় নি সে। মৃন্ময়কে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে দেখে হাসিমুখে বলে উঠলো সে,
— স্যার মনে হয় ক্লান্ত? বলি কি? একটা গান ধরেন স্যার। শিল্পী মানুষ বইলা কথা। দেখবেন, মনটা একদম ফুরফুরা হয়ে গেছে। গাইবেন স্যার?
মৃন্ময় চোখ খোলে আবারও আয়নায় তাকালো। রোজা বাতাসের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে চুলগুলো মুড়িয়ে হাতখোপা করায় ব্যস্ত। মৃন্ময়ের চাহনীটা তার চোখে পড়লো না। মৃন্ময় আবারও চোখ বন্ধ করে নিলো। অসম্ভব সুন্দর গলায় গেয়ে উঠলো,
“”তোমার চুল বাঁধা দেখতে দেখতে,
তোমার চুল বাঁধা দেখতে দেখতে।
ভাঙল কাঁচের আয়না।।
তোমার ছলাকলা দেখতে দেখতে,
তোমার ছলাকলা দেখতে দেখতে,
হেই..ভাঙল বুকের আয়না।।
ভরা যৌবনে সাজাতে তোমাকে ষোলটি
ফাগুন লেগে গেছে।
ভরা যৌবনে সাজাতে তোমাকে ষোলটি
ফাগুন লেগে গেছে।
তোমার অপরূপ ধরে রাখতে,
তোমার অপরূপ ধরে রাখতে
পাগল হল যে আয়না।।
তোমার চুল বাঁধা দেখতে দেখতে,
তোমার চুল বাঁধা দেখতে দেখতে।
ভাঙল কাঁচের আয়না।।
তোমার ছলাকলা দেখতে দেখতে,
তোমার ছলাকলা দেখতে দেখতে,
হে..ভাঙল বুকের আয়না।।
আমি যেমন তোমারই ছিলাম
আমি যেমন তোমারই ছিলাম
তেমন তোমারই আছি।
তুমি আয়নাকে প্রশ্ন করো,
তুমি আয়নাকে প্রশ্ন করো
শুনে নাও কী বলে আয়না।।
তোমার চুল বাঁধা দেখতে দেখতে,
তোমার চুল বাঁধা দেখতে দেখতে।
ভাঙল কাঁচের আয়না।।
তোমার ছলাকলা দেখতে দেখতে,
তোমার ছলাকলা দেখতে দেখতে,
হেই..ভাঙল বুকের আয়না।।”””
গানটা শেষ হতেই চমকে উঠলো রোজা। তীর্থও ফোন কেটে মনোযোগী হয়েছে গানে। রোজার মনে হচ্ছে গানের প্রতিটি লাইন তাকে উদ্দেশ্য করে গাওয়া। প্রতিটি শব্দ যেন তার নামকেই ডেকে যাচ্ছে আনমনে। পরমুহূর্তেই নিজের ভাবনাটাকে দূরে ঠেলে সিটে গা এলিয়ে দিলো রোজা। এ-ও কি সম্ভব! মৃন্ময়ের মতো একজন সেলিব্রিটি তাকে উদ্দেশ্য করে গান গাইবে? কথাটা নিজের কাছেই বড্ড হাস্যকর লাগলো রোজার।
# চলবে….