রোদ শুভ্রর প্রেমকথন পর্ব ২১
#নৌশিন আহমেদ রোদেলা
৯.
নূরজাহান আন্টিদের বাসা থেকে সোজা মামানিদের বাসায় যেতে হলো আমাদের। আম্মু নাকি মামানির থেকে কি একটা বই চেয়েছেন। মামুদের বাসায় এসে কলিংবেল চাপতেই দরজা খুলে দিলেন মামু। মামুর সাথে কুশলাদি বিনিময়ের মাঝপথেই ঘরে ঢুকলেন শুভ্র ভাই। উনার হাতে কিছু প্যাকেট ছিলো। কিছু প্যাকেটে নূরজাহান আন্টি আম,লিচু, পিঠা পাঠিয়েছেন আর কিছুতে দোকানের জিনিস। শুভ্র ভাই ড্রয়িংরুমে ঢুকেই প্যাকেটগুলো একরকম ছুঁড়ে ফেললেন সোফায়।
আম আর লিচুর প্যাকেটটা উল্টে পড়লো মেঝেতে। কিছু আম গড়িয়ে গিয়ে ঠেকলো পায়ের তলায় আর কিছু সোফা আর টেবিলের নিচে। আমরা সবাই অবাক চোখে তাকালাম। হঠাৎ কি হলো উনার? শুভ্র ভাই সেখানে এক মিনিটও দাঁড়ালেন না। ব্যাগগুলো ছুঁড়ে ফেলে রুমে ঢুকে দরজা লাগালেন। দরজা লাগাতে গিয়ে এতো শব্দ করলেন, মনে হলো ঘরটা খানিকের জন্য কেঁপে উঠলো। মামু ভ্রু কুঁচকে মামানির দিকে তাকালেন। বিস্ময় নিয়ে বললেন,
— “ছেলের হলো টা কি? হঠাৎ এতো রাগ?”
মামানি কপাল কুঁচকে বললেন,
—” বুঝতে পারছি না। হঠাৎ কি হলো? নূর আপার বাড়িতে তো হাসি-খুশিই ছিলো।”
আমি আর আপু ঢোক গিলে একজন অন্যজনের দিকে তাকালাম। শুভ্র ভাইয়ের রাগের ভয়ে মারাত্মকভাবে ভীতু আমরা। আপু আরো খানিকটা সরে এসে আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলে উঠলো,
— “রোদু রে? এই পোলা নির্ঘাত বউ পিডাবো। আল্লাহ বাঁচাইছে তোর বিএফ আছে। আমি তো ভাবছিলাম তুই আর শুভ্র ভাই….। তবে যা হয় ভালোর জন্যই হয়। তোর জন্য কতো চিন্তা হতো আমার। না জানি কবে ঘুম থেকে উঠে শুনি আমার বোন আর নাই। সে শুভ্র ভাইয়ের রাগের নিচে পিষ্ট হয়ে হাওয়া হয়ে গেছে। তোর ওই “আমি-তুমি” বয়ফ্রেন্ডই ঠিক আছে। চালিয়ে যা বইন…”
আমি বিরক্ত গলায় বললাম,
— “আপু চুপ করবা? “
মামু এবার আমাদের দিকে ফিরে বললেন,
— “রোদ-রুহি? কাহিনি কি বল তো। “
আমি ঢোক গিলে অসহায় গলায় বললাম,
—” আমরা জানি না মামানি। বলছি কি? আমরা আজ যাই। বইটা বরং পরে নিবো…”
মামানি বললেন,
— “সে কি? রাতে খেয়ে তারপর যাবি। শুভ্র দিয়ে আসবে।”
আমার আর আপুর এবার কেঁদে দিবো দিবো অবস্থা। মামানি বললেন,
—” তোরা একটা কাজ কর। ফ্রেশ হয়ে নে। একজন মার রুমে চলে যা আরেকজন গেস্টরুমে আর আদিবাকে আমার সাথে নিয়ে যাচ্ছি। “
আমরা বাধ্য মেয়ের মতো রুমের দিকে পা বাড়াতেই পেছন থেকে ঢেকে উঠলেন মামানি,
—” রোদু? “
আমি ফিরে তাকাতেই একটা পেনড্রাইভ এগিয়ে দিয়ে বললেন,
—” এটা একটু শুভ্রকে দিয়ে আয় না মা। আসার সময় কিনে আনলো আর প্যাকেটগুলোর সাথে এখানেই ফেলে গেছে। আমি আদিবাকে নিয়ে যাচ্ছি তুই একটু দিয়ে আয়।”
আমি ভীত গলায় বললাম,
—” মামানি? আমিই কেন? উনি আমাকে আছাড় দিয়ে এই চারতলা থেকে ফেলে দিবেন। প্লিজ মামানি….”
— “তোকে কেন আছাড় দিবে? শুভ্র একজনের রাগ আরেকজনের উপর ঝাড়ে না। হয়তো ফ্রেন্ডদের সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছে। তুই যা…”
আমি ঠোঁট উল্টে কপাল কুঁচকে বললাম,
—” মামানি? প্লিজ! আমার ভয় লাগে উনাকে।”
মামানি মুচকি হেসে বললেন,
—” ভয় কি রে পাগলী? যা তো! “
মামানিকে বুঝানোটা দায় হলো আমার। তাই বাধ্য হয়েই শুভ্র ভাইয়ের রুমের দিকে পা বাড়াতে হলো। উনার রুমের সামনে এসে দোয়া পড়ে বুকে ফু দিয়ে নিলাম। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেলাম। ঘরে আবছা অন্ধকার। লাইট অফ তবে ডীম লাইটের আলোয় চারপাশটায় আবছা আলো। কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থেকে আলোটা চোখে সয়ে এলে চারপাশে তাকালাম। জানালার পাশে উল্টো দিকে ফিরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন উনি। অন্ধাকারে সাদা টি-শার্টটা নজরে লাগছিলো খুব। উনি পকেটে হাত গুঁজে স্ট্রেট দাঁড়িয়ে আছেন। আমি খানিকটা এগিয়ে গিয়ে ভয় পাওয়া গলায় বললাম,
— “শুভ্র ভাই?”
উনি জবাব দিলেন না। আমি আবারও ডাকলাম,
—“শুভ্র ভাই? আপনার পেইনড্রাইভটা সোফায় ফেলে এসেছিলেন। কোথায় রাখবো?”
শুভ্র ভাই এবারও কিছু বললেন না। আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। উনার রাগের কারণটাও ধরতে পারছিলাম না। তাই জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বললাম,
— “আপনি রেগে আছেন কেন? সিরিয়াস কিছু হয়েছে? ”
শুভ্র ভাই শান্ত গলায় বললেন,
—“এই মুহূর্তে রুম থেকে চলে যা রোদু। আমার মেজাজ খারাপ উল্টাপাল্টা কিছু হয়ে যাবে। প্লিজ যা…”
তখন আমার কি হলো কে জানে? বাড়াবাড়ি রকমের জেদ নিয়ে বলে উঠলাম,
—” আগে বলুন রেগে আছেন কেন? নয়তো যাবো না।”
—” জেদ না করে যা রোদ।”
—” বললাম তো যাবো না। নাহিদ ভাইয়াদের বাসায়…”
এটুকু বলতেই ঘুরে দাঁড়ালেন উনি। ধাক্কা দিয়ে পাশের দেয়ালের সাথে দাঁড় করিয়ে ডানহাতটা উঁচু করে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে রাগী গলায় বললেন,
—“নাহিদ কি? সারাদিন নাহিদ নাহিদ করিস কেন তুই? সমস্যা কি তোর?”
উনার কথায় কান নেই আমার। হাতের অসহ্য ব্যাথায় চোখ-মুখ কুঁচকে গেছে আমার। অন্ধকারে আমার মুখের ভাবটা ঠিক বুঝতে পারলেন না উনি। কিন্তু আমার তো জান বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। দাঁতে দাঁত চেপেও ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে ফুঁপিয়ে উঠলাম আমি। মুহূর্তেই থেমে গেলেন শুভ্র ভাই। অবাক চোখে তাকিয়ে বললেন,
— রোদু? এই রোদু? তুই কাঁদছিস? কি হয়েছে? ব্যাথা লেগেছে হাতে?
আমার ব্যাথার গতির সাথে কান্নার গতিও বাড়লো। উনি দ্রুত লাইট জ্বালালেন। সুইচ অন করে ব্যস্ত ভঙ্গিতে আমার সামনে আসতেই চমকে উঠলেন। দেয়াল বেয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। দেয়ালে লাগানো চিকন প্যারেকটা অসাবধানতায় ঢুকে গেছে আমার হাতে।
আমি প্যারেকটা থেকে হাতটা ছুঁটানোর চেষ্টা করতেই সারা শরীরে তীক্ষ্ণ ব্যাথা খেলে গেলো। না চাইতেই মুখ থেকে হালকা আর্তনাদ বেরিয়ে এলো। শুভ্র ভাই স্তব্ধ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। উনার হাত-পায়ের কম্পনটা খুবই স্পষ্ট। আমি চাচ্ছিলাম কোনো রকম প্যারেক থেকে হাতটা উঠিয়ে রক্ত লুকাতে নয়তো মামানি কেমন রিয়েক্ট করবে কে জানে? কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। আমার চিৎকারে ছুটে এলেন মামানি আর আপু। আমার হাতের অবস্থা দেখে আৎকে উঠেই চড় লাগালেন শুভ্র ভাইয়ের গায়ে। মামানি আপুকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
— “তোমার মামুকে ডেকে আনো রুহি। জলদি যাও। তোমার মামু ছাঁদে আছেন।”
আপু ছুটে বেরিয়ে গেলো। আদিবা দরজার এক কোণা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ভয়ে ভয়ে তাকাতে লাগলো। শুভ্র ভাইয়া কোনোরকম বললেন,
—” আম্মু, আম্মু আমি..”
মামানি উনাকে সেখানেই থামিয়ে দিয়ে রাগী কন্ঠে বললেন,
—“একদম চুপ। এতো রাগ কেন থাকবে তোমার? তোমাকে দেখে তো এখন ভয় লাগছে আমার শুভ্র। না জানি রাগের মাথায় আরো কি কি করতে পারো তুমি। মানুষ খুন করে ফেললোও অবাক হবো না আমি। এমন চলতে থাকলে একদিন তোমার হাতেই মরে যাবে মেয়েটা। “
শুভ্র ভাইয়া অবাক চোখে তাকালেন,
—” আম্মু!”
—“আম্মু নেই। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো। আজই শেষ শুভ্র এরপর থেকে রোদের আশেপাশেও যেন না দেখি তোমায়। ৩ বছর আগে যেমন বন্ধ ছিলো তেমনই বন্ধ।”
—” আম্মু! তুমি ওভার রিয়েক্ট করছো। আগে রোদের হাত থেকে প্যারেকটা খুলে ঔষধ লাগাই তারপর নাহয় তোমায় বুঝিয়ে বলছি। আমি….”
— “আমি যথেষ্ট বুঝি। এই বয়সে তোমার থেকে জ্ঞান নিতে হবে না আমায়। আর এটা ওভার রিয়েক্ট? আজ তুমি ওর হাতটা এভাবে ক্ষতবিক্ষত করে বলছো ওভার রিয়েক্ট তাহলে কাল ওকে খুন করে হাসতে হাসতে বলবে সরি ওভার রিয়েক্ট করো না ভুলে হয়ে গেছে।”
—” কি সব বলছো আম্মু? আমি রোদকে…. “
—” রোদ নয় রোদেলা। আজ থেকে রোদেলাই বলবে তুমি। “
এরমধ্যেই মামু এলেন। আমার হাত থেকে প্যারেক বের করে দিয়ে নিচের তলার ফার্মেসীর আংকেলকে ফোন দিলেন। আংকেল জায়গাটা পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দুটো ইনজেকশন পুশ করলেন। শুভ্র ভাই এক কোণায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। উনার জন্য খুবই কষ্ট হচ্ছে আমার। যায় হোক, উনি তো ইচ্ছে করে করেন নি। সম্পূর্ণটাই জাস্ট একটা এক্সিডেন্ট।
মামানি এতোটা রিয়েক্ট কেন করছেন? মামানি আর মামু নিজে গিয়ে বাসায় পৌঁছে দিলেন আমাদের। মায়ের সকাল প্রশ্নের উত্তরও তারায় দিলেন। আবারও সবকিছু আগের মতোই চলতে লাগলো। হাতের ঘা ও ঠিক হতে লাগলো কিন্তু ঠিক হলো না শুধু একটা জিনিস। আর তা হলো, শুভ্র ভাই। সেদিনের পর থেকে সত্যি সত্যিই আমাদের বাড়ি আসা বন্ধ করলেন উনি। তার প্রায় চার/পাঁচদিন পর হঠাৎই ফোন বেজে উঠলো আমার। ফোনের স্ক্রিনে “শুভ্র ভাই” নামটা ভাসতেই বুক কেঁপে উঠলো আমার। তাড়াতাড়ি ফোনটা রিসিভ করে সালাম দিয়ে বললাম,
—” শুভ্র ভাই?”
ওপাশে নীরবতা। কোনো কথা নয় শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ। কিছুক্ষণ পর নরম গলায় বলে উঠলেন উনি,
—” কেমন আছিস রোদু? মাফ করে দিস প্লিজ। আমি বুঝতে পারি…”
এটুকু বলতেই কিছু একটা ঘটলো ওপাশে। শুভ্র ভাই বিস্মিত কন্ঠে বলে উঠলেন,
—” এসব কি আম্মু? আমার ফোন দাও প্লিজ।”
তারপর মামানির কন্ঠ কানে এলো,
—“তোমাকে আমি রোদুর থেকে দূরে থাকতে বলেছিলাম শুভ্র। ফোন দিয়েছো কোন সাহসে?”
—” মা প্লিজ!আমাকে ওর সাথে জাস্ট একটু কথা তো বলতে দাও। আমি শুধু জানবো কেমন আছে ও।”
—” ও খুব ভালো আছে। তোমার থেকে দূরে থাকলে অবশ্যই ভালো থাকবে রোদ।”
—“আম্মু আমার কথাটাও একটু ভাবো…”
তারপর আর কিছুই শোনা গেলো না। কানে এলো অদ্ভুত কিছু শব্দ। কিসের শব্দ বোঝতে না পেরে কল কেটে দিলাম আমি। মামানি সামান্য একটা বিষয় নিয়ে এতোটা রিয়েক্ট কেন করছেন বুঝতে পারছি না আমি। শুধু এটুকু বুঝতে পারছি, বড্ড কষ্ট হচ্ছে আমার। মামানি কি করে ভাবতে পারেন শুভ্র ভাইয়ের সাথে থাকলে ক্ষতি হবে আমার। আমি তো এমনটা ভাবতে পারি না।
কারণ আমি জানি উনার সাথেই সব থেকে সুরক্ষিত থাকবো আমি। সেদিন থেকে ফেসবুক এমনকি ফোনেও ব্লক লিস্টের খাতায় চলে যাই আমি। অদ্ভুতভাবেই অগোছালো হয়ে পড়ে আমাদের এই প্রেমকাহিনী। এখনও প্রতিদিন বিকেলে ছাঁদের কার্নিশে গিয়ে দাঁড়াই কিন্তু আগের মতো হুট করে এসেই ফালতু কথায় বিরক্ত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন না শুভ্র ভাই। সকাল গড়িয়ে বিকেল হয় বিকেল থেকে রাত। দীর্ঘ রাত পেরিয়ে আবারও সকাল হয় কিন্তু সত্যিকারের সকালটা যেন আর হয় না।
#রোদবালিকা
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/rodsuvro/
[অবশ্যই শুভ্র একটি কাল্পনিক চরিত্র। কেউ বিভ্রান্ত হবেন না।]