রোদ শুভ্রর প্রেমকথন পর্ব ৪৭
#লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
‘আকস্মিক’ শব্দটাই বড় গোলমেলে। হুটহাট ঘটে গিয়ে আলগোছে অগোছালো করে দেয় সব। জমাট বাঁধা প্রশ্নগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভ্রান্ত করে দেয়। আমাকেও করল। হঠাৎ এক রাতে আকস্মিক এক ঘটনা ঘটে গেল। শুভ্র ভাই আর আমার মাঝে বিশেষ কোনো সম্পর্ক নেই, তা সত্য। আবার কোথাও একটা অনেক কিছু আছে, সেটাও সত্য। সেই অনেককিছুর মাঝেই ভয়ানক এক প্রশ্ন উঠল। আমি ভীত হলাম,উদভ্রান্ত হলাম। কিন্তু কেন হলাম? জানা নেই। বয়সের দোষ? অপরিপক্কতা? নাকি অন্যকিছু?
শীতের রাত। রাতের খাওয়া শেষ করে মাত্রই কম্বল মুড়িয়ে শুয়েছি। ঘড়িতে দশটা কি এগারোটা বাজে। ঠিক তখনই ঘটনাটা ঘটল। অপরিচিত এক নাম্বার থেকে কয়েকটি দীর্ঘ ম্যাসেজ এলো। তাসনিম আপুর ম্যাসেজ। আমি বিস্মিত হলাম। কৌতূহলী হলাম। কিন্তু কিছুটা পড়েই বুকের কোথাও চিনচিনে ব্যথা, অদ্ভুত এক ভয় আর চাপা কষ্ট কাজ করতে লাগল। উদ্ভ্রান্তের মতো কাঁদতে ইচ্ছে হল। আমি আবারও তাসনিম আপুর লেখাটা পড়লাম। তিনি লিখেছেন,
‘ রোদেলা, তুমি খুবই মিষ্টি একটা মেয়ে। খুবই বাচ্চা। কিন্তু আমি তোমাকে মেনে নিতে পারছি না। আমাকে ভুল বুঝো না, প্লিজ। সবকিছুর পেছনেই কারণ থাকে, তাই না? তোমাকে আমার মেনে নিতে না পারার পেছনেও হয়ত আছে। অবশ্যই আছে। শুভ্র তোমাকে আমার সম্পর্কে কিছু বলেছে কি-না জানি না। না বলার সম্ভবনাটাই হয়তো বেশি। আমার বয়স তখন খুবই অল্প। পনেরো কি ষোল হবে। বাচ্চামো আর চঞ্চলতায় ভরপুর এক কিশোরী। আমার সেই জীবনটাতে কোনো কষ্ট ছিল না।
বাবা-মার একমাত্র মেয়ে আমি। বাবা ডাক্তার। সম্ভ্রান্ত বংশ পরিচয়। আদর, ভালোবাসা, বন্ধুমহল সব দিক থেকেই আমি সুখী। কিন্তু এই সুখের জীবনটা বেশিদিন টিকল না। সুখটাকে তছনছ করে, আমার ছোট্ট জীবনটায় এলো শুভ্র। তোমার শুভ্র ভাই। শুধু এসেই ক্ষান্ত হলো না। কিশোরী মনের প্রবল ভালোবাসা নিয়ে তার প্রতি আকৃষ্ট হতে বাধ্য করল।
আমি ওকে প্রচন্ড ভালোবেসে ফেললাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে। এতো এতো মেয়েদের মাঝে এই আমাকেই প্রোপোজ করল শুভ্র। আমাকেই ভালোবাসলো। শুভ্রর মুখে ভালোবাসার কথা শুনে আমি যেন হাওয়ায় উড়তে লাগলাম। সারাটা রাত বুকে বালিশ চেপে কাঁদলাম। হাসলাম। নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে সুখী মনে হচ্ছিল সেদিন। যার একটা শুভ্র আছে সে কী সুখী না হয়ে পারে, বলো? আমি ছোট্ট থেকেই টিপিক্যাল বাঙালি মেয়ে, রোদেলা। ভীষণ আবেগী আর রক্ষণশীল। তবুও রক্ষণশীল চিন্তাভাবনার গন্ডি পরিয়ে, সেই প্রথম আমি শুভ্রর হাত ধরলাম।
ধুরু ধুরু বুক নিয়ে সিনেমার হলে পা রাখলাম। ওসব আমার জন্য প্রথম ছিল। অন্যরকম ছিল। তবু আমি করেছিলাম। কারণ একটাই ,শুভ্রর মন রাখা। কিন্তু এক সপ্তাহের মাথায় সব যেন থমকে গেল। শুভ্র হঠাৎই জানাল, তার আর আমার সঙ্গ ভালো লাগছে না। আমাদের আর না এগুনোই ভালো। তার ব্রেকআপ চাই। কথাটা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম রোদেলা। আমি ওই অতটুকুন মেয়ে, ওই অতটুকুন বয়সে বুক উজাড় করা ভালোবাসা নিয়ে প্রত্যাখাত হলাম।
আমার রঙিন দুনিয়াটা ভেঙে গেল। আমি শুভ্রকে রিকুয়েষ্ট করলাম। শুভ্র আমাকে বুঝাল, তার মন থেকে আসছে না। জোর করে কিছু হয় না। অসহায় আমি শুভ্রকে আমার ভালোবাসাটা বোঝানোর চেষ্টা করলাম। শুভ্র একদমই আলাদা ধাঁচের মানুষ। ওর সিদ্ধান্ত হের ফের করার ক্ষমতা হয়তো সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত কারো ছিল না। আমারও না। আমার থমকে যাওয়া পৃথিবীটা ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে এলো। আমার রিস্ট্রেক্টিক ফ্যামিলি ব্যাপারটা জেনে গেল। ম্যান্টাল প্রেসার বাড়ল। আমি এতোটাই ডিপ্রেশড হয়ে পড়লাম যে সুইসাইড এট্যাম্প করা ছাড়া অন্যকোনো রাস্তা পেলাম না।
কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত বেঁচে গেলাম। বাবা তখন দিশেহারা হয়ে পড়লেন। শুভ্রর সাথে কথা বললেন। কি কথা বললেন জানি না। তবে শুভ্র খুবই অদ্ভুত এক কাজ করলো। বাসায় এসে কোনো কথাবার্তা ছাড়াই আমার গালে ভয়ানক এক চড় বসালো। বাবা-মা হতভম্ব। চোখে-মুখে অবিশ্বাস। একটা ছেলে এতোটা বেয়াদব আর অসভ্য কি করে হতে পারে? কিন্তু শুভ্র তো এমনই। বেপরোয়া। অসহ্য। সেই সাথে পাগল করা। কখনো ভীষণ ভালো তো কখনো ভয়ানক খারাপ। সেদিন রাতে কষ্টে আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। শুভ্র চড় মেরেছে বলে নয়।
ওই বেপরোয়া, অসভ্য ছেলেটাকে আমি পেতে পারছি না বলে। করলামও তাই। এক গাদা ঘুমের ঔষধ খেলাম। কিন্তু এবারও…এবারও এই নষ্ট ভাগ্যের অজুহাতে বেঁচে গেলাম আমি। শুভ্র তার সিদ্ধান্তে অটল রইল। আমায় ভালোবাসলো না। চোখ তুলে তাকালও না। একটা খোঁজ পর্যন্ত নিল না। তুমিই বলো, মানুষের কি এতোটা পাষাণ হওয়া সাজে? কিন্তু শুভ্রর সাজল। আর এই পাষাণ, নির্বিক শুভ্রকে আমি আরো বেশি ভালোবেসে ফেললাম। সেই সাথে আমার অসুখটাও বাড়লো।
এই শুভ্রময় অসুখে থিতু হয়ে রইলাম পরবর্তী নয় নয়টা বছর। আমি খুবই দুর্বল মনের মানুষ রোদেলা। শুভ্রহীন জীবনটা আমার সহ্য হয় না। এই নয়টা বছর কি নিদারুণ যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছি তা কি তুমি উপলব্ধি করতে পারছ রোদেলা? তুমি এখন যে বয়সটাতে আছো। তার থেকেও দু-তিন বছরের ছোট ছিলাম আমি। সেই ছোট্ট, অপরিণত বয়সে কতটা ব্যথা হতে পারে বুঝতে পারছ? আমার সেই ব্যথাটা দিনের পর দিন বাড়ছে। এই ব্যথার কষাঘাতে এই নয় বছরে আরো বার দুয়েক আত্মহননের চেষ্টা করেছি আমি। মুক্তি চেয়েছি। কিন্তু, ওই যে? নষ্টভাগ্য!
তুমি নিশ্চয় ভীষণ ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখছ আমায়? কিন্তু এই ঘৃণাটা কি সত্যিই আমার প্রাপ্য? সবার জীবনই যদি একটা উপন্যাস হয় তাহলে আমার জীবনের পাতাগুলোই এতোটা শূণ্য কেন, বলতে পারো? আমিই কেন ভালোবাসাটা পেলাম না? শুভ্র আমাকে ভালোবাসতে গিয়েও কেন ভালোবাসল না? বুক উজাড় করে ভালোবেসেও ‘তৃতীয়ব্যক্তি’ উপাধিটা কেন আমিই পেলাম? কেন-ই-বা কিছু কিছু মানুষের নজরে ঘৃণার পাত্র হয়ে উঠলাম?
আমার জীবনের প্রতি আমার অনেক অভিযোগ রোদেলা। আমি এই অভিযোগগুলো তোমার ঝুলিতে ঢেলে দিতে চাই। আমি জানি না, তুমি কে। শুভ্রর কতটা জুড়ে আছো। কিন্তু কোথাও একটা আছো। আর আছো বলেই ওর ভয়। আমি সেদিন শুভ্রর চোখে ভয় দেখেছিলাম। তোমার নুপুরহীন, শূন্য পায়ের দিকে ফ্যাকাশে দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখেছিলাম। আমার ভাবনাটা যদি সঠিক হয় তাহলে আমি ভীষণ স্বার্থপরের মত চাইব, শুভ্র ভেঙে গুড়িয়ে যাক। ওর ভয়টা সত্যি হোক। ওর পাষাণ হৃদয় বুঝুক সেই কষ্ট। তোমার মৃত্যু হোক। আল্লাহ নাকি সবার দোয়ায় কবুল করেন? আমার তো প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্ত, প্রতি ওয়াক্ত নামাযের পর ওই একটিই দোয়া থাকে। তবু তুমি মরবে না? জানি অদ্ভুত কথা বলছি। কিন্তু আমি চাই ব্যাপারটা সত্যিই ঘটুক। খুব জলদি ঘটুক।’
এটুকু পড়েই থমকে গেলাম আমি। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে রইলাম। কি আশ্চর্য! একজন মানুষ নিরবিচ্ছিন্নভাবে, নিঃসংকোচে মৃত্যুকামনা করছে আমার। এই পৃথিবীর একটি মানুষের কাছে আমার মৃত্যুটাই বৃহৎ প্রাপ্তি। তার গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো সে আমার মৃত্যুকামনায় ব্যয় করছে। কথাগুলো ভাবতেই গা শিউরে উঠলো। আমি বিভ্রান্ত হয়ে পড়লাম। ধীরে ধীরে সারা শরীরে বয়ে গেল মন খারাপের মেঘ। রাতে আমার ঘুম হলো না। অর্ধেকটা রাত কম্বলের নিচে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে রইলাম। গুমট মনটাই বাজতে লাগল একটাই বাক্য, ‘তবুও তুমি মরবে না?’ সত্যিই তো। তবুও আমি মরব না? অদ্ভুত এক খারাপ লাগায় সারা শরীর অবশ হয়ে এলো আমার। গলা শুকিয়ে এলো। হঠাৎ করেই মনে হলো, সত্যিই হয়তো খুব বেশিদিন বাঁচব না আমি। কিছুতেই না। ঘড়ির কাটা একটায় পৌঁছাতেই শুভ্র ভাইকে ফোন লাগালাম। দু’বারের মাথায় তিনি ফোন ধরলেন। অত্যন্ত ব্যস্ত গলায় বললেন,
‘ কি সমস্যা? কি চাই?’
আমি থতমত খেয়ে গেলাম। হঠাৎ কি বলব বুঝতে পারলাম না। শুভ্র ভাইকে কখনোই খুব প্রয়োজন ছাড়া ফোন করা হয় নি। কিন্তু এই মুহুর্তে প্রয়োজনীয় কিছু মনে পড়ছে না। আচ্ছা? শুভ্র ভাইকে তাসনিম আপুর ব্যাপারটা বলা কি প্রয়োজনীয় কিছু হতে পারে?শুভ্র ভাই অধৈর্য্য গলায় বললেন,
‘ ঠাডিয়ে চড় লাগব একটা। ফাইজলামি চলছে? মাঝরাতে ফোন দিয়ে ভং ধরার মানে কি? কি বলবি বলে ফোন কাট।’
আমি কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থেকে অত্যন্ত দুঃখী গলায় বললাম,
‘ সবসময় এতো নিকৃষ্ট ব্যবহার কেন করেন শুভ্র ভাই। চড়-থাপড়া ছাড়া কি আর কোনো শব্দ আপনার ডিকশনারিতে নেই? আজ বাদে কাল যদি মরে টারে যাই তখন কি হবে? ‘
শুভ্র ভাই অত্যন্ত স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,
‘ কি হবে? মানুষ মরে গেলে যা হয় তাই হবে। জানাজা করে মাটি চাপা দিয়ে দেওয়া হবে।’
শুভ্র ভাইয়ের উত্তরে হতভম্ব হয়ে গেলাম আমি। মাটি চাপা দিয়ে দিবে? এইটুকুই? আর কিছুই না? এজ আ কাজিন, তার বিন্দুমাত্র খারাপ লাগা কাজ করবে না? তার প্রাক্তোনের অভিশাপের ঠেলা সামলাতে না পেরে যে আমি মরে গেলাম, তাতে তার বিন্দুমাত্র আফসোস হবে না? এমন একটা অসহ্যকর মানুষের জন্য আমাকে মরে যেতে হবে? আমার এই মুহুর্তে তাসনিম আপুর জন্য বড্ড আফসোস হচ্ছে। বেচারা যে ভুল মানুষের জন্য বদদোয়া করে সময় নষ্ট করছে সেটা তাকে বুঝাতে ইচ্ছে করছে। শুভ্র ভাইয়ের যে আমার বাঁচা-মরা নিয়ে কোনো প্রকার যায় আসে না তা না বুঝিয়েই মরে যাওয়াটা ভীষণ অন্যায় হবে। শুভ্র ভাই আবারও ধমকে উঠলেন।
‘ সমস্যা কি তোর? মাঝরাতে ঢং লাগাইছিস কেন? দ্যাখ! আমি এখন এসাইনমেন্ট করছি। ভীষণ টিপিক্যাল কেস। গ্রাফ টাফ করতে গিয়ে মাথা ঘুরে যাচ্ছে। তাই থাপড়া না খেতে চাইলে ফোন দেওয়ার কারণটা বলে ফোন রাখ।’
শুভ্র ভাইয়ের কথায় দুঃখে মরে যেতে ইচ্ছে করছে আমার। একটা মানুষ এতটা অসহ্যকর কি করে হতে পারে? এতটা বিশ্রী ব্যবহার কি করে করতে পারে? আমি থমথমে কন্ঠে বললাম,
‘ আপনি একটা অসহ্য, শুভ্র ভাই।’
‘ সেটা এর আগেও বহুত বলছিস। তারপর?’
‘ তারপর আপনার মাথা। একটা মেয়ে আপনাকে তার মরে যাওয়ার কথা বলছে আর আপনি তাকে নাচতে নাচতে মাটি চাপা দিয়ে দিচ্ছেন। মানবিকতা বলে কিছু নেই?’
শুভ্র ভাই মাত্রাতিরিক্ত বিরক্ত হয়ে বললেন,
‘ মাঝরাতে আজাইরা আলাপ। কোন মেয়ে কোন দুনিয়ায় মরে যাচ্ছে তার জন্য কি এখন মানববন্ধন করতে বলিস তুই? শোন, বি প্রেকটিক্যাল। অতো মানবতা আসলে আমার নাই। কেউ ইচ্ছে করে মরে যেতে চাইলে তাকে আমি বড়জোর বুঝাতে পারি কিন্তু জোর করে বাঁচিয়ে রাখতে পারি না। তাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্বও আমার না। আমার দায়িত্ব নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা আর আমার ঠিকঠাক বেঁচে থাকার জন্য যাদের বেঁচে থাকা দরকার তাদের বেঁচে থাকতে সাহায্য করা। এর বাইরে কে মরছে, কে বাঁচছে আই ডোন্ট কেয়ার।’
শুভ্র ভাইয়ের কথায় আবারও বিভ্রান্ত হয়ে পড়লাম আমি। কোন কথাটা আলোচনার মূখ্য বিষয় ছিল তাই ভুলে গেলাম। কিছুক্ষণ আকাশ পাতাল চিন্তা করে বললাম,
‘ আপনি খুবই হৃদয়হীন নিষ্ঠুর একটা মানুষ। আর যায় হোক, কাজিন হিসেবে আমার প্রতি একটু হলেও সহানুভূতি থাকা উচিত আপনার। আমার মৃত্যুর কথাটা শুনেই মাটি চাপা দেওয়ার জন্য উতলা হয়ে যাওয়াটা বোধহয় ঠিক না। মানুষের মৃত্যুর খবরে খুশি হতে নেই। আমি মরে যাওয়ার আগে আম্মুকে বলব আপনাকে যেন আমার মৃত্যু সংবাদ না জানানো হয়। আপনার মতো নিষ্ঠুর মানুষ হাসতে হাসতে আমার জানাজায় অংশ নিবে তা আমি চাই না।’
শুভ্র ভাই ক্লান্ত গলায় বললেন,
‘ মানে কি? ফাজলামো হচ্ছে? তুই কি মাঝ রাতে মশকরা করতে ফোন দিয়েছিস আমায়? আমার মেজাজ এমনিতেই ব্যাপক খারাপ। এসব আউলফাউল কথা বলে মেজাজ খারাপ ভাবটা বাড়াস না, প্লিজ। নয়তো সিরিয়াসলি চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেব। মাথা পাগল মেয়ে।’
‘ আপনার মত একজন মানুষের জন্য আমি অলমোস্ট মারা যাচ্ছি তাতেই কষ্টে মরে যেতে ইচ্ছে করছে আমার।’
কথাটা বলেই ফোন কাটলাম আমি। ফোনটা পাশে রেখে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ তাসনিম আপুর ব্যথায় ব্যথিত হওয়ার চেষ্টা করলাম। চেষ্টা সফল হলো না। যে প্রতিনিয়ত আমার মৃত্যুকামনা করছে তার জন্য দুঃখের সাগরে হাবুডুবু খাওয়ার কোনো কারণ নেই। আচ্ছা?
আমি যদি তাসনিম আপুর জায়গায় থাকতাম তাহলেও কি এমনটাই করতাম? আমার ভোঁতা মস্তিষ্ক তুমুল প্রতিবাদ করলো, কক্ষনো না। আমি হয়তো ব্রেকআপের দিনই ঠাডিয়ে দুটো চড় লাগাতাম শুভ্র ভাইয়ের গালে। তারপর ধীরে ধীরে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করতাম কিন্তু তাসনিম আপু যা করছেন তা তো রীতিমতো পাগলামো। আচ্ছা? এই অসহ্য মহিলাটা কি মেন্টালি সিক? এই মহিলা কি প্রতিদিন দু’হাত তুলে বলে, রোদেলা তুমি এই মুহুর্তে মরে যাও? কি সাংঘাতিক! তাহলে কি আমার উচিত
‘ আমি মরব না। মরব না।’ বলে প্রার্থনা করা? আমার উলোটপালোট চিন্তার মাঝেই ফোন বাজল। আমি ফোনটা সাইলেন্ট করে ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলাম। একবার, দুইবার, তিনবার। ঠিকঠাক দশবারের মাথায় ফোন তুললাম আমি। এতো ধৈর্য্য সহকারে ফোন করে যাওয়া মানুষটি অত্যন্ত উচ্ছল গলায় বললেন,
‘ কি অবস্থা রোদপাখি? কেমন আছিস?’
কেমন আছি, মানে কি? একটু আগে মহিষের মতো আচরণ করে এখন আমার কেমন থাকা-না-থাকার প্রশ্নটা ঠিক কতটুকু যৌক্তিক বুঝতে পারছি না। এই লোকের সমস্যাটা কি? উনি কি কিছুক্ষণ আগের ব্যাপারটা ভুলে গেলেন? এটা কি শর্ট টাইম মেমোরি লস টাইপ ব্যাপার? আশ্চর্য!
‘ কি রে? কথা বলছিস না কেন? কি অবস্থা? ভালো? নাকি খারাপ?’
আমি থমথমে কন্ঠে বললাম,
‘ আমি আপনার সাথে কথা বলতে চাই না। আপনি এই মুহুর্তে ফোন কাটুন।’
শুভ্র ভাই স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,
‘ তোর ধান্দাবাজ বাপ কি ঘুমিয়ে পড়েছে? নাকি এখনও ভূতের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে?’
আমি শক্ত কন্ঠ বললাম,
‘ আপনি আবার বাবাকে টেনে কথা বলছেন! একদম বাবাকে নিয়ে বাজে কথা বলবেন না।’
‘ আচ্ছা যা। সুন্দর করে বলছি। তোর শ্রদ্ধীয়, নিষ্পাপ, নিষ্কলঙ্ক পিতা মহোদয় কি এখনও জেগে আছেন? নাকি ভূতগ্রস্তের মতো ঘরময় পায়চারি করছেন?’
আমি ফুঁসে উঠে বললাম,
‘ আপনি ফাজলামো করছেন? আমার বাবাকে নিয়ে মজা করবেন না বলে দিচ্ছি।’
শুভ্র ভাই ভারি ইনোসেন্ট কন্ঠে বললেন,
‘ এই যা! তুই তো ব্যাপক জিনিস রে রোদু। কত সুন্দর শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে প্রশ্ন করলাম। তুই সেই শ্রদ্ধাবোধটাকে একদম ফাজলামো বানিয়ে ফেললি? কাজটা একদম ঠিক করিস নি তুই। আল্লাহ কষ্ট পাবে।’
‘ আপনি খুবই খারাপ একজন মানুষ। সবসময় আমাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন। আমি আপনার সাথে কথা বলব না। আপনি ফোন রাখুন।’
শুভ্র ভাই বললেন,
‘ কথা বলতে হবে না। ছাঁদে আয়। আসার সময় এন্টিসেপটিক আর তুলো আনিস। হাতে পায়ে কেটে গিয়েছি। রক্ত পড়ছে।’
আমি বিস্মিত কন্ঠে বললাম,
‘ মানে কী? কোন ছাঁদের কথা বলছেন আপনি? আর রক্তই বা পড়ছে কেন?’
শুভ্র ভাই বিরক্ত গলায় বললেন,
‘ তুই অত্যন্ত বেশি প্রশ্ন করিস। অতিরিক্ত প্রশ্ন করা আমার পছন্দ না। ফোনে তো একদমই না। আমি তোদের ছাঁদে আছি, ছাঁদে আয়। গেইট বন্ধ। দেয়াল টপকাতে গিয়ে কাটাতাঁরে হাত-পা চিঁড়ে গেছে। তোর বাপ চরম বেয়াদব। এক নাম্বারের ধান্ধাবাজ। কি দরকার ছিল দেয়ালে কাঁটাতার দেওয়ার? সবকিছু আমাকে ঘিরে ষড়যন্ত্র।’
আমি রাগে ক্লান্ত গলায় বললাম,
‘ আবার বাবা! আপনার সমস্যাটা কোথায়? শখ করে দেয়াল টপকে হাত-পা কেটে বাবাকে দোষ দিচ্ছেন কেন? বাবা কি বলেছিল দেয়াল টপকাতে? আপনি জোরপূর্বক দেয়াল টপকেছেন। আপনাকে তো পুলিশে দেওয়া উচিত। এই মুহুর্তে থানায় ফোন দিব আমি।’
‘ তোর কাছে তো থানার নাম্বারই নেই গর্দভ। তোর মতো গর্দভের কাছে কখনোই থানা-পুলিশের নাম্বার থাকে না। এ্যাম্বুলেন্সের নাম্বারও থাকে না। তোদের ফোনলিস্ট ওলওয়েজ কিছু ইডিয়ট বন্ধুবান্ধবের মা, বাবা, বোন, চাচা, জ্যাঠা, চৌদ্দগোষ্ঠীর নাম্বারে বোঝাই থাকে।’
আমি অসহায় মুখ নিয়ে বসে রইলাম। শুভ্র ভাইয়ের কথাটা পুরোপুরি মিথ্যে না। আমার কাছে সত্যি সত্যিই থানা পুলিশের নাম্বার নেই। ফোনে থানার নাম্বার না থাকায় যদি কাউকে গর্দভ বলা যায়। তাহলে আমি নিঃসন্দেহে একটা গর্দভ। কথাটা ভেবে তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। শুভ্র ভাই হঠাৎই ভীষণ মায়া মায়া কন্ঠে বললেন,
‘ কোনো দয়া নেই না? এই যে আমার শরীর থেকে রক্ত পড়ে ভেসে যাচ্ছে তবু তুই তুলো টুলো নিয়ে ছুটে আসছিস না। অন্যকেউ হলে কিন্তু ঠিক আসতো। কি নিষ্ঠুর তুই।’
আমি কয়েক সেকেন্ড থমথমে মুখে বসে থেকে বললাম,
‘ আমি যাব না।’
শুভ্র ভাই হেসে বললেন,
‘ ঠিক তো? আচ্ছা।’
‘যাব না’ বলেও না গিয়ে থাকা গেল না। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক পায়চারী করে মস্তিষ্কের বিপক্ষে গিয়েও ছাঁদের দিকে পা বাড়াতে হলো। ডাইনিং এ থাকা ছাঁদের চাবিটা তুলে নিয়ে সাবধানী পায়ে বেরিয়ে গেলাম। শুভ্র ভাই ছাঁদের রেলিং-এ বসে রুমাল দিয়ে হাত বাঁধার চেষ্টা করছেন।
দরজা খোলার শব্দ শুনেই ফিরে তাকালেন। হাতদুটো পকেটে ঢুকিয়ে রেলিং থেকে নেমে দাঁড়ালেন। সাথে সাথেই কুঁচকে গেল তার চোখ-মুখ৷ আকাশে তখন বিশাল চাঁদ। চারদিকে ঘন কুয়াশার সাদা সাদা কুন্ডলী। ছাঁদের পাটাতনে বৃষ্টির ফোঁটার মতো ঝড়ে পড়ছে একটা দুটো শিশির ফোঁটা। শুভ্র ভাইয়ের গোছালো চুলগুলো নিয়ম মেনেই কেঁপে কেঁপে উঠছে।
চাঁদের চকচকে আলোয়, গোলাপী শার্ট পরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে পৃথিবীর বাইরের কেউ বলে বোধ হচ্ছে। একদম স্বচ্ছ, পবিত্র কেউ। শুভ্র ভাইয়ের এই বিস্ময়কর রূপ দেখতে দেখতে হঠাৎই মনে হলো, এই ছেলেটাকে না পাওয়ার দুঃখে বেদুইন হয়ে যাওয়ার ইচ্ছে জাগাটা দোষের কিছু নয়। মরে যাওয়ার ইচ্ছেটা তো আরো নয়। আমি কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন ছুঁড়লাম,
‘ এতো রাতে এখানে কেন এসেছেন? তাও আবার লুকিয়ে চুরিয়ে?’
শুভ্র ভাই অস্বস্তি নিয়ে তাকালেন। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে এদিক ওদিক উদাসী দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই তার বামগালের মোহনীয় গর্তটা চোখে পড়ল।
‘ হঠাৎ ভয় করছিল।’
আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,
‘ কিসের ভয়?’
শুভ্র ভাই চোখ ফিরিয়ে নিয়ে দায়সারা কন্ঠে বললেন,
‘ জানি না।’
‘ বাসায় ভয় পাচ্ছিলেন আর এখানে আসতে ভয় পেলেন না? রাস্তায় যদি ভূত টূত ধরত?’
শুভ্র ভাই প্রথম দফায় হতাশ চোখে তাকালেন। তারপর প্রচন্ড রাগ নিয়ে ধমকে উঠলেন। গলার স্বর খানিকটা নিচু করে বললেন,
‘ আমার জন্য অলমোস্ট মরে যাচ্ছিস মানে কি? কেন বললি সেই কথা?’
আমি জবাব দিলাম না। শুভ্র ভাই কয়েক পা এগিয়ে এলেন। প্রায় সাথে সাথেই জুতোই ল্যাপ্টে থাকা রক্তটুকু চোখে পড়ল আমার। আমি আৎকে উঠে বললাম,
‘ একি! আপনার পায়ে রক্ত। হাতও কেটেছে, না? রক্ত বন্ধ হয় নি? দেখি।’
শুভ্র ভাই সুন্দর করে হাসলেন। তার সুন্দর মুখটা মুহূর্তেই উচ্ছ্বাসে ভরে উঠল। ফোনের ফ্ল্যাশটা অন করে উনার পায়ের দিকে ঝুঁকে পড়ে বললাম,
‘ হাসছেন কেন? ব্যথা পেলে কেউ হাসে?’
শুভ্র ভাই আবারও হাসলেন। বললেন,
‘ মাঝে মাঝে ব্যথা পেতে ভালোই লাগে।’
আমি ভ্রু কুঁচকে উপরে তাকালাম,
‘ ব্যথা পেতে ভালো লাগে?’
‘ হ্যাঁ লাগে। এখন পায়ের ওপর ঝুঁকা ঝুঁকি না করে উঠে দাঁড়া। তোর সাথে কথা আছে। কথাটা বলে চলে যাব। জলদি।’
আমাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে পকেট থেকে হাত বের করে কয়েক গাছি চুল টেনে ধরলেন। আমি ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে বাধ্য হয়েই উঠে দাঁড়ালাম। নিজের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে মুখ ফুলিয়ে তাকালাম। শুভ্র ভাই ভ্রু নাচিয়ে বললেন,
‘ কাহিনী কি? আমার জন্য মরে যাচ্ছিস মানে কি?’
তারপর হঠাৎই খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে চোখ বড়বড় করে বললেন,
‘ এই? কোনভাবে তুই আমার প্রেমে টেমে পড়ে যাস নি তো? কি সাংঘাতিক! প্রেমে পড়ে সুইসাইড করতে চাইছিস? তোর বাপ তো আমায় জেলে দিয়ে দিবে রে।’
কথাটুকু বলে খানিকক্ষণ আকাশ-পাতাল চিন্তা করলেন শুভ্র ভাই। তারপর সিরিয়াস মুখভঙ্গি নিয়ে একরকম ফিসফিস করেই বললেন,
‘ শোন, সুইসাইড যেহেতু করবিই তাহলে যেনতেন উপায় অবলম্বন করে লাভ নেই। খুব ইউনিক কিছু চিন্তা করতে হবে, বুঝলি? যাতে সুইসাইড করার পর পরই সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোরণ পড়ে যায়। ধর, মরতে মরতে সেলিব্রিটি বনে গেলি। ব্যাপারটা দারুণ না? আর শোন, সুইসাইডের আগে কাগজে বড় বড় করে লিখে যাবি, ” আমার অাত্মহত্যার জন্য কেউ দায়ী নয়। ব্লা ব্লা ব্লা।” নয়তো…’
আমি হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইলাম। বিস্ফারিত কন্ঠে বললাম,
‘ আপনি হাত-পায়ে রক্ত ঝরিয়ে, এই এতো রাতে আমাকে সুইসাইড করার ক্লাসিফিকেশন জানাতে এসেছেন শুভ্র ভাই? সত্যিই? আমি জাস্ট বিশ্বাস করতে পারছি না।’
‘ আশ্চর্য! তুই ফোন করে বললি মরে যাবি। তাও আবার আমার জন্য। তুই ঠিকঠাক মরতে পারছিস কিনা সেটা দেখার দায়িত্বটা তো আমার, নাকি?’
রাগে সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল আমার। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
‘ আপনাকে কোনো দায়িত্ব দেখাতে হবে না শুভ্র ভাই। আপনার মতো হার্টলেস মানুষের জন্য সুইসাইড করার মানেই হয় না। সবাই কী আর আপনার প্রাক্তোনের মতো পাগল নাকি? নিজে সুইসাইড করছে তো করছে আবার আমাকেও মরে যেতে বলছে। আশ্চর্য!’
শুভ্র ভাই এবার সরু চোখে তাকালেন। চোয়াল শক্ত করে বললেন,
‘ তোকে মরে যেতে বলছে, মানে? তাসনিম কি তোকে সুইসাইড করার জন্য কুমন্ত্রণা দিচ্ছে নাকি? আশ্চর্য! তুই ওর কথা শুনছিস কেন? ওর যদি কোনো সমস্যা থেকে থাকে তাহলে সেটা আমার সাথে। তোর সাথে ওর যোগাযোগ থাকবে কেন?’
কথা বলতে বলতেই চোখ-মুখ শক্ত হয়ে এলো শুভ্র ভাইয়ের। ফর্সা মুখটা ঝাপসা অন্ধকারেও হয়ে উঠল টকটকে লাল। শুভ্র ভাই হেঁচকা টানে ডানহাতটা পেছন দিকে চেপে ধরে আমার দিকে তাকালেন। রাগে তার কন্ঠ কাঁপছে। সেই কম্পিত কণ্ঠেই বলে উঠলেন,
‘ ওর সাথে তোর যোগাযোগ কেন থাকবে? ওর কথায় মরার শখ জাগছে তোর? এতো সহজ মরে যাওয়া? প্রত্যেকটা মানুষ সারাটাক্ষণ বুক দিয়ে আগলিয়ে রাখছে তোকে। ভালোবাসছে। আর তুই বাইরের মানুষের কথায় নাচছিস? এতো মরার শখ? চল, আজ তোকে জ্যান্ত মাটিচাপা দিয়ে আসব আমি।’
ততক্ষণে ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এসেছে আমার। শুভ্র ভাইকে আমি যথেষ্ট চিনি। উনার রাগ মানেই ধ্বংসাত্মক কিছু। আমি কাতর চোখে শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকালাম। উনার দানবীয় হাতজোড়ায় আটকে থেকে প্রায়শই আমার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যাওয়ার জোগার। আমি উনার চোখে চোখ রেখেই বিপন্ন গলায় বললাম,
‘ আমি মরে যাব কখন বললাম? আমি দোয়া করি যেন আমি একশো বছর বাঁচি। শুধু একশো না প্রয়োজনে পাঁচশ বছর বাঁচব। আমার বেঁচে থাকতে কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা তো তাসনিম আপুর। উনি চান আমি মারা যাই কিন্তু আমি চাই না আমি মারা যাই। উফ! আমি আপনাকে ব্যাপারটা বুঝাতে পারছি না। একটু ছাড়ুন। দমবন্ধ লাগছে আমার। আপনি এভাবে ধরে রাখলে পাঁচশ বছর তো দূর পাঁচ মিনিটও বেঁচে থাকতে পারব কিনা সন্দেহ।’
শুভ্র ভাই আমাকে ছেড়ে দিলেন। আমি শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে নিজের হাতের দিকে তাকালাম। কব্জির ওপর নিশ্চয় দাগ বসিয়ে দিয়েছে এই লোক? অন্ধকারে হাতের ছাপটা দেখতে না পেলেও কব্জির ওপর উনার হাতের চটচটে রক্তের অস্তিত্ব ঠিকই টের পেলাম। শুভ্র ভাই ফুঁসে উঠে বললেন,
‘ তাসনিম কি বলেছে তোকে? ও চাই মানে কি? ও এমনটা চাইবে কেন? তুই ওকে কি করেছিস?’
‘ আমি কিছুই করি নি। যা করার আপনি করেছেন। আর কে কি চাইবে তা তো আর আমাদের হাতে নেই। তিনি আমার মৃত্যু চাইতেই পারেন। এটা সম্পূর্ণই তার ব্যাপার।’
শুভ্র ভাইয়ের মুখ আরো খানিকটা শক্ত হলো। তিনি থমথমে গলায় বললেন,
‘ এটা কখনোই সম্পূর্ণই ওর ব্যাপার নয়। ও এমন ফলিস কিছু চাইতে পারে না। আর যা করার আমি করেছি, মানে কি? কি করেছি আমি? সেই নয় বছর আগে, সাত দিনের প্রেমের জন্য এতোটা কাহিনী করার কি আদৌ কোন মানে আছে? আমি তাকে বাজে ভাবে টাচ করি নি, চুমু খাই নি, তার সাথে ঘুমাইও নি। পাঁচ মিনিটের জন্য হাত ধরেছিলাম হয়ত। তবুও শুধু ধরতে হয় বলেই ধরা। অথচ তার ভাব দেখে মনে হচ্ছে আমি তার সর্বনাশ করে দিয়েছি। চরম নাটকবাজ মেয়ে একটা। ছোটবেলায় ওকে চড় লাগিয়েছি বেশ করেছি। আরো দুটো দেওয়া উচিত ছিল।’
উনার কথায় ফিক করে হেসে উঠলাম আমি। উনার চোখে-মুখে বাচ্চামো অভিমান। আমাকে হাসতে দেখে কথা থামিয়ে গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন। কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ তাকিয়ে থেকে দুই পা এগিয়ে একদম কাছাকাছি এসে দাঁড়ালেন। বিরবির করে কিছু একটা বললেন। তারপর আমার শরীরে পরপর তিনবার ফু দিলেন। উনার কাজে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলাম আমি। কৌতূহল নিয়ে বললাম,
‘ বিরবির করে কি বললেন? ভূত তাড়ানোর সূরা? আপনি কি ভয় পাচ্ছেন?’
শুভ্র ভাই ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। পরমুহূর্তেই হেসে ফেলে বললেন,
‘ তোর মতো বলদ এই দুনিয়ায় দুটো আছে বা থাকতে পারে তা আমি বিশ্বাস করি না। আল্লাহ রোদপাখি নামক বলদ একটাই বানিয়েছেন। একদম ওয়ান পিস।’
আমি কিছু বলতে গিয়েও বললাম না। চোখ-মুখ ফুলিয়ে বামহাতে থাকা মেডিসিনের বাক্সটা এগিয়ে দিয়ে বললাম,
‘ এই নিন আপনার এন্টিসেপটিক আর তুলো।’
শুভ্র ভাই বললেন,
‘ প্রয়োজন নেই।’
তার কন্ঠে কোথাও একটা অভিমানের সুর এসে ধাক্কা দিয়ে গেল। আমি উনার ডানহাতটা টেনে নিলাম। ডানহাতের এক জায়গায় বাজেভাবে কেঁটে গিয়েছে। অন্যহাত চোটহীন। আমি আরো একপা এগিয়ে গিয়ে এন্টিসেপটিক আর তুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
বেশ কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম শুভ্র ভাই আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তার চোখের ভাষা ভিন্ন। আমার মাথায় চট করেই গোলাপের পাতায় পাতায় লেখা ওই বাক্যটা খেলে গেল। আমি ধুরু ধুরু মনে হাতে ব্যান্ডেজ লাগালাম। কাজ শেষে যখন সরে আসার চেষ্টা করলাম ঠিক তখনই উপলব্ধি করলাম আমি আগে থেকেই শুভ্র ভাইয়ের বাহু বেষ্টনীতে আবদ্ধ।
শুভ্র ভাইয়ের অন্যরকম দৃষ্টিটা তখন আমার চোখে-ঠোঁটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শুভ্র ভাই মাথাটা নিচু করতেই পিলে চমকে উঠল আমার। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতেই এক ঝটকায় চোখ বন্ধ করলাম। শুভ্র ভাইয়ের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস নাকে-মুখে এসে ঠেকল। আর তপ্ত ঠোঁটদুটো এসে ঠেকল কপালে। কপালে গভীর এক চুমু দিয়ে মোহনীয় কন্ঠে আবৃত্তি করলেন,
‘ জানি শুধু তুমি আছ তাই আছি
তুমি প্রাণময় তাই আমি বাঁচি,
যতো পাই তোমায় আরো ততো যাচি
যতো জানি ততো জানি নে।’
শুভ্র ভাইয়ের কন্ঠ সবসময়ই সুন্দর, প্রাণোবন্ত। কিন্তু এই কবিতাটা আরো বেশি প্রাণোবন্ত লাগল আমার কানে। লজ্জায় মুখে লালাভ রঙ ছড়ালো। আমি চোখ মেলে তাকাব এমনটা সিদ্ধান্ত নিতেই ডানগালে তপ্ত ঠোঁটের স্পর্শ পেলাম। আমি চমকে উঠলাম। আমার শরীরের ওপর থেকে সরে দাঁড়াল সেই ছায়া মূর্তি। পরমুহূর্তেই অসহ্য সুন্দর কন্ঠস্বরটা ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,
‘ শ্যামবতীকে ঘিরে থাকা হাজারও বদদোয়া গুলো শুভ্র চাদরে ঢাকা পড়ুক। হৃৎস্পন্দনের তালে তালে স্পন্দিত হওয়া পবিত্র দোয়াগুলো পৃথিবীর সবচেয়ে দামী পাখিটির নামে লেখা হোক। আমার প্রাণভোমরার ছোট্ট শরীরটিতে নজর না লাগুক। পৃথিবীর সবটা সুখ শুধু তার খামেই লেখা হোক। আমিন।’
আমি বিস্ময় নিয়ে চোখ মেলে তাকালাম। ততক্ষণে শুভ্র ভাই রেলিং পেরিয়ে নেমে গিয়েছেন আম গাছের ডালে। সেখানে থেকে চোখের পলকেই দেয়াল টপকে শূন্য রাস্তায়। আমি দৌঁড়ে গিয়ে ছাঁদের রেলিং ধরে দাঁড়ালাম। গোলাপী শার্ট গায়ে আশ্চর্য সুন্দর ছেলেটি হালকা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। শার্টের হাতা ভাঁজ করে রাখা ডানহাতের কব্জিটিতে সিলভার রঙের ঘড়িটা চকচক করছে। আমার মনের কোথাও একটা শীতল শিহরণ বইছে। নদীর কূলকূল ধ্বনির মতো নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে বলে চলেছে,
‘ শুনছো রোদপাখি? তোমার অদ্ভুত এই পৃথিবীতে পাগলাটে এক শুভ্র আছে। তোমার এক পৃথিবী দুঃখ, ভয়, সংকোচগুলো তার ভয়ে সর্বদা তটস্থ। যার এমন এক পুরুষ আছে তাকে কি মানুষের ধ্বংসাত্মক চাহনীগুলো এক বিন্দুও ছুঁতে পারে?’
আমার ঠোঁটের কোণে অজান্তেই এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে। অগোছালো মনটা মাথা চাড়া দিয়ে বলে,
‘ নাহ্। কক্ষণো না।’
#রোদবালিকা….
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/rodsuvro/