রোদ শুভ্রর প্রেমকথন পর্ব ৪৮
#লেখনী- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
আকাশের কোণে মেঘ জমেছে। ভীষণ কালো, আষাঢ়ে মেঘ। সেই সাথে মেঘ জমেছে আমার মনেও। গুমট আকাশে বৃষ্টি নামার পূর্বাবাস দিয়ে চারপাশটা নীরব, নিস্তব্ধ। এই মিথ্যে পৃথিবীর ছলাকলাময় নির্লজ্জ মানুষদের দ্বারা ত্যক্ত, বিরক্ত আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। বুকের ভেতর উথলে উঠল কান্না। চোখ দুটোতে খেলে গেলো নিদারুণ অসহায়ত্ব। অন্ধকারে ঢাকা সুপ্ত মনটা কোথাও একটা নির্ভরতা খুঁজতে লাগল। বুকে মাথা রেখে কাঁদার জন্য শক্ত, প্রশস্ত একটা বুক খুঁজতে লাগল। এমন সময় পেছনে এসে দাঁড়াল দীর্ঘকায় একটি ছায়া। নাকে এসে লাগল সেই চির পরিচিত সুগন্ধ। বুকের ভেতর পুষে রাখা কান্নাগুলো মুহূর্তেই বাঁধনহারা হয়ে উঠল। আমি দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলাম। পেছনে থাকা মানুষটি ধীর পায়ে পেছনে এসে দাঁড়াল। শীতল হাতজোড়া দিয়ে কোমর জড়িয়ে ধরে অত্যন্ত ঠান্ডা গলায় বললেন,
‘ মন খারাপ? ‘
আমি অভিমানী কন্ঠে বললাম,
‘ আপনি আসেন নি। এই যে আমার সাথে দাঁড়িয়ে আছেন এটা শুধুই আমার কল্পনা। তাই না?’
তিনি হাসলেন। বললেন,
‘ হ্যাঁ তাই।’
‘ আপনি চলে যান। কাল্পনিক আপনাকে আমার সহ্য হচ্ছে না।’
আমার কথার জবাবে হাতের বাঁধন আরও খানিকটা শক্ত করলেন তিনি। অত্যন্ত নরম গলায় বললেন,
‘ উহুঁ। যাব না। সহ্য না হলেও যাওয়া যাবে না। তোমার কী হয়েছে বলো? কাঁদছ কেন?’
‘ আপনি আমায় ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করছেন কেন? আপনি তো আমায় ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করেন না কখনো।’
শুভ্র ভাই আমার খোলা চুলে মুখ ডুবালেন। শান্ত কন্ঠে বললেন,
‘ কখনো ‘তুমি’ সম্বোধন করি না কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। চিঠি,ক্ষুদে বার্তা আর বিশেষ মুহূর্তে আমি তোমাকে তুমি বলেই সম্বোধন করি। তুমি খেয়াল করো নি বলে জানো না।’
‘ এখন কি কোনো বিশেষ মুহূর্ত?’
‘ উহুঁ। এখন কল্পনা। আমি তোমাকে কল্পনাতেও তুমি সম্বোধন করি রোদপাখি। তুমি বারবার ভুলে যাচ্ছ কেন বুঝতে পারছি না।’
আমি উদাস চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম, জবাব দিলাম না। শুভ্র ভাই নড়েচড়ে বেশ আয়েশ করে জড়িয়ে ধরে প্রলম্বিত দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। আমার ডান কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে বললেন,
‘ লাল শাড়িতে সুন্দর লাগছে। একদম পরীদের মতো সুন্দর। পরীরা সবার চোখে পরী হলেও তুমি আমার ব্যক্তিগত পরী। আমার রোদপরী।’
আমি হাসলাম। ঘুরে উনার দিকে ফিরে তাকালাম। শুভ্র ভাই শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়ালেন। তার হাতদুটো এখনও আমার কোমরে আবদ্ধ। গভীর, শান্ত চোখদুটো মেলে আমাকে দেখছেন। বলিষ্ঠ গায়ে বাদামী রঙের পাঞ্জাবি। হাতাদুটো কনুই পর্যন্ত গোটানো। গালে ছোট ছোট দাড়ি। গায়ের ফর্সা রঙটা ঠান্ডায় মিষ্টি গোলাপি। থুঁতনির কাছের তিলটা ঘন কালো। আমি নিবিষ্ট চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে দুহাতে উনার গলা জড়িয়ে ধরলাম। অকপট কন্ঠে বললাম,
‘ আমি আপনাকে মিস করছিলাম খুব।’
উনি চমৎকার একটা হাসি দিয়ে বললেন,
‘ আমি হয়তো বুঝতে পারছিলাম।’
‘ জানেন? আমার ভীষণ মন খারাপ। আমার মন খারাপ হলেই আপনার কথা মনে পড়ে। আপনি ছাড়া অন্য কেউ আমার মন ভালো করতে পারে না।’
‘ কেন মন খারাপ? কেউ কিছু বলেছে?’
‘ বললে কি করবেন? মারবেন তাকে?’
এবারে শব্দ করে হেসে উঠলেন শুভ্র ভাই। কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো ফুঁ দিয়ে সরিয়ে নিয়ে বললেন,
‘ তোমার কী ধারণা? আমি যাকে তাকে ধরে মাইর লাগাই?’
আমি জবাব দিলাম না। শুভ্র ভাই আমার মাথাটা বুকে টেনে নিয়ে বললেন,
‘ সবসময় মাইর লাগানোর জন্য আমি থাকব না। সব মানুষ সারা জীবন থাকেও না। তাই বলে রোদ্রাণীকে উদাস হওয়া চলবে না। দুঃখী হয়ে ভেঙে পড়াও চলবে না। পৃথিবীতে অনেক নিচু মনের মানুষ আছে যাদের কাজই হলো অন্যের গাঁয়ে কাঁদা ছুড়ে অন্যকে কুলষিত করা, অপদস্ত করা। তাদের লোকলজ্জা নেই। ভয় নেই। তাদের সাথে তর্ক-বিতর্ক করেও লাভ নেই। তাই বলে এই নিয়ে মন খারাপ করে, কেঁদে কেটে নিজেকে পরাজিত আর একা ভাবতেও নেই।’
আমি নীরবে তার কথা শুনছিলাম। তার
বুকের ধুকপুক শব্দ, শরীরের উষ্ণতা আর মাদকীয় গন্ধে ব্যকুল হয়ে তার স্পষ্ট সুন্দর বাক্যগুলো শুনতে ভালো লাগছিল। তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে গভীর নিঃশ্বাস ফেললেন। কয়েক সেকেন্ড নীরব থেকে বললেন,
‘ যখনই খুব মন খারাপ হবে। পরিস্থিতিটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে মনে হবে। একদল বিশ্রী মানসিকতার মানুষের সামনে অপদস্ত আর ক্ষত বিক্ষত হয়ে নিজেকে অসহায় মনে হবে। তখন ভাববে তুমি একা নও। তোমার সাথে স্বয়ং আল্লাহ আছেন। এই ঘটনাপ্রবাহগুলোর পেছনেও শক্ত কোনো কারণ আছে। এই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এবং সুন্দর সত্য কী জানো? এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সত্য হলো আমাদের সৃষ্টিকর্তা। পৃথিবীর কোথাও এমন কোনো ঘটনা ঘটে নি যা আল্লাহ জানতেন না বা তার পেছনে আল্লাহর কোনো সুদৃঢ় পরিকল্পনা বা ইচ্ছে ছিল না। আমাদের সাথে যা ঘটে, যেভাবে ঘটে সবই আল্লাহর ইচ্ছের ওপর নির্ভর করেই ঘটে।
আর যা আল্লাহর ইচ্ছেতে ঘটে তা কি কখনো অভিশপ্ত হতে পারে? অসহায়ত্ব বহন করতে পারে? আমার তো মনে হয় না। তাই অপ্রিয় কোনো ঘটনা ঘটলেই তাতে মন খারাপ করা উচিত নয়। পরিস্থিতিটা যেহেতু আল্লাহর ইচ্ছেতেই সৃষ্টি হয়েছে। এর সমাধান বা মুক্তিও আল্লাহর ইচ্ছেতেই হবে। আল্লাহ কখনো তাঁর বান্দার জন্য অমঙ্গলকর কোনো ঘটনা ঘটান না। কিছু কিছু ঘটনা অপ্রিয় থাকে সত্যি কিন্তু সেই সকল ঘটনার পেছনেও লুকিয়ে থাকে সুন্দর কোনো শিক্ষা বা মঙ্গলকর কোনো প্রাপ্তি। তাই আমাদের উচিত কি বলো তো?’
আমি বড় বড় চোখ মেলে জিগ্যাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। শুভ্র ভাই চোখ নামিয়ে আমার চোখের দিকে তাকালেন। মৃদু হেসে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বললেন,
‘ আমাদের উচিত ভালো কিছুর জন্য অপেক্ষা করা এবং নিজ জায়গায় সৎ এবং স্বচ্ছ থাকার চেষ্টা করা। ব্যস, তাহলেই দেখবে জীবনটা মুহূর্তেই ভাবনাতীত সুন্দর হয়ে উঠেছে। দুই-একটা অপ্রীতিকর কাজ আর অপ্রীতিকর মানুষের জন্য ছোট্ট সুন্দর জীবনটার গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো মন খারাপ করে নষ্ট করার কোনো মানে আছে, বলো? মনে রেখো, দুষ্কৃতিকারীরা কখনোই বেশিদূর এগোতে পারে না। আর রোদ্রাণীদের এভাবে হা-হুতাশ করাটাও মানায় না। বি স্ট্রং মাই লেডি।’
আমি বুক ভরে শ্বাস নিলাম। হঠাৎ করেই খেয়াল করলাম আমার মনের কালো মেঘগুলো আর নেই। মনটা ঝরঝরে দুপুরের মতো রৌদ্রজ্জল। শুভ্র ভাই এবার কপাল কুঁচকে তাকালেন। আমার মুখের দিকে খানিক তাকিয়ে থেকে বৃদ্ধাঙ্গুলের কিনারা দিয়ে ছড়িয়ে যাওয়া কাজল মুছতে মুছতে বললেন,
‘ ইশ! কেঁদেছ নাকি? কার এতো বড় সাহস তোমাকে কাঁদাল? নাম বলো। এবার সত্যি সত্যিই মাইর লাগাব।’
আমি হেসে ফেললাম। আঙ্গুলের কিনারায় লেগে থাকা কাজলটুকু আমার ঘাড়ে চুলের আড়ালে লাগাতে লাগাতে তপ্ত চুমু খেলেন কপালে। সুখী সুখী কন্ঠে বললেন,
‘ মাশাআল্লাহ! এই হাসিটাই তো চাই। এই হাসিটার জন্য হাজারটা দুনিয়াও কুরবান।’
আমি আবারও মুখ ফিরিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়ালাম। মাথার উপর থাকা বিশাল আকাশটির দিকে তাকিয়ে মুখ ফুলিয়ে শ্বাস নিলাম। মেঘলা আকাশে গুটিকয়েক পাখি উড়ছে। মুক্ত হাওয়ায় ডানা মেলে তাদের কত আনন্দ। কত সুখ। চারপাশে ধোঁয়ার মতো কুয়াশা হানা দিচ্ছে। স্বচ্ছ বিকেলে ধীরে ধীরে নেমে আসছে সন্ধ্যা। বাড়ির সামনের পাকা রাস্তাটা ধরে ছুটে চলেছে ফেরিওয়ালাদের দূরন্ত সাইকেল। সাইকেলে বাঁধা হরেক রঙের খেলনা আর সিসার হাঁড়ি-পাতিলের পসরা। আমি ডানহাতে আঁচল টেনে পিঠ ঢাকার চেষ্টা করলাম। ঠিক তখনই খেয়াল করলাম শুভ্র ভাই নেই। তবে তার গায়ের সুগন্ধটা আছে। আঁচলের পাশে পেঁচিয়ে রাখা তাজা বেলীফুলের মালাটা এখনও সুগন্ধ ছড়াচ্ছে। কিন্তু, কোথা থেকে এলো এই মালা? এই তীব্র সুবাস? আমার ভাবনার মাঝেই আকাশ বাতাস আলোড়িত করে বেজে উঠল সুমধুর আহ্বান, ‘আল্লাহু আকবার’ ‘আল্লাহু আকবার’। রাফিয়া সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে ডেকে বলল,
‘ এই রোদু? সন্ধ্যায় ছাঁদে কি করিস? জলদি নিচে আয়। শুভ্র ভাই এসেছেন । সাথে মামানির বানানো একগাদা পিঁয়াজু আর সমুচা এনেছেন। সব শেষ হয়ে গেল। জলদি আয়।’
আমি চমকে উঠে সিঁড়ি ঘরের দিকে তাকালাম। শুভ্র ভাই এসেছেন? কিন্তু কিভাবে? উনার তো মাস্টার্সের এক্সাম চলে। দুই সপ্তাহ আগেই গেলেন চট্টগ্রাম। আজই ফিরে এসেছেন? রাফিয়া আবারও ডাকল,
‘ কি রে রোদু এলি না? জলদি আয়। জেঠিমণি বকছে।’
শাড়ির আঁচলে পিঠ ঢেকে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালাম আমি। একহাতে শাড়ির কুঁচি অন্যহাতে বেলীফুলের মালা ধরা। মাথায় ধোঁয়াশা এক চিন্তা। একটু আগে ঘটে যাওয়া সময়টুকু কী সত্যিই কল্পনা? নাকি বাস্তব? আর এই বেলীফুলের মালা? সিঁড়ির গোঁড়ায় দাঁড়িয়ে ছিলেন শুভ্র ভাই। গায়ে বাদামী রঙের পাঞ্জাবি। আমার চোখে বিস্ময়। ভাইয়ার সাথে গল্পে মশগুল শুভ্র ভাই বেখেয়ালি দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। চোখ কপালে তুলে অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সাথে বললেন,
‘ যখন তখন শাড়ি পরে ঘুরঘুর করিস, ব্যাপার কি? রাহাত ভাই? তোমার বোনের মতিগতি কিন্তু ঠিক নাই। সদ্য প্রেমে পড়া টাইপ বিহেভিয়ার। ছকিনার মার শুধু ছুক ছুক স্বভাব।’
ভাইয়া হেসে ফেলল। শুভ্র ভাইয়ের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল,
‘ চলো ভেতরে যাই। রাতের বাসেই ফিরছ নাকি আবার? ঠিকঠাক একদিনও থাকতে পারলে না। এসে কি লাভ হলো?’
শুভ্র ভাইয়ের সহজ উত্তর,
‘ গোটা ময়মনসিংহটাই বোধহয় আমায় মিস করছিল রাহাত ভাই। হাজার হলেও প্রিয়তমা শহর আমার। তার ইচ্ছে পূরণের দায়িত্ব তো আমারই। তাই ব্যাগ উঠিয়ে চলে এলাম। প্রিয়তমার মন ভরলো এবার ফেরার পালা।’
ভাইয়া হেসে উঠলো। শুভ্র ভাই আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে মাদক হাসলেন। সাথে সাথেই বুকের ভেতর ছলকে উঠলো রক্ত। চারপাশটা ভরে উঠলো তীব্র শিউলি ফুলের সুগন্ধে। সুপ্ত মনটা মাথা চাড়া দিয়ে বলল, ‘ প্রিয়তমার মনটা এবার সত্যিই ভরলো। হাজারও মন খারাপ আর অসহায়ত্ব প্রিয়তমের শুভ্র চাঁদরে ঢাকা পড়লো। বেঁচে থাকাটা আরও একবার অদ্ভুত সুন্দর হয়ে উঠল!’ আহা! পৃথিবীটা সত্যিই বড্ড সুন্দর। এই সুন্দর পৃথিবীতে নোংরা মানুষদের ভেবে সময় কাটানোর সময় কই? নেই! কোথাও নেই!
# রোদবালিকা
[ খাপছাড়া লাগছে? আগের পর্বের সাথে মিল পাচ্ছেন না? প্রেমকথন আসলে এমনই হয়। কখনো খাপছাড়া, কখোনো ছোট, কখনো বড়। ]
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/rodsuvro/