রোদ শুভ্রর প্রেমকথন পর্ব ৪৯
#লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
শোবার ঘরের মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে আছি। বুকের ভেতর আবদ্ধ হৃদপিণ্ডটা ভীত হরিণীর মতো লাফালাফি করছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। খিঁচে বন্ধ করে রাখা চোখদুটোর একটি খুলে ক্ষ্যাপা মা জননীকে দেখার চেষ্টা করলাম আমি। আম্মু রক্তলাল চোখে তাকিয়ে আছেন। রাগে তার ছোটখাটো শরীরটা মৃদু কাঁপছে। আম্মুর অগ্নিমূর্তি দেখে এই ঠান্ডাতেও হাত-পায়ে ঘাম দিচ্ছে আমার। কিছুক্ষণ ঠোঁটে ঠোঁট চেপে দাঁড়িয়ে থেকে ঢোক গিললাম আমি। অনুযোগের স্বরে বললাম,
‘ আম্মু…’
সাথে সাথেই গর্জে উঠলেন আম্মু। কিছুক্ষণ আগেই বাবার সাথে বিশ্রী ঝগড়া হয়েছে আম্মুর। আর সেই দূর্দশাময় সময়েই আম্মুর হাতে পড়েছে শুভ্র ভাইয়ের দেওয়া শাড়ি, চুড়ি, দুল। পরিস্থিতিটা প্রতিদিনের মতো স্বাভাবিক হলে মা হয়তো ব্যাপারটা ততটা খারাপভাবে নিতেন না। কিন্তু এখন নিচ্ছেন। সেই সাথে আমার জান বেরিয়ে যাচ্ছে। বাড়িভর্তি মানুষ। আম্মুর চিল্লাচিল্লিতে কত বিশ্রীভাবেই না প্রকাশ পাবে ব্যাপারটা। মান-সম্মানের আর কিছু বাকি থাকবে না। আম্মুর ধমকে আরও একদফা কেঁপে উঠলাম আমি।
‘ কী? কথা নেই কেন মুখে? কে দিয়েছে এসব? তোদের কী এসব করার জন্য বড় করেছি? এসব শিখেছিস আমার থেকে? তোর বাবা ঠিকই বলে, উচ্ছের ঝাড় আমি। আমার শিক্ষা খারাপ। এইজন্যই তো আমার মেয়েরা এতোটা নীচে নেমে গিয়েছে। এই বয়সে প্রেম করে বেড়াচ্ছে। বড়টা তো ছিলই এখন ছোটটাও। লজ্জা করে না তোর?’
কথাটা বলেই হাতের কালো শাড়িটা ছুঁড়ে ফেললেন আমার গাঁয়ে। আমি অসহায় কন্ঠে বললাম,
‘ এভাবে বলছ কেন আম্মু। বিশ্বাস করো, আমি এসব কিছু করি নি। বিশ্বাস করো।’
আম্মু গর্জে উঠে বলল,
‘ বিশ্বাস করব? চোখের সামনে প্রমাণ পেয়ে বিশ্বাস করব? আচ্ছা যা। বিশ্বাস করলাম। তাহলে বল এই জিনিসগুলো কই পাইছিস? বল শুনি। আমি তো কিনে দিই নি।’
আমি হতাশ চোখে তাকালাম। বিপন্ন কন্ঠে বললাম,
‘ এ এগুলো তো আপু… আপু কিনে দিয়েছিল।’
আপু ঘরের এক কোণায় দাঁড়িয়ে ছিল। আমার কথায় চমকে আমার দিকে তাকাল। পরমুহূর্তেই মাথা নাড়িয়ে মৃদু কন্ঠে বলল,
‘ হ্যাঁ। আমিই কিনে দিয়েছিলাম। আসলে…’
আপু কথাটা শেষ করার আগেই শক্ত চড়ে গাল লাল হয়ে গেল আমার। আম্মু রাগে ফুঁসে উঠে বাক্সে থাকা চিরকুটগুলো ছুঁড়ে ফেললেন মেঝেতে। আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আপুও মাথা নিচু করল। আম্মু বাঘিনীর মতো গর্জন তুলে বললেন,
‘ এই চিঠিগুলোও তুই দিয়েছিস? আমার সাথে মিথ্যা? তোরা আর কত মিথ্যা লুকিয়েছিস আমার থেকে?’
ভয়ে হাত-পা কাঁপছে আমার। শুভ্র ভাই এখন শহরে থাকলে এতো কাহিনী হয়তো ঘটতো না। আর ঘটলেও এতোটা বাজেরূপ নিত না। শুভ্র ভাইয়ের কাছে অদ্ভুত এক ম্যাজিক আছে। সেই ম্যাজিকটা মুহূর্তেই পরিস্থিতি সামলে নিতে পারে। সামলে নিতে পারে আমাকেও। আমাকেও! শব্দটা মাথায় বার বার ঘুরতে লাগল। আম্মু চোখ-মুখে রাগের ঝিলিক ফুটিয়ে তুলে বললেন,
‘ তোর কী টাকা-পয়সার আহাল পড়ছিল? আমাকে বা তোর বাপকে বললে কিনে দিত না এসব? অন্যের থেকে নিতে হবে কেন? তোর বাপ কী ফকির?’
আমি প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে বললাম,
‘ তুমি ব্যাপারটাকে খুব বিশ্রীভাবে নিচ্ছ আম্মু। আমি আমার প্রয়োজনীয়তার জন্য নয়…’
এটুকু বলতেই আরও একটা শক্ত চড়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি। আম্মু দক্ষ গোয়েন্দার মত প্রশ্ন করলেন,
‘ ছেলেটার নাম কী? কী করে?’
আমি মুখে কুলুপ এঁটে দাঁড়িয়ে রইলাম। আম্মু হুঙ্কার দিয়ে বললেন,
‘ নাম জিগ্যেস করেছি আমি। নাম কী ছেলের?’
আমি কেঁপে উঠে বললাম,
‘ নাম দিয়ে কী করবে?’
আম্মু চিঠি আর চিরকুটগুলো ভালো করে ঘেঁটেও পত্রপ্রেরকের কোনোরূপ নাম ধাম খুঁজে পেলেন না। আম্মুর রাগ আকাশ ছুঁলো। উত্তপ্ত কন্ঠে বললেন,
‘ আত্মসম্মানহীন মেয়ে। মুখে মুখে কথা বলছিস, লজ্জা করছে না? একে তো বাজে সম্পর্কে জড়িয়েছিস তারওপর এতোগুলো জিনিস নিয়েছিস। ছিঃ! একটাবারের জন্যও নিজের আত্মসম্মানে লাগে নি? আমার মেয়ে হয়ে এতোটা বেহায়া কিভাবে হলি তুই?’
আম্মুর কথাটা যেন শূলের মত বিঁধল আমার মনে। মস্তিষ্কের ভেতর হাতুড়ির মতো পেটাতে লাগল প্রতিটি শব্দ। সুপ্ত কিন্তু প্রগাঢ় আত্মসম্মানবোধটা প্রবল নাড়ায় বিক্ষিপ্ত করে দিল আমাকে। আমি চমকে উঠলাম। মনের গভীর থেকে ছুটে এলো একটাই প্রশ্ন, আমি কী সত্যিই অত্যন্ত বেহায়ার মতো কাজ করেছি? মস্তিষ্ক উত্তর দিল, হ্যাঁ। অবশ্যই। কী করে পারলে তুমি এই সকল উপহার গ্রহণ করতে? কীসের অধিকারে? বিবেকে বাঁধল না?
সেই মানুষটা না-জানি কতটা ঠুনকো, কতটা স্বস্তা ভাবছে তোমায়। ছিঃ রোদ ছিঃ। কথাগুলো ভাবতেই দুনিয়াটা ঘুরে গেল আমার। প্রচন্ড কান্নায় সারা শরীর কেঁপে উঠল। জিহ্বার কাছে এসে আটকে গেল একটাই বাক্য, আমি এতোটাই সস্তা!! মস্তিষ্ক আর মনের দ্বিমুখী অত্যাচারে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম আমি। আম্মুর বিষবাক্যগুলো মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছাল না। সদ্য যৌবনে পা রাখা আত্ম-প্রত্যয়ী মন বিদ্রোহী হয়ে উঠল। আম্মুর চোখের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বললাম,
‘ তুমি এখন কী চাইছ আম্মু?’
আম্মু থমকালেন। আমার স্পষ্ট প্রশ্নে কিছুটা অগোছালো হয়ে পড়লেন। হঠাৎ কথা খুঁজে পেলেন না। আম্মু কী সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন? তার চোখে-মুখে একটু দ্বিধা কাজ করছে কী? আম্মু কিছুক্ষণ চুপ থেকে উঁচু কন্ঠে বললেন,
‘ কী চাইছি মানে? কী শুনতে চাইছ তুমি?…’
আম্মুকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে অত্যন্ত শান্ত কন্ঠে বললাম,
‘ আস্তে আম্মু। আমি তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। অযথা চেঁচিয়ে পাড়াসুদ্ধ করবে না। যা বলার ধীর গলায় বলো। আমি শুনছি।’
আম্মু বক্রচোখে তাকালেন। কিছু কড়া কথা বলতে নিয়েও থেমে গেলেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ধীর কন্ঠে বললেন,
‘ আমি তোমার মা। আমার সিদ্ধান্তে তোমার ক্ষতি হবে না, তা বিশ্বাস করো?’
আমি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললাম,
‘ তুমি ছোটবেলা শিখিয়েছিলে, একটি মেয়ের পৃথিবীতে মা ভিন্ন অন্যকাউকে পরিপূর্ণ বিশ্বাস করতে নেই। নিজের বাবাকেও নয়। মায়ের মতো বিশ্বস্ত বন্ধু, যোদ্ধা পৃথিবীতে অন্যকেউ হতে পারে না। অনেক বছর আগে সেই শিক্ষাটা আমি মেনে নিয়েছিলাম আম্মু। আমি তোমাকে আমার সৃষ্টিকর্তা, আমার ধর্মের পর সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করি।’
আম্মু কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন। তারপর মৃদু কন্ঠে প্রশ্ন করলেন,
‘ ছেলেটা কে?’
আমি মাথা নিচু করে বললাম,
‘ তার নামটা বলে তাকে তোমার কাছে নিন্দার পাত্র বানাতে চাইছি না আম্মু।’
আম্মু থমথমে কন্ঠে বললেন,
‘ নিন্দার কাজ করলে নিন্দার পাত্র হবে না? তার ঠিকানা দাও। তার সাথে কথা বলতে চাই আমি। একটা বাচ্চা মেয়ের সাথে যে বাজে সম্পর্কে জড়াতে পারে সে কতটা সৎপাত্র আমিও দেখতে চাই।’
আমি সাহস নিয়ে বললাম,
‘ আমরা কোনো বাজে সম্পর্কে নেই আম্মু। আর তার কোনো দোষও নেই। দোষটা হয়তো আমার। আমার প্রশ্রয় দেওয়াটা ভুল ছিল। আমিই হয়তো ছেলেমানুষীর বশে তার কাছে নিজেকে ছোট করেছি। সেই সাথে ছোট করেছি তোমার শিক্ষাকেও। সরি, আম্মু।’
আম্মু শান্ত হলেন। ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানার উপর বসলেন। দু’হাতে মুখ চেপে জোরে শ্বাস টানলেন। বেশ কিছুক্ষণ নীরবে জানালার বাইরে তাকিয়ে থেকে বললেন,
‘ কোনো সম্পর্কে জড়ানোর মতো বয়স তোমার হয় নি। যদিও আমার বিয়েটা তোমার বয়সেই হয়েছিল তাই বলে নিজের মেয়েকেও সেদিকে ঠেলব না আমি। ছেলেটা যে-ই হোক। তার সাথে গড়ে ওঠে সম্পর্কের সাথে সাথে তার কোনো চিন্হও তোমার জীবনে চাইছি না আমি। আপাতত তিন-চার বছরের মধ্যে তো নয়ই।’
আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। আম্মুর সামনে এমন একটা বিষয় নিয়ে অপদস্ত হতে হবে কল্পনাও করতে পারি নি আমি। আম্মু উঠে দাঁড়িয়ে শোবার ঘর ছাড়তে ছাড়তে বললেন,
‘ আমি কী বুঝাতে চেয়েছি। বুঝেছ?’
আমি অনুতাপের স্বরে বললাম,
‘ জিনিসগুলো আজই ফিরিয়ে দিব, আম্মু।’
আম্মু দাঁড়ালেন। এক নজর আমার দিকে তাকিয়ে শক্ত কন্ঠে বললেন,
‘ সেই ছেলের সাথে দেখে করবে আজ? আমিও যাব সাথে। ছেলেটিকে দেখতে চাই আমি।’
আমি আৎকে উঠলাম। ঢোক গিলে নিয়ে মাথা নুঁয়ালাম। বললাম,
‘ না আম্মু। দেখা করব না। আমরা আলাদাভাবে কখনও দেখা করি নি আম্মু। আর না আমাদের মধ্যে তেমন কোনো সম্পর্ক আছে। জিনিসগুলো কুরিয়ার করব। শহরের বাইরে থাকেন তিনি।’
আম্মু কিছুক্ষণ বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলেন। সন্দিহান কন্ঠে বললেন,
‘ বেশ! কুরিয়ার অফিসে আমার সাথেই যেও তবে।’
আম্মু বেরিয়ে যেতেই ফুঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বিছানায় গাঁ এলিয়ে দিলাম। মাথায় তখন আত্মসম্মানের পোকা দৌঁড়াতে ব্যস্ত। চোখে-মুখে চিন্তা। আম্মু সাথে থাকায় জিনিসগুলো মামানির কাছে পাঠানো সম্ভব নয়। পাঠাতে হবে শুভ্র ভাইয়ের হাতে। কিন্তু, পার্সেলগুলো শুভ্র ভাইয়ের হাতে পৌঁছানোর পর কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবেন তিনি? প্রতিক্রিয়া দেখালেই বা কী? তার জিনিস তার কাছে পৌঁছাবে তাতে এতো প্রতিক্রিয়া দেখানোর কী আছে? তবে, আমার এই চিন্তাটা বেশিক্ষণ টিকল না। পার্সেলগুলো কুরিয়ার করে দেওয়ার পর পরই ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এলো। শরীরের ভেতর থাকা বাচ্চা, ভীত মনটা ভয়ে সিঁটিয়ে গেল। সন্ধ্যার পর অস্থিরতা বেড়ে দ্বিগুণ হলো। টেনশন রুমময় পায়চারী করতে লাগলাম। আপু আমার শুকনো মুখ দেখে মায়াভরা কন্ঠে বলল,
‘ তোর খুব খারাপ লাগছে, তাই না? আমি বুঝতে পারছি তোর পরিস্থিতিটা। আচ্ছা? তোর বয়ফ্রেন্ডের সাথে কী তোর খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল?’
আমি ভ্রু বাঁকিয়ে তাকালাম। জবাব না দিয়ে আবারও হাঁটাহাঁটি করতে লাগলাম। আপু আবারও বলল,
‘ তোর অস্থিরতা দেখেই বুঝতে পারছি। এতো অস্থির হোস না। আমি না-হয় আম্মুর সাথে কথা বলব। তুই এখন ভালো করে পড়াশোনা কর। ভার্সিটিতে এডমিশন নিলেই মোটামুটি স্বাধীনতা পেয়ে যাবি। তখন নাহয় কন্টিনিউ করিস রিলেশন।’
আমি হতাশ চোখে তাকালাম। বিরক্ত কন্ঠে বললাম,
‘ আপু থামবা প্লিজ? কোনো রিলেশন টিলেশনে নেই আমি। ওসব নিয়ে চিন্তা-ভাবনাও নেই আমার। আমার চিন্তা আমার জীবন নিয়ে। আমি আর বেশিদিন বাচঁব না বুঝছ? হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখবে বোন তোমার ঠুস করে আল্লাহ পেয়ারা হয়ে গিয়েছে।’
‘ কী বলছিস এসব? পাগল টাগল হয়ে গেলি নাকি?’
আমি বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে দিয়ে বললাম,
‘ নিজেকে পাগল পাগলই লাগছে রে আপু। তুমি চিন্তাও করতে পারছ না কতোটা ভয়ানক ঘটনা ঘটতে চলছে তোমার এই কচি বোনের সাথে। উনি কতটা রাগী তা তুমি চিন্তাও করতে পারবে না। পার্সেলটা হাতে পড়ার সাথে সাথেই লাশ পড়ে যাবে আমার। এক্কেবারে কনফার্ম।’
আপু যেন ভয় পেয়ে গেল এবার। চোখ বড় বড় করে তাকাল। ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ এই? তুই কোনো সন্ডা টন্ডার সাথে রিলেশনে জড়াস নি তো?’
আমি বাঁকা চোখে আপুর দিকে তাকালাম। আপুর থেকে বেশি ফিসফিস করে বললাম,
‘ শুধু সন্ডা নয়। সন্ডার বাপ। তবে রিলেশনে জড়িয়েছি ব্যাপারটা ভুল৷ বারবার রিলেশন রিলেশন করবে না। তার থেকে বরং এক গ্লাস পানি খাওয়াও। দুই দিন পর তো আর পানি খাওয়ানোর জন্য আমারে পাবা না। দুঃখের বিষয়।’
আপু কিছুক্ষণ বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থেকে দ্রুত বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল। গাঁয়ের ওড়নাটা ঠিকঠাক করে নিয়ে দরজার দিকে এগুতেই স্প্রিং-এর মতো উঠে বসলাম আমি। অবাক হয়ে বললাম,
‘ কই যাও?’
‘ আম্মুর কাছে।’
আমি কপাল কুঁচকে বললাম,
‘ কেন?’
আপু বিজ্ঞদের মতো বলল,
‘ আম্মুকে ব্যাপারটা জানাতে হবে না? সন্ডা, গুন্ডারা কত খারাপ হয় জানিস? তোকে যদি তুলে নিয়ে যায়? এখন দেশের যা পরিস্থিতি। গন্ডায় গন্ডায় ধর্ষণ কেইস হচ্ছে, বিচার নেই।’
আপুর কথায় চোখ বড় বড় করে তাকালাম আমি। সটান দাঁড়িয়ে পড়ে অবিশ্বাস্য কন্ঠে বললাম,
‘ আপু! তুমি তো দেখি খুব একটা ভালো মানুষ না। তুমি যে এতোটা লো চিন্তা-ভাবনা করতে পারো ভাবনাতেই ছিল না আমার। তুমি আম্মুকে সন্ডা-মন্ডা, ধর্ষণ-টর্ষণের কথা বলবা আর আম্মু বেচারাকে বিনাদোষে ধর্ষণকারী বানিয়ে ছেড়ে দিবে। ইয়া মাবুদ! আল্লাহর ওয়াস্তে চুপ করে বসো।’
আপু হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আমার কথার আগেমাথা বুঝতে না পেরে চোখে-মুখে অসহায়ত্ব মেখে ফোনের স্ক্রিনে মনোযোগ দিল৷ আমার টেনশন সময়ের সাথে সাথে হুহু করে বাড়তে লাগল। পরবর্তী দু-দুটো দিন টাকি মাছের মতো লাফাতে লাফাতেই কেটে গেল আমার। ফোনের শব্দেই ধরফর করে উঠতে লাগলাম। দরজায় কলিং বেল বাজতেই চমকে উঠতে লাগলাম। দু-দিন পর এক বিকেল বেলায় সেই ভয়ানক ফোনটা এলো। স্ক্রিনে শুভ্র ভাইয়ের নামটা দেখেই হাতে-পায়ে কাঁপন দিলো।
দুই থেকে তিনবার বাজার পর ফোন কেটে ব্লক লিস্টে ফেলে দিলাম নাম্বার। আপুর ফোনটা সামনে পেয়ে আপুর ফোন থেকেও ব্লক লিস্টে ট্রান্সফার করলাম উনাকে। আপুর সোশ্যাল মিডিয়া থেকেও সরিয়ে দিয়ে খানিকটা আশ্বস্ত হলাম। হাত-পা ছড়িয়ে বিছানায় গা এলাতেই মনে পড়ল আম্মুর ফোনের কথা। অনেক কৌশলে আম্মুর ফোন থেকে নাম্বারটা ব্লক করার পর মনে খুশির জোয়ার এলো।তবে খুশিটা বেশিক্ষণ টিকল না। বসার ঘর থেকে বাবার রাশভারী কন্ঠ ভেসে এলো,
‘ রোদু? আম্মু? শুভ্র ফোন করেছে। তোমাকে এডমিশনের ব্যাপারে জরুরী কিছু বলবে। জলদি এসে ফোনটা নিয়ে যাও।’
বাবার কথায় মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল আমার। তাড়াহুড়ো করে লেপের তলায় আশ্রয় নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললাম,
‘ আপু? বাবাকে বল আমি ঘুমিয়েছি। শুভ্র ভাই টুভ্র ভাইয়ের সাথে কথা বলার সময় নেই। রোদু নামের কোনো ব্যক্তি এই দুনিয়াতেই নেই।’
এমন সময় দরজার পাশে এসে ধমকে উঠলেন আম্মু,
‘ এই ফাজিল মেয়ে? বাপে ডাকছে কানে ডুকে না? শুভ্র ফোন দিয়েছে, নে কথা বল।’
আমি লেপের তলা থেকেই বললাম,
‘ আমি ঘুমিয়ে গিয়েছি আম্মু।’
‘ দুই গালে দুটো থাপ্পড় দিলেই ঘুম ভেঙে যাবে তোমার। বেয়াদব মেয়ে।’
আমাকে বাধ্য হয়েই উঠতে হলো। আম্মু ফোনটা এগিয়ে দিতেই চোখে-মুখে কান্নাভাব এনে বললাম,
‘ আমি উনার সাথে কথা বলব না। উনি শুধু বকে।’
‘ তুই বকার মতো কাজ করলে বকবে না? ফোন ধর বলছি।’
আমি চোখ-মুখ অন্ধকার করে ফোন কানে নিলাম। শুকিয়ে থাকা গলা দিয়ে অনেক কষ্টে বললাম,
‘ আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।’
ওপাশ থেকে জবাব এলো না। আমি ফোনটা কান থেকে নামিয়ে দেখলাম ফোন এখনও কাটা হয় নি। ফোনটা কানে নিয়ে আবারও সালাম দিলাম আমি। ওপাশে পিনপতন নীরবতা। কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকার পরই কানে এলো তপ্ত দীর্ঘশ্বাসের শব্দ। তারপরই কেটে গেল লাইন। মনের মধ্যে একটা মন খারাপ দানা বাঁধতে লাগল। নিজের পাগলামো আর বাচ্চামোকে প্রশ্রয় দিয়ে শুভ্র ভাইকে অপমান করে ফেললাম না তো? নিজের আত্মসম্মানের খেয়াল রাখতে গিয়ে অপর পাশের মানুষটির আত্মসম্মানে আঘাত হানাটা তো অন্যায়। ভয়ানক অন্যায়।
#রোদবালিকা
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/rodsuvro/