রোদ শুভ্রর প্রেমকথন পর্ব ৫৭
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
রাজশাহী থেকে ফিরে এসেই ভয়াবহ এক ধাক্কা খেলাম আমি। আম্মুর ভীষণ অসুখ। বাসার পরিবেশ থমথমে। বাবার চোখে-মুখে মামলায় হেরে সর্বশান্ত হওয়ার মতো কালিমা। ক্লান্তি। সব সময় তেজের ছঁড়ি চালানো আম্মু স্তব্ধ, নিশ্চুপ। সেই নিস্তব্ধতা কী ভয়াবহ, অসহায়। লোকে বলে, মাইরের থেকে বড় কোনো ঔষধ হয় না। কিন্তু আমি সেদিন উপলব্ধি করলাম, খুব মিথ্যে। বিপদের থেকে বড় কোনো ঔষধ হয় না। বিপদে পড়েই আমার ব্ল্যাকআউট কেটে গেল। নারকীয় বিষণ্ণতাটাকে সঙ্গী করে রাগটা কোথায় মিলিয়ে গেল।
আমি ঝুপ করেই শান্ত হয়ে গেলাম। হঠাৎ আম্মু কী করে এতো অসুস্থ হয়ে পড়ল, কিছুতেই বোধগম্য হলো না। আম্মুকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটোছুটি হচ্ছে। খুব স্পর্শকাতর জায়গায় টিউমার ধরা পড়েছে। টিউমারের আকারটা হুহু করে বাড়ছে। ক্যান্সারের জার্ম থাকতে পারে। জলদি অপারেশন করা প্রয়োজন। পুরো ব্যাপারটা শুনে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম আমি। নাটকের স্ক্রিপ্টের মতো ঘটনা ঘটে চলেছে একের পর এক। মস্তিষ্কে কিচ্ছু রেজিস্টার হচ্ছে না। সবকিছু ভাসা-ভাসা, শূন্য। তার থেকেও শূন্য হলাম যখন শুনলাম, এই অসুখ আকস্মিক নয়।
টিউমারটা ধরা পড়েছিল আরও বছর দুয়েক আগে। আম্মু বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি, কাউকে জানায়নি বলেই আজকের এই অন্ধকার। নিজেদের ব্যাপারে বাঙালি মায়েদের এমন স্বার্থপরতায় ভেতরটা বিরক্তিতে রিরি করে উঠল আমার। একের পর এক ডিফিকাল্টিস দেখা দিতে লাগল। ডাক্তার জানাল, অপারেশনের ঝড়টা সামলে নেওয়ার মতো শারিরীক অবস্থা আম্মুর নেই। ভেতর থেকে খুব দুর্বল হয়ে পড়েছেন। শরীরে পর্যাপ্ত রক্তের অভাব। অপারেশন সম্ভব নয়।
লোকে বলে জীবনটা কোনো উপন্যাস নয়। গল্পের মতো জীবন কল্পনা করা বোকামো। অথচ আমি দেখলাম, আমার জীবনটা নাটকের থেকেও নাটকীয়ভাবে পট বদলাল একের পর এক। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র যেমন হঠাৎ অসংখ্য ঝড়ে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে।
ঠিক তেমনই একের পর এক মানসিক ঝড়ে বিধ্বস্ত হয়ে পড়লাম আমি। আম্মুকে পর্যাপ্ত রক্ত তৈরির জন্য ঔষধ দেওয়া হলো। সাথে দেওয়া হলো টিউমার ছোট হওয়ার ঔষধ৷ কিন্তু সবই কেমন উল্টো হলো। আমাদের বুঝি তখন উল্টো হওয়ার দিন চলছিল। ঔষধ খেয়ে আম্মুর টিউমার দ্বিগুণ গতিতে বাড়তে লাগল। আমার তেজী মা চোখের পলকে বিছানা নিলেন। চুলোয় হাঁড়ি উঠলো৷ রান্না-বান্না বন্ধ হয়ে গেল। পরিবারের পাঁচজন সদস্যর চোখে নেমে এলো ধিক-ধিক অসহায়ত্ব। কয়েক মাসের ব্যবধানে সদা হাস্যোজ্জ্বল একটি বাড়ি মৃত্যুপুরি হয়ে গেল। মাসখানেক আগে যে বাড়িতে ঝুড়ি ঝুড়ি হাসির গল্প জুটতো।
খিলখিল হাসিতে আকাশ-পাতাল কেঁপে উঠতো। ভীষণ তেজি মায়ের শাসনে তটস্থ থাকতো বাড়ির প্রতিটি ইট,পাথর। সেই বাড়িতেই হঠাৎ কেমন হাসির উপর খাজনা পড়ল। স্তব্ধ আকাশ, স্তব্ধ বাতাস। চাঁদ স্তব্ধ। হাওয়ায় হাওয়ায় অসহায়ত্বের বিষ। বাবার চোখের দিকে চাওয়া যায় না। ভাইয়া-আপুর মুখেও সর্বস্ব হারিয়ে ফেলার ভয়। আমি, বাবা, ভাইয়া, আপু সবাই যেন একইসাথে উপলব্ধি করলাম, মাকে হারিয়ে ফেলা মানেই আমাদের সর্বস্ব হারিয়ে ফেলা। আম্মুর বাইরে আমাদের কোনো সম্পদ নেই। ছিলো না কখনো। এই তেজী নারীটা আমাদের প্রাণ। তাকে ছাড়া পৃথিবীটা অসম্ভব।
আমার জীবনটা ছিল রূপকথার মতো। রূপকথার অচিনপুরের মতোই আকাশে-বাতাসে কেবল আনন্দ, হাসি-মজা আর ভালোবাসার গল্প। আমার উনিশ বছরের জীবনে কখনো থমকে যাইনি আমি। বড় হইনি। বড়সড় কোনো বিপদ দেখিনি। বাবাকে কখনো অসহায় দেখিনি। মাকে অসুস্থ দেখিনি।
আমাদের ছোট্ট দু’তলা বাড়িটির মন খারাপ দেখিনি। সব থেকে বেশি দেখিনি পাঁচজন মানুষ হাতে হাত চেপে বসে থেকেও একা হয়ে যাওয়া। পাঁচজোড়া চোখ একই সাথে অসহায় হয়ে পড়া। এই উনিশ বছরে পা দিয়েও দুঃখের ঝুলি আমার খাঁ খাঁ শূন্য। কোথাও কোনো আফসোস নেই, আক্ষেপ নেই, না-পাওয়ার বেদনা নেই। প্রেমে হেরে যাওয়ার কাতরতা নেই। কাউকে ভালো লাগার ইতিহাস নেই। বিরহ নেই। মূলত শুভ্র ভাই হতে দেননি। পুরুষমানুষ ভালো লাগার বয়সটিতে শুভ্র ভাই কী ভীষণ ভয় দেখাতো আমায়। ভূতের থেকেও ভয়ঙ্কর ভয়। মা জননীর ভয়।
আমি ভয়ে, বিরক্তিতে তটস্থ হয়ে স্কুলে যেতাম। ফিরতাম। শুভ্র ভাইয়ের অসহ্য জ্বালাতনে মাঝে মাঝে নিরুদ্দেশ হতে চাইতাম। দশ টাকা ভাড়া দিয়ে রেললাইনে মাথা দেওয়ার প্ল্যান-প্রোগ্রাম বানাতাম। ব্যস, এভাবেই ফট করে কৈশোর থেকে যৌবনে এসে পৌঁছালাম। ছয় ছয়টা বছর কেটে গেল। প্রেমে পড়া হলো না। শুভ্র ভাইয়ের বিশাল বট ছায়ার নিচে আমার আর দুঃখ পাওয়া হলো না। তাই বুঝি, বট ছায়াটা সরে যেতেই একের পর এক মন কেমনের সন্ধ্যাগুলো ঝাপটে ধরতে লাগল আমায়। যে সন্ধ্যাগুলো কোনো এক বিস্ময় পুরুষ বন্দী করে রেখেছিল তার বিস্মিত জাদু বলে।
কখনো বিধ্বস্ততা দেখিনি, এজন্য? নাকি আমার বিধ্বস্ত হওয়ার দিন চলছিল, এজন্য? জানা নেই। কিন্তু একের পর এক বিধ্বস্ত ঘটনাপ্রবাহে চারপাশটা এলেমেলো হয়ে গেল আমার। এলেমেলো হয়ে গেলাম আমি, আমার চিন্তাভাবনা। আশেপাশের সকলের মন খারাপ দেখতে দেখতে হাঁপিয়ে উঠলাম। অসুস্থ মনটা চুপিচুপি আরও গভীর অসুস্থতায় ডুবে গেল। কোনো এক গোধূলি সন্ধ্যায় হুট করেই উপলব্ধি করলাম, এভাবে আর বাঁচা যাচ্ছে না। আমি বাঁচতে পারছি না। এই প্রিয় ময়মনসিংহ শহরটা বিষের মতো গলায় ফুটছে।
শ্বাস নিতে পারছি না। একটু শ্বাস নেওয়া প্রয়োজন। একটুখানি বাতাস প্রয়োজন। সত্যিকারের বাতাস। ঘরের ভেতর, বারান্দায়, খোলা আকাশের নিচেও দম বন্ধ হয়ে আসছে। বুক ফেঁটে যাচ্ছে একটুখানি বাতাসের আশায়। একটুখানি বাঁচার আশায়। হঠাৎ করেই বিশ্বাস হলো, এই শহরটিতে থাকলে আমি আর বাঁচবো না। ফুরিয়ে এসেছে গোধূলির আলো। আমার আর বাঁচা হলো না। আমি আরও নির্লিপ্ত হয়ে গেলাম। সকল অনুভূতি ভোঁতা হয়ে গেল।
ফুরিয়ে গেল। নিজের জীবনের শেষটা দেখতে পেয়েই বুঝি প্রিয়জনের অসুখ ভুলে গেলাম, দুঃখ ভুলে গেলাম, চিন্তা ভুলো গেলাম, ভুলে গেলাম সকল মন খারাপ। কেবল মনে হতে লাগল, একটু…. যদি একটু শ্বাস নিতে পারতাম! এই বন্ধ ঘর ছাড়িয়ে, এই পরিচিত দুশ্চিন্তা, পরিচিত মুখগুলো ছাড়িয়ে খুব খুব দূরে নির্জনে একটু শ্বাস নিতে পারতাম!
আমার দমবন্ধ জীবনটা যখন দিশেহারা হয়ে উঠল। অসহনীয় যন্ত্রণার হয়ে গেল। ঠিক তখনই অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটল। নাটকের স্ক্রিপ্টের মতোই অদ্ভুত এক ঘটনা। একদিন সকালে, নির্লিপ্ত দেহে, ধুলো পড়া টেবিলটা ঝাড়তে গিয়েই পায়ের কাছে পড়ে থাকা ভর্তি পরীক্ষার ফরমটা চোখে পড়ল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ফরম। আমি উল্টেপাল্টে দেখলাম, আটাশ অক্টোবর পরীক্ষা। ফরমটা দেখতে দেখতেই যেন অনেক কিছু পাল্টে গেল। চট্টগ্রাম! চট্টগ্রাম শব্দটা যেন হিমশীতল বাতাসের মতো ছুঁয়ে গেল আমার মন। কুয়াশা ঢাকা গহীন বুকে চিরপরিচিত এক জোড়া ঠোঁট মৃদু হাসল। আচমকা মনে হলো, এই চট্টগ্রামেই আমার প্রাণ বাঁধা।
আমার সারা জীবনের শ্বাসের টান। এই চট্টগ্রাম আমায় যেতেই হবে। ওখানেই পড়তে হবে। চট্টগ্রাম পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলেই বেঁচে যাবে মৃতপ্রায় মন। পেয়ে যাব অমূল্য রতন। সেদিন বুঝিনি। আজ বুঝি। সত্যিই কী অমূল্য রতন ছিলো ওই বহুদূরের চট্টগ্রাম শহরটায়? নাকি ছিলো এক বিস্ময় পুরুষের স্মৃতির আকর্ষণ? যার নামের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে চট্টগ্রাম শহর। রাত, ক্লান্তি মাথায় নিয়ে ছুটে আসার গল্প। অদ্ভুত কিছু শিহরণ।
খুব আশ্চর্যভাবে এই প্রথম সকল বিষণ্ণতা, দমবন্ধ, মন খারাপ দূরে ঠেলে অদম্য মনের জোর নিয়ে পড়তে বসে পড়লাম আমি। বছরের পর বছর অন্ধকারে বন্দী থাকা মানুষ যেমন আগুনের ফুলকির সন্ধান পেলেও অস্থির হয়ে উঠে। প্রাণপণে ছুটে যায় আলোর পানে? ঠিক তেমনভাবেই প্রাণ দিয়ে বইয়ের মাঝে ডুবে গেলাম আমি। খুঁজে ফেরলাম বেঁচে থাকার রশদ। বাসার পরিস্থিতি, প্রিয়জনের অসুস্থতা সবকিছু ছাপিয়ে এতোটা মানসিক শক্তি সেদিন কোথায় পেয়েছিলাম, কে জানে? ভাবলেই আশ্চর্য হই। ভীষণ আশ্চর্যে বুক কাঁপে।
বহু দৌঁড়ঝাপের পর আম্মুর অপারেশনের ডেইট ফাইনাল হলো। দীর্ঘ অন্ধকার দিন-রাত্রি যাপনের পর, গুহার মুখে মশাল দেখলে যেমন আনন্দ হয়, তেমনই আনন্দিত হলাম আমরা। আশা আশা চোখে চেয়ে রইলাম। এবার বুঝি দিন পাল্টে যাচ্ছে। সবকিছু স্বাভাবিক হচ্ছে। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি গল্প শেষ হলো না। অপারেশনের ঠিক আগের দিন হঠাৎ আম্মুর ডায়েবিটিস ধরা পড়ল। ডায়েবিটিস লেভেল পঁচিশ। ডাক্তারসহ আমরাও যেন চমকে গেলাম।
গল্পের ছক আবারও উল্টেপাল্টে এলোমেলো হয়ে গেল। আম্মুকে এই প্রথম আমি হতাশ হতে দেখলাম। দুর্বল হতে দেখলাম। ব্যথা আর যন্ত্রণায় ছটফট করে চিৎকার করতে দেখলাম। আমার পৃথিবীটা তখন উইপোকায় খাওয়া খুঁটির উপর দাঁড়িয়ে কাঁপছিল থরথর। কেবল ভেঙে পড়ার অপেক্ষা। কী করব? কী হবে? কী হতে চলেছে সামনে? কিচ্ছু জানি না। শুধু জানি, আমায় এই বদ্ধ জীবন থেকে বেরুতে হবে। আমি এই হাহাকারময় পৃথিবীতে বাঁচতে চাই না। বাঁচতে পারছি না। একটু মানসিক শান্তি দরকার। আত্মবিশ্বাস দরকার। দুই একদিনের মাঝেই আম্মুর বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেল, তিনি আর বাঁচবেন না। মানুষ আসছে, দেখছে, থেকে থেকে কান্নার রোল উঠছে।
আর আমি বন্ধ ঘরের কোণায় দু’হাতে কান চেপে বসে আছি। আমার মানসিক চাপ বাড়ছে। আমি বুঝতে পারছি, আমি ঠিক নেই। এই ঠিক না থাকাটা, অন্যরকম। খুব খারাপ রকম। এমনও সময় গিয়েছে দুই তিনদিন ঘর থেকে বেরুইনি আমি। সবার থেকে বিচ্ছিন্ন থেকেছি। খাওয়া-দাওয়া করিনি। বিচ্ছিরি বিষাদে কেঁপে কেঁপে উঠেছি। মুখে আঁচল গুঁজে চিৎকার করে কেঁদেছি। উফ! কী যন্ত্রণার দিন ছিলো সেগুলো। মাঝে মাঝে আশেপাশের শব্দ, আহাজারি, হাহাকার শুনে মাথায় তীব্র ব্যথা হয়েছে। চোখের সামনে ভয়াবহ অন্ধকার তাড়া করেছে।
সজ্ঞা হারিয়েছি, চোখ মেলে নিজেকে আবারও তীব্র ব্যথার মাঝে খুঁজে পেয়েছি। একা, একদম একা আমিকে খুঁজে পেয়েছি। কখনো খুঁজে পেয়েছি ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমে মাতাল, ঘামে জবজবে আমিকে। আমূল পাল্টে যাওয়া রোদুকে। কখন দিন হচ্ছে?কখন রাত হচ্ছে? খেয়াল না রাখা সত্তাকে।তারপর একদিন আম্মু আমায় ডেকে পাঠালেন। ঘরভর্তি আত্মীয়-স্বজনের কারো দিকে না চেয়ে আমি আম্মুর পাশে গিয়ে বসলাম। আম্মুর ফর্সা, সুন্দর মুখটি কিছুটা শীর্ণ দেখাচ্ছে।
চোখদুটো ঘোলাটে। আম্মু আমার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে চুপচাপ শুয়ে রইলেন। কোনো কথা না বলেও কী জানি কেন, আমাদের দু’জনেরই দুনিয়া ভেঙে কান্না পেলো। আমি যথাসম্ভব গম্ভীর হয়ে বসে রইলাম। কিছুতেই কাঁদব না বলে প্রতিজ্ঞা করলাম। ঠিক তখনই আমার কঠিন আম্মু আমার হাতের উপর নরম আদর দিলেন। উদাস চোখে চেয়ে নিচু কণ্ঠে বললেন,
‘ লক্ষ্মী হয়ে থাকবে বাবু। বাবার সব কথা শুনবে। আমি জানি, আমি আর বাঁচবো না।’
আমি আম্মুর দিকে চাইলাম। ঝকঝকে, তকতকে মুখটির এই ভঙ্গুর, অসহায় রূপের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম কেবল। আমার ভঙ্গুর দুনিয়াটা চোরাবালির মতোই ঝরঝর করে ঝরে পড়তে লাগল। মাথার যন্ত্রণাটা ফিরে ফিরে এলো। বিতৃষ্ণ মন নিয়ে দেখলাম, জীবনের সবচেয়ে প্রিয় সম্পদগুলোই ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছি আমি। এই হারিয়ে ফেলার পেছনে দায়টা কার? নিতান্তই আমার?
আম্মুর অপারেশন ডেইট ঠিক হলো অক্টোবরের সাতাশ তারিখ। আমি চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে গাড়িতে উঠলাম ছাব্বিশ তারিখ সন্ধ্যায়। ময়মনসিংহ থেকে শেরপুর একা না যাওয়া মেয়েটা বারো ঘন্টার পথ পেরিয়ে দূরের এক অপরিচিত শহরে চলল একদম একা। তাও আবার অপারেশনের টেবিলে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়া মাকে ফেলে রেখে, চিন্তা করা যায়? হয়তো করা যায় না। আমিও চিন্তা করতে পারছিলাম না। আম্মুকে এই কঠিন অবস্থায় ফেলে নিজের বাঁচার আলো খুঁজতে যাব, তাই কী হয়? ভাইয়া বুঝালো, হয়। আমার মাথায় হাত রেখে বলল,
‘ অপারেশন থিয়েটারের সামনে বসে থেকেই বা কী করতে পারবি তুই? আমরা তো আছি৷ সব ঠিক হয়ে যাবে। তুই চট্টগ্রাম থেকে ঘুরে আয়। তোর একটা রিফ্রেশমেন্ট দরকার। পরীক্ষা টরীক্ষা নয়, ভাব সলো ট্রিপে যাচ্ছিস। চট্টগ্রাম থেকে ফিরে এসে দেখবি, সব ঠিক হয়ে গিয়েছে। আম্মু হাঁটাচলা করছে। বাবার মন ভালো হয়ে গিয়েছে। ছাদে আবারও আড্ডা বসেছে। তোর সব মন খারাপ কেটে গিয়েছে। আম্মু আবারও রাগারাগি করে বাড়ি মাথায় করে ফেলছে।’
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে খোলা বই, আধ-গোছানো ব্যাগের দিকে চেয়ে রইলাম। তারপর সত্যি সত্যিই চট্টগ্রামের পথে পা বাড়ালাম, কোনো এক দৈবিক আকর্ষণে। আমাদের প্রাচীর ঘেরা ছোট্ট বাড়িটি থেকে একইসাথে দুটো গাড়ি বেরুলো। দুটো গাড়িই ব্যস্ত হয়ে ছুটে গেলো একদম উল্টো দুটো পথে। পৃথিবী হয়তো বুঝল না, সেদিন দুটো গাড়িতেই ছিল দু’জন দ্বিধাময়ী রমণীর বাস। গাড়ির কাঁচে তাদের অসহায় দৃষ্টি। একজনের দ্বিধা, আবারও এই বাড়িটিতে ফিরতে পারবে তো? ছুঁতে পারবে নিজের হাতে তৈরি সোনার সংসার? অপরজনের দ্বিধা, অসুস্থ মাকে ফেলে, প্রিয়জনদের ফেলে একদম একা ছুটে চলা জীবনযুদ্ধটা আদৌ জিততে পারবে তো? দু’জন রমণীর বুকেই সেদিন ছিল দুরুদুরু ভয়। বাতাসে দীর্ঘশ্বাস। হেরে যাওয়ার অদম্য ত্রাস।
নভেম্বরের হিমেল হাওয়া ফুঁড়ে ছুটে চলেছে বাস। মেঘহীন আকাশে সরু, সুন্দর চাঁদটাও ছুটে চলেছে অক্লান্ত। মাঝে মাঝে পিছিয়ে পড়ছে। মাঝে মাঝে ঢেকে যাচ্ছে পাতলা মেঘ অথবা গাছের জঞ্জালে। তারপর আবারও হন্তদন্ত ছুটে এসে ধরে ফেলছে বাসের কার্ণিশ। একটুখানি অপ্রস্তুত হাসিও বুঝি হাসছে চাঁদ? লাজুক হেসে জানাতে চাইছে প্রিয় কারো খবর। চাঁদের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে ভেতরের ভয়টা একটু থিতিয়ে এলো। এই নিঃসঙ্গ ছুটে চলায় হঠাৎ’ই চাঁদটাকে খুব আপন মনে হলো। ডাকপিয়ন মনে হলো। নিজের মনে হলো। ভ্রু কুঁচকে শুধালাম,
‘ এভাবে ছুটছো কেন? তুমি কী ডাকপিয়ন? চিঠি আছে? তোমায় দিয়ে চিঠি পাঠায় এমন সাধ্য কার?’
চাঁদটা হাঁপ ধরা হাসি হেসে বলল,
‘ আমি কেবল প্রিয়কে প্রিয়র চিঠি পৌঁছে দিই। এই সকল চিঠিতে একাকিত্ব থাকে, হাসি, আনন্দ, অভিমান, কষ্টের সাথে এক আকাশ ভালোবাসা মিশে থাকে।জনসাধারণের ভুজংভাজং চিঠি আমি পৌঁছে দিই না।’
আমি হেসে ফেললাম। চাঁদ আমার হাসির দিকে চেয়ে থেকে বলল,
‘ বাহ! তুমি তো বেশ হাসো! কোনো এক গভীর রাতে, এমনই এক বাসের সীটে গা এলিয়ে কোনো এক অকতোভয় পুরুষ খুব স্পর্ধা দেখিয়েছিল। আমার রূপকে তাচ্ছিল্য করে তোমার হাসিকে তুলনা করেছিল শরতের আকাশের সাথে। বৃষ্টির সাথে। আমি খুব মন খারাপ নিয়েও তার কথা শুনেছি। প্রতিবারের আসা-যাওয়ায় তার সঙ্গী হয়েছি। হুটহাট পাগলামোই সঙ্গ দিয়েছি। তুমি নাকি খুব একা? সে আজ আমায় তোমার সঙ্গী হতে বলছে৷ তোমায় ভয় পেতে নিষেধ করছে। আমি আজ তারই চিঠি এনেছি। তুমি চিঠিটা পড়বে না রোদপাখি?’
আমি উত্তর না দিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। সীটে গা এলিয়ে দিতেই উপলব্ধি করলাম, ভয়টা কেটে যাচ্ছে। এইযে বাস ভর্তি অপরিচিত মানুষের সাথে বহুদূরের পথ পেরুচ্ছি? রাতের বাসে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক খবরগুলো মাথায় উঁকিঝুঁকি দিয়ে ভয় দেখাচ্ছে? সেই ভয়গুলো ধীরে ধীরে গায়ের উপর চাদর টানছে। কারো তীব্র চোখ রাঙানিতে মুখ লুকোচ্ছে। আশেপাশে না থেকেও, প্রিয় কারো অস্তিত্ব বাতাসে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।
এই ক্লান্ত চাঁদ, ভয়ার্ত রাত, ছুটন্ত বাস সবটাতেই ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে তার নিঃশ্বাসের আওয়াজ। দীর্ঘশ্বাসের ধ্বনি। যেখানে তার অস্তিত্ব এতো প্রবল সেখানে কী আমার ভয় পাওয়া সাজে? আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। গভীর রাতের হিমেল হাওয়া চোখে-মুখে আছড়ে পড়ে জানাল, সাজে না। আমি যেন ভয়কে ভয় দেখাতে শিখে গেলাম। বুকের ভেতর বুদবুদ করে উঠল অদম্য সাহস। দু’চোখে আগুনের তেজ। চাঁদ যেন ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ জ্বলন্তি কন্যাদের কেবল জ্বলতে হয়। তাদের দুর্বল হতে হয় না। ভয় পেতে হয় না।’
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। বহুদিন পর স্বস্তিময় ঘুমে বোজে এলো চোখ। বাকিটা পথ কেটে গেল ম্যাজিকের মতো। ঝুমঝুম, আধো আধো স্বপ্ন আর মিঠে কিছু অনুভূতির ফোয়ারায় চাঁদ লুকিয়ে সূর্য এলো। মিঠে ঘুমে ডুবন্ত চট্টগ্রামে বাস থামল। অপরিচিত শহরে পা রাখতেই অদ্ভুত এক শিহরণে কেঁপে উঠল বুক। বারবার মনে হতে লাগল, এই বুঝি চিরপরিচিত একজন খুব বিরক্ত হয়ে তাকাচ্ছে। ভীষণ রাগ করা কথা বলে মাথা ধরিয়ে দিচ্ছে। বহুদিন পর বুকের ভেতরটাতে হিমেল হাওয়ার মতোই শীতল হাওয়া বয়ে গেল। ময়মনসিংহ থেকে বেরিয়ে, পরিচিতের গন্ডি পেরিয়ে, বহুদিন পর সত্যিকারের বাতাস পেলাম।
নিজের মুখোমুখি হওয়ার জন্য যোগ্য একটি জায়গা পেলাম।। আমি ব্যাগ হাতে একপাশে দাঁড়িয়ে রইলাম। এখান থেকে কোথায় যেতে হবে আমি জানি না। কোনো এক আবাসিক এলাকার নাম বলেছিল ভাইয়া। মনে করার চেষ্টা করলাম, মনে নেই। চারদিকে ধোঁয়া ধোঁয়া কুয়াশা ভেদ করে ঘুমো ঘুমো মানুষরা চলে যাচ্ছে তাদের গন্তব্যে। কেবল আমিই দাঁড়িয়ে আছি নিশ্চুপ। কোনো তাড়া নেই। অস্থিরতা নেই। কে যেন আমায় নিতে আসার কথা? তার নামটাও মনে নেই। অথচ একবিন্দু দুশ্চিন্তা নেই। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর ভাইয়াকে কল করলাম,
‘ বাস থেকে তো নেমে গিয়েছি, এখন?’
‘ মিরাজ ভাইকে কল দে। উনি তো বলেছিলেন তোকে নিয়ে যাবে। বাসে থাকা অবস্থায় কল দিসনি কেন? এহসান সিটি থেকে আসতে সময় লাগবে না এখন? কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবি এভাবে?’
আমি উত্তর দিলাম না। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে ফোন কাটলাম। এই কুয়াশা ঢাকা ভোরে খুব দুঃসাহসিক এক কাজ করে বসলাম। একটা সিএনজি ডেকে এহসান সিটির নাম বলে উঠে পড়লাম। পুরো সিএনজিতে আমি একলা মেয়ে মানুষ। রাস্তাঘাট ফাঁকা, নিশ্চুপ। ঘুমন্ত শহরটিতে এখনও আদুরে আড়মোড়া ভাব। এমন একটা পরিবেশে আমি যে পাচারও হয়ে যেতে পারি, খারাপ কিছু ঘটে যেতে পারে, সে ভয়টুকুও আমার করল না। অলঙ্কার থেকে এহসান সিটি পর্যন্ত পথটিতে আমি কেবল নিজেকে খুঁজলাম।
বুঝার চেষ্টা করলাম। ঘন্টাখানেকের পথ পেরিয়ে সুন্দর, ঝকঝকে আবাসিক এলাকায় এসে পৌঁছালাম আমি। কিন্তু তারপর? কোন বাড়িটিতে যাওয়ার কথা আমার? মিরাজ ভাইয়ের নাম্বারটা সেইভ করেছিলাম? ফোনের কল লগ ঘেঁটে ‘মিরাজ’ নাম খুঁজতে খুঁজতে পেলাম একটি নাম্বার। ফোন দিতেই রিসিভ হলো।ওপাশ থেকে ‘হ্যালো’ না বলেই ঘুমো ঘুমো গম্ভীর কন্ঠে শুধাল,
‘ তুই রোদ?’
আমি আশ্চর্য হলাম। চিনি না, জানি না, ডিরেক্ট তুই বলে ফেলল! কতবড় বেয়াদব! কোনো ভদ্রতা জ্ঞান নেই? ব্যাপারটা আমার আত্মসম্মানে লেগে গেল। আমি কী এখনও ছোট আছি যে, যে কেউ সটান তুই করে সম্বোধন করে ফেলবে? তাদের অবশ্যই উচিত, আপনি করে কথা বলা। আপনি না বললেও এটলিস্ট তুমি? আমি চোখ-মুখ শক্ত করে সালাম দিলাম। বললাম,
‘ জি। আমি রোদেলা। এহসান সিটির গেইট পেরিয়ে কিছুটা সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আপনাদের এপার্টমেন্টটা চিনতে পারছি না।’
মিরাজ ভাইয়া বিস্মিত হলেন। বিস্ময় ঢাকার বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করে বললেন,
‘ তুই এহসান সিটিতে চলে এসেছিস? কী আশ্চর্য! সাথে কে?’
আমি উদাস কন্ঠে বললাম,
‘ সিএনজি ড্রাইভার।’
ওপাশ থেকে কোনো কথা শোনা গেল না। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে ফোন কেটে গেল। তার প্রায় দশ মিনিট পরই অদূরের এক এপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে এলেন লম্বা-চওড়া, শুকনো করে এক ভদ্রলোক। ধবধবে সাদা ফর্সা গায়ের রঙ। এদিক ওদিক চেয়ে ফোন ডায়াল করতে গিয়েই থমকালেন। দূর থেকে আমার দিকে চেয়ে শুধালেন,
‘ রোদ?’
আমি মাথা নাড়লাম। উনি লম্বা পা ফেলে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমার ব্যাগটা হাতে নিয়ে সিএনজির ভেতর উঁকি দিলেন। আশ্চর্য হয়ে বললেন,
‘ তুই সত্যি সত্যিই একা এসেছিস দেখছি। কী আশ্চর্য! দুই ইঞ্চি থেকে চার ইঞ্চি হতেই একা একা এতোদূর চলে এলি? আরও দুই ইঞ্চি বেড়ে গেল কোথায় কোথায় চলে যাবি বল তো?’
আমি উত্তর দিলাম না। এই লোকের কোনো কথায় আমার পছন্দ হচ্ছে না। মিরাজ ভাই আমার উত্তরের অপেক্ষা করলেন না। আমাকে নিয়ে ঝটপট লিফ্টে উঠলেন। চট্টগ্রামে বেশ ঠান্ডা পড়েছে। এই ঠান্ডাতেও ভদ্রলোক একটা পাতলা টি-শার্ট পরে দাঁড়িয়ে আছেন। ভেজা চুল থেকে জল গড়াচ্ছে। আমি মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলাম। এই লোকের সাথে আমাদের পরিবারিক পরিচয়ের গভীরতা সম্পর্কে কোনো ধারণা আমার নেই। তাকে আমি কখনো দেখিনি। তিনি আমাকে কখনো দেখেছেন কি-না বুঝতে পারছি না।
ছয় তলার ফ্ল্যাট নম্বর বি-২ এর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম আমরা। কয়েক সেকেন্ড পরই হাস্যোজ্জ্বল, ঝকঝকে এক তরুনী দরজা খুললো। প্রায় সাথে সাথেই দরজার ফাঁকফোকর দিয়ে বাচ্চা একটা ছেলে ঝাঁপিয়ে পড়ল মিরাজ ভাইয়ের কোলে। তিনি বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে সানন্দে ঘরে চলে গেলেন। আমি এবার খুব বেকায়দায় পড়লাম। অপরিচিত মেয়েটির দিকে চেয়ে হাসার চেষ্টা করলাম। মেয়েটা সপ্রতিভ হেসে বলল,
‘ ভেতরে এসো, ভেতরে এসো। কতটা জার্নি করে এসেছ। টায়ার্ড নিশ্চয় খুব?’
আমি উত্তরে অল্প হাসলাম। সোফার এক কোণায় বসে চোখ ঘুরিয়ে সাজানো গোছানো ঘরটা দেখতে লাগলাম। অন্দরমহলের পর্দা সরিয়ে আরও একজন সম্ভ্রান্ত মহিলা বেরিয়ে এলেন। আমার পাশে বসে বললেন,
‘ বেশ মিষ্টি তো তুমি।’
আমি মুখ কাঁচুমাচু করে নিজের দিকে তাকালাম। বারো ঘন্টার জার্নি করে চুলের অবস্থা পথের ধারের পাগলীটির থেকেও ভয়াবহ। জামাটাও কুঁচকে আছে এদিক-সেদিক। চোখদুটো ঘুমে ফুলো। এই অবস্থায় তিনি আমাকে ঠিক কী রকম মিষ্টি দেখলেন, বুঝতে পারলাম না। উনার দিকে চেয়ে মৃদু হাসার চেষ্টা করলাম। উনি শুধালেন,
‘ তুমি অরির মেয়ে না? শুভ্র তোমার মামাতো ভাই, তাই তো?’
আমি চমকে তাকালাম। এই ভদ্রমহিলা শুভ্র ভাইকে চিনেন? আমি হতবিহ্বল হয়ে মৃদু মাথা নাড়লাম। উনি বললেন,
‘ আমাকে বোধহয় দেখোনি কখনো। দেখবেই বা কী করে? আমিই তো দেখিনি তোমাদের। আমি হলাম তোমার মা আর মামুর আপন মামাতো বোন৷ অন্যদিকে তোমার বাবার জেঠাতো বোন হই৷ কতদিক থেকে আমাদের সম্পর্ক দেখেছ? অথচ এখন আর যোগাযোগ নেই। কারো মৃত্যু সংবাদ ছাড়া শেরপুর যাওয়া হয়ে উঠে না। একসময় সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। এখন সংসারের চাপ নেই কিন্তু শরীর সাঁয় দেয় না।’
এটুকু বলে থামলেন উনি। আমার মুখের দিকে চেয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললেন,
‘ অরি নাকি অসুস্থ শুনলাম? এখন কেমন আছে তোমার মা?’
উনার প্রশ্নে আচমকা মায়ের কথা মনে পড়ে গেল আমার। মন খারাপ হয়ে গেলো। ক্ষয়ে যাওয়া চিন্তাটা আবারও ফিরে ফিরে আসতে লাগল। মাথা নুইয়ে মৃদু কন্ঠে বললাম,
‘ আজ সন্ধ্যায় অপারেশন।’
ভদ্রমহিলা উদ্বিগ্ন মুখে বসে রইলেন। পরিবেশটা মুহূর্তেই গম্ভীর হয়ে গেল। আমার বুকটাতেও চেপে বসল অদম্য কান্না। বাবা-মাকে ছাড়া থাকার অভ্যেস না থাকার সাইড ইফেক্ট বলেই হয়তো বাচ্চাদের মতো আম্মুকে মনে পড়তে লাগল। এমন গম্ভীর পরিবেশে বাজি ফাটালেন মিরাজ ভাই। রুম থেকে বেরিয়ে এসে চিন্তিত কন্ঠে বললেন,
‘ কী রে? তুই নাকি বাসে উঠলেই বমি করতে করতে অজ্ঞান হয়ে যাস? আকাশ-পাতাল ভাসিয়ে ফেলিস? আমাকে তো অ্যাম্বুলেন্স রেডি রাখতে বলা হয়েছিল৷ আমি অবশ্য একটা ঠেলাগাড়ি রেডি রেখেছিলাম। ঠেলা গাড়িতে ঠেলে ঠেলে আনবো বলে প্ল্যান করেছিলাম। কিন্তু তুই তো দেখি একদম ফিট। একা একাই এহসান সিটি পর্যন্ত এসে হাজির। এখন এই ঠেলা গাড়িটার কী করি বল তো?’
এই লোকের কথার ধরনেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল আমার। আমি চোখ-মুখ শক্ত করে এক নজর চেয়েই চুপ করে রইলাম। হাস্যোজ্জ্বল মেয়েটি হেসে উঠে বলল,
‘ ওর কোথায় কিছু মনে করো না তো। ও সবসময়ই এমন করে। তুমি বরং আমার সাথে চলো। তোমাকে রুম দেখিয়ে দিই। ফ্রেশ হও।’
আমি প্রত্যুত্তর না করে উঠে দাঁড়ালাম। এখন সত্যি সত্যিই একটু ফ্রেশ হওয়া দরকার। দক্ষিণের ঘরের দিকে যেতে যেতে মেয়েটি বলল,
‘ তুমি শুভ্র ভাইয়ার কাজিন হও?’
আমি মাথা নাড়লাম। মেয়েটি হাসল। বলল,
‘ কোথাও একটা মিল আছে অবশ্য। মিলটা ঠিক ধরতে পারছি না। শুভ্র ভাইয়া যখন চট্টগ্রাম থাকতো তখন ভাইয়ার সাথে মাঝে মাঝে আসতো। ভাইয়াও চুয়েট থেকেই পড়াশোনা করেছে।’
আমি মনোযোগ দিয়ে শুনলাম। মেয়েটি বিছানার চাদর ঠিক করে আমাকে ওয়াশরুম দেখিয়ে দিলো৷ গোসল সেড়ে শরীরটা একটু ঝরঝরে হতেই পৃথিবী ভাসিয়ে বৃষ্টি নামল। আমি স্নিগ্ধ চোখে চেয়ে রইলাম৷ মাথার ভেতর অনেক, অজস্র চিন্তারা ঘুরেফিরে গেল। কিন্তু সেই চিন্তাগুলোর কোনো নাম খুঁজে পাওয়া গেল না। ঘন্টাখানেক পর আবারও রুমে উঁকি দিল মেয়েটি। নক করে বলল,
‘ তুমি এখন ঘুমাবে?’
আমি মৃদু মাথা নাড়লাম। মেয়েটি সদা হাসে। এবারও হেসে বলল,
‘ তাহলে নাস্তা করে নাও। তোমার অস্বস্তি হলে নাস্তা তোমার ঘরে নিয়ে আসি? আমিও নাস্তা করিনি। একসাথে নাস্তা করলে বিরক্ত হবে?’
আমি একটু হেসে বললাম,
‘ তা কেন? আসুন না। একসাথে খাই।’
মেয়েটি খুশি খুশি মনে নাস্তা নিয়ে এলো। টি-টেবিলে প্লেট সাজিয়ে আচমকা প্রশ্ন ছুঁড়লো,
‘ শুভ্র ভাইয়ার সাথে তোমার সম্পর্ক কেমন? আই মিন, কতটা ক্লোজ?’
আমি কী উত্তর দেব বুঝে না পেয়ে বললাম,
‘ আমার মামুর ছেলে। কাজিনদের সাথে যতটা ক্লোজ হওয়া যায় ততটাই।’
মেয়েটি হাসল। সপ্রতিভ কন্ঠে বলল,
‘ শুভ্র ভাইয়া দূর্দান্ত একটা মানুষ বুঝলে? কম কথা বলে। কিন্তু যখন বলে, কী সুন্দর করে কথা বলে! আমি উনাকে চিনি প্রায় ছয় বছর হলো। এই ছয় বছরে আমার সাথে উনার যতবারই দেখা হয়েছে হাসিমুখে শুধু একটি কথায় বলেছেন, “ভালো আছো মিহু?” এর বাইরে একটা কথাও না। আমি উনার এই একটি কথা শুনেই হাত-পা পিছলে প্রেমের সাগরে ডুবে গেলাম। অল্প বয়স ছিলো তো, তাই।’
কথাটা বলে নিজেই খিলখিল করে হেসে উঠলেন মিহু আপু। আমি কী বলব বুঝতে না পেরে মৃদু হেসে ভুনাখিচুড়ি আর গরুর মাংসে মনোযোগ দিলাম। মিহু আপুর হাসতে হাসতে চোখে জল চলে এলো। হাসি থামিয়ে নিজে থেকেই বললেন,
‘ তখন আমি কেবল ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। শুভ্র ভাইয়াকে মনের কথা বলব সেই সাহস নেই। হেসে কথা বললেও সবসময় কেমন গম্ভীর্যের দেয়ালে এঁটে রাখেন নিজেকে। কথা বলতেও বুক কাঁপে। কিন্তু আমার ভাইয়া খুব বুদ্ধিমান। কীভাবে যেন বুঝে ফেলল। আমাকে ডেকে জানাল, শুভ্র ভাইয়ার পছন্দের মানুষ আছে। তাকে সে প্রাণাধিক ভালোবাসে। সুতরাং, প্রেমে টেমে পড়ে লাভ নেই। তার থেকে বরং তরমুজ খা। শরীর-মন ঠান্ডা হবে। আমি তরমুজ খেলাম না। তরমুজ তো দূর, সেদিন রাতে ভাতও খেলাম না। ভেঙে খান খান হওয়া হৃদয় নিয়ে বসে রইলাম। রাত ভোর করে কাঁদলাম। এতো কষ্ট হলো!’
এটুকু বলে আবারও হেসে ফেললেন মিহু আপু। তাকে এতো আনন্দ নিয়ে নিজের হৃদয়ভঙ্গের গল্প বলতে দেখে অবাক চোখে চেয়ে রইলাম আমি। মিহু আপু বললেন,
‘ আমার না খুব জানতে ইচ্ছে করে শুভ্র ভাইয়ার পছন্দের মানুষটির নাম কী? কেমন দেখতে? যদিও আমরা সবাই সবার জায়গা থেকে খুব স্পেশাল। তবু, মেয়েটি বোধহয় শুভ্র ভাইয়ের মতোই চমৎকার হবে?’
কথাটি বলে আমার দিকে জ্বলজ্বলে চোখে চাইলেন মিহু আপু। ডানহাতে খাচ্ছিলাম। উনি আমার বামহাতটা চেপে ধরে বললেন,
‘ তুমি তো শুভ্র ভাইয়ার কাজিন। চেনো তার পছন্দের মানুষটিকে? দেখেছ? কেমন দেখতে?’
আমি তৃতীয়বারের মতো কোনো উত্তর খুঁজে পেলাম না। অসহায় চোখে চেয়ে বললাম,
‘ নাহ্! শুভ্র ভাই তো সবার সাথেই এমন গম্ভীর। উনার সম্পর্কে জানা একটু কঠিন। ভাইয়ারা হয়তো জানে। আমি বলতে পারি না।’
মিহু আপু কিছুটা হতাশ হয়েও মিষ্টি হাসলেন। আমি ভুনাখিচুড়ি আর মাংসের টুকরো পেটে চালান করতে করতে ভাবলাম, আর কত ভাই? আর কত? মানে, মিথি আপু থেকে শুরু করে সুদূর চট্টগ্রাম। আর কোথায় কোথায় প্রেয়সী লুকিয়ে রেখেছেন এই বেয়াদব লোক? আর মেয়েরাও বা কী?
একজনের প্রেমে আর কতজন হাবুডুবু খাবে? যেখানে তাকাই সেখানেই একজন না একজন মূর্তিমান আপদ হয়ে বসে থাকে। বলি, তোদের কী আক্কেল পছন্দ নেই? যেখানে সেখানে পিছলে যাস! আজাইরা। খাওয়া-দাওয়া শেষে খুব আয়োজন করে ঘুমুতে গেলাম আমি। কিন্তু ঘুমটা বেশিদূর এগোলো না। দরজায় তুমুল কড়া নাড়ার শব্দে হুড়মুড় করে উঠে বসলাম। ভূমিকম্প হচ্ছে কিনা খেয়াল করে ধীরেসুস্থে দরজার দিকে চাইলাম। বিরক্তি চেপে বললাম,
‘ কে?’
সাথে সাথে ধাম করে দরজা খুলে দরজায় দাঁড়ালেন মিরাজ ভাই। বরাবরের মতোই চিন্তিত কন্ঠে বললেন,
‘ তুই ঘুমুচ্ছিলি? নাকি কেঁদেকেটে চোখ-মুখ ফুলিয়ে ফেলেছিস? এতো চোখের জল তোদের থাকে কোথায় বল তো? দেশে খরা টরা হলে তো সেচের পানির প্রয়োজন নেই। তোদের মতো কিছু রমণীকে কাঁদতে বসিয়ে দিলেই প্রবলেম সল্ভ। একেবারে বন্যা।’
আমি বিরক্তিতে রি রি করতে করতেও চুপ করে রইলাম। মিরাজ ভাই হতাশ হয়ে বললেন,
‘ শোন, কান্নাকাটি বন্ধ। তোর নাকি মুড সুয়িংয়ের বি-রা-ট সমস্যা আছে? এই মুহূর্তে নাকি তোর উচ্চ মাপের মন খারাপ হওয়ার কথা? আমাকে বলা হয়েছে, তোর এই ফ্যাঁচফ্যাঁচ কান্নাকাটি বন্ধ করিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে এনে মন ভালো করে দেওয়া। তো, ঝটপট রেডি হয়ে যা। দেখি কান্নারাণীর মন ভালো করা যায় কি-না।’
আমি জ্বলন্ত চোখে চাইলাম। এই ভদ্রলোকের মাথাটা তরমুজ ফাটার মতো ফাটিয়ে দিতে ইচ্ছে হলো। আর যে তাকে আমার মন ভালো করার মহান দায়িত্ব দিয়েছে তার মাথাটা লবণ, মরিচ দিয়ে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে হলো। আমি লম্বা দম নিলাম। নিজেকে শান্ত করে ভদ্র মেয়েটির মতো বললাম,
‘ আমার মন ভালো আছে, মিরাজ ভাই। কান্নাকাটি করছি না। যে আপনাকে আমার মন নিয়ে হিউজ গবেষণা করার আদেশ দিয়েছে তাকে বলুন চিন্তা-ভাবনা কমাতে। আমি এখন ঘুমোবো। কোথাও যাব না। দয়া করে আমার ঘুমের ডিস্টার্ব করবেন না। আমার মাথাব্যথা করছে।’
মিরাজ ভাই আমাকে দুনিয়ার ডিস্টার্ব করলেন। পাশের রুমে ফিরে গিয়ে ধুমধাম গান বাজাতে লাগলেন,
”ওরে, মন ভালা না রে তোর
পিরিত ভালা না রে, বন্ধু।
তোর প্রেমে পাগল হইয়া
হইলাম কূলহারা….”
রাগে শরীরটা জ্বলে গেল আমার। মিরাজ ভাই গানের সাউন্ড আরও বাড়িয়ে দিলেন। সেই মুহূর্তে আমার ইচ্ছে হলো, এই অভদ্র লোকটিকে এই মুহূর্তে পৃথিবী থেকে ভ্যানিশ করে দিই। দুনিয়ার অসভ্য মানুষ! শুভ্র ভাইয়ের থেকেও অসভ্য! বেয়াদব! আমি নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে বইয়ে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলাম। মনোযোগ এলো না। অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, যা পড়েছিলাম সব ভুলে যাচ্ছি। কিচ্ছু মনে থাকছে না৷ অন্যদিকে বাসায়ও যোগাযোগ করতে পারছি না। চট্টগ্রামে নেটওয়ার্কের অবস্থা খুব খারাপ। আপু সাতবার ফোন দিয়েছিল, রিসিভ করতে পারিনি। ওখানে কী হচ্ছে, আম্মু কেমন আছে?
কিচ্ছু জানতে পারছি না। অচেনা মাথা ব্যথাটা ফিরে ফিরে আসছে। দুশ্চিন্তায় আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। পরিচিতের দেয়াল পেরিয়ে যে আমি’র অস্পষ্ট অবয়ব খুঁজে পেয়েছিলাম চট্টগ্রামের ভোরে। সে আমি আবারও হারিয়ে যাচ্ছে। আত্মবিশ্বাস কমে আসছে। কালকের পরীক্ষাটা যদি জঘন্য হয়? তাহলে কী হবে? আর কোথাও পরীক্ষা দিইনি। আবারও কী ময়মনসিংহ ফিরতে হবে? ওই দমবন্ধকর জীবনে? আচ্ছা, আম্মু কেমন আছে? একটু পর তো অটিতে নেওয়ার কথা। কেউ ফোন তুলছে না কেন? নতুন কোনো বিপদ হলো না তো?
দুশ্চিন্তায় দুশ্চিন্তায় অচেনা ব্যথাটাও হুহু করে বাড়তে লাগল। বুক বেয়ে উথলে উঠল কান্না। কিন্তু সেই উথলানো কান্না কিছুতেই জল হয়ে বেরিয়ে আসতে পারছে না। আবার আটকে রাখাও যাচ্ছে না। মিহু আপু আমার বিছানার উপর বসে ফোন ঘাঁটছে। ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে, আমার সাথেই থাকবে। অন্যকারো সামনে নিজেকে ছিঁচকাদুনে, দুর্বল দেখানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং, আজকের রাতে কান্নাকাটি নিষিদ্ধ। রাত আটটা পর্যন্ত মিরাজ ভাইয়ের গানের অত্যাচার চলল। এখন অবশ্য গান চেঞ্জ হয়েছে। মিউজিক প্লেয়ার ফাটিয়ে গান বাজছে,
” টেরেনে চইড়াছি,
পেলেনে চইড়াছি,
চইড়াছি কত গাড়িতে,
আজকে হাওয়াতে উইড়া
আইছি রে তোর বাড়িতে
ঐ নাম কি রে তোর
কুত কুতি
ঐ কাম কি রে তোর
কুত কুতি-
আজকে প্রেমের কুতকুত খেলমু
দেখবে সবাই চাইয়া।”
এই গানটা এই নিয়ে চতুর্থবার চলছে। অশ্লীল এবং দুনিয়ার বিশ্রী গান। মিউজিক প্লেয়ারটা শিল-নোড়া দিয়ে ছেঁচে গুড়োগুড়ো করে ফেলতে ইচ্ছে করছে আমার। এই মাইগ্রেনের ব্যাথা, এতো এতো দুশ্চিন্তার মাঝে এমন অত্যাচার সহ্য করা যায়? আমি সহ্য করে নিলাম। দুনিয়া ভাঙা কান্না চেপে একের পর এক ফোন ট্রাই করতে লাগলাম। কেউ ফোন তুলছে না! কেউ না! ঘড়ির কাটা নয়টায় পৌঁছাতেই আমার আত্মবিশ্বাস ভেঙে পড়ল। বইয়ের প্রতিটি পাতাই নতুন মনে হতে লাগল। আমি বুঝে ফেললাম, আমি হেরে গিয়েছি।
আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। নিজেকে এতো দুর্বল ভাবতেই ঘৃণা হচ্ছে। আত্ম ঘৃণা খুব কঠিন জিনিস। আত্মঘাতের মতোই কঠিন। আমি এক মুহূর্তের জন্য বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই হারিয়ে ফেললাম। সব ছেঁড়েছুঁড়ে বাসায় ফিরতে ইচ্ছে হলো। নিজের ঘরটাতে আরাম করে বসে পৃথিবীকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো, আমার পৃথিবীতে শান্তির এতো অভাব কেন? হে পৃথিবী আমাকে একটু শান্তি দাও! রাত সাড়ে নয়টায় বাবা ফোন রিসিভ করলেন। আমি অস্থির হয়ে বললাম,
‘ আম্মু কেমন আছে বাবা? আমার এখানে ভালো লাগছে না। আমি পরীক্ষা দেব না। এক্ষুনি বাসায় যাব। এক্ষুনি।’
বারান্দায় দাঁড়িয়ে এই প্রথম হুহু করে কেঁদে ফেললাম। বাবা কিছুক্ষণ চুপ থেকে কেবল বললেন,
‘ চট্টগ্রাম থেকে ময়মনসিংহের বাস তো একটায় মা। কাল সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করো। কাল তো চলেই আসবে। তোমার আম্মুকে অটিতে নিচ্ছে পরে ফোন দিচ্ছি।’
সন্ধ্যার অপারেশন এতো রাতে হচ্ছে কেন? এই প্রশ্নটা করার সুযোগ পেলাম না। আপুর ফোনে ট্রাই করলাম। ফোন তুলছে না। নতুন বিপদের ভয়ে গায়ের রোম দাঁড়িয়ে গেলো আমার। আম্মু কী সত্যিই ঠিক আছে? বাবার কন্ঠ কী একটু অন্যরকম ঠেকলো? ময়মনসিংহ ফিরে কী আদৌ মাকে দেখতে পাবো? আমার পৃথিবী কেঁপে উঠল। পুরোটা রাত এক ফোঁটা ঘুম হলো না। মুখটা যথাসম্ভব আড়াল করে জায়নামাজে চুপচাপ বসে রইলাম। কোনোভাবেই কান্না আটকানো যাচ্ছে না। মিহু আপু খেতে ডাকতে এসে একবার বলেই ফেললেন,
‘ তুমি কী কাঁদছো রোদ?’
আমি উত্তর দিতে পারলাম না। কান্নায় রুদ্ধ হয়ে আছে গলা। কোনোরকম মাথা নেড়ে জানালাম, না। রাত একটায় আপু ফোন দিলো। জানাল,
‘আম্মু ভালো আছে। এখনও জ্ঞান ফিরেনি। এখন ডায়েবিটিস কন্ট্রোলে থেকে ঘা’টা দ্রুত শুকিয়ে গেলেই আলহামদুলিল্লাহ।’
আপুর কন্ঠটা খুব সাদামাটা লাগল আমার। বারবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘সত্যি তো?’ আপু খুব বিরক্ত হলো। ধমক দিয়ে বলল,
‘ তোকে মিথ্যা বলব কেন? আজাইরা চিন্তা বাদ দিয়ে ভেবেচিন্তে পরীক্ষা দে।’
আমার মন আশ্বস্ত হলো না। মাইগ্রেনের ব্যথাটা হু হু করে বাড়তে লাগল। চোখ দুটো অন্ধকার হয়ে আসতে লাগল। কয়েকমাস যাবৎ আমি ঠিক নেই। কোনোরকম আওয়াজ মস্তিষ্ক সহ্য করতে পারছে না। নিজের উঁচু কন্ঠতেও ঝাঁঝিয়ে উঠে মাথা। অস্থির লাগে। পাগল পাগল লাগে। তারওপর মিরাজ ভাইয়ের এতো উচ্চ আওয়াজ, দুশ্চিন্তা, ঘুমহীন রাত সব মিলিয়ে শরীরটা যেন সহ্যের সীমা পেরিয়ে গেল৷ ভাইয়াকে ফোনে পাওয়া গেল রাত দুটোই। ছোট্ট করে বলল,
‘ আম্মু ভালো আছে৷ ঘুমাচ্ছে।’
আমার মনে হলো সবাই যেন কেমন হেঁয়ালি করে কথা বলছে। সঠিক তথ্যটা দিচ্ছে না। সারাটা রাত নির্ঘুম কেটে পরের দিন যে কী করে পরীক্ষা দিতে পৌঁছালাম আমি নিজেও মনে করতে পারি না। নিঃশ্বাসের থেকেও দ্বিগুণ গতিতে সৃষ্টিকর্তার নাম জপছিলো ঠোঁটের ডগা। পরীক্ষার আগের একটি ঘন্টা টেবিলে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম। মাইগ্রেনের ব্যথায় শরীর ঝাঁকিয়ে কান্না পেলো। কী পরীক্ষা দিলাম জানি না। তবে, পরীক্ষা দেওয়ার পর বুঝলাম পরীক্ষা ভালো হয়েছে। আশা রাখা যায়।
কিন্তু পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়েই নিরাশ হতে হলো আমায়। ভয়াবহ এক বিপত্তি ঘটে গেল। চবির ক্যাম্পাসে ভ্যাবলাকান্তের মতো হারিয়ে গেলাম। আসার সময় তো ঘোরের মাঝে এসেছি। এখন আর মিরাজ ভাইকে খুঁজে পাচ্ছি না। যেদিকে এগিয়েছি সেদিক মানুষের পর মানুষ আর জঙ্গল ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না। নেটওয়ার্কের অবস্থা যাচ্ছেতাই, ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না। তার থেকেও বড় সমস্যা আমি মিরাজ ভাইয়ের চেহেরা ভুলে গিয়েছি। চোখ বন্ধ করে মিরাজ ভাইয়ের চেহারা ভাবার চেষ্টা করতেই শুভ্র ভাইয়ের চেহারা ভাসছে। নয়তো মায়ের মুখ মনে পড়ছে।
কিছুতেই মিরাজ ভাইয়ের চেহারা মনে হচ্ছে না। কী বিপদ! এখন কী হবে? এই হাজার হাজার মানুষের মাঝে এই অভদ্র লোকটাকে খুঁজে পাব কী করে? প্রায় ঘন্টাখানেক ঘুরেফিরে চার রাস্তার মোড়ে একটা স্তম্ভের সিঁড়িতে পা ছড়িয়ে বসে পড়লাম আমি। মিরাজ ভাই আমায় খুঁজে পেলেন আরও মিনিট পনেরো পর৷ আমাকে নিরুদ্বেগ বসে থাকতে দেখে বিস্মিত কন্ঠে বললেন,
‘ তুই যে কতটা সাংঘাতিক মেয়ে জানিস? হারিয়ে গেছিস, কোথায় সিঁড়িতে বিলাপ পেরে কাঁদবি। তা না, টাইট হয়ে বসে আছিস। তোর কোনো ধারণা আছে চিন্তায় চিন্তায় এখনও কেমন দপদপ করছে আমার মাথা? আরেকটু হলেই তো হার্ট ফেল করে মরে যেতাম ভাই।’
আমি উত্তর না দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। মিরাজ ভাই এক বোতাল পানি সঙ্গে সঙ্গে নিজের মাথায় ঢেলে গোসল হয়ে গেলেন। স্তম্ভের সিঁড়িতে হাত-পা ছড়িয়ে বসে পড়ে বললেন,
‘ ওড়না দিয়ে একটু বাতাস টাতাস কর। আরেকটু হলেই তো হার্ট ফেল করতাম। আমার উচিৎ ছিলো তোকে নিয়ে বেরুনোর আগে থানায় একটা লিখিত জবানবন্দি লিখে আসা। সেখানে লেখা থাকতো, আমি নিতান্ত বাধ্য হইয়া একটা দপদপে রমণীকে লইয়া চট্টগ্রাম জনপদে বাহির হইতেছি।
এই দপদপে রমণীর যেখানে সেখানে হারাইয়া যাওয়ার ব্যামো আছে৷ সুতরাং, সে হারাইয়া গেলে আমি মিরাজ কোনোরূপ দায়ী নহে। তুই সেখানে টুক করে একটা সই করে দিতি। নাহলে তো তোর বাপ-ভাই আমাকে জেলের ভাত না খাইয়ে ছাড়তো না। মাইয়াদের তো আবার আরেক জিনিস থাকে, জামাই। বউদের প্রতি তাদের গদগদে প্রেম। বউ যে কত মাথা নষ্ট, তা তো দেখবে না। সব দোষ হবে আমার মতো আমজনতার।’
আমি ফুঁস করে নিঃশ্বাস ফেললাম। মিরাজ ভাইয়ের আজাইরা কথায় মেজাজ খারাপ হলেও নির্লিপ্ত কন্ঠে বললাম,
‘ ছয়টায় আমার বাস আছে মিরাজ ভাই৷ ফিরে গিয়ে ব্যাগ গোছাতে হবে। আপনি কী এখানেই বসে থাকবেন? নাকি বাসায় ফিরবেন?’
মিরাজ ভাই উত্তর দিলেন না। এক চুল নড়লেনও না। সেখানে বসে থেকেই দশ টাকার বাদাম খেলেন। ভিজে যাওয়া শার্ট শুকালেন। আমি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করলাম। এই এলোমেলো লোক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করে তা আমার এক মুহূর্তের জন্যও বিশ্বাস হলো না। ঘড়িতে সাড়ে চারটা বাজিয়ে উনি উঠলেন। গাড়িতে উঠেই বললেন,
‘ তুই নাকি কালো সুন্দরী? কিন্তু গায়ের রঙ তো ফকফকাই দেখা যাচ্ছে। সাদার সঙ্গে থাকতে থাকতে সাদা হয়ে গেছিস? নাকি কাহিনি অন্য?’
আমি উত্তর না দিয়ে চোখ গরম করে তাকালাম। পরপরই মুখ ঘুরিয়ে রাস্তা দেখায় মনোযোগ দিলাম। মিরাজ ভাই আচমকা বললেন,
‘ যাকে খুঁজছিস তার সাথে চবির কোনো সম্পর্ক নেই। তার বাস ছিলো চুয়েটে। চুয়েটের হলে। হলরুম নাম্বার ১০২। তুই বললে, তোকে চুয়েটের রাস্তায় নিয়ে বসিয়ে দিয়ে আসতে পারি। আসব?’
আমি চমকে চাইলাম। মিরাজ ভাই এই প্রথম হাসলেন। সামনের দিকে চেয়ে থেকেই বললেন,
‘ আমাদের জীবনটা অনেকটা আয়নার মতো। তুই জীবনকে দেখে যত মুগ্ধ হবি। সে তোকে তত মুগ্ধতা দেবে। যত হতাশ হবি। তত হতাশা। ভালোবাসার ব্যাপারটাও সেরকম। কিন্তু কিছু কিছু চমৎকার মানুষের ক্ষেত্রে আয়না থিওরিটা কাজে লাগে না। তারা যখন ভালোবাসে তখন জলোচ্ছ্বাসের মতো ভালোবাসে। এদের চাওয়া-পাওয়ার আয়না দিয়ে আটকে রাখা যায় না। তাদের থিওরি একটাই, হয় ভালোবাসা, নাহয় ধ্বংস৷ আমি এমন একটা ছেলেকে দেখেছি, যে মাঝরাতে আচমকা ব্যাগহাতে বেরিয়ে যেতো।
জীবনটাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে, বিপদজনক মহাসড়কে, বাইক ভাড়া করে ছুটে যেতো দেশের অপর প্রান্তে নিজের শহরটাতে। আমরা অবাক হতাম। ভাবতাম এবারই এই ছেলের শেষযাত্রা। মরণ নিশ্চিত। কিন্তু সে ঠিক ঠিক পরেরদিনের বাস ধরেই ক্যাম্পাসে এসে উপস্থিত হতো। ক্লান্তিহীন ক্লাস করতো, টিউশন করতো। পুরো দুনিয়াকে এক আনা পাত্তা না দেওয়া ‘ডোন্ট কেয়ার’ ছেলেটা শুধুমাত্র কারো মন খারাপের চিন্তায় একের পর এক ভালো ভালো টিউশনগুলো ফিরিয়ে দিতো কেবল মেয়ে স্টুডেন্ট পড়াতে হবে বলে।
জিজ্ঞেস করলে হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলতো, ‘মেয়েদের পড়িয়ে শান্তি নেই। এদের ব্রেন অত্যন্ত লো লেভেল। এদের থেকে ট্যালেন্টেড ছেলেদের পড়িয়ে শান্তি আছে। আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ। রমণীদেরকে তোমাদের হৃদয় হস্তে সম্প্রদান করা হলো।’ আমরা হাসলেও অবাক হতাম। মনে মনে বলতাম, ছেলেটা চমৎকার। এই চমৎকার মানুষগুলোকে চমৎকারভাবে আগলে রাখা উচিত। এদের ধ্বংসাত্মক রূপ খুব কঠিন। ভালোবাসার রূপও কঠিন। তোর কী মনে হয়? যারা তাদের পায় তারা কী একটু বেশিই ভাগ্যবান নয়? অথবা খুব দুর্ভাগা?’
মিরাজ ভাইয়ের মুখে এমন গোছালো কথা আশা করিনি বলেই হয়তো একটু অবাক হলাম। উনি কী আমায় আগে থেকেই চিনেন? হঠাৎ করেই উনার এই প্রসঙ্গটা বুঝা-না-বুঝার মতো ঝুমঝুমিয়ে মস্তিষ্কব্যপী ঘুরতে লাগল। ঝিমিয়ে আসা মন বারবার শুধাল, তবে তুই কী রোদু? ভাগ্যবতী? নাকি খুব দুর্ভাগা? এইযে স্বাভাবিক হতে হতেও কোথায় একটা অস্বাভাবিকতার সুর? সেই বেসুরে জীবনের দায়ভারটা কার? তোর? হ্যাঁ, নিশ্চয়ই তোর। তোর দুর্বলতার কারণ কেবল তুই। এই পৃথিবীতে কেউ কাউকে ভাঙার ক্ষমতা রাখে না, যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ তাকে ভেঙে ফেলার অস্ত্র তুলে দেয় অন্যকারো হাতে। অবচেতনেই অধিকার দেয়, ভেঙে ফেলার। আর খুব আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই ধ্বংসাত্মক অধিকারটা মানুষ তাকেই দেয় যাকে সে প্রচন্ড ভালোবাসে। তবে কী আমিও ভালোবাসি? জলোচ্ছ্বাসের মতো না হলেও বৃষ্টির মতো করে ভালোবাসি?
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/rodsuvro/
[ বিঃদ্র-১ঃ পর্বটা বেশি বড় হয়ে গিয়েছে। অযথা বর্ণণাও চলে এসেছে কিছু জায়গায়। আরো গুছিয়ে, কাট-ছাঁট করে লেখা যেতো। কিন্তু সুযোগ হয়ে উঠেনি। তাই পর্বটি ভেঙে দুই অংশে ভাগ করেছি। এই পর্বের দ্বিতীয় অংশটুকু কাল সন্ধ্যায় পোস্ট করা হবে।
বিঃদ্র-২ঃ আমি জানি, প্রেমকথনের রিসেন্ট কিছু পর্ব একদম অন্যরকম ধাঁচে লেখা হচ্ছে। তার একটা কারণ অবশ্য আছে। প্রেমকথনে সাধারণত একটি টপিক দিয়ে একটি পর্ব লেখা হয়। পরবর্তী পর্বে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আগের টপিকের কোনো উল্লেখ থাকে না। এবারের টপিকটা বড় বিধায় একের পর এক পর্বগুলো একই টপিকে সীমাবদ্ধ থাকছে। কাহিনি বিন্যাসও হয়ে গিয়েছে নিতান্ত সাধারণ। গল্পটা যেহেতু রোদ বলছে, তাই তার চিন্তাগুলোই প্রকাশ পাচ্ছে। তার ভুল, তার সাফারিং। এতে প্রেমকথনের শোভা নষ্ট হওয়ার কিছু নেই। কারো জীবনই সবসময় আনন্দের হয় না। কেউ কখনো পার্ফেক্ট হয় না। গল্প, উপন্যাসও না। কেননা, গল্প, উপন্যাস বাস্তবতারই এক নিগূঢ় প্রতিচ্ছবি। পাঠকরা শুধু রোদ-শুভ্রর আনন্দের দায়ভার নিবে। বিচ্ছেদের দায়ভার নিবে না তাই কী হয়? আশা করি পাঠকরা ধৈর্য রাখবেন। ভালোবাসা ]