রুম নম্বর ৯০৯ পর্ব ২
মহিলাকণ্ঠের ডাকে পিছনে ঘুরে তাকান আহমেদ সাবাজ। আবছা আলোতে দূরে থাকা অবয়বটিকে চেনা সম্ভব হচ্ছে না। ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসছে মহিলাটি। কাছে আসতেই পরিচিত মুখ, ভীষণ পরিচিত- সাবাজের অর্ধাঙ্গিনী।
“তুমি এখানে কীভাবে এলে?”- সাবাজ প্রশ্ন করে।
“কেন? তোমার অসুবিধা হচ্ছে?”
“প্রশ্নবিদ্ধ করছো কেন আমাকে?”
কিছু না বলে সাবাজের পাশ কাটিয়ে জানালার দিকে মুখ করে তাকায় তার স্ত্রী। সাবাজ ঘাড় ঘুরিয়ে নেয় সেদিকে। জানালা বন্ধ, তাছাড়া অন্ধকার রাতে জানালার থাই গ্লাস ভেদ করেও বাইরের কিছু দেখার সম্ভাবনা নেই। তবে কী দেখছে সে? জানালার দুপাশে ঝুলানো পর্দা? নাকি জানালার উপরে থাকা ডিম লাইট যেখান থেকে আবছা আলো আসছে?
কোথাও এমনটা নয়তো এই সামান্য আলোও তাকে বিরক্ত করছে? কয়েক সেকেন্ড এভাবেই চললো, নীরব দু’জনেই।
সাবাজের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে পুনরায় প্রশ্ন করে তার স্ত্রী, “কখনও কি আমার কিংবা আমার বাচ্চার কথা মনে পড়ে না তোমার?”
সাবাজ উত্তর দেয় না। পেটের উপর থেকে শাড়ির অংশটুকু সরিয়ে নিয়ে তার স্ত্রী আবারও বলে, “দেখ, কেমন নির্দয়ভাবে আমার পেট চিরে তারা তোমার সন্তানকে বের করেছিল। এটাও কি কষ্ট দেয় না তোমাকে?”
সাবাজ তার স্ত্রীর পেটে ঊর্ধমুখীভাবে কাটার দাগ দেখতে পায় যেগুলোকে চৌদ্দটি সেলাই দ্বারা জোড়া লাগানো হয়েছে। তার স্ত্রী ফের প্রশ্ন করে, “বলো? কখনও কি মনে পড়ে না আমাদের? কষ্ট হয় না আমাদের জন্য?”
সাবাজের চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা হয়- হ্যাঁ প্রচণ্ড মনে পড়ে তোমাদের, খুব বেশি কষ্ট হয় তোমাদের অনুপস্থিতিতে। কিন্তু তার গলা দিয়ে একটি শব্দও বের হয় না।
“আমি জানি তুমি কোনো উত্তর দেবে না। এটাও জানি আমাদের অনেক বেশি মনে পড়ে তোমার। বেঁচে থেকে এতো কষ্ট ভোগ করে লাভ আছে বলো? তোমাকে নিয়ে যেতে চাই আমি। যাবে?”
সাবাজের উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে ডান হাতে থাকা ড্যাগারটি নিয়ে ক্ষীপ্র ষাঁড়ের মতো ঝাপিয়ে আসে তার স্ত্রী।
_____
বাথরুমে গিয়ে চোখে-মুখে পানি ছিটায় সাবাজ। রুমে ফিরে এসে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে চোখ বন্ধ করলেই দৃশ্যটি আবারও ভেসে ওঠে। স্বাভাবিকভাবেই তোয়ালেটা রেখে আবারও বিছানায় শুয়ে পড়েন। কিঞ্চিৎ ভয় পাওয়ার কথা তবে তিনি পাচ্ছেন না। স্বপ্নটি পরিচিত তার কাছে, আগেও দেখেছেন কয়েকবার। সেজন্যই ভয় নামক জিনিস টা সাড়া দিচ্ছে না।
একই স্বপ্ন বারবার দেখাকে প্রাথমিকভাবে “ড্রিম ল্যাগ” নাম দেওয়া হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ কিংবা আবেগতাড়িত ঘটনাকে মস্তিষ্ক সংরক্ষণ করে থাকে৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নেতিবাচক ঘটনাগুলো স্বপ্নে ফিরে আসে।
সাবাজের জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছিল তার স্ত্রী-বাচ্চার মৃত্যু। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে দু’জনেই মারা যান। একসাথে দু’টি জীবনের নিভে যাওয়া সাবাজের জীবনে কম শোকের সাড়া জাগায়নি। তাদের মৃত্যুর ঘটনাকে সাবাজ কখনওই ভুলে থাকতে পারেননি আর এটাকে তার মস্তিষ্ক তীব্রভাবে সংরক্ষণ করে রেখেছে যা বারবার স্বপ্নে ফিরে এসে ড্রিম ল্যাগ ঘটাচ্ছে।
তবে স্বপ্নের বিষয়গুলির ব্যাখ্যা সাবাজ দাঁড় করাতে পারেননি৷ স্বপ্নে তিনি তার স্ত্রীর পেটে চৌদ্দটি সেলাইয়ের দাগ লক্ষ্য করেন অথচ সিজারে এত বড় করে কাটা হয় না যে এতগুলো সেলাই-এর প্রয়োজন হবে। তাছাড়া সিজারের জন্য পেটে আড়াআড়িভাবে কাটা হয় কিন্তু তার পেটে কাটার দাগ নাভী থেকে ঊর্ধ্বগামী।
এবং সবথেকে বড় বিষয় হলো তার স্ত্রী-সন্তান দু’জনেরই মৃত্যু নরমাল ডেলিভারির সময়ে হয়েছিল, সিজারে নয়।
স্বপ্নে মানুষ অবাস্তব, অসম্ভব, অপ্রাসঙ্গিক কতকিছুই তো দেখে। এই যেমন, স্বপ্নে যখন তার স্ত্রী প্রথমে তার নিকটে আসে, তার দু’হাতে কিছুই ছিল না। অথচ খানিক বাদেই সে বড় এক ছুরি নিয়ে আক্রমণ করে বসে। এজন্য সাবাজ স্বপ্নটিকে সাধারণ ড্রিম ল্যাগ হিসেবেই মেনে নেন।
সকালের খাবারের টেবিলেও গতরাতের মতই যথারীতি চারজন। রাফিয়া আর তার স্বামী ও গতকালের সেই মেয়েটি। তবে রাফিয়ার মেয়েটি এখানে নেই। তার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে রাফিয়া উত্তর দেয়, “নওরিন তার ঘর থেকে কখনও বের হয় না। তাকে খাইয়ে দিয়ে এসেই খেতে বসি আমরা।”
“মানে শুধুমাত্র ঘুমানোর পরের সময় বাদে বাকি সবসময় সে স্বাভাবিক থাকে?”
“স্বাভাবিক থাকে তেমনটা নয়। চুপচাপ, মুখ মলিন করে রাখে সবসময়। কথা বলে না বললেই চলে। কিছু জিজ্ঞাসা করলেও ভালো করে উত্তর দেয় না।”
আহমেদ সাবাজ খাওয়া শেষ করে হাত ধোয়ার জন্য উঠেছেন। নিজের বাড়ি হলে অবশ্য প্লেটেই হাত ধুয়ে নিতেন।
রাফিয়া আর তার স্বামীর ব্যাপারে একটা বিষয় খুব ভালো লাগে তার। একই টেবিলে বসে খাবার খাওয়া মেয়েটি তাদের কেউ না। দত্তক নেওয়া সন্তানও না। সুশীল সমাজে যাকে “কাজের মেয়ে” নামে আখ্যা করা হয়। কিন্তু এই বাড়িতে তাকে একদমই কাজের মেয়ে লাগছে না। তারা দু’জনেই নিজের মেয়ের মতোই দেখভাল করেন ওর।
খাবার পর্ব সেরে ড্রয়িং রুমে বসে তারা। মোস্তফা আনওয়ারকে দেখে খুব দুঃখ হয় সাবাজের। হুইল চেয়ার যেন তার জগতকে সংকীর্ণ ঘরে আবদ্ধ করে রেখেছে। তাদের সাথে মেয়েটিও আছে।
“আপনি কিন্তু একটি বিষয়ের সমাধান এখনও দেননি।”- অভিযোগ রাফিয়ার।
“কোন বিষয়?”- সাবাজ প্রশ্ন করেন।
“আমি আপনার নিকট সকালে রওনা হয়ে সন্ধ্যার দিকে আপনার বাড়িতে পৌঁছাতে পারতাম আর রাতে রওনা করে সকালে ফের আমার বাড়িতে চলে আসতে পারতাম। তবে আমি সকালেই কেন গিয়েছিলাম?”
“আপনি সকালে আমার কাছে পৌঁছেছিলেন যাতে করে রাতে এখানে মানে আপনার বাড়িতে পৌঁছাতে পারেন। আপনার উদ্দেশ্য ছিল এমন কিছু দেখানো যা দিনের বেলায় আসলে পরবর্তী রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। কিন্তু আপনি বিষয়টি নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন ছিলেন বলে অপেক্ষা করতে চাচ্ছিলেন না। এজন্যই আমার কাছে সকালেই গিয়েছিলেন।”- একনাগাড়ে উত্তর দেন আহমেদ সাবাজ। বাকি সবাই দক্ষ শ্রোতার বেশে তার কথা শুনছে৷
“তবে বিষয়টি কী হতে পারে এ ব্যাপারে তখন আমার ধারণা ছিল না যে কারণে উত্তর দিয়েছিলাম না। কিন্তু গতরাতে বুঝতে পারলাম আপনার মেয়ে ঠিক কেমন আচরণ করে এটা আমাকে বুঝানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন।”
ডানে তাকাতেই সাবাজ লক্ষ্য করেন মেয়েটি কেমন উসখুস করছে। নাম জানা হয়নি তার। সাবাজ তার নাম জিজ্ঞাসা করলেন। মেয়েটি নিচুস্বরে উত্তর দিলো, “আয়েশা আফরিন।”
“তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে কিছু বলতে চাচ্ছো। বলবে কিছু?”- প্রশ্ন সাবাজের।
“আপনি কীভাবে সবকিছু ধরে ফেলেন আমার খুব জানতে ইচ্ছা হয়।”
আহমেদ সাবাজ মুচকি হাসলেন, “অনুমান করে।”
“অনুমান করে সবকিছুর ব্যাখ্যা দাঁড় করানো সম্ভব না।”
নড়েচড়ে বসলেন সাবাজ- “মনে করো আকাশে ভীষণ কালো মেঘ করেছে। এই মূহুর্তে তোমার অনুমান কী হবে?”
“বৃষ্টি আসতে পারে।”
“কেন? মেঘ কাটিয়ে উঠে রোদ বের হওয়ার সম্ভাবনা নেই?”
“আছে। কিন্তু বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।”- একজন সুতার্কিকের মতো উত্তর দেয় আয়েশা।
“এক্স্যাক্টলি এটাই। মেঘ করলে বৃষ্টি হওয়া না হওয়া দু’টোরই সম্ভাবনা থাকে তবে সবথেকে গ্রহণযোগ্য সম্ভাবনা হচ্ছে বৃষ্টি হওয়া। তেমনি কোনো বিষয় যদি আমার সামনে আসে আমি কয়েকটি সম্ভাবনা দাঁড় করাই আর সেখান থেকে সবথেকে বেশি গ্রহণযোগ্য যেটা, তা গ্রহণ করি। মেঘ কাটিয়ে যেমন রোদ উঠতে পারে তেমনি কোনো বিষয়ের সবথেকে গ্রহণযোগ্য সম্ভাবনাও ভুল হতে পারে।”
কথা শেষ করে সাবাজ আয়েশার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারেন তার উত্তরে মেয়েটা যথেষ্ট সন্তুষ্ট হয়েছে৷
ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত নওরিন অনেকটা স্বাভাবিক থাকে। সাবাজ এই সময়ে তার সাথে কথা বলার জন্য ঠিক করেন। সাথে রাফিয়াও আছে৷ মেয়েটির রুমে ঢুকতেই গরম আবহাওয়া অনুভব করেন সাবাজ। রুম হিটার ব্যবহার করা হয়েছে। এখন খুব বেশি শীত নেই। মাঝরাতের পর একটা পাতলা কম্বল কিংবা কাঁথা লাগে এই যা৷ কিন্তু নওরিনের রুমে কাঁথা কম্বল কিছুই নেই। তাছাড়া ঘুম থেকে উঠেই চিৎকার মেরে সব কাপড় খুলে বাইরে ছুড়ে আবার দরজা লাগিয়ে দেয়। যে কারণে তার রুমে হিটার ব্যবহার করা হচ্ছে এখনও।
নওরিনকে কথা বলানোর চেষ্টা করানো হচ্ছে। কিন্তু মেয়েটির কাছ থেকে আশানুরূপ কিছুই পাচ্ছেন না সাবাজ। মেয়েটি কোনো ঘোরে আছে মনে হচ্ছে, আশেপাশে কিছুর দিকেই কোনো খেয়াল নেই। গরমে সাবাজের কপাল ঘেমে উঠছে। পকেট থেকে সাদা রুমাল বের করলে তা হাত থেকে নিচে পড়ে যায়।
ওটাকে উঠিয়ে দু’তিনবার ঝাড়া দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নেন তিনি। নওরিন চোখ বড় বড় করে রুমালের দিকে তাকায়, পরবর্তী মূহুর্তেই চোখ বন্ধ করে চিৎকার শুরু করে। তার হঠাৎ এমন আচরণে রাফিয়া এবং সাবাজ দু’জনেই চমকে যান। রাফিয়া সাবাজকে অনুরোধ করে বাইরে নিয়ে আসেন। রুমাল দেখে এভাবে সে চমকে যাবে সাবাজ কল্পনাও করেননি। আর চমকানোর কারণটাও মাথায় আসছে না৷
“মিসেস রাফিয়া, আপনার মেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে আমায় জানাবেন।”
“কেন?”
“ঘুম ভাঙা পর্যন্ত আমি তার রুমে থাকবো।”
রাফিয়া কিছু বলার আগেই সাবাজ বলেন, “আর হ্যাঁ, আপনিও থাকবেন অবশ্যই।”
রাফিয়া হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ান।
_____
নওরিন ঘুমিয়ে পড়েছে৷ তাকে খাওয়ানোর পরেই সে ঘুমিয়ে পড়ে। অনেকসময় হলো সাবাজ আর রাফিয়া তার রুমে আছেন৷ সাবাজ নওরিনের বিছানার পাশ দিয়ে নিঃশব্দে পায়চারি করছে। কয়েক সেকেন্ড পরপর নওরিনের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। কিছু সময় বাদে পায়চারি থামিয়ে নওরিনের চোখের দিকে লক্ষ্য করে সাবাজ। রাফিয়াও এগিয়ে আসে। নওরিনের চোখের পাতা হাল্কা কাঁপছে; পাতার উপর দিয়ে চোখের মনির নড়াচড়া খেয়াল করা যাচ্ছে। সাবাজ রাফিয়াকে বলে ছোট আয়না কিংবা চশমা থাকলে দ্রুত নিয়ে আসতে। রাফিয়া কয়েক সেকেন্ডের মাথায় দৌঁড়ে তার স্বামীর চশমা নিয়ে আসেন।
চশমাটি নওরিনের নাকের সাথে প্রায় মিশিয়ে ধরেন সাবাজ। কোনোরকম ঘোলাটে হয়েছে চশমার কাঁচ। সম্ভবত শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার। কিন্তু তার হাত-পা একবিন্দুও নড়ছে না।
ওগুলো যেন একেবারে অসাড় হয়ে আছে।
চলবে…
©Sayan