রুম নম্বর ৯০৯
পর্ব ৩
নওরিনের চাপা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। তার হঠাৎ ঘুম ভাঙার সাথে সাথেই রাফিয়া সাবাজকে রুমের বাইরে নিয়ে আসেন। মিনিটখানেকের মতো চিৎকার মেরে এখন কান্না করছে মেয়েটা। সাবাজ তার এখনকার অবস্থা দেখতে যেতেও পারছেন না কারণ মেয়েটি এখন সম্পূর্ণ বিবস্ত্র।
“ঘুম থেকে উঠে সে কেমন আচরণ করে আপনি জানেন কি মিসেস রাফিয়া?”- সাবাজ প্রশ্ন করেন।
“না। ঘুম ভাঙার পর সে তার পাশে কাউকে দেখলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতো। তার রুম থেকে বাইরে বের করে দেওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতো।”- ক্ষীণস্বরে উত্তর দেন রাফিয়া, “তবে তার ঘুম ভাঙার দশ থেকে পনেরো মিনিট পর্যন্ত সে এভাবে কান্না করতে থাকে। এরপর থেমে যায়।”
আহমেদ সাবাজ কিছু না বলেই মাথা ঝাঁকান। তার এ মাথা ঝাঁকানোর ভঙ্গিমা বলে দেয় রাফিয়ার বলা কথাটি তাকে ভাবাচ্ছে খুব।
“তবে আপনাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানানো হয়নি।”-সাবাজের মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন রাফিয়া।
“কী বিষয়?”- ভাবনা ছেড়ে প্রশ্ন করেন সাবাজ।
“নওরিনের এমন অবস্থায় তার পাশে কাউকে দেখলেই সে চিৎকার করলেও আয়েশার বেলায় তার উল্টো।”
“উল্টো বলতে?”
“আয়েশাকে দেখে সে মোটেও চিৎকার করে না কিংবা ভয়ও পায় না।”
“তার মানে নওরিনের ঘুম থেকে ওঠার পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে আয়েশা জানে?”
“হ্যাঁ। আয়েশা এখন থেকে বাকি রাত তার সাথে থাকবে।”
“সে কোথায়?”
“চলে আসবে এখনই। আমাদের এখান থেকে যাওয়া উচিত। তার রুমে যাওয়ার আগে আয়েশাকেও বাইরে থেকে গায়ের সব কাপড় ছেড়ে যেতে হয়।”
তারা চলে আসে ওখান থেকে। রাত একটা তেরো বাজে। সাবাজের জন্য যে রুমটি দেওয়া হয়েছে বেশ চমৎকার বলতে হয়। পায়চারি করতে করতে কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করা তার পছন্দ নয়। কারণ তা কোনো কিছুর সমাধান দেয় না বরং আরও উদ্বিগ্নতা বাড়িয়ে দেয়। কোনো বিষয়ের সমাধান পেতে হলে ভাবতে হয় ঠাণ্ডা মাথায়। তা হতে পারে বিছানায় শুয়ে, নির্জনে কোথাও বসে কিংবা রকিং চেয়ারে দোল খেতে খেতে। সাবাজ সবথেকে বেশি পছন্দ করেন রকিং চেয়ারে বসে ভাবতে। রাফিয়া এ ব্যাপারে জানে হয়তো। তার জন্য নতুন একটা রকিং চেয়ার জানালার পাশে পাতানো আছে।
চেয়ারে বসে ভাবতে থাকেন তিনি। কোনো একটা বিষয় নিয়ে নওরিন ভীষণ ভয় পাচ্ছে নিশ্চিত। তবে সেটা কী এমন বিষয় যার কারণে শরীরের সব কাপড়কেও ছুড়ে ফেলতে হচ্ছে? তাছাড়া তার কাছে থাকতে আয়েশাকেও বিবস্ত্র হয়েই তার রুমে যেতে হচ্ছে? প্রথম দিন এসেই তার রুমে জানালায় পর্দা, বিছানার বেডশিট সহ কাপড় জাতীয় কিছুই দেখতে পাননি সাবাজ। তাছাড়া ঘাম মুছার জন্য তিনি পকেট থেকে রুমাল বের করলে নওরিন ভয় পায় না কিন্তু হাত থেকে পড়ে যাওয়ার পর রুমাল ঝেড়ে নিতে যখন তার ভাঁজগুলো খুলে রুমাল মেলে যায় তখনই চিৎকার করে সে।
আচ্ছা কাপড়ের উপর ভয় পাওয়া কি কোনো ধরণের ফোবিয়া?- সাবাজ নিজেকে প্রশ্ন করেন। উত্তর জানেন না তিনি।
দিনের বেশিরভাগ সময় ঘুমিয়ে কাটায় নওরিন। দিনে অতিরিক্ত ঘুম স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ তো বটেই সাথে তা মানসিক চাপও বাড়িয়ে দেয়। মাঝরাতের পর ঘুম ভাঙার পর বাকি রাতটুকু নির্ঘুম কাটায় সে। তাকে এই অভ্যাস থেকে বের করে নিয়ে আসা জরুরী- ভাবেন আহমেদ সাবাজ। মানসিক রােগের চিকিৎসা একটি দলগত প্রচেষ্টা বা টিমওয়ার্ক। যাকে বলা হয় বায়ো-সাইকো-সােশ্যাল বা মনো-জৈব-সামাজিক পদ্ধতি। ওষুধ কাজ করে রাসায়নিক পদার্থ বা নিউরােট্রান্সমিটারের ওপর। সাইকোথেরাপি বা কাউন্সেলিং কাজ করে জ্ঞানীয় বিকাশ (Cognition), আচরণ ও মনের গড়নের ওপর। সেই সঙ্গে সামাজিক সহায়তা দেয় বাড়তি নিরাপত্তা আর বিশেষ প্রণােদনা। মানসিক রােগের চিকিৎসায় এই তিন প্রক্রিয়াই জরুরি। তবে রােগভেদে কোনাে কোনো প্রক্রিয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং অত্যাবশ্যকীয় হয়ে ওঠে।
নওরিনের ক্ষেত্রে স্পষ্টতই সামাজিক সহায়তা পদ্ধতি ব্যর্থ হয়েছে। তার পরিবারের কেউ বুঝে উঠতে পারেননি ঠিক কী করা উচিত। তবে বাকি দু’টো প্রক্রিয়ায় চিকিৎসা করতে তার রোগ ধরতে পারা আবশ্যক।
আয়েশার সাথে কথা বলাটা জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে তার জন্য সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। বাকি রাতটুকু রকিং চেয়ারে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেন আহমেদ সাবাজ।
_____
“রুমের এক কোণে বসে হাটুকে দু’হাতে জাপটে ধরে তার মধ্যে মাথা গুঁজে কাঁদে নওরিন।”
“এ সময়ে তার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ্য করেছো?”- সাবাজ প্রশ্ন করেন।
“হ্যাঁ।”- উত্তর আয়েশার।
“কী সেটা?”
“খুব বেশি পরিমাণে ঘামতে থাকে সে। মনে হয় যেন সারা গায়ে পানি ঢেলে নিয়েছে। তাছাড়া তার পুরো শরীর কাঁপতে থাকে।”
“আচ্ছা তোমার কী মনে হয়? সে কেন এমন করবে?”
“কোনো বিষয় নিয়ে ভয় পাচ্ছে সে হয়তো, প্রচণ্ড ভয়। তবে কিছু সময় বাদে সে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে আর বাথটাবে গিয়ে ডুবে থাকে আধঘন্টার মতো।”
রাফিয়ার মুখের দিকে একবার তাকান আহমেদ সাবাজ- একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে।
“আচ্ছা আরেকটা প্রশ্ন- সে কি কখনও কিছু বলেছে তোমাকে? বা বলার চেষ্টা করেছে?”
“হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে আসার পর প্রথম যেদিন সে এমন আচরণ করছিল, আমি খুব ভয় পেয়ে যাই। খালাম্মা-খালুজান কাউকেই সে রুমে ঢুকতে দিচ্ছিলো না। ঢুকলেই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে সে।”
“তারপর?”
“আমি খুব সাহস করে তার রুমে যাই। সে মুখ উঁচু করে আমাকে দেখে কিন্তু আগের মতো চিৎকার করেনি।”
“সে কিছু বলেছিল তোমাকে?”- অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন সাবাজ।
“বলেছিল- তোমাকেও মেরে ফেলবে তারা।”
“তারা মানে?”
“প্রশ্ন করেছিলাম, সে তীব্র আতঙ্ক নিয়ে রুমের চারপাশে তাকিয়েছিল। পরে আঙুল উঁচিয়ে আমার দিকে লক্ষ্য করলো।”
সাবাজের কাছে বিষয়টা কেমন জটিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। রাফিয়া শুরু থেকেই চুপচাপ তাদের কথাগুলো শুনে যাচ্ছেন।
“সে তোমার দিকে ইশারা করলো কেন?”
সাবাজের প্রশ্নে মাথা নিচু করে ফেলে আয়েশা। সাবাজ এবং রাফিয়া দু’জনেই উদগ্রীব হয়ে তার উত্তরের অপেক্ষা করছে।
“সে মূলত আমার পোশাকের দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছিলো। বলেছিল সেগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিতে নয়তো নাকি তারা আমাকেও মেরে ফেলবে। কিন্তু এই ‘তারা’ বলতে নওরিন কাকে বুঝিয়েছিল তার উত্তর আমি পাইনি৷ বাধ্য হয়ে নওরিনের কথা মেনে নিতে হয়। এরপর থেকে প্রতিরাতেই ওর রুমের বাইরে পোশাক ছেড়ে তার সঙ্গ দিতে হয়। মেয়েটি ভীষণ ভয়কে সাথে নিয়ে আমাকে জড়িয়ে রেখে বাকি রাত হয়তো না ঘুমিয়েই পার করে দেয়।”
_____
রাফিয়াদের বাড়ির পিছে বড়সড় একটা বাগান করেছেন মোস্তফা আনওয়ার। পরিচর্যার জন্য তিনি বেশ কয়েকজন লোক রেখেছেন। এ মূহুর্তে সম্ভবত হুইল চেয়ারে বসে বাগানটিকে ঘুরে ঘুরে দেখছেন তিনি।
“চলুন আমরা আপনাদের বাগানটি ঘুরে দেখে আসি।”- রাফিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন আহমেদ সাবাজ। রাফিয়া সম্মতি জানালে তারা বাইরে বের হন। হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছেন তারা।
“আয়েশা আপনাদের সাথে কতদিন যাবৎ আছে?”
“চার বছরেরও বেশি৷”
“মেয়েটি খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারে।”
রাফিয়া মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি প্রকাশ করেন।
“আপনার ব্যাপারে একটা প্রশ্ন আছে আমার।”- দাঁড়িয়ে পড়েন সাবাজ।
“কী প্রশ্ন?”
“আপনি যখন আমার কাছে আপনার মেয়ের সমস্যা নিয়ে গিয়েছিলেন আপনাকে দেখে খুব স্বাভাবিক মনে হচ্ছিলো।”
“আমি যদি আপনার কাছে গিয়ে খুব বেশি উদ্বিগ্ন থাকতাম তবে হয়তো আমার মেয়ের সমস্যা নিয়ে আপনাকে বুঝাতে সক্ষম হতাম না। আর তাছাড়া আমি সেখানে গিয়েছি আমার মেয়ের সমস্যার কথা জানাতে, আমার কষ্ট বা দূর্বলতা দেখাতে নয়।”
তারা আবারও হাঁটতে শুরু করেন। একটু সামনে হুইলচেয়ারে মোস্তফা সাহেবকে বসে থাকতে দেখেন। বড় একটা আমগাছের গোঁড়ার আগাছা পরিষ্কার করে মাটি দেওয়া হচ্ছে- এটাকেই দেখছেন তিনি।
“আমার মেয়ের ব্যাপারে কী ভাবলেন?”
“এখন পর্যন্ত যতটুকু বুঝতে পেরেছি আপনার মেয়ে কোনো কিছু নিয়ে প্রচণ্ড আতঙ্কিত। ঘুমের মাঝে সম্ভবত ভয়ানক কিছু দেখে তার আতঙ্ক আরও বেড়ে যায়। ঘুম থেকে হঠাৎ উঠে দশ থেকে পনেরো মিনিটের মতো এই আতঙ্ক তার মধ্যে বিরাজ করে। এ সময়ে ঘেমে যায় সে খুব, কাঁপতে থাকে ভয়ে। এমন একটা আশঙ্কা তার মাঝে যে কেউ হয়তো তাকে মেরে ফেলবে।”
“কোনো রোগ এটা?”
“হুম, মানসিক রোগ। যাকে প্যানিক ডিসঅর্ডার বলা হয়। তবে ঘুমের মধ্যে তার অস্বাভাবিক আচরণকে আরও একটু খুঁটিয়ে দেখতে হবে। তাছাড়া সে বলেছিল কেউ তাকে মেরে ফেলতে চায় কিন্তু সে বা তারা আসলে কে হতে পারে এটা নওরিনই বলতে পারবে।”
দিনের বেলা আর রাতে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত নওরিনের অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক থাকে। গতকাল সাবাজ তার সাথে কথা বলার জন্য রাতের সময়টুকু বেছে নিয়েছিলেন যেখানে এক অপ্রত্যাশিত আচরণের সম্মুখীন হন তিনি। আজ দিনের বেলাতেই কথা বলবেন তার সাথে- সিদ্ধান্ত নেন সাবাজ।
বাড়িতে ফিরে এসে কলিং বেল চাপতে আয়েশা দরজা খুলে দেয়। রাফিয়া তার স্বামীর কাছেই আছেন। সাবাজ একাই ফিরেছে। ভিতরে ঢুকে নিজের কক্ষের দিকে পা বাড়াতে আয়েশা পিছন থেকে ডাক দেয়।
“কিছু বলবে আয়েশা?”
“হুম।”- মাথা ঝাঁকায় সে, “মিসির আলি থেকে ৯ অংক দিয়ে একটি মজার জিনিস পড়েছি। পড়ে ভাবলাম ৯ অংকটি আসলেই অন্য সব অংকগুলো থেকে আলাদা। এরপর ৯ কে নিয়ে নিজেও একটা বিষয় বের করেছি।”
“তোমার হঠাৎ ৯ অংকটির কথা মাথায় এলো যে?”
“নওরিনের কেবিন নম্বর ছিল ৯০৯। এখানেও ৯ অংকটি আছে। কেবিন নম্বর অর্থাৎ ৯০৯ এর সবগুলো অংক যোগ করলে ১৮ হয় (৯+০+৯=১৮)। আবার এই যোগফলের দু’টি অংক (১ ও ৮) যোগ করলে ফের আবার ৯ হয়। আবার ৯০৯ সংখ্যার সব অংক গুণ করলে হয় ৮১, এটিরও অংক দু’টি যোগ করলে ফের ৯ হয়৷ অদ্ভুত না?”
“হুম অদ্ভুত। কিন্তু তুমি একটু ভুল করে বসলে না?”
“কোথায়?”
“৯+০+৯=১৮ হয় এটা ঠিক কিন্তু ৯×০×৯=৮১ নয় বরং ০ হয়।”
মেয়েটি এবার চোখ বন্ধ করে জিহ্বা কামড়ে ধরে। কত সাধারণ একটা হিসাবে ভুল করে বসলো সে। সাবাজ মুখে সামান্য হাসির ছাপ এনে নিজ কক্ষের দিকে পা বাড়ান।
_____
“তুমি কি আমাকে চেন মামণি?”- নওরিনকে প্রশ্ন করেন সাবাজ।
নওরিন না-সূচক মাথা নাড়ায়।
“আমাকে ভয় পাচ্ছো?”
এবারও সে মাথা নাড়িয়ে বুঝায় সে তাকে ভয় পাচ্ছে না। মেয়েটি কথা বলতে চাচ্ছে না। বারবার তার বাবা-মায়ের দিকে তাকাচ্ছে চোখে আতঙ্কের ছাপ নিয়ে। সাবাজ তাদেরকে ইশারা করে নওরিনকে আবার প্রশ্ন করেন, “তুমি কি তাদের ভয় পাচ্ছো?”
মেয়েটি এবার হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ায়।
“একদমই ভয় পাবে না। আমার চোখের দিকে তাকাও মামণি।”
সাবাজের কথায় নওরিন তার চোখের দিকে তাকায়।
“দেখ, আমি আছি এখানে। মোটেও ভয় পাবে না।”
মেয়েটির চোখদু’টো সাবাজকে জানান দেয় সে তাকে ভরসা করেছে।
“কেন ভয় পাচ্ছো? আমাকে বলো।”
“আমায় মেরে ফেলবে।”- কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে প্রথমবারের মতো মুখ খোলে মেয়েটি।
“এতো বড় সাহস কার? কে মেরে ফেলবে আমার মিষ্টি মামণিকে?”- নওরিনকে সাহস যোগাচ্ছেন আহমেদ সাবাজ।
নওরিন তার দূর্বল কাঁপতে থাকা ডান হাত ধীরে ধীরে উঠায়। শাহাদাত আঙুলটিকে সামনে রেখে কাঁপা হাত দিয়ে ইশারা করে তার মা-বাবার দিকে।
চলবে…
©Sayan