কলমে: মিথিলা জামান নিভা – Methela Jaman Neva
সারাঘরে পিনপতন নীরবতা। আমি থরথর করে কাঁপছি আপাকে দেখে কিংবা রুহজানিয়াকে দেখে। আপা গর্ত থেকে উঠে এসেছে। ওকে চেনা যাচ্ছে না। দুইচোখ টকটকে লাল, লম্বা চুল উষ্কখুষ্ক হয়ে ছড়িয়ে আছে মুখের চারপাশে। বড় বড় করে নি:শ্বাস ফেলছে আপা।
আমি কাঁপতে কাঁপতে বললাম,”দেখুন, আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি। আমি আপনাদের দুইজনেরই জানাযার ব্যবস্থা করবো। এতো বছরের কষ্ট আর থাকবে না আপনাদের। এখান থেকে বের হয়েই আমি আমার বাবা চাচাদের বলে আপনাদেরকে নতুন করে ক*বর দেওয়ার ব্যবস্থা করবো। আমার পূর্বপুরুষ আপনাদের সাথে যা করেছে আমার ক্ষমা চাওয়ার কোনো ভাষা নেই। কিন্তু সেই দোষ তো আমাদের নয় বলুন? আমরা যেটুকু করতে পারি আপনাদের জন্য আমরা আমাদের সাধ্যমতো সেই চেষ্টা করবো।”
এইটুকু বলার সাথে সাথেই হিসহিস করে উঠলো রুহজানিয়া। তর্জনী মুখের সামনে এনে বললো,”চুপ, একদম চুপ। তোদের আমি বিশ্বাস করিনা। ওই শয়তানের র ক্ত যার যার শরীরে আছে তারা কেউ ভালো হতে পারে না।এখান থেকে বের হওয়ার পর তোরা কি করবি আমি জানি। আমাকে আবার এখানে আটকে রেখে দিবি। হয়তো এবার আরো শক্তিশালী কোনো কবিরাজ তোরা নিয়ে আসবি। অনন্তকাল আমাদেরকে আবার নারকীয় যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে। তোদের আমি বিশ্বাস করিনা।”
“আচ্ছা, আমাদের মেরে আপনাদের কি লাভ হবে? আপনারা কি এই পৃথিবীতে আবার ফিরতে পারবেন? নিজের মেয়েকে নিয়ে আবার সেই শান্তির সংসারে ফিরতে পারবেন? আপনাদের সাথে যা হয়েছে ঘোরতর অন্যায় হয়েছে। আর এর শাস্তি মীর মতলেব খাঁ হাড়ে হাড়ে পেয়েছেন শেষ বয়সে। কিন্তু একটাবার আপনার মেয়ের কথা ভেবে দেখুন। আমরা চলে গেলে ওই মানুষটা কাদের নিয়ে বাঁচবে? বাবা মা কে হারিয়ে এই সংসারকেই তো আপন করে নিয়েছে সে। আমরাই তার প্রাণ, আমরা না থাকলে কি নিয়ে বাঁচবে মানুষটা?”
হঠাৎই আপার মুখটা চুপসে যায়। যেই মুখে এতোক্ষণ ক্রোধের আগুন জ্বলজ্বল করছিলো, সেই মুখে হঠাৎ অমাবস্যার অন্ধকার ভর করে। যেনো একটা কিশোরী মেয়ে এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে। ছোট্ট একটা মেয়ের মতো গুটিশুটি মেরে বসে পড়ে এক কোণায়। টেনে টেনে শ্বাস নেয় আর গুণগুণ করে কাঁদতে থাকে। ভীষণ কষ্ট হয় আমার।
আমি তাকে শান্ত করার জন্য আবার বলি,”আমাকে একটু বিশ্বাস করুন। এতোদিন এই বংশে কোনো মেয়ে আসে নি, এজন্য আপনারা এভাবেই কাটিয়েছেন এই বদ্ধ কুঠিরে বছরের পর বছর। কিন্তু এই বাড়িতে এখন দুইটা মেয়ে আছে। সাঁঝ আর সাজ। ওরা আপনাদের আর এই কষ্ট করতে দিবে না। আপনাদেরকে মুক্তি দেবে এই অভিশপ্ত জীবন থেকে।”
আপা একটু একটু করে তাকায় আমার দিকে। তার মুখে একটু আশার আলো। আমার ভালো লাগে দেখে। এই বাড়ি থেকে এতোটা বিশ্বাসঘাতকতার মুখোমুখি তারা হয়েছে, আর হয়তো বিশ্বাস করতে পারছে না। কারণ দাদীকে সত্ত্বা হিসেবে গ্রহণ করে নিজেদের মুক্তি দেওয়ার পথ বের করতেই মীর মতলেব খাঁ আবার কবিরাজ ডেকে বদ্ধ করে রেখেছিলো এই ঘরের মধ্যে। তখন মীর মতলেব খাঁ-ও তাদের কথা দিয়েছিলো সে তাদের আত্মার শান্তির ব্যবস্থা করবে। কিন্তু এই বলে বিশ্বাসঘাতকতা করে আবারও আটকে রেখে দিয়েছিলো এই অভিশপ্ত জীবন। কিন্তু আমি তা আর কখনোই করতে দিবো না।
আমি আস্তে আস্তে রুহজানিয়া তথা আপার দিকে হাঁটতে থাকি। সে চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। হয়তো আমাকে বিশ্বাস করতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না। আমার একটুও ভয় করছে না এখন রুহজানিয়াকে। মনে হচ্ছে সে ছোট্ট একটা কিশোরী মেয়ে, যার ছোট্ট কোমল হৃদয়টা এখনো ভালোবাসা চায়, ভরসা চায়।
আমি কাছে আসতেই রুহজানিয়া বললো,”তুই সত্যি বলছিস? আমাদের আবার আটকে রাখবি না তো এই নরকে? আমাদের শান্তির ব্যবস্থা করবি?”
আমি ভরসার দৃষ্টি মেলে তার দিকে তাকালাম।
“আমার বাবা, ছোট চাচাকে ছেড়ে দিন। উনারা নিতান্তই সহজসরল ভালো মানুষ। মীর মতলেব খাঁ এর জমিদারির সাথে সাথে তার সকল তেজ, রাগ বিসর্জন হয়েছে। এই বংশে কেউ আর তেমন নেই। আমি বলছি আপনাকে।”
রুহজানিয়া চুপচাপ আমার কথা শুনছিলো, মনে হয় সে আমাকে বিশ্বাস করা শুরু করেছে।
আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম ঠিক এমন সময় বাইরে কিছুর ঝনঝন করে আওয়াজ শুনলাম। আর সাথে তীব্র আলো। রুহজানিয়া ঈষৎ কেঁপে উঠলো। ভয় পেয়ে উঠলাম আমিও। এ সময় এখানে কে? তবে কি আমাদের খোঁজ না পেয়ে দাদীর কাছ থেকে কিছু শুনে মা এখানে চলে এসেছে? আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়লাম। এখন কি করা উচিত আমার? রুহজানিয়াকে আমাকে যেভাবেই হোক এই অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে হবে। কিন্তু বাইরের কেউ এসে এই অবস্থা দেখলে? আবার সেই রাগে রুহজানিয়া যদি সবাইকে মেরে ফেলে?
আমি এসব ভাবছিলাম তার আগেই দরজার বাইরে মেজো চাচার গলার আওয়াজ শুনলাম,”এইযে এই ঘরে, এই ঘরে।”
আমার বুকটা ধক করে উঠলো। মেজো চাচা কীভাবে জানলো আমরা এই ঘরে আছি? সে কেনো নিজের মৃত্যু ডাকতে এখানে চলে এসেছে?
শক্ত কুড়াল জাতীয় কিছু ধাতব জিনিস দিয়ে দরজা ভাঙ্গার চেষ্টা করা হচ্ছে বাইরে থেকে। শুধু মেজো চাচা একা না, সাথে মনে হচ্ছে আরো অনেকে আছে। আমি একবার রুহজানিয়া মানে আপার দিকে তাকাচ্ছি আর একবার দরজার দিকে। আপার মুখটা দেখলাম ফ্যাকাশে হয়ে আছে। মনে হচ্ছে কিছু নিয়ে খুব ভয় পাচ্ছে। সে নিজেও স্তব্ধ হয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। খুব মায়া হয় আমার সে মুখটা দেখে।
আমি তাকে সাহস দেওয়ার জন্য বলি,”ভয় পাবেন না। উনি আমার মেজো চাচা। আমি উনাকে সব কিছু বুঝিয়ে বলবো। যদিও উনি কিছুটা রাগী কিন্তু মানুষটা অতোটা খারাপ নন। সবকিছু বুঝিয়ে বললে ঠিক বুঝবেন। আমি থাকতে আপনার ভয় নেই। আপনাকে আর কেউ এই বদ্ধ কুঠুরিতে আটকে রাখবে না। আমাকে বিশ্বাস করুন।”
উনি কি বুঝলেন আমি জানিনা, উনার মুখ-চোখ আরো ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। আমি যদিও উনাকে মুখে সাহস দিলাম, কিন্তু আমার মন কেনো জানি মানছে না। জানিনা ঠিক নাকি ভুল, তবে শুনেছি গঞ্জে নাকি অনেকে বলে মেজো চাচা নাকি তান্ত্রিকতায় দীক্ষা নিয়েছেন মীর মতলেব খাঁ মারা যাওয়ার পর। মীর মতলেব খাঁ-ই তার এক সাগরেদকে বলে এই কাজ করিয়েছিলেন। যদিও আমরা কেউ-ই এসব কিছু বিশ্বাস করিনি কখনো। কারণ মেজোচাচাকে কখনো সেভাবে দেখিনি। তাকে নেহায়েতই একজন সংসারী মানুষই মনে হয়। তবুও মনটা বার বার কুঁ ডাকছে। আমি আপাকে আড়াল করে দরজার দিকে মুখ করে দাঁড়াই। যাই হয়ে যাক, এই নারকীয় জীবন থেকে রুহজানিয়াকে আমার মুক্তি দিতে হবে, মেজোচাচা যদি বলতেও আসেন, আমি বাঁধা হয়ে দাঁড়াবো। আমি পিছনে না তাকিয়েও বুঝতে পারছি রুহজানিয়া অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো এই মীর বাড়ির কারো কাছ এই সামান্য বিশ্বাস টুকু সে পায়নি কখনো।
প্রায় বিশ মিনিট মতো সময় লাগলো দরজা ভাঙতে। পুরোনো আমলের লোহার ভারী দরজা। এতো সহজে কি ভাঙ্গা যায়? আমি এই এতোটা সময় রুহজানিয়াকে আগলে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
ঝনঝন করে শব্দ করে দরজা খুলে গেলো। আমি আচমকা ভয় পেয়ে যাই বাইরের মানুষগুলোকে দেখে। মেজোচাচা লাল রঙা একটা থান কাপড় পরেছে, তার মাথায় কালো পট্টি বাঁধা। মেজোচাচাকে এই সাজে আগে কখনো দেখিনি আমি। সাথে আরো চারজন মানুষ, যাদেরকে আগে কখনো দেখিনি আমি। তাদের মধ্যে তিনজনের সাজ পোষাক মেজোচাচার মতো। তবে তার মধ্যে একজন যিনি কিনা বেশ বৃদ্ধ, প্রায় একশত বছরের বেশি হবে বলে মনে, তার সাজ আরো ভয়ানক। তার গাত্রবর্ণ কুচকুচে কালো, পরনের কাপড়টিও কালো। মাথায় একটা গেরুয়া রঙের পট্টি বাঁধা। প্রত্যেকের হাতে জ্বলন্ত মশাল। আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে যায়। এই মেজোচাচাকে বড় অপরিচিত লাগে আমার।
মেজোচাচা আমাকে দেখে হাসেন, সেই হাসি কী ভয়ানক আমি ঈষৎ কেঁপে উঠি। মেজোচাচা যেনো জানতেন আমি এখানে থাকবো। উনার উদ্দেশ্য কি?
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,”মেজোচাচা? আপনি এখানে?”
“কেনো? এসে কি বিরক্ত করলাম তোদের?”
“ঠিক বুঝতে পারলাম না চাচা।”
“সাজ, তুই না বড্ড ভালো মেয়ে জানিস তো, বড্ড সহজ সরল।”
“কেনো চাচা এমন কথা বলছেন?”
“আমাকে যে তুই কতো বড় একটা উপকার করলি, তুই নিজেও জানিস না।”
মেজোচাচার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। কি উপকার করেছি আমি উনার? আমি বুঝতে পারলাম পিছনে রুহজানিয়া ভয় পাচ্ছে। সে আমার পিছন থেকে নড়ছেই না।
“এই তেতলার চাবির জন্য আমি অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু তোর ওই ভালোমানুষ বাবার কাছ থেকে চাবিটা কখনো উদ্ধারই করতে পারিনি আমি। সেদিন মনে আছে তোর জ্বর এলো। তোর বাবা মায়ে ঘরের সামনে তুই কোনো একটা ছায়া দেখেছিলি।”
“সেই কথা তো আমি কাউকে বলিনি, আপনি কীভাবে জানলেন?”
মেজোচাচা বিকট শব্দে হাসেন। এতো ভয়ংকর হাসি আমি চাচার থেকে কখনো শুনিনি। ভীষণ ভয় করতে থাকে আমার।
“কারণ সেই ছায়াটা ছিলো আমার। আমি-ই সেদিন গিয়েছিলাম চাবি চুরি করতে। আর আমি জানি তুইও সেখানে একই কাজ করতেই গিয়েছিলি। আর এই তেতলার এমনই এক বৈশিষ্ট্য করে রেখে গেছে মীর মতলেব খাঁ কোনো নকল চাবি পর্যন্ত বানানো যায়না। তবে সেদিন আমি বুঝতে পেরেছিলাম এই চাবি তুই উদ্ধার করেই ছাড়বি। আর সেদিন আমার উদ্দেশ্য সফল হবে, আর হলোও তাই।”
“কিন্তু আপনি কেনো এতো মরিয়া হয়েছেন তেতলায় আসার জন্য? আমি যতদূর জানি মীর মতলেব খাঁ এই তেতলা পরিত্যক্ত করেছিলো। এখানে এই বাড়ির কারো আসা নিষেধ। আসলেই বিপদ হবে। তবে আপনি কেনো……?”
“বিপদ? কার বিপদ হবে? আজ বিপদের বিপদ হবে।”
“আপনার কথা কিছু বুঝলাম না মেজো চাচা। কি বলছেন আপনি?”
“সব আস্তে আস্তে বুঝতে পারবি। কি রে সাঁঝ? তুই সাজের পিছনে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?”
আমি অবাক হয়ে পিছনে তাকাই। রুহজানিয়া চোখ বন্ধ করে রেখেছে কেনো?”
আপা চিৎকার করে বললো,”আগুন বন্ধ কর, আগুন বন্ধ কর।”
আমি ভয়ে পেয়ে গেলাম কথা শুনে। এরা এতো এক্ষুনি বুঝে যাবে এটা আপা নয়।
আমি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বললাম,”আরে আপা, কি বলিস এসব? মেজোচাচা এখানে, এমন বলছিস কেনো?”
“সাজ, আগুন বন্ধ করতে বল ওদের, এক্ষুনি বল।”
আমি মেজোচাচার দিকে তাকাই। তার মুখ একটা রহস্যের হাসি, যেনো আমাদের কাণ্ড দেখে খুব মজা পাচ্ছেন উনি।
“এই যাও, মশালগুলো বাইরে রেখে আসো। ভিতরে যে আলো আছে তা দিয়ে দিব্বি সব দেখা যাবে।”
দলের মধ্যে কমবয়সী একজন মশালগুলো বাইরে রেখে আসলো।
আমি আপার দিকে ফিরে বললাম,”আগুন চলে গেছে, শান্ত হও আপা।”
রুহজানিয়া আমার কথা শুনে প্রথমে অল্প করে চোখ মেললো এরপর হঠাৎ মেজোচাচার দিকে চোখ পড়তেই বিকট র একটা আর্তচিৎকার দিয়ে উঠলো সে। আমি হতবাক হয়ে আছি।
“মীর মতলেব খাঁ, তুই এখনো মরিস নি? আজ তোর মৃত্যু হবে আমার হাতে। আমাকে যে যন্ত্রণা দিয়ে তুই মেরেছিস, তার চেয়ে দ্বিগুণ যন্ত্রণা দিয়ে তোকে মারবো আমি আজ। আমার সোনার সংসার নষ্ট করেছিস তুই, তোকে আমি ছাড়বো না।”
আমি আপাকে জাপটে ধরে বলি,”আপা চুপ কর। কি আজেবাজে কথা বলছিস এসব? উনি মীর মতলেব খাঁ হতে যাবে কেনো? উনি তো আমাদের মেজোচাচা। ভালো করে দেখে নে তুই।”
আমাকে এক ধাক্কা দিয়ে দূরে ফেলে দিলো রুহজানিয়া। আমি ছিটকে যেয়ে পড়লাম আরেকদিকে।
রুহজানিয়া ছুটে যেতে লাগলো মেজোচাচার দিকে। মেজোচাচা অন্যদের নির্দেশ দিলেন। সাথে সাথে দলের দুইজন লোক ধরে ফেললো আপাকে। আপার নরম হাত দু’টো শক্ত করে চেপে ধরেছে লোকগুলো।
আমি আবারও ছুটে গেলাম সেদিকে।
“এ কি করছেন কি? ছাড়ুন আমার আপাকে। ছাড়ুন।”
লোকগুলো আমাকে আবারও ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো।
আমি এবার মেজোচাচাকে যেয়ে বললাম,”চাচা এসব হচ্ছেটা কি? এরা কারা? কেনো পরপুরুষ হয়ে আমার আপাকে এভাবে শক্ত করে ধরেছে? আপনার সামনে এসব হচ্ছে আপনি চুপ করে সব দেখছেন?”
হঠাৎ মেজোচাচা চোখ লাল করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,”একদম চুপ সাজ। নিজেকে অনেক বেশি চালাক মনে করিস? এই সাঁঝের মধ্যে এখন রুহজানিয়ার সত্ত্বা প্রকট হয়েছে আমি জানিনা ভেবেছিস? আমি এতোগুলো বছর ধরে এই দিনটার অপেক্ষাতে আছি। এই সত্ত্বাকে আমি আজ ধ্বংস করবো, তবেই আমার শান্তি। ওস্তাদ আপনি কাজ শুরু করুন।”
সাথে সাথেই সেই বৃদ্ধ লোক ঘরের মাঝে কীসব আয়োজন শুরু করলো। সাথে সাথে আগুনও জ্বেলে দিলো। বিড়বিড় করে কীসব মন্ত্র পড়া শুরু করলো।
আমি হতভম্ব হয়ে দেখছি সব। আচমকাই আপা ওই দু’টো লোককে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। এরপর ছুটে আবারও ওই গর্তের কাছে দৌড়ে যেতে থাকে।
কিন্তু বেশিদূর আগাতে পারে না। আপার পা জাপটে ধরে টানতে থাকে লোকগুলো। আপার শক্তি কমে যেতে থাকে মন্ত্রের তালে তালে।
আমি চিৎকার করে উঠে বললাম,”আরে চাচা করছেন কি আপনি? আমার আপাকে এভাবে কেনো ধরছে ওরা? ছাড়তে বলুন ওদের। রুহজানিয়ার আত্মা হলেও শরীরটা তো আমার আপার। এসব কি করছেন আপনারা?”
“এটা তেমন কিছুই না সাজবুড়ি। এখন রুহজানিয়াকে ওহ দু:খিত তোর আপাকে এই আগুনের মধ্যে ফেলা হবে।”
আমি যেনো স্তব্ধ হয়ে গিয়েছি। নিজের কানকেও বিশ্বাস হলো না আমার। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,”কি বললেন আপনি? আবার বলুন তো।”
“শোন সাজ, তোরা তো জানিস আমি মানুষটা ভালো না। আমিও নিজেও জানি। এই বাড়িটার উপর আমার অনেক লোভ। এই বাড়ি তোদের নামে হওয়াতে আমার সারাজীবনের ক্ষোভ থেকে গেছে। আমি ভাবতাম কীভাবে এই বাড়ি আমার একার হবে। তাছাড়া তেতলা নিয়ে অনেক কাহিনীও আছে। তাই ভাবলাম আমি এক ঢিলে দুই পাখি মারবো। এই রুহজানিয়াকেও চিরকালের জন্য চুপ করিয়ে দিবো, আর তোদেরও আমার রাস্তা থেকে সরিয়ে দিবো। তাই তোর বাবার দোকানের সামনে চিরকুট ফেলা থেকে শুরু করে, সাঁঝকে ওই জংলায় ফেলে আসার সব কাজ আমার। কারণ যেই মন্ত্রবলে তেতলা পুরোপুরি বন্ধ হয়েছিলো, সেই মন্ত্রবলে এটা খুলতে এই বাড়ির বড় মেয়েকে ওই জংলায় যেতে হতো। তবেই শাহনেওয়াজ মানে আমার শ্রদ্ধেয় নানাজান তার শরীরে ভর করে এই বাড়ি ঢুকতে পারতো। কারণ মীর মতলেব খাঁ এভাবেই তাদের এখানে বন্দী রেখেছিলো। আর নিজেই দেখে নে সব কেমন আমার পরিকল্পনা মোতাবেক হলো। এখন এ বাড়ির সব উত্তরাধিকার আমার হাতে বন্দী। তোর বাবা, ছোট চাচা, তুই, তোর আপা। তোদের সবাইকে যদি আমি এখানে মেরে ফেলি কেউ জানবে না। আর এই রুহজানিয়া আর শাহনেওয়াজকেও আজীবনের জন্য আমি বদ্ধ করে রাখবো। যাতে আর কেউ কোনোদিন আমাকে এই বাড়ি দখল দিতে বাঁধা না দেয়৷ এই বাড়ি ভেঙে আমি বড় মার্কেট বানাবো, শুরু হবে এই বাড়ির নতুন অধ্যায়। বোকা মীর মতলেব খাঁ এই দুইটা আত্মাকে জব্দ করতে পারেনি, নিজেই মরেছে। তবে আমি সেই ভুল করবো না। আমি আঁটসাঁট বেঁধেই নেমেছি। তোরা ভাবিস না, তোদের স্মৃতি ধরে রাখবো আমি। এ বাড়ির নাম যা ছিলো, মার্কেট হলেও সেই নামই থাকবে।”
আমার মনে হচ্ছে আমি কোনো দু:স্বপ্ন দেখছি। মেজোচাচার মনে মনে এই ছিলো? আজ এখানে শুধু রুহজানিয়া বন্দী না, আমরা সবাই মারা পড়বো? মেজোচাচা এতো নিচে নামবে? ওদিকে রুহজানিয়া সমানে ছটফট করছে।
“মেজোচাচা।”
“ওস্তাদ, আপনি তাড়াতাড়ি হাত চালান। ভোর হওয়ার আগে সব কাজ করা চাই।”
“মীর মোস্তফা খাঁ, এখানেই থেমে যা। তোর দাদার মতো ভুল তুই করিস না। আমার অভিশাপে তিলে তিলে মরবি তুই।”
মেজোচাচা অট্টহাসি দিয়ে বলেন,”তাই নাকি? আগে নিজে অনন্তকালের জন্য অভিশপ্ত জীবনে যাওয়ার প্রস্তুতি নে। তারপর আমাকে অভিশাপ দিস।”
জোরে জোরে মন্ত্রপাঠ হতে থাকে। বিশ্রী একটা গন্ধে সারাঘর ভরে যায়। আমাকে বেঁধে ফেলা হয়েছে শক্ত করে। আমি নড়াচড়া করতে পারছি না। আমি জানিনা কি হতে চলেছে। আমাকে আর আপাকে দুইজনকেই কি এই আগুনে পুড়িয়ে মারা হবে?
“মেজোচাচা, ভালো হবে না। আমাদের ছেড়ে দিন। আমরা এই বাড়ি আপনার নামে লিখে দিবো। আমাদের মারবেন না।”
“না, এখান থেকে বের হয়ে তোরা আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবি। তোদের এখানেই মরতে হবে, আজকেই।”
আমি শব্দ করে কাঁদছি আর সমানে আল্লাহকে ডাকছি। আপার মধ্যে থাকা রুহজানিয়ার শক্তি ফুরিয়ে এসেছে। সে নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে আছে এক কোণায়। আমি হাউমাউ করে কাঁদতে থাকি।
“মীর সাহেব, সব তৈয়ারি। প্রথমে কাকে দিয়ে শুরু করবেন?”
“প্রথমেই এই বড়টাকে দিয়ে। এটাও মরবে আর সেই ছাই আমি পুঁতে ফেলবো এই কুঠুরিতে আবার। তাতে রুহজানিয়াও আর কখনো নিজেকে উন্মুক্ত করতে পারবে না।”
আপাকে টানতে টানতে আগুনের কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমি চিৎকার করছি জোরে জোরে।
“আপাকে ছাড়ুন চাচা, আমরা কোনো দাবি রাখবো না, আপাকে ছাড়ুন।”
হঠাৎ………
কোথা থেকে ঝড়ো হাওয়া আসতে থাকে। এতোটাই হাওয়া যে জানালার কপাট জোরে জোরে ধাক্কা খেতে থাকে। মেজোচাচার মুখটা হঠাৎ ভয়ে চুপসে যায়। বাকিদেরও সেই অবস্থা। বৃদ্ধ লোকটা ভ্রু কুঁচকে তাকায়।
“এই তোরা দেখছিস কি? বাতাস বন্ধ কর। এই আগুন একবার নিভে গেলে সব শেষ হয়ে যাবে।”
দলের একজন বললো,”ওস্তাদ, বাইরে তো কোনো বাতাস নেই। ঘরের মধ্যেই শুধু বাতাস। এই বাতাস বন্ধ করবো কি করে?”
বৃদ্ধ লোকটা তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়ালো।
“দেখি দেখি আমাকে দেখতে দে।”
মেজোচাচার মুখও ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।”
জানালায় দাঁড়িয়ে কি যেনো দেখলো ওই বৃদ্ধলোকটা। এরপর চোখমুখ অন্ধকার করে ফিরে আসলো।
“কি হয়েছে ওস্তাদ?”
মেজোচাচার দিকে ফিরে লোকটা বললো,”আমার মনে হচ্ছে এখানে একটা আত্মা প্রবেশ করেছে।”
“হ্যা, সে তো এই রুহজানিয়ার আত্মা। ওকে তো আমরা আটকে ফেলেছি মন্ত্র পড়ে।”
” না না, রুহজানিয়া না, অন্য একটা আত্মা এখানে আছে। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি।”
আমি সাথে সাথে আপার মুখের দিকে তাকাই, তার মুখে ছোট্ট একটা রহস্যের হাসি ঝুলে আছে।
শোঁ শোঁ শব্দে বাতাস বইতে থাকে। মেজোচাচার দল শত চেষ্টা করেও আগুন ধরে রাখতে পারলো না। মিনিট পাঁচের মাথায় আগুন নিভে গেলো। ওরা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো।
মেজোচাচা হঠাৎ ছুটে এসে আমার গলা টিপে ধরলো। আমার শ্বাস বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা। আমার হাতও এদিকে বাঁধা।
“এই রুহজানিয়া, এক্ষুনি এখান থেকে যা, নাহলে একে মেরে ফেলবো আমি।”
আমি ছটফট করতে থাকি। মনে এখনই মরে যাবো আমি।
রুহজানিয়া ক্ষুব্ধ চোখে তাকায় সেদিকে। হঠাৎ মেজোচাচা আমার গলা ছেড়ে দিয়ে ছুটে যেয়ে পড়লো আরেক দিকে। গলা ছাড়তেই আমি কাশতে কাশতে হাঁপাতে থাকি।
“শেহনেওয়াজ এসেছে।”
আপার মুখে এটুকু শুনেই আমরা সবাই সেদিকে তাকাই। শেহনেওয়াজ মানে দাদীর বাবা? তিনিই তবে আমাদের উদ্ধার করলেন?
সারাবাড়ি পুলিশ ঘিরে ফেলেছে। এই চক্রটাকে অনেকদিন ধরে খুঁজছিলো পুলিশ। আমাদের সবাইকে না পেয়ে মা পুলিশে খবর দিয়েছিলো। মেজোচাচা আর তার দলকে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বাবা আর ছোট চাচাকে অজ্ঞান অবস্থায় গর্ত থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। তারা কিছুই বুঝতে পারছে না এখনো। আপা এখনো অজ্ঞান, তার জ্ঞান ফেরেনি। তাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে ঘরে।
আমি ছুটে দাদীর ঘরে যাই। দাদীকে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরি।
“দাদী দাদী।”
“কি হয়েছে সাজবুড়ি? কাঁদছো কেনো তুমি? তুমি তো সাহসের সাথে এই মীর বাড়িকে বাঁচিয়েছো। এখন এভাবে কাঁদলে হবে?”
আমি ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলি,”আমি কিচ্ছু করিনি দাদী। সব ওই দুজন করেছে। দাদী ওই দুইজনকে তো আমি কখনো দেখিনি। তাদের জন্য আমার কলিজাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে কেনো দাদী? এতো কষ্ট হচ্ছে কেনো তাদের জন্য আমার?”
দাদী কোনো কথা বলেন না। চুপচাপ শক্ত করে চেপে ধরে রাখেন আমাকে। তবে তার চোখের নোনাজল ঠিকই টের পাই আমি।
আজকাল প্রায়ই একটা স্বপ্ন দেখি আমি। খুব সুন্দর পরীর মতো একটা মেয়ে আর খুব সুদর্শন একজন লোক আমার দিকে তাকিয়ে হাসে। তাদের গায়ে ধবধবে সাদা পোষাক। দাদীর বাবা মায়ের জানাযার ব্যবস্থা করার পর থেকেই এই স্বপ্ন দেখছি আমি প্রায়ই। আপাকেও বলেছি, আপাও নাকি বেশ কিছুদিন এই স্বপ্ন দেখছে৷ যেদিন স্বপ্নটা দেখি, সেদিন বাকি রাত আর ঘুম হয়না। ঘুম ভাঙতেই একটা মিষ্টি জাফরানের গন্ধ টের পাই আমার চারপাশ জুড়ে। মনে হয় কেউ মাত্রই জাফরান ছিটিয়ে দিয়েছে সারাঘর জুড়ে। আম টের পাই ওই সুন্দর দুই অবয়ব আমাদের ঘিরে রেখেছেন সবসময়।
(সমাপ্ত)