কলমে: মিথিলা জামান নিভা – Methela Jaman Neva
“ক্যাচ” করে দরজায় একটা শব্দ হলো। অনেক বছরের পুরোনো লোহার ভারী দরজা। সারাজীবন যেখানে তালা ঝুলতেই শুনেছি, সেই দরজা আজ এতোগুলো বছর পর আমরা দুইবোন খুললাম। কৃষ্ণপক্ষ শুরু হয়ে গেছে, চলছে ঘোর অমাবস্যা। তার বিপরীতে আমাদের কাছে ছোট্ট একটা টর্চলাইট৷ তা যেনো অন্ধকার কমানোর বদলে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। আর কিছু আনারই সুযোগ পাইনি। মা সারাক্ষণ পাহাড়াতে রেখেছিলেন আমাদের। তার চোখ ফাঁকি দিয়ে আসা একরকম অসম্ভব ছিলো। আমাদের কথা ছিলো মেজ চাচাকে চোখে চোখে রাখা আর বাবার আগে এখানে পৌঁছানো। মেজ চাচাকে চোখে চোখে রাখা সম্ভব হয়নি। কারণ দাদীর ঘর থেকে বের হওয়ার পর মা দুইটা মিনিটের জন্যও আমাদের চোখের আড়াল করেননি। মনে হয় কোনো সন্দেহ করেছেন তিনি। কিন্তু কিছুই করার নেই। আজ এখানে আমাদের আসতেই হবে, নাহলে বাবা আর ছোট চাচার সাথে কি হবে তার কোনো ঠিক নেই। তাই যখনই বাবা মাকে রাতের খাওয়ার সময় ডাক দিয়েছে তৎক্ষনাৎ আমরা দুইবোন টর্চ লাইটটা নিয়েই বেরিয়ে পড়েছি। আসার সময় এক নজর দেখে এসেছি বাবাকে। বাবা সবার সাথে হাসিমুখে বসে গল্প করছিলেন৷ তার মানে বাবার আগেই আমরা তেতলায় পৌঁছাতে পেরেছি।
আমি আপার হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছি। ঘড়িতে এখন বাজে এগারোটা দশ। আসার সময় দেখে এসেছি এগারোটা বাজে। এতোক্ষণে দশ মিনিট হয়েছে মনে হলো। যা করার বারোটা বাজার আগেই আমাদের করতে হবে। কারণ বারোটা বাজলেই আপার দ্বিতীয় সত্ত্বা হিসেবে আপার শরীরে প্রবেশ করবে রুহজানিয়ার আত্মা। তখন আমি একা কিছুই করতে পারবো না। বাবার, ছোট চাচার, আমার আমাদের সবার জীবন হুমকির মুখে পড়ে যাবে৷ ভয়ে আমার শরীরে কাঁটা দিচ্ছে একেকবার৷ যতো দোয়া দরুদ শিখেছি জীবনে সব মনে মনে আওড়াতে লাগলাম।
দরজাটা খোলার সাথে একঝাঁক চামচিকার মতো পাখি মাথার উপর দিয়ে কিচকিচ করতে করতে উড়ে যেতে লাগলো। যেনো কতোদিন বদ্ধ ছিলো এরা এখানে। এতোকাল শুধু ভয়ংকর নাটক,সিনেমাতেই এসব দেখেছি। আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না নিজেদের জীবনেও এরকম একটা দিন আসবে। আমি আর আপা মাথা ঢেকে বসে পড়লাম কারণ চামচিকাগুলো এমনভাবে উড়ছিলো যেনো আমাদের মাথাতেই বসে পড়বে। বেশ অনেকক্ষণ যাবৎ মাথার উপর দিয়ে ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ শুনলাম। ভয়ে, আতঙ্কে বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ আওয়াজ দিচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ পর যখন ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ কমলো আমরা আস্তে আস্তে করে মাথা তুললাম। আপা কাঁপা কাঁপা হাতে টর্চটা উপরের দিকে ফেললো। কিছুক্ষণ সময় লাগলো আমাদের চোখে অন্ধকারটা সহনীয় করতে। কিন্তু তবুও বেশ অন্ধকার চারিদিকে। এখন আর কোনো চামচিকা নেই, কি জানি কোথায় গেলো এতোটুকু সময়ের মধ্যে। কিন্তু আমাদের চোখ আটকে গেলো তেতলার সিলিং এর দিকে। কি ভীষণ সুন্দর করে নকশা আঁকানো কড়িকাঠ দিয়ে। ঠিক যেনো সেই পুরোনো আমলের রাজবাড়ির মতো। ঘোর লেগে যাওয়ার মতো অবস্থা। মাঝে মাঝে একটু চিকচিক করে উঠছে কড়িকাঠগুলো৷ আমার মনে হয় অনেক আগে হয়তো এগুলোর মাঝে মাঝে মুক্তোর মতো কিছু বসানো ছিলো। কালের বিবর্তনে যা ক্ষয়ে গেছে কিন্তু কিছুটা হয়তো ফিকে হতে যেয়েও হয়নি। আমি অবাক হয়ে দেখি, দোতলা আর নিচতলার সাথে এই তেতলার কতো পার্থক্য। এ যেনো ঠিক রাজপুরী। এটাই যে আমাদের সেই চিরচেনা সাঁঝবাতির সাজবাড়ি ভাবতেই অবাক লাগে আমাদের।
আমি ফিসফিস করে উঠলাম,”আপা এই আপা।”
আপাও আমার মতোই ফিসফিস করে বললো,”কি হয়েছে বল?”
“আমাদের এখন সেই ঘর খুঁজে বের করতে হবে যে ঘরে দাদীর মা কে মেরে ফেলা হয়েছিলো।”
“সবই মনে আছে। কিন্তু এতো সারি সারি ঘরের মধ্যে কীভাবে খুঁজে পাবো আমরা? আমার মাথায় তো কিছুই আসছে না।”
আমিও তাই ভাবছিলাম এতোক্ষণ। মূলত আমরা একটা বিশাল বারান্দা ধরে হাঁটছিলাম। যে বারান্দা থেকে সামনের দিকে টর্চ ফেললেও শেষটা দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে বুঝি বাড়িটার সীমানাই শেষ হয়ে যাবে কিন্তু বারান্দা শেষ হবে না।
“আপা আমরা কি একটা একটা করে ঘরের দরজা খুলে দেখবো?”
“বোকার মতো কথা বলিস না সাজ। তেতলায় কম করে হলেও তেরোটা ঘর। সবগুলো ঘর এখন দেখতে গেলে বারোটা বেজে যাবে। তাছাড়া ঘরের মধ্যে যেয়ে বুঝবোই বা কীভাবে এই সেই ঘর? বুদ্ধি করে বের করতে হবে।”
“কি বুদ্ধি আপা?”
“মাথা থেকে বুদ্ধি বের কর, জলদি।”
দাদী সবকিছু বললেও ওই ঘর চেনার জন্য কোনো উপায় আমাদের বলে দেননি। আর এতাটুকু সময়ে কি বুদ্ধিই বা বের করবো আমরা?
আমাদের নিচতলা আর দোতলার বারান্দার রেলিঙ গুলো সব কাঠের কিন্তু তেতলার রেলিঙগুলো লোহার। সেই লোহাতেও যেনো ভীষণ সুন্দর মতো ডিজাইন করা। একটু হাত দিয়ে স্পর্শ করতেই হাতটা ঝিনঝিন করে উঠলো। আমি ভয়ে হাত সরিয়ে নিলাম।
হঠাৎ আমার মাথায় একটা বুদ্ধি আসলো। আমি আপাকে দাঁড় করিয়ে আমার দিকে ফেরালাম।
“কি হলো কি সাজ? দাঁড়িয়ে পড়লি কেনো?”
“আপা দাদী বলছিলেন, তোকে স্বপ্ন দ্বারা এতোদিন নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। তুই প্রায়ই এমন কিছু স্বপ্নে জানতে পেরেছিস যা শুধুমাত্র রুহজানিয়াই জানতো, ওদিন কি কি হয়েছে।”
আপা আমতা আমতা করতে করতে বলে,”হ্যা হয়তো।”
আমি অসহিষ্ণু হয়ে মাথা নাড়িয়ে বললাম,”হয়তো না আপা, তুই মনে করে দেখ৷ এটাই সুযোগ। মনে করতে থাক, ওদিন এমন কিছু হয়েছিলো যা তুই স্বপ্নে দেখেছিস? কিছু একটু ক্লু দে, যা দিয়ে বুঝতে পারি কোন ঘরে এই ঘটনা ঘটেছিলো।”
আপা অসহায় মুখে বললো,”আমার কিচ্ছু মনে আসছে না সাজ, বিশ্বাস কর। আমার তো এটাও মনে নেই আমি কোনোদিন এসব নিয়ে কোনো স্বপ্ন দেখেছি কিনা।”
আমি আপাকে ধরে জোরে জোরে ঝাঁকাতে থাকি।
“আপা এটাই শেষ সুযোগ, আর বেশি সময় নেই। আচ্ছা, তোকে জোর করে সব মনে করতে হবে না। সময় নে, আস্তে আস্তে মনে করতে শুরু কর।”
আপা মাথাটা হালকা চেপে ধরলো। আপার হাত থেকে টর্চটা ছিটকে দূরে যেয়ে পড়লো। মনে হচ্ছে ও খুব কষ্ট পাচ্ছে। আমি ছুটে যেয়ে টর্চটা তুলে ওকে জড়িয়ে ধরলাম।
“আপা তুই ঠিক আছিস? শান্ত হ।”
“সাজ, সাজ।”
“হ্যা আপা বল।”
“আমার কেনো জানি খুব কষ্ট হচ্ছে।”
“কোথায় কষ্ট হচ্ছে আপা? শরীর খারাপ লাগছে?”
আপা ততক্ষণে মেঝেতে বসে পড়েছে, আমিও ওর পাশে বসে ওকে চেপে ধরে রাখি যেনো ভয় না পায়।
“আমার নিজের জন্য না, রুহজানিয়া নামের ফুটফুটে সুন্দর মেয়েটার জন্য আমার অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে।”
আমার বুকটা কেঁপে উঠলো। তবে কি আপার দ্বিতীয় সত্ত্বা প্রকট হতে শুরু করেছে?
“আপা তোর কি হয়েছে বল আমাকে? এমন করছিস কেনো তুই?”
“সাজ, সাজ। উনার খুব কষ্ট হচ্ছে তুই জানিস?”
“কার?”
“রুহজানিয়ার।”
“কি বলছিস কি তুই?”
“হ্যা রে৷ উনার সারা শরীর র ক্তে ভেসে যাচ্ছে। তবুও উনাকে দিয়ে জোর করে নাচ করাচ্ছে পাষণ্ডগুলো। পাগলের মতো নাচাচ্ছে উনাকে দিয়ে। উনাকে বলেছে, যদি উনি ওদের নাচ না দেখায় তাহলে তার মেয়ের সাথেও এই একই কাজ করবে ওই নরপিশাচগুলো। নিজে বাঁচার জন্য না মেয়েটার জীবন ভিক্ষা চেয়ে আকুতি করে যাচ্ছে রুহজানিয়া। আর ওই পাষণ্ডগুলো চিৎকার করে হাসছে উনাকে দেখে, আর আরো বিশ্রীভাবে নাচতে বলছে। আমি আর সহ্য করতে পারছি না সাজ।”
আমি বুঝতে পারলাম আপা স্বপ্নে দেখা কাহিনীগুলো মনে করতে শুরু করেছে। এখন বুঝলাম, আপা কেনো প্রায় রাতে ঘুমের ঘোরেই ওভাবে গোঙানি দিতো। তবে না, আপাকে এখনই ওই ঘোর থেকে বের করা যাবে না। অনেক কিছু শুনে নিতে হবে এখন।
“আপা, আমার লক্ষী আপা। একটু খেয়াল কর ঘরটার দিকে। এমন কোনো আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে ওই ঘরের? যা দিয়ে চেনা যাবে ঘরটা।”
“খুব অন্ধকার সাজ, আমি কিচ্ছু দেখতে পারছি না।”
“একটু চেষ্টা কর আপা, তুই পারবি, আমি বলছি তুই পারবি।”
“অনেকগুলো ঘুঙুর ছড়ানো চারপাশে। মীর মতলেব খাঁ যখন গ্রামের মেয়ে বউদের তুলে আনতো তাদেরকে জোর করে এই ঘুঙুর দিয়ে নাচানো হতো। তাই ঘরের চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেক অনেক ঘুঙুর। সেখানে পাগলের মতো নাচানো হচ্ছে রুহজানিয়াকে। তার শরীর র ক্তে ভেসে যাচ্ছে কারণ একটু আগে তার সাথে অনেক অমানবিকতা করা হয়েছে। তার পা থেকে খসে পড়ছে ঘুঙুর গুলো, তবুও তাকে থামতে দেওয়া হচ্ছে না, থামলেই তার মেয়ের উপর অত্যাচার চালানো হবে তার মতোই।”
“আপা আর কিছু দেখতে পারছিস না? ঘরের রঙ কেমন? আসবাবপত্র কেমন?”
“অনেক অন্ধকার সাজ, কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“আপা অনেক অন্ধকার হলেও তুই অনেক কিছুই দেখতে পারছিস। নাচ, ঘুঙুর সবকিছুই। অন্য কিছু একটু দেখ আপা।”
“হ্যা দেখেছি, অনেক বড় একটা ঝাড়বাতি উপরে৷ সেই ঝাড়বাতির গায়ে নকশা কেটে লেখা সাঁঝবাতির সাজবাড়ি। আর হ্যা, ওইতো দরজা থেকে গড়িয়ে রুহজানিয়ার রক্ত বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে। দরজাটা একদম টকটকে লাল রঙের। সেই লালের সাথে র ক্তের কালচে লাল মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। আমি আর সহ্য করতে পারছি না সাজ, আমাকে তুই আর কিছু জিজ্ঞেস করিস না।”
এইটুক বলে আপা আমার গায়ের উপর ঢলে পড়লো।
আমি ওকে ধরে রাখলাম শক্ত করে। আমার কাছে এখন বেশকিছু ক্লু। সবচেয়ে আগে যেটা দরকার হবে তা হলো লাল দরজা। কারণ রক্তের দাগ এতোবছর পর দেখা সম্ভব নয়। বহু আগেই তা পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার কথা। এরপর ঘরের মধ্যে পাওয়া যেতে পারে একটা বড় নকশা কাটা ঝাড়বাতি, যেখানে লেখা সাঁঝবাতির সাজবাড়ি। কপাল খুব ভালো হলে ঘুঙুর পেয়ে যেতে পারি মেঝেতে, যদিও সেই সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
আমি আপাকে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। এখানে আসার পর অনেকটা সময় চলে গেছে। বারোটা বাজার মনে হয় না আর বেশি সময় বাকি আছে। যা করার খুব দ্রুত করতে হবে, খুব।
“আপা তেতলায় সব মিলিয়ে যদি তেরোটা থেকে চৌদ্দটা ঘর হয় তবে আগে আমাদের দেখতে হবে কোন ঘরের দরজার রঙ লাল।”
আপা ক্ষীণস্বরে বললো,”হ্যা চল।”
“কিন্তু আপা, তোকে দেখে তো খুবই ক্লান্ত মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে তুই হাঁটতে পারবি না আর।”
“আমি আসলেই খুব ক্লান্ত সাজ। আমি আর এক পা-ও হাঁটতে পারছি না। ভীষণ পানি তেষ্টা পেয়েছে।”
আমি এখন পানি কোথায় পাবো? তেতলায় পানির আশা করা বোকামি। এখন যদি নিচে যেয়ে পানি আনতে হয় মায়ের চোখে পড়ে যাবো।
“আপা তুই একটা কাজ কর৷ তুই এখানেই মেঝেতে বসে বিশ্রাম কর। আমি ঘরটা খুঁজে আসি। এরপর তোকে নিয়ে যাবো আমি এসে।”
“তুই একা যাবি সাজ?”
“আর বেশি সময় নেই আপা, এখন একা যাওয়া ছাড়া কিছুই করার নেই। এতোগুলো ঘরের মধ্যে খুঁজতে যেতে তুই পারবি না। তুই এখানেই বসে থাক। আমি খুঁজে এসেই তোকে নিয়ে যাবো।”
“টর্চটা নিয়ে যা। আমার এখানে টর্চ লাগবে না। তোর লাগবে।”
“কিন্তু আপা, তুই এখানে অন্ধকারে বসে থাকবি?”
“আমার কথা ভাবিস না সাজ, দ্রুত যা। দেরি হয়ে যাবে।”
আমি আপাকে একবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরি। কেনো জানি আপাকে ছাড়তে মন চাচ্ছে না। মনে হচ্ছে আপাকে ছাড়লে আপা অনেক দূরে হারিয়ে যাবে।
আপাও আমাকে একবার জড়িয়ে ধরে ছাড়িয়ে দিয়ে বললো,”যা সাজ, আমি আছি।”
আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালাম। টর্চটা হাতে শক্ত করে চেপে ধরে ধীর পায়ে আগাতে থাকলাম। হাত-পা যেনো কাঁপছে থরথর করে। পিছন ঘুরে আপার দিকে তাকালাম একবার। আপার জ্বলজ্বল চোখ গুলো শুধু দেখা যাচ্ছে। আপা হাত নেড়ে আমাকে বিদায় জানালো।
ঘরগুলোর দরজাগুলো সাধারণত এতো বড় হয়না। একেকটা দরজা পার হতে যেনো কতো বছর লেগে যাচ্ছে। আমি টর্চ ফেলে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছি। প্রথম দরজাটা গাঢ় নীল বর্ণের। টর্চের আলোয় তো তাই মনে হলো। এরপরের দরজাটা সবুজ। আমি শুধু অবাক হয়ে দেখছি এরকম উদ্ভট কোনো দরজার রঙ হতে পারে? আর সবগুলোই খুব গাঢ় বর্ণের। তেষ্টায় তো আমারও গলা শুকিয়ে এসেছে। শরীর ঘামে জবজব করছে। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে পড়তে চায়, কিন্তু এখন থামলে হবে না। ওই ঘর খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত আমাকে থামা যাবে না।
এভাবেই মোট আটটা ঘর পেরোলাম। আর যেনো হাঁটতে পারছি না। মনে হচ্ছে মাথা ঘুরে পড়ে যাবো। নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।
ঠিক এমন সময়, নয় নম্বর ঘরটার সামনে এসে আমার শরীরটা কেমন অদ্ভুত ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো। মনে হচ্ছে যেনো বৈদ্যুতিক শক লাগলো। আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম ঘরের সামনে এসে। কেনো জানি আমার হাত অসম্ভবভাবে কাঁপা শুরু করেছে। তাও আমি কাঁপা কাঁপা হাতে টর্চের আলোটা দরজায় ফেলতেই চমকে উঠলাম। এই সেই গাঢ় লাল রঙের দরজা। দরজার বাইরে খয়েরী রঙের শিকল দিয়ে ক্রস চিহ্ন দেওয়া। তার মানে কি? এই ঘরে প্রবেশ নিষিদ্ধ? আমি নিশ্চিত, এই সেই ঘর। যে ঘরে রুহজানিয়ার আত্মাকে আটকে রাখা হয়েছে, আর এখানেই নির্মমভাবে খু*ন করা হয়েছে তাকে।
আমার কেনো জানি খুব ইচ্ছা হলো টর্চের আলোটা মেঝেতে ফেলতে। আমি জানিনা কেনো এই ইচ্ছা আমার হলো৷ আমি থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে আলোটা ঘরের বাইরে মেঝেতে ফেলতেই একটা আর্তনাদ দিয়ে বসে পড়লাম নিচে। আমার হাত থেকে টর্চটা নিচে পড়ে যেয়ে আলো বন্ধ হয়ে গেলো। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে গেলো চারপাশ।
সেখানে কালচে রক্তের বিশ্রীরকম দাগ। কিন্তু এটা অসম্ভব। উনার মৃত্যুর পরেও তেতলায় অনেক মানুষের বসবাস ছিলো। নিশ্চয়ই এখানে পরিষ্কার করা হয়েছে। মীর মতলেব খাঁ অবশ্যই এই জায়গা অসংখ্যবার পরিষ্কার করিয়েছে। এই দাগ তবে কোথা থেকে এলো?
আমি কোনোরকমে হাতড়ে হাতড়ে উঠে দাঁড়ালাম। হাত থেকে টর্চটা পড়ে যাওয়ায় আমি আস্তে আস্তে হাত বাড়িয়ে খুঁজতে থাকি টর্চটা। হঠাৎ একটা পিচ্ছিল তরলে হাত লাগতেই আমার সারা শরীর শিরশির করে উঠলো। সারা শরীর গুলিয়ে উঠে বমি আসতে থাকে আমার। এসব কি আমার ভ্রম? আজ ষাট বছরের বেশি হতে চললো তেতলার এই ঘর তালাবদ্ধ অবস্থায় আছে। কেউ আসেনি এখানে। এখানে কোথা থেকে এমন তরল আসবে? আমি পাগলের মতো টর্চটা খুঁজতে থাকি। ভাগ্য ভালো থাকায়, একটু পাশেই টর্চটা পেয়ে যাই। অনেক চেষ্টার পর টর্চটা জ্বালাতেই হাতটা মুখের সামনে এনে গোঙানি দিয়ে চিৎকার করে উঠি আমি। এতো রক্ত। একদম তাজা কালচে রক্ত। এখানে এমন তাজা রক্ত কোথা থেকে আসবে? আমি চিৎকার করে আপাকে ডাকি।
“আপা, আপা রে। তাড়াতাড়ি আয়। আমার খুব ভয় করছে।”
কিন্তু কোথায় কে? আমার চিৎকার প্রতিধ্বনি হয়ে আমার কাছে ফিরে আসে। আমার এবার একটু ভয় ভয় করে। আপা যদিও আমার কাছ থেকে বেশ দূরে, কিন্তু তেতলায় আর কোনো শব্দ নেই, একটা ঝিঁঝি পোকার শব্দও নেই। সেখানে এতো জোরে চিৎকার করলাম আপা শুনতে পেলো না?
ঠিক এমন সময় হঠাৎ মনে হলো আমার গলাটা কেউ চেপে ধরেছে। কারণ নিচতলা থেকে আমাদের বিশাল ঘড়ির ঢংঢং শব্দ ভেসে এলো। এই ঘড়ি কেবল দিনে এবং রাতে দুইবার বারোটা বাজলেই বেজে ওঠে। তার মানে বারোটা বেজে গেছে? এখন কি হবে? আপার মধ্যে তার দ্বিতীয় সত্ত্বা চলে আসার কথা। আমি কি ফিরে যাবো আপা যেখানে বসে ছিলো সেখানে? নাকি ভিতরে ঢুকে যাবো? দাদীর কথামতো এই ঘরের মধ্যে আমাদের আগেই বাবা আর ছোট চাচার থাকার কথা। কিন্তু সেইটা কি কোনোদিন সম্ভব? আমি তো এখান থেকেই এলাম। কাউকেই তো আসতে দেখিনি। আর এই ঘরের দরজা দেখে মনে হচ্ছে না এখানে এতো বছরেও কারো পা পড়েছে।
আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না আমি। আচমকাই কোথা থেকে যেনো শোঁ শোঁ আওয়াজ করে বাতাস বইতে শুরু করলো। সেই বাতাসের সাথে অজস্র ধূলো। আমি যেনো অন্য জগতে এসে পৌঁছিয়েছি। সবকিছু মনে হচ্ছে স্বপ্ন। কোনো একটা ভয়ংকর দু:স্বপ্ন। আমি চোখমুখ ঢাকার চেষ্টা করি, ধুলো থেকে বাঁচার চেষ্টা করি। আমার হাত থেকে টর্চটা কোথায় যেনো ছুটে চলে গেলো। আমি খুঁজতে থাকি অস্থির হয়ে। কোথাও কিছু নেই। আমি দরজার এ মাথা থেকে ও মাথা দৌড়ে বেড়াচ্ছি। একবিন্দু আলোর আশায় আমার প্রাণটা ছটফট করছে।
বাতাসের বেগ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। আমি দরজার সামনে অসহায়ের মতো ছটফট করছি, ঠিক এমন সময় ঘটলো সেই ঘটনা।
আমার চোখের সামনেই এতো বড় ভারী দরজা সামান্য বাতাসের ধাক্কায় ক্যাচক্যাচ করে শব্দ করতে করতে খুলে যেতে থাকে। আমি হতবাক হয়ে দেখছি। আপাও কোথাও নেই। বিশাল একটা দরজার সামনে ছোট্ট আমি দাঁড়ানো। দরজাটা পুরোপুরি খুলতেই এক খাবলা জমাট অন্ধকার যেনো আমাকে চারপাশ থেকে জড়িয়ে ধরলো। বাদুড়ের মতো কোনো একটা প্রাণী, কিন্তু বাদুড়ের থেকে আকারে অনেকটা বড় মনে হলো। ঘর থেকে বের হয়ে এসেই আমার মাথার উপর দুইবার চক্রাকারে ঘুরলো। আমি মাথার উপর হাত দিয়ে চেপে বসে পড়লাম। ওটা মাথার উপর থেকেই উড়ে অন্যদিকে চলে গেলো। এবার আমি আস্তে আস্তে করে উঠে দাঁড়ালাম। সামনে থাকা একটা জিনিসও আমি চোখে আমি দেখতে পারছি না।
হঠাৎ আমার সামনে মেঝেতে কিছুটা একটা চিকচিক করে উঠলো। মনে হচ্ছে সোনার গহনা। যেহেতু আমার সামনে আলো বলতে কিছুই নেই, ওটুকু জিনিসই আমার ভরসা। আমি কিছুটা ইতস্তত করে একবার পিছন ঘুরে তাকালাম। আমার সামনে বাবা মায়ের মুখটা ভেসে উঠলো। আমার আবেগ বলছে,”যা সাজ ফিরে যা, এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকিস না। অনেক বিপদ সামনে তোর, ফিরে যা মায়ের কাছে।”
কিন্তু না, আমাকে এখন ফিরলে হবে না? আমার নিয়তি এখানে আমাকে টেনে এনেছে। এই বাড়ির এখন পর্যন্ত প্রথম মেয়ে আমরা। আমাদের অপেক্ষাতেই রুহজানিয়া এখানে বছরের পর বছর অপেক্ষা করে আছে। উনাদের এখান থেকে মুক্তির পথ শুধু আমরাই দিতে পারবো। আমাকে এখন ফিরলে চলবে না।
আমি ওই চিকচিক করা জিনিসটাকে লক্ষ্য করে এগোতে থাকি। আচমকা আমার পিছনে দরজাটা যেভাবে খুলেছিলো ঠিক সেভাবেই বন্ধ হয়ে যায়। আমি ছুটে যাই দরজাটার কাছে। আকুল হয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করি আমি। কোনোভাবেই দরজা খুলছে না। যেনো আমার প্রবেশের অপেক্ষাতেই কেউ ছিলো। আমি এসেছি আর সাথে সাথেই দরজা বন্ধ হয়ে গেছে।
কিন্তু না, আমাকে এখন সাহস হারালে চলবে না। ভয় পেলেই এখানেই আজ আমাদের বংশ নির্বংশ হয়ে যেতে পারে। আমি আবার ওই সোনার মতো চিকচিক করা জিনিসটার দিকে আগাতে থাকি। ওটা যেনো একরকম মোহ দিয়ে টানছে আমাকে। আমি ওটার কাছে যেয়ে ভয়ে ভয়ে হাতে নিই। যেনো হাতের মধ্যে এক টুকরো আলোর মশাল নিয়েছি। এতো সুন্দর জিনিস আমি আমার এই জীবনে দেখিনি। ছোট্ট একটা ঘুঙুর, একদম সোনার মতো রঙ বা আরো বেশি চকচকে। আমি হাতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ওটা দেখতে থাকি। হঠাৎ ঘুঙুরের এক পাশে দেখি রক্তের কালচে ছিটে পড়া দাগ। আমি ভয়ে ওটা হাত থেকে ফেলে দিই। নিচে পড়তেই ওটা ঝনঝন শব্দ করে ওঠে। নিজের করা শব্দে নিজেই আঁৎকে উঠি। আর ঠিক তখনই স্তম্ভিত হয়ে আমি লক্ষ্য করি আমার চারপাশে মেঝেতে শতশত ঘুঙুর। সবগুলো থেকে যেনো আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে। হঠাৎ অনেক অন্ধকার থেকে এতোটা আলো চোখ সহ্য করতে পারলো না। আমি হাত দিয়ে চোখ ঢেকে ফেলি। এখনো আমার সামনে তাকানোর মতো সাহস নেই। আমি জানিনা সামনে তাকালে আমি কি দেখবো। কারণ এখন এতোটাই আলো যে ঘরের সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাবে।
বেশ কিছুক্ষণ এভাবে চলার পর আমি ভয়ে ভয় আস্তে করে চোখ খুলে তাকাই। আর তাকাতেই যেনো আমি হতভম্ব হয়ে যাই। আমার মনে হলো আমি বুঝি ভুল করে রূপকথার কোনো যাদুরাজ্যে এসে পড়েছি। এটা কিনা আমাদের বাড়ি? পুরো ঘরজুড়ে দামী দামী আসবাবপত্রে ঠাসা। কি সুন্দর বিশাল পালঙ্ক, টেবিলের উপরের ফুলদানিটা দেখে কে বলবে এই ঘরে ষাট বছরেরও বেশি সময় ধরে কারো পা পড়েনি? মনে হচ্ছে এই মাত্রই কেউ সাজিয়ে রেখেছে। প্রতিটা জিনিসের উপরের নকশায় মন আত্মহারা হয়ে যায়। আমি সিলিং এ তাকাতেই দেখি ভীষণ সুন্দর একটা বিশাল ঝাড়বাতি। ঝাড়বাতির চারপাশে মোমবাতি দেখে মনে হচ্ছে মাত্রই কেউ বসিয়েছে এগুলো ওখানে। ঝাড়বাতির চারপাশে সুন্দর নকশা করে লেখা “সাঁঝবাতির সাজবাড়ি।”
আমি ঘুরে ঘুরে সব দেখছি আর অবাক হয়ে যাচ্ছি। এতো সুন্দর ঘর এতো বছর যাবৎ আমাদের অদেখা থেকে গেছে? আমি দেয়ালের দিকে তাকাতেই দেখি অনেক মানুষের তৈলচিত্র আঁকানো। এরা সবাই কি তবে আমার আদিপুরুষ?
একটা ছবির সামনে এসে আমার চোখ আটকে যায়। কি প্রতাপশালী চেহারা, গায়ে মোটা তসরের চাদর। বিশাল একটা সিংহাসনসম চেয়ারে রাজার মতো করে বসে আছেন। কিন্তু তার সারা শরীরেই কেমন দাগ কাটা। মনে হচ্ছে কারো ভীষণ রাগ এই তৈলচিত্রটার উপরই ঝেরেছে। তবে কি ইনি-ই সেই বিখ্যাত বা কুখ্যাত মীর মতলেব খাঁ?
আমি ধীর পায়ে ছবিটার দিকে আগাতে থাকি। কেনো জানি আমার খুব চেনা চেনা লাগছে মানুষটার চেহারা, কোথায় যেনো দেখেছি। কিন্তু আমার দেখার কথা না। কারণ মীর মতলেব খাঁ এর কোনো স্মৃতি আমাদের দেখানো হয়নি। তবে আমার এতো চেনা কেনো লাগছে? আমি সম্মোহন হয়ে আগাচ্ছি ছবিটার দিকে। ঠিক এমন সময় শক্ত কোনো উঁচু একটা ঢিবি যেটা আমি ছবি দেখার চক্করে খেয়ালই করিনি তাতে পা বেঁধে ছুটে যেয়ে পড়লাম অন্যদিকে। আমার পায়ে ভীষণ জোরে আঘাত লাগলো। আমি চিৎকার করবো না করবো না করেও আর্তনাদ করে উঠলাম যন্ত্রণায়।
বিরক্ত হয়ে কিসের ঢিবি এটা দেখার জন্য তাকাতেই আমার পুরো শরীর জমে গেলো যেনো। এখানে কি এটা? কালো কাপড়ে ঢাকা? কি পোঁতা আছে এখানে?
(চলবে….)