শাশুড়ি মা যখন বড় রুইমাছের মাথাটা তিথির প্লেটে তুলে দিলেন তখন তিথির চোখে ছিলো ঘোর বিস্ময়। মামা-মামীর সংসারে কখনো এতটা যত্ন তিথি পায়নি। আরমানের সাথে তিথির বিয়ে হয়েছে আজ সাতদিন।
অনার্স পড়ুয়া দুচোখে স্বপ্ন ভরা তিথি এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চায়নি। ইচ্ছে ছিলো বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে পুলিশ অফিসার হবে। ঠিক বাবার মতো। তিথির বাবা যখন সন্ত্রাসীর গু’লিতে মারা যান তখন সে কেবল দশ বছর বয়সের। মা বাবাকে বড়ই ভালোবাসতেন কিনা। তাইতো তিথিকে ফাঁকি দিয়ে বাবা মা’রা যাওয়ার একমাসের মাথাই চলে গেলেন।
সেই দশ বছর বয়সের ছোট আদুরে তিথির ঠাঁই হলো মামা-মামীর সংসারে। মামী কত আদর করতেন তিথিকে! সব কেমন যেন বদলে গেলো। মামী আর আগের মতন রইলেন না। মামাও কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেলেন। তার কন্ঠে ‘তিথিমণি’ ডাকটাও কোন তমসায় মিলিয়ে গেলো।
আদুরে তিথির হাতে পুতুলের বদলে উঠলো খুন্তি। বইয়ের বদলে কাপড় ধুয়ার পাউডার। নরম হাতটা দিনকে দিন কেমন খসখসে হয়ে উঠলো। চেহারায় চলে এলো নিষ্প্রাণ ভাব। চুলগুলো কেমন রুক্ষ মরুভূমির মতো।
এত বাঁধার মাঝেও পড়াশোনা চালিয়ে গেছে তিথি। ভালো ফলাফল হয়তো করতে পারেনি তবে মোটামুটি একটা ফলাফল ছিলই সবসময়। তিথির একুশ বছরের জীবনে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিলো সেদিন যেদিন মামাতো ভাই জিদান তাকে একা পেয়ে জড়িয়ে ধরেছিলো। অশোভন কিছু আচরণ করেছিলো। তখন তিথি ইন্টারে পড়ে।
ভাগ্য সহায় মামী ধরে ফেলেন হাতে নাতে। বেঁচে যায় তিথি। জিদানকে মামী থাপ্পড় মে’রে শাসিয়ে ছিলেন সেদিন। এজন্য তিথি তার মামীর নিকট কৃতজ্ঞ। জিদান আর তার কাছ ঘেঁষার সাহস পায়নি।
অনার্সে উঠার কিছুমাস পরেই মামা হুট করে বললেন তিথিকে একজন পছন্দ করেছে। ছেলেটা তার মামার বন্ধুর ছেলে। বিদেশে পড়াশোনা করে দেশে ফিরে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে জব করছে।
তিথির মামাতো বোনকে দেখতে এসেছিলো ইদের দিন। তিথিরও মনে পড়ে একজন চশমা পরা ঝাকড়া চুলের ছেলে সঙ্গে তার মা এসেছিলেন। তবে ঝুমা, তিথির মামাতো বোনকে যে দেখতে এসেছে তা তিথি জানতো না।
কেউ তাকে জানায়নি। মামী বলেছিলেন এমনি বেড়াতে আসছে। তিথির মনে পড়ে ঝাঁকড়া চুলের চশমামানবের সাথে সে একখানা ধাক্কা খেয়েছিলো ছাদে উঠার পথে। তারপর দৌড়ে ঘরে চলে এসেছিলো। যাই হোক মামী বিয়েটা চাননি। মামাই বিয়েটা দিলেন শেষ পর্যন্ত। তিথি কেবল আকাশ পানে তাকিয়ে ভেবেছিলো,” তবে কি আমার স্বপ্ন শেষ বাবা?”
আরমান মানুষটা বেশ প্রাণখোলা। আরমান এবং তার মা। এই তাদের পরিবার। এখন যোগ হয়েছে তিথি। তিথি মিসেস শেখ কে যত দেখে তত অবাক হয়। একটা মানুষ এতটা প্রাণখোলা,
হাসিখুশি কি করে হতে পারে! তিথি যেন সেই দশ বছর বয়সে ফিরে যায়। আস্তে আস্তে তার চুলগুলো যত্নে যত্নে প্রাণবন্ত হয়ে উঠে। ভালোবাসায়, স্নেহে তিথি সেই আগের আদুরে, ছোটপাখিটি হয়ে যায়। যেন বহুদিন বাদে কোনো নীড় হারানো ছানাটি তার মাকে খুঁজে পেয়েছে। তিথির দুনিয়া হয়ে উঠে তিথির ‘মা’।
যদিও মাঝে মাঝে আরমান মেকি রাগ দেখিয়ে মাকে নালিশ করে, “মা, তুমি তো তোমার বউমাকেই বেশি ভালোবাসো। আমি তো পর হয়ে গিয়েছি এখন।” মা হাসেন। কপালে চুমু খেয়ে বলেন, “আমার বোকা ছেলে। তুই যেমন আমার সন্তান ঠিক তিথিও আমার সন্তান। তোদের দুজনকে আমি সমান ভালোবাসি।”
দূর সম্পর্কের একজন বোন এসেছিলেন মায়ের। গল্পের ফাঁকে বলে উঠলেন, “ছেলের বিয়ে তো করালে অনেকদিন হলো। নাতি-নাতনির মুখ কবে দেখবে? বাচ্চা নিতে বলো ওদের। দুজনের তো বয়স কম হয়নি।” মা মুচকি হেসে জবাব দিলেন, “আমার মেয়েটা পড়তে চায় আপা। অনার্স শেষ করে বিসিএস দিতে চায়। ওর স্বপ্ন পুলিশ অফিসার হবে। আমি মা হয়ে মেয়ের স্বপ্নে কিভাবে বাঁধা দেই? আগে নিজের স্বপ্ন পূরণ করুক। তারপর বাচ্চা নিবে কি নিবেনা সেটা স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার।”
“তোমার যে কি আক্কেল না শামীমা। পরের মেয়ে কি নিজের মেয়ে হয়! অনার্স শেষ করবে। বিসিএস দিবে। হাসালে আমাকে। এখনই তো বয়স পঁচিশ হবে। কবে চাকরি করবে আর কবে সংসার করবে? বিসিএসে যদি চাকরিও হয় পোস্টিং হবে দূরে। তখন তোমার ছেলের কি হবে? পরের মেয়েকে এত আহ্লাদ দিও না শামীমা।”
“আপা, তিথিকে আমি নিজের মেয়ের মতোই দেখি। আমার ছেলেও তো এমবিএ শেষ করে বিদেশে পড়তে গেলো। আমি কি ওকে বাঁধা দিয়েছি। কিংবা আমার পেটের মেয়ে যদি পুলিশ অফিসার হতে চাইতো আমি কি মা হয়ে তাকে মানা করতাম আপা?
তিথি কেবল ছেলের বউ হয়ে এসেছে দেখে কি তার সকল স্বপ্ন বিসর্জন দিতে হবে? আমি একজন মা হয়ে সন্তানের স্বপ্নকে গলা টি’পে কি করে হত্যা করি আপা? আপনার মেয়ে অর্পা যে বিদেশে পড়াশোনা করতে গিয়েছে আপনি কি বাঁধা দিয়েছেন আপা?”
“অর্পা আমার নিজের মেয়ে শামীমা। থাক। তোমাকে আমি বুঝিয়ে পারবো না। যা ভালো বুঝ করো। পরে আবার না পস্তাতে হয়।”
“সে না হয় সময়ই বলে দিবে।”
দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে তিথি সব কথাই শুনেছে। হঠাৎ করেই খুব কান্না পেলো তিথির। কেন জানেনা। তবে ইচ্ছে করলো চিৎকার করে কিছুক্ষণ কাঁদুক। বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে তিথি। মা ঘরে এলেন। তিথি চোখের পানি মুছে নেয়। মা বিছানায় বসেন। মাথায় হাত রাখেন তিথির। তিথি মায়ের কোলে মাথা রেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে।
“রাগ করেছিস তিথি?”
তিথি চুপ করে থাকে। মা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। বিলি কেটে দেন চুলে। আনমনে বলেন,
“জানিস তিথি, আমার যখন বিয়ে হয় তখন আমার বয়স কেবল ষোল। দুচোখ ভরা স্বপ্ন ছিল আমার। বাবার মতো সেনাবাহিনীর অফিসার হতে চেয়েছিলাম। বাবারও তাই স্বপ্ন ছিলো।
একটা এ’ক্সি’ডেন্ট সব স্বপ্ন শেষ করে দেয়। বাবা-মা যখন মা’রা যান আমরা তিনবোনই ছোট। ফুফু নিয়ে গেলেন মেঝো বোনকে আর চাচা নিলেন ছোটকে। আমার ঠাঁই কোথাও হলোনা। একা একা কি করে থাকবো? সমাজে নিজেকে অপাংতেয় মনে হচ্ছিলো তখন। সবাই সিদ্ধান্ত নেয় বিয়েই এর সমাধান। যৌথ পরিবারে বিয়ে হয় আমার।
উনি বিদেশে পড়াশোনা করতেন তখন। দেশে এসে বিয়ে করে আমাকে রেখে চলে গেলেন। পড়াশোনা থেমে গেলো। হুট করেই বড় হয়ে গেলো ছোট শামীমা। শাশুড়ীর কাপড় ধুয়া থেকে ননদের এসাইনমেন্ট করে দেওয়া সবই পারতাম। রক্ষণশীল পরিবারের বউ হয়েছিলাম। যেখানে ঘরের মেয়েরা চাকরি করতে পারবে তবে বউয়েরা হবে মাথা নিচু করে রাখা শ্রেণির।
কোনো উচ্চবাক্য করা যাবেনা। পড়াশোনা করা যাবেনা। আমার উনি যথেষ্ট সম্মান করতেন আমাকে। তাই তো আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখেছিলাম আমি। তিনি দেশে ফিরে আলাদা বাসা নিলেন। এস.এস.সি, এইচএসসি, অনার্স, মাস্টার্স শেষে একজন শিক্ষক হয়ে উঠলাম আমি। বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে না পারলেও শত শত শিক্ষার্থীকে পড়িয়ে মানসিক আনন্দ আমি পেয়েছিলাম। আরমানকে আমি ছোটবেলা থেকেই তার বাবার মতো করে মানুষ করেছি।
মেয়েরা কোনো দ্রব্য নয়। বিয়ে করে তাদের ক্রয় করা হয়েছে এমন ভাবারও কোনো মানে নেই। যদি সে স্বেচ্ছায় ঘরের কাজ করতে চায় তাহলে করবে কিন্তু বাইরে কাজ করার স্বাধীনতা, কথা বলার স্বাধীনতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতাও তাদের দিতে হবে। যেন বিয়েটা তাদের কাছে কোনো শাস্তি আর সংসারকে তাদের কাছে কোনো জেলখানা মনে না হয়। গৃহিণী হোক কিংবা কর্মজীবী সমান সম্মান তার পাওনা। নিজের মেয়েকে এক চোখে দেখা আর বউমাকে আরেক চোখে দেখা সত্যি কাম্য নয়।”
মা থামেন। একটু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার বলেন,
“তবে আমাদের সমাজ এখনো বউগুলোকে সেই পরের মেয়েই ভাবে। আমি জানিনা কবে মানুষের চিন্তা ভাবনায় পরিবর্তন আসবে। মনে রাখিস তোর এই মা সেসব শাশুড়ীদের মতো নয়। তোকে আমি আরমানের মতোই ভালোবাসি। তোর যা হতে ইচ্ছে তাই তুই হবি। আমি এবং আমার ছেলে সর্বাত্মক সাহায্য করবো তোকে। বিয়ে হয়েছে মানে এই নয় যে তুই তোর স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দিবি। এবার কান্না থামা মা।” তিথি কোলে মুখ লুকিয়ে আলতো সুরে বলে, “ভালোবাসি মা।”
সব বাঁধা পেরিয়ে আজ তিথি একজন সফল পুলিশ অফিসার। তার সাহসিকতার জন্য বেশ পুরষ্কার সে পেয়েছে। আজও পাবে। আরমান একপাশে বসে। আরেকপাশে মা বসে। মায়ের কোলে তিথি আর আরমানের সন্তান আদনান। তিথির নাম ঘোষণা করা হয়েছে। আরমান তিথির হাতে চুমু এঁকে সাহস জোগায়। তিথি হাসিমুখে উঠে দাঁড়িয়ে স্টেজের দিকে পা বাড়ায়।
পুরষ্কার হাতে নিতেই সকলের উদ্দেশ্যে তাকে কিছু কথা বলতে বলা হয়। তিথি পুরষ্কারটা মায়ের দিকে হাত উঁচিয়ে ধরে। চিৎকার করে বলে, “ভালোবাসি মা। আজ আমি যা হয়েছি সব কেবল তোমার এবং আরমানের কারণে। আমার পৃথিবীটাকে এত সুন্দর করার জন্য আমি কৃতজ্ঞ মা।”
সকলে ফিরে তাকায় মিসেস শেখ ও আরমানের দিকে। করতালিতে মুখরিত হয়ে উঠে চারপাশ।
(সমাপ্ত)….
গল্প- মা
লেখনীতে- আনিকা রাইশা হৃদি