আমি যখন বাবলি আপার প্রেমে পড়লাম তখন সে মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে আর আমি অনার্স প্রথম বর্ষে। অতি সুন্দরী বাবলি আপার জন্য পাড়ার সব বেকার ছেলে দিওয়ানা। আমিও ছোঁয়াচে রোগে দিওয়ানা মাস্তানা হয়ে গেলাম।
বাবলি আপা যখন কলেজে যেত তখন কিছু দূর পর পর রাস্তার পাশে এলাকার ভাইদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতাম। আমি ওসব দেখতে দেখতে স্কুলে যেতাম। বাবলি আপার কলেজ আর আমাদের স্কুল পাশাপাশি হওয়ায় এলাকার ভাইদের প্রেম দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। তবে বাবলি আপা খুব বিরস রমনী। কিছুতেই তাদেরকে পাত্তা দিতো না। এসব দেখেই এসএসসি এবং এইচএসসি পাশ করার পরে আমিও সেই বিরস রমনীর প্রেমে পড়ে গেলাম। অত্র এলাকায় এত মেয়ে থাকতে বাবলি আপার জন্য ওরা কেন পাগল ছিল তা আমার বোধগম্য নয়। আমিই বা কেন সেই মেয়েটির জন্যই পাগল হলাম তাও আমার বোধগম্য নয়।
আমাদের বাড়ির এক বাড়ির পরে বাবলি আপাদের বাড়ি। ছাদে গিয়ে দাঁড়ালে তাকে দেখা যায় দূর থেকে। গোসল করেই ভেজা চুল আর চিরুণী হাতে সে ছাদে যায়। যতক্ষণ তার লম্বা কেশ না শুকায়, সে ননস্টপ চুল ব্রাশ করে। আমি ক্লাস ফাঁকি দিয়ে দুপুর রোদে ছাদে দাঁড়িয়ে থাকি তার চুল ব্রাশ করা দেখার জন্য। চুল ব্রাশ করা দেখার মধ্যেও যে এত সুখ লুকিয়ে থাকতে পারে তা প্রেমে না পড়লে বুঝতাম না। এছাড়া অন্য সময়ে তাকে ছাদে পাওয়া যায় না। তবে বিকেলে ঝুল বারান্দায় তাকে বসে থাকতে দেখা যায়। রাস্তার ধারেই ওদের বাড়ি এবং ঝুলবারান্দা। প্রেমে পড়ার পরে বিকেলে আমার হাঁটাহাঁটি বেড়ে গেল। নতুন প্রেমের জোয়ার আমার মনে। বিকেলে কমপক্ষে বিশবার চক্কর দিই ওদের বাড়ির সামনে দিয়ে। একদিন বাবলি আপা উপর থেকে বলল, “ওটা মৃদুল না!”
আমি থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। শুকনো হেসে চোরের মতো তাকিয়ে রইলাম।
বাবলি আপা বলল, “ক’দিন ধরে তোকে দেখছি রাস্তা দিয়ে যাস আর আসিস, এত হাঁটাহাঁটি করছিস; তোর ডায়বেটিস হয়েছে নাকি?”
আমার উত্তপ্ত প্রেমে “ডায়বেটিস” শব্দটি শীতল জল ঢেলে দিলো। বড়ই নিষ্ঠুর মনে হলো বাবলি আপাকে। নারী হয়ে একটা প্রেমিক মন কেন বুঝবে না সে? পাষাণ রমনী একটা! অবশ্য সে যে পাষাণ তা নতুন কিছু নয়। এই পাড়ার সব বেকার ছেলের দিল চূর্ণবিচূর্ণ তো সে-ই করেছে।
তবুও আমি প্রতিদিন চক্কর দিই ওদের বাড়ির সামনে দিয়ে। প্রেমিক মন যে কিছুই মানতে চায় না। বাবলি আপা আমাকে ডায়াবেটিস রোগী মনে করলে করুক। কিন্তু আমি যে ভয়ানক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছি তা সে কবে জানবে? তাকে দেখলেই বুকের কাঁপনে আমার জ্বর আসে অথচ তাকে না দেখে থাকতে পারি না; এসব সে কবে বুঝবে?
আমার প্রেমের খবর শুনে বন্ধুরা তো প্রথমে হাসি তামাশা শুরু করল। সিনিয়র মেয়ের সাথে প্রেম তারা ভালো চোখে নিলো না। তাতে কী, আমি তো প্রেমিক! জাত-কুল, বয়স এসব কিছুই ম্যাটার নয় প্রেমে। পরে অবশ্য বন্ধুরা মেনেই নিলো। তাদের সাথে আলোচনায় বসলাম, কেমন করে মনের কথা বাবলি আপাকে জানাব! একজন বুদ্ধি দিলো চিঠি লিখতে।
সেই রাতেই এগারো পৃষ্ঠার একটা চিঠি লিখে ফেললাম। চিঠি রিভিশন দিতে গিয়ে দেখলাম, জীবনে কতজনকে কতভাবে প্রেমে পড়তে দেখেছি, কতজনের প্রেমের অনুভূতি শুনেছি, চাচার প্রেম, মামার প্রেম, বড় ভাইয়ের প্রেম, পাড়াতো ভাইয়ের প্রেম, লাইলি-মজনু, শিরি-ফরহাদ, কারও প্রেমের কথা লিখতে বাদ রাখিনি চিঠিতে। আস্ত একটা চিঠিকে মস্ত একটা উপাখ্যান বানিয়ে ফেলেছি। রাজ্যের সব কথা লেখা হলেও “ভালোবাসি” তাকে এই কথাটি লেখা হয়নি। লিখতে গিয়ে বুকসহ হাতপা কাঁপা শুরু হলো। কাঁপা কাঁপা হাতে তাকে লিখলাম, “ভালোবাসি।” কিন্তু নিজের নাম লেখার সাহস জুটল না। সাহস না জুটলে তো হবে না, কারণ পাড়ার সিনিয়র বেকার ভাইয়েরাও বাবলি আপার জন্য পাগল। এত পাগলের মধ্যে এই মহান পাগলকে বাবলি আপা চিনবে না, তা কী করে হয়? বড় বড় অক্ষরে লিখলাম, “মৃদুল।”
এরপর সমস্যা তৈরি হলো চিঠিটা বাবলি আপার কাছে পৌঁছাব কী করে। আমার কোনো বন্ধুই পিয়ন হতে রাজী নয়। সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, বাবলি আপা যখন ছাদে বসে চুল শুকোবে তখন চিঠিটা তার দিকে ছুঁড়ে মেরে পালিয়ে আসতে হবে।
দুইদিন ধরে চেষ্টা করেও সাহস পেলাম না। তৃতীয় দিনে ছুড়েই মারলাম চিঠি। চিঠির ভেতরে একটা ইটের টুকরো ছিল যেন ছুড়ে মারলে বাবলি আপার ছাদে গিয়ে পড়ে। কিন্তু চিঠি পড়ল আমাদের আর বাবলি আপাদের বাড়ির মাঝখানের বাড়িটার ছাদে। আমি হাবলার মতো তাকিয়ে রইলাম। এই চিঠি কারও হাতে পৌঁছানোর আগেই উদ্ধার করতে হবে।
চিঠি উদ্ধার করা সম্ভব হলো না। চিঠি অন্যের হাতে পড়লে কী হবে সেই ভয়ও নেই আমার। আমি যে নির্ভীক প্রেমিক। আমার মনে ভয় নয়, প্রেমের জোয়ার বয়ে চলে।
পরেরদিন বিকেলে বাবলি আপাকে ঝুলবারান্দায় নয়, তাদের বাড়ির সামনেই পেলাম। তাকে দেখে বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেল। না না পাঠক, এটা ভয়ের ধুকপুকানি নয়, এটা প্রেমের ধুকপুকানি।
বাবলি আপা বলল, “মৃদুল শোন।”
আমি কিছু না জানার ভান করে তাকিয়ে বললাম, “বলো।”
“তুই বয়সে আমার পাঁচ বছরের ছোট। তুই যখন ছোট ছিলি তখন তোকে আমি অনেকবার কোলে নিয়েছি। চাচী তো তোকে আমার কাছে রেখে বাড়ির কাজ করতেন। তুই যে কতবার আমার কোলে মুতে দিয়েছিস। দেখ, এখনো হয়তো সেই দুর্গন্ধ আমার গায়ে আছে। অথচ সেদিনের সেই তুই বহুমুত্র রোগে আক্রান্ত। ভাবতেই কষ্ট হয় আমার।”
কথাগুলো বলেই বাবলি আপা করুণ চোখে তাকাল। আমিও করুণ চোখে তাকিয়ে রইলাম।
যার জন্য আপনি দিবানা, মাস্তানা, পাগল মজনু, তার মুখে যদি শোনেন তার কোলে ছোটবেলায় আপনি মুতে দিয়েছেন; তাহলে আপনার অনুভূতি কেমন হবে? এসব কথা শোনার পর কোন প্রেমিকের বুকে প্রেম অবশিষ্ট থাকবে? আপনার হৃদমাজারে গর্জন করা প্রেম কর্পুরের মতো উড়ে যাবে না? যাবার তো কথা। কিন্তু আমার প্রেম খরস্রোতা নদীর মতো অবিরাম বয়েই চলেছে। এটা কখনোই উড়োজাহাজ হবার সম্ভাবনা নেই।
পাশের ছাদের চিঠিটা যে বাবলি আপার হাতে পৌঁছেছে তা বুঝতে আর বাকী নেই। মনে মনে বললাম, “এরপর আমাদের সন্তান তোমার কোলে ইশু করবে, বাবলি আপা।”
কিন্তু কথাটা মুখে বলার সাহস হলো না।
সে বলল, “তোর তো দাড়ি-গোফই এখনও ঠিকঠাক ওঠেনি।”
তার মুখে এমন কথা শুনে বুকের পাজর ভেঙে এলো। হায় একি কষ্ট! বাড়ি ফিরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দাড়ি-গোফ গোনা শুরু করলাম। গুনে শেষ করতে পারলাম না অথচ নিষ্ঠুর রমণী বলে কি না, আমার দাড়ি-গোফ ভালো করে ওঠেনি!
সেই রাতেই আমি আবার চিঠি লিখতে বসলাম। ঐশ্বরিয়ার যে অভিষেকের সিনিয়র, প্রিয়াঙ্কা চোপড়াও যে নিকের সিনিয়র, সচীন টেন্ডুলকারের বউও যে সিনিয়র, এসব সব লিখলাম। সেলিব্রিটি দম্পতিদের বয়সের এমন অসম ব্যবধানের বিষয়টা সুন্দর করে বিশ্লেষণ করলাম। এছাড়াও যুগে যুগে যারা বয়সে বড় মেয়ের সাথে প্রেম করে বিয়ে করেছে তাদের সবার কথাই লিখলাম। এমনকি যারা সিনিয়র মেয়েকে বিয়ে করেনি তাদেরকেও দলে যুক্ত করে নিলাম। সৌরভ গাঙ্গুলী, অমিতাভ বচ্চন, এদেরকেও বাদ দিলাম না। তাও যদি বাবলি আপা আমার অনুভূতি একটু বোঝে।
এবার চিঠি ছাদে নয়, বাবলি আপার বারান্দায় ছুড়ে মারা হলো। তারপর ভয়ে আমি তিন চারদিন ধরে ওদের বাড়ির সামনে যাই না। কয়েকদিন পর বিকেলে ওদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাবার সময় উপর থেকে আওয়াজ এলো, “মৃদুল দাঁড়া!”
আমার হার্টের বিট থেমে গেল, সারা শরীর মুহূর্তেই ঘেমে ভিজে উঠল। আমি উপর দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস পেলাম না। বাবলি আপা বলল, “তোর চিঠির জবাব নিয়ে যা, মৃদুল।”
মুহূর্তেই আমার সবকিছুই যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। কে জানত, আমার সেই চিঠিতেই বাবলি আপা আমার প্রেমে পড়বে! অবশ্য তার প্রেম আমার প্রেমের মতো দুরন্ত টাইপের হবে না সেটা আমি আগে থেকেই জানতাম।
আমার শ্বাস আটকে এলো উত্তেজনায়। প্রেম সফল হতে চলেছে, বিশ্বাসই হচ্ছে না।
বাবলি আপা নিচে এসে একটা কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বলল, “সামনে শুক্রবার আমার বিয়ে। বরের গেট ধরবি তুই। গেটটা সুন্দর করে সাজাবি কিন্তু।”
আমি কোনো শব্দ করতে পারলাম না। বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলাম শুধু। আমার জীবনের প্রথম প্রেম এমন করে শেষ হবে ভাবিনি। আমি বাবলি আপার বিয়ের কার্ডটা হাতে নিয়ে হাঁটছি উদাসীন। আমার দুই চোখে সামনে শুক্রবার ভেসে উঠল, আমি বাবলি আপার বিয়ের গেট সাজাচ্ছি; পাড়ার সব বেকার সিনিয়র ভাইয়েরা আমার সাথে হাত লাগিয়ে কাজ করে চলেছে।
#সমাপ্ত
“ছোঁয়াচে প্রেমে”
Written by- Sazia Afrin Sapna