টু ফাইভ এইট জিরো পর্ব ৩
ওসি সাহেব বললেন,
– তাইশা ম্যাডাম, আপনাকে আমাদের সঙ্গে থানায় যেতে হবে।
তাইশা বললো,
– কিন্তু কেন?
– এরকম একটা কল আসার পরে, এমন কথা শোনার পরও আপনি জিজ্ঞেস করছেন ‘কেন? ‘
– আমি তো বললাম যে আমি কিছু করিনি। যদি বিশ্বাস নাহয় তাহলে হাসপাতালে চলুন। সেখানে গিয়ে সবকিছু জানতে পারবেন।
– আমরা সবখানেই যাবো, সবকিছুই চেক করে সামনে আগাবো। আমাদের নিয়ে আপনাকে মোটেও চিন্তা করতে হবে না।
– আমি তো পালিয়ে যাচ্ছি না। আমার বাবা এখন হাসপাতালে, আমাকে এই মুহূর্তে থানায় যেতে হলে বাবার কি হবে।
– আপনার বাবার যেন কোনো অসুবিধা না হয় সেই ব্যবস্থা আমরা করবো।
– কিন্তু বাবা যদি জানতে পারে, আমাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে তাহলে…..!
– আপনার বাবাকে জানানোর হবে না।
তামান্না নিচে নামলো, পুলিশ ও তাইশাকে দেখে অবাক হলেও উপরে উপরে স্বাভাবিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন রাখলো। তারপর তাইশার কাছে এসে বলল,
– কি হয়েছে আপু?
ওসি সাহেব বললেন,
– আপনি কে?
তাইশা বললো,
– আমাদের ভাড়াটিয়া।
– আপনি গতকাল রাতে বাসায় ছিলেন?
– না, মিরপুরে ছিলাম। সকালে এসেছি, কিন্তু কি ব্যাপার বলেন তো।
– ছাদে রুদ্র নামে একটা ছেলে উঠেছে নতুন। তাকে চিনতেন?
– একবার দেখেছিলাম শুধু। আজকে সকালে শুনলাম সে নাকি সন্ত্রাসী। রাতে পুলিশ এসে তাকে ধরে নিয়ে গেছে।
– কে বলেছে?
– দারোয়ান।
– ওহ্ আচ্ছা।
ওসি সাহেব তাইশার দিকে তাকিয়ে বললো,
– চলুন আমাদের সঙ্গে।
★★
একদিন পরের ঘটনা। সাজু বসে আছে রুদ্রর সামনে। আগের শুনানির সময় সে হাসপাতালের একটা মেয়ের কথা বলেছিল। সাজু ভাই রুদ্রর কাছে সেই মেয়ের ঘটনা জিজ্ঞেস করলো।
রুদ্র বললো,
বছর খানিক আগে আমি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসছিলাম৷ সেই রাতেও প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টির কারণে বাস ঢাকায় পৌঁছাতে প্রায় তিন ঘন্টার মতো দেরি হলো। বাস থেকে নামার পরে কোনো রিক্সা না পেয়ে হেঁটে হেঁটে বাসায় রওনা দিলাম। বৃষ্টি কমেছে কিন্তু রাস্তায় পানি জমে গেছে হাঁটু পর্যন্ত। হঠাৎ করে একটা রিক্সা পেলাম। ৩০ টাকার ভাড়া ১০০ টাকায় ঠিক করে রিকশার মধ্যে উঠে বসলাম।
কিছুদূর যাবার পরই একটা মেয়েকে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রিকশাওয়ালা ও আমি দুজনেই অবাক হলাম। রিকশা থামলো, মেয়েটা আমাদের সামনে এসে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
– আমাকে একটু সাহায্য করবেন? আমার মা খুব অসুস্থ, তাকে হাসপাতালে নিতে হবে। কিন্তু কোথাও কিছু পাচ্ছি না। এম্বুলেন্সের জন্য কল দিলাম তারা এখনো আসছে না কেউ।
আমি কিছু বলার আগেই রিকশাওয়ালা আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
– কি করবেন স্যার?
বললাম,
– আপনি কি হাসপাতাল পর্যন্ত যেতে পারবেন?
– পারা যাবে, কাছেই তো একটা হাসপাতাল আছে। আধা ঘণ্টার মতো লাগবে সেখানে যেতে।
– আমি তাহলে হেঁটে হেঁটে বাসায় চলে যাচ্ছি। আপনি তার মাকে নিয়ে হাসপাতালে যান৷
– এটা কি বলেন স্যার? আপনি গেলে আমিও যামু, এর সঙ্গে তো কোনো পুরুষ নাই।
মেয়েটা বললো,
– পুরুষ নাই এটা ঠিক বলেছেন। যদি থাকতো তাহলে তো আমার এই রাতের মধ্যে কষ্ট করে গাড়ি খুঁজতে হতো না।
বললাম,
– ঠিক আছে চলুন।
রিকশা করেই মেয়েটার মাকে নিয়ে হাসপাতালে আসলাম। আমরা হাসপাতালের কাছাকাছি যখন এসেছি তখন এম্বুল্যান্স বাসার সামনে গিয়ে কল করেছিল।
হাসপাতালে ঢুকে আমি অবাক। এখানেই আমার বন্ধু রাশেদ চাকরি করে। তবে আগে কখনো আসা হয়নি এখানে। কতবার আসতে বলেছে কিন্তু আমি আসিনি। অবশ্য এলাকায় আমি এসেছি তখন মাত্র চার মাসের মতো হবে। কোম্পানির চাকরি করা মানুষের চারিদিকে এতকিছু চেনা সম্ভব না।
হাসপাতালে বসে বন্ধুর কাছে কল দিলাম। এমারজেন্সি বিভাগের ডাক্তারের কাছে সুপারিশ করে দিল। মেয়েটার মাকে কেবিনে নিয়ে গেলাম।
আমি বাহিরে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। তারপর নিচে নেমে বসে ছিলাম। ডাক্তার একটা স্যালাইন দিল আরো কিছু ওষুধ দিল। আমি সবকিছুই নিচের ফার্মেসি থেকে সংগ্রহ করলাম।
এরপর যখন একটু ফ্রী সময় পেলাম তখন ফজর ওয়াক্ত হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পরেই মসজিদের মাইকে আজান দিল। আমি হাসপাতালের একটা চেয়ারে বসে বসে ঘুমালাম।
ঘুম ভেঙ্গেছিল মেয়েটার ডাকে। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি সকাল হয়ে গেছে। চারিদিকে পরিষ্কার, এবং মানুষজন হাঁটাচলা করতে দেখা যাচ্ছে।
– আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করতে চাই না। সবকিছুর জন্য আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ।
বললাম,
– আপনার মা এখন কেমন আছে?
– কিছুটা ভালো আছে, ঘুমাচ্ছে।
– আমি তাহলে যাই, আমাকে আবার অফিসে যেতে হবে।
– আপনি রাতে অনেক ওষুধের টাকা নিজের পকেট থেকে দিয়েছেন। মোট কত টাকা হয়েছে?
– আমি অফিস থেকে ফিরে আবার আসবো। তখন নাহয় জানাবো?
– সত্যি আসবেন?
– হ্যাঁ, কোনো সমস্যা?
– না না সমস্যা হবে কেন? আমি একটা অপরিচিত মানুষ, আপনি এতটা সাহায্য করবেন কখনো আশা করিনি।
– ঠিক আছে তাহলে যাই। আমার বন্ধু আসবে সকাল আটটার দিকে, ওকে আমি বলে দেবো। কোনো সমস্যা হলে আমার বন্ধু আপনাকে সাপোর্ট দিবে আশা করি।
– আপনার নামটা জানতে পারি?
– রুদ্র, শাকিল আহমেদ রুদ্র। আপনি?
– অবন্তী রহমান।
– আপনার বাবা কোথায় থাকেন? তাকে কি জানানো হয়েছে?
অবন্তী মুখটা ফ্যাকাসে করে বললো,
– আমাকে বাবা নেই, ঢাকা শহরে আমি আর আমার মা থাকি। এছাড়া আমাদের আর তেমন কোনো আত্মীয় নেই।
– আপনার বাবার কথা মনে করানোর জন্য দুঃখিত আমি।
– আপনি তো জানতেন না, সরি বলার কিছু নেই। গ্রামের বাড়িতে মামাকে জানানো হয়েছে। মামা ইতিমধ্যে রওনা দিয়েছে। আমার একটা মামাতো ভাই আছে কিন্তু সে ঢাকা শহরের কোথায় থাকে আমি জানি না। মামার সঙ্গে বা আমাদের কারো সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই।
– ঠিক আছে, আপনি সাবধানে থাকবেন। আর আমার নাম্বারটা রাখুন, প্রয়োজন হলে কল দিবেন।
আমি হাসপাতাল থেকে বের হয়ে বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ শুইলাম। মেসে থাকতাম, তাই অফিসের পোশাক পরে বাসা থেকে বের হয়ে গলির হোটেল থেকে নাস্তা করে অফিসে চলে গেলাম। চট্টগ্রামে অফিসের কাজেই গেছিলাম। তাই সেখান থেকে আসার পরে আজকে অফিসে কাজের চাপ বেশি ছিল।
হাসপাতালের কথা মোটামুটি ভুলেই গেলাম। দুপুরের খাবার খেলাম চারটার দিকে তা আবার বসের সাথে বসে। মেয়েটার কোনো নাম্বার আমি আনিনি সুতরাং সে কল না দিলে আমি তো যোগাযোগ করতে পারবো না।
সন্ধ্যার পরে অফিস থেকে বের হয়ে মোবাইলে তাকিয়ে হতাশ হলাম। কারণ অপরিচিত কোনো নাম্বার থেকে কোনো কল আসেনি। হাসপাতালের দিকেই গেলাম। হাসপাতালে গিয়ে শুনলাম তারা নাকি দুপুরের দিকে চলে গেছে।
অবন্তীর মামা এসে অবন্তীর মাকে নিয়ে গেছে হাসপাতাল থেকে। সত্যি বলতে মেয়েটাকে বেশ ভালো লেগেছিল সাজু ভাই। আজও মেয়েটার মুখটা মনে পড়ে, কতদিন তাকে খুঁজেছি কিন্তু কোথাও পেলাম না।
★★
– স্যার আপনাকে ওসি সাহেব ডাকছেন।
একজন কনস্টেবল দাঁড়িয়ে আছে রুদ্রর কেবিন এর সামনে। কেবিনের মধ্যে সাজু ও রুদ্র ছাড়া আর কেউ নেই। সাজু কেবিন থেকে বের হয়ে ওসি সাহেবের কাছে গেলে।
ওসি সাহেব বললেন,
– কিছু জানা গেল?
– স্যার এখানে অতীত আর বর্তমান নিয়ে একটা গোলমাল আছে মনে হয়। সবটা এখনো বুঝতে পারছি না।
– সকালে তো ওই বাড়িতে গেলে, সেখানে কিছু জানা যায়নি?
– যেটুকু জানতে বা বুঝতে পেরেছি সেটুকু বলার মতো সময় এখনো হয়নি স্যার। সময় হলে আমি সবকিছু বলবো আপনাকে। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আমি একটু থানায় যাবো তাইশার সঙ্গে কথা বলতে।
– ঠিক আছে। কিন্তু নিয়াজ হাসানের বোনটা বারবার শুধু কল দিচ্ছে।
– বলেন যে তদন্তের কাজ চলছে। দেড় মাস যখন অপেক্ষা করতে পেরেছে তখন আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে সমস্যা কি।
– আচ্ছা তুমি থানায় গেলে চলো, আমি এখন থানার দিকে যাচ্ছি।
– আমি রুদ্রর সঙ্গে আরেকটু কথা বলতে চাই। আমার সঙ্গে বাইক আছে, আমি একাই চলে যেতে পারবো। আপনি বরং চলে যান।
ওসি সাহেব কিছু বললেন না। ডিবি অফিস থেকে বলা হয়েছে সাজুকে নিজের মতো থাকতে দিতে। সে যদি কোনকিছু একা একা করতে চায় বা গোপন করে কাজ আগাতে চায় সেখানে যেন বাঁধা দেওয়া না হয়।
ওসি সাহেব চলে যাবার পরে সাজু ভাই আবারও কেবিনে প্রবেশ করলো। কেবিনে ঢুকেই দেখে রুদ্র তড়িঘড়ি করে বিছানায় বসেছে।
সাজু মিয়া,
– আপনি বিছানা থেকে নামলেন কেন?
রুদ্র আমতাআমতা করে বললো,
– ওয়াশরুমে গেছিলাম।
– কোই হাত দেখি?
রুদ্র হাত দেখালো, দুটো হাতই শুকনো। সাজু ভাই কিছু না চুপ করে রইল। রুদ্র বললো,
– স্যরি সাজু ভাই, আড়াল থেকে আপনাদের কথা শুনতে মনটা খচখচ করছিল।
– আপনি ইনফর্মার হিসেবে কাজ করেন কতদিন ধরে?
– সাত আট মাস হবে।
– কিছু প্রশ্ন করি সঠিক উত্তর দিবেন।
– জ্বি বলেন।
– আমার ধারনা অবন্তীর সঙ্গে আপনার অনেক আগেই দেখা হয়েছে। অবন্তীর সেই যোগাযোগ ছিল না মামাতো ভাইটা কি নিয়াজ হাসান? যিনি তাইশার এক্স বয়ফ্রেন্ড।
– কি বলেন স্যার? আমি কেন…
– স্যার না সাজু ভাই, সাজু ভাই বলে ডাকবেন তাহলে ভয়টা কাজ করবে না। আপনি সবকিছু ঠান্ডা মাথায় বলেন। নিয়াজ হাসানের সঙ্গে কিসের ঝামেলা ছিল?
– কোনো ঝামেলা ছিল না।
– সেদিন রাতে বৃষ্টি থামার পরে আপনার সঙ্গে ঘটেছে এরকম যে ঘটনা আপনি বলেছেন। সেটা সম্পুর্ন আপনার বানানো ঘটনা। সেই রাতে শরীরে যা নেবার সেটা আপনিই নিয়েছেন। আর ওসি সাহেবের কাছে বলেছেন আপনাকে জানালা দিয়ে কেউ দিয়েছে। আবার তাইশা নাকি জানালা দিয়ে কথা বলেছে, বলেন এসব মিথ্যা ঘটনা বানানোর কারণ কি?
রুদ্র যেন আকাশ থেকে পড়লো। প্রথমে কিছু বলতেই পারছিল না। তারপর আস্তে করে বললো,
– সাজু ভাই আমি পুলিশের হয়ে কাজ করতে ওখানে গিয়েছি। আমি কেন শুধু শুধু বানিয়ে বানিয়ে কথা বলবো?
– শেষ আরেকটা প্রশ্ন করবো, তারপর সবগুলো প্রশ্নের উত্তর একসঙ্গে দিবেন।
– কি প্রশ্ন?
– নিয়াজ হাসানকে হত্যা করেছে কে? আপনি নাকি অবন্তী? খুনটা কে করেছে? তামান্না কে, তামান্নার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কিসের? এটা কি সেই তামান্না যে টাকার জন্য মানুষ খু!ন করে?
আস্তে আস্তে সবগুলো উত্তর দিন।
.
.
চলবে…
[ কেমন হয়েছে, কমেন্ট করে জানাবেন। আর সাজু ভাই কীভাবে ডিবি পুলিশের চাকরি নিয়েছে সেই সম্পর্কে বিস্তারিত থাকবে ” চাদর জড়ানো চিরকুট দ্বিতীয় খন্ডে ” যেহেতু দুটো গল্পের আগের গল্প হচ্ছে ” চাদর জড়ানো চিরকুট দ্বিতীয় খন্ড ” তাই সেখান থেকেই তার চাকরির শুরু। ]
লেখা:-
মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)