#এক কাপ চা .
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্ব ৯
(২৫)
সাগরিকাকে নিজ বেডে শুইয়ে দিয়ে তাশদীদ তার পাশেই বসেছিল।হঠাৎ তার নাকে ধুনোর গন্ধ এসে ধাক্কা দিচ্ছে। এই গন্ধটা তার পরিচিত। মনে পড়ে গেল এই গন্ধটা তার গ্রামের এক দাদার বাড়ি থেকে সন্ধ্যে বেলা পাওয়া যেত।
ধুনোর গন্ধ মানেই সাধু সন্ন্যাসীর একটা ব্যাপার মনে হচ্ছিলো তার। হঠাৎ মনে জেকে বসেছে এক রাশ অস্বস্তি।
অস্বস্তিটা কে পাত্তা না দিলেও গন্ধটা তীব্র হতে লাগলো।সে মোটামুটি নিশ্চিত হলো যে এই বাড়িতেই কেউ কারোর ক্ষতির উদ্দেশ্যে কোনো সাধনা করতে বসেছে।কিন্তু বাড়ি তখনো ফাঁকা।
সাগরিকার গায়ে চাদর টেনে দিয়ে দরজা খুলেই নিচে নামতেই দেখতে পেলো ইখুমের ঘর ধোঁয়ায় ভর্তি।
কোনো কিছু চিন্তা না করে তাশদীদ দ্রুত ছুটে গেল ঘরের দিকে।পুরো ঘর ধোঁয়ায় পূর্ণ। তার সামনেই চেয়ারে বসে আছে ইখুম।সম্ভবত তার কোনো জ্ঞান নেই।মাথা নুইয়ে ঠেকেছে বুকে।শরীরের কাপড় এলোমেলো।তার সামনেই চলছে যজ্ঞের আগুন।সাধু বেশে একজন মহিলা বিড় বিড় করে মন্ত্র পড়ে আগুনে আহুতি দিচ্ছে কিছু একটা।
অন্য সময় হলে চক্ষু লজ্জায় ঘরে প্রবেশ তো দূর,ইখুমের দিকে তাকানোর সাহস করতো না তাশদীদ কিন্তু এখন ইখুমের এলোমেলো শাড়ির ঠিক থাকার থেকে তার জীবনের নিরাপত্তা অধিক জরুরী।
ঘরে আর কেউ নেই। তান্ত্রিক মহিলা এবং ইখুম।কিন্তু তাশদীদ খেয়াল করলে দেখতে পেত ইখুমের ঘরের দরজার ঠিক পিছনটায় ধোঁয়ায় দাঁড়িয়ে আছে জুলি।
তাশদীদ এগিয়ে যেতেই সে সুযোগ বুঝে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।সামিনা গিয়েছিল নিচে, বলির জন্য পশুর ব্যবস্থা করতে কিন্তু জুলি দৌড়ে এসে তাকে বলল,
“বড় বাবা বাড়িতে কেন?কোন সময় আইলো?”
জুলির কথায় জান-পরাণ অবাক হয়ে সামিনা বলল,
“মানে?”
“মানে তাশদীদ বাবা বাসায়। ইখুমের ঘরে। তান্ত্রিক মা কিছু বলার আগেই আপনে বাগানে চইলা যান। বাকীটা আমি সামলে নিমু।যান দেরি কইরেন না।”
“কিন্তু ইখুম?”
“এই বাড়িত থাকলে আপনি অনেক সুযোগ পাবেন।বাড়ি থেকে বাইর কইরা দিলে পাবেন না।”
তান্ত্রিকের যজ্ঞের আগুনে পানি ঢেলে দিয়ে ইখুমকে টেনে তুলে নিলো তাশদীদ। সোজোরে দরজা বন্ধ করে সিকিউরিটি গার্ডদের কল দিয়ে উপরে আসতে বলল।ইখুম কে নিয়ে শুইয়ে দিয়েছে সাগরিকার পাশে।
সাগরিকা ততক্ষণে উঠে বসেছে।ইখুমকে দেখে সাগরিকা কিছুটা ভয় পেয়ে গেলেও তাশদীদের জন্য কিছু বলল না।
ইখুমের চোখে মুখে পানি দিলেও যখন তার জ্ঞান ফিরলো না তখন সাগরিকার হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“আংকেল কে কল দিয়ে আসতে বল এক্ষুণি।আর নিচে আসবি না। যাই হোক,আমি না আসা অবধি আসবি না।”
(২৬)
পুলিশ এসে ধরে নিয়ে গেছে সেই তান্ত্রিক মহিলাকে। সে বোবা মনে হচ্ছে কারণ তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের করা যায়নি।তাকে বাড়িতে আসতে দেখেনি কেউ।কিন্তু এমন কেন করেছে সে এটা জানা গেল না।পুলিশ নিশ্চয়তা দিয়েছে বিষয়টা তারা গুরুত্বের সাথে দেখবে।বাড়িতে ততক্ষণে সবাই ফিরে এসেছে। সাগরিকার মা সেই যে ইখুমের পাশে বসেছে এখনো উঠেনি।
ভাগ্যিস তাশদীদ দেখেছিল না হলে আজ ইখুমের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেত। কিন্তু বিষয়টি স্বাভাবিক ভাবে নিচ্ছে না রাশেদ।
আজ যেন সে অনেকটা পাগল ষাঁড়ের মতোন আচরণ করছে। এই বাড়িতে এতগুলো সিকিউরিটি গার্ডকে চোখে ধুলো দিয়ে একজন সরাসরি কারোর বেড রুমে চলে গেল কী করে?
কিন্তু পরক্ষণেই তাদের খেয়াল হলো বাড়ির পিছনের দরজা, মানে ফায়ার এক্সিটটা ভাঙ্গা।কেউ ইচ্ছে করে ভেঙ্গেছে।
এত কিছুর মাঝে তুলি এক কান্ড করে বসলো।সে সরাসরি সামিনাকে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি তো ছিলেন। আপনি বুঝেন নি?”
সামিনা কাঠ কাঠ গলায় জবাব দিলো,
“না।”
(২৭)
সাগরিকা বার বার কেঁপে উঠছে আজ তাশদীদের কথাগুলো মনে করে। সে যেন আজ তাকে মেরেই ফেলতো। গালে আংগুলের ছাপ পড়েছে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে দাগ গুলোর দিকে তাকিয়ে সাগরিকা দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,
“আমি বড় হয়ে তোমার ছেলে মেয়েদের পড়াবো।আমিই তাদের টিউশন দিবো তাদের। তারপর পড়া পারুক বা না পারুক তাদের পাচ্ছুতে পটাশ পটাশ মার দিবো।তখন বুঝবে নিজের
বাচ্চাদের মারলে কেমন লাগে।”
কারো আসার শব্দে সাগরিকা দ্রুত তার নিজের বিছানায় শুয়ে কম্ফোর্টারে তার মুখ ঢেকে ফেলল।
কিছুক্ষণ পর অনুভব করলো কেউ একজন ধীরেধীরে এগিয়ে আসছে তার দিকে।উষ্ণ এক স্পর্শে কেউ ছুয়ে দিচ্ছে সাগরিকার গালের দাগ।সাগরিকা প্রানপণে চেষ্টা করছে সেদিকে না তাকানোর। এজন্য সে উল্টো পিঠে ঘুরার আগেই তার নাকে এলো কড়া বেলি ফুলের গন্ধ এবং গলায় পেলো এক জ্বলন্ত ঠোঁটের স্পর্শ। বিছানার চাদর খামছে ধরে সে শক্ত হয়ে মনে মনে ভাবলো
“আজ তো বিয়ের কথা ভাবিনি।তবে আশিক জিন কেন এলো?”
ইখুমের পায়ের কাছে বসে আছে রাশেদ। তার চোখে যেন আগুন জ্বলছে।ইখুমের নগ্ন শুভ্র পায়ে তখন ক্ষততে ভরপুর। রশি দিয়ে শক্ত করে বাধার ফলে কালো দাগ পড়েছে। খুব আস্তে-ধীরে সেই ক্ষততে মলম লাগিয়ে দিচ্ছে রাশেদ। সে না চাইতেও অনেক ক্ষতি ইখুমের চারপাশে ঘুর ঘুর করে। তিন বছরের এক তরফা ভালোবাসা রাশেদের এই ইখুম।যাকে বিয়ে করার জন্য সে বাড়িতে সাত দিন না খেয়ে পড়ে ছিল।রাগ জেদ দেখিয়েছিল মায়ের সাথে। সে নিতে রাজি হয়নি সামিনার দায়িত্ব কিন্তু নিয়তি এমন কেন?
উদ্ভ্রান্ত মরু পথিক হয়ে বেঁচে থাকা তার জন্য সত্যি মৃত্যুর থেকেও জঘন্য। মানুষ শুধু বাঁচার নামেই বেঁচে থাকে অনেক সময়। দায়িত্ব এবং ভালোবাসা দুটোর মাঝে দায়িত্বকেই কেন বেছে নিতে হয়?
যে দায়িত্বে ভালোবাসার স্পর্শ থাকে না সে দায়িত্ব কেবল মাত্র গলার ফাঁস। এই ফাঁস থেকে বাঁচতে চায় রাশেদ।ইখুমকে নিয়ে কিন্তু তা হয় না।
নিজের সমস্ত আবেগ পানির সাথে ঢকঢক করে গিলে ফেলল রাশেদ।সামিনা কখন তার ঘরে এসেছে সে বুঝেনি কিন্তু উপস্তিতির টের পেয়ে সে বলল,
“কেন করলেন ভাবী এমন?”
“আমার স্নেহার জন্য।”
“আমি তো আপনাকে নিষেধ করিনি।দায়িত্ব থেকে সরে যাইনি।”
“তোমার সন্তান থাকলে তুমি স্নেহাকে মানবে না।”
“ইখুম স্নেহাকে ভালোবাসে। ও স্নেহাকে নিজের সন্তানের পরিচয় দিবে।এখন সময় এসেছে ওকে সবটা জানানোর।”
“তবে আমি গলায় দড়ি দিবো।স্নেহা মা আমিই থাকবো।”
“কিন্তু বাবা আমি হলে মায়ের জায়গায় ইখুমের নামই আসবে।”
“আসবে না।কারণ আমিই স্নেহার মা।”
“কী চাইছেন আপনি?”
“বিয়ে করো আমাকে রাশেদ।শরীয়ত এবং আইন মোতাবেক।”
চলবে ……