#ফাবিয়াহ্_মমো
সকাল সাতটা বাজতেই বনানীর উদ্দেশ্যে গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে পূর্ব। বাড়িতে পূর্ণতা সবার সাথে সকালের নাস্তাটা সারলেও পূর্ব যে খেয়ে যায়নি এ নিয়ে ভীষণ চিন্তাগ্রস্ত। পলাশ ওয়াসিফ তাঁর দুই ভাইকে নিয়ে অফিসে চলে গেছে। আয়েশা চলে গেছে ডাক্তারের কাছে রেগুলার চেকাপ করতে। মেজো চাচী এসে রুমের দরজায় নক করে জানালো,
– আমরা একটু শপিংয়ে যাচ্ছি পূর্ণতা। তুমি কি আসবে?
পূর্ণতা ভাবনা ছাড়াই জানিয়ে দিলো, না বড় চাচী। আপনারা যান। আমি আরেকদিন যাবো কেমন?
মেজো চাচী কয়েকবার তোষামোদ করলো এতে বিশেষ কোনো লাভ হলোনা। পূর্ণতা বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে আছে সিলিংয়ের দিকে চোখ স্থির রেখে। এসিটা বাড়িয়ে গায়ে কাথা টেনে নিয়েছে। পূর্বকে একটা কল করবে? বাইরে থেকে কিছু খেয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করবে? গতরাতে ফোনটা সিমসুদ্ধো দিয়েছে পূর্ব। পূর্ণতা ফোনটা হাতে নিয়ে কয়েকবার কললিস্টে চাপ দিতে যেয়েও দিলো না। এতো অস্বস্তি হচ্ছে কেন? পূর্ব ওকে হাইড রাখছে এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ ক্লিয়ার ব্রিফ দিয়েছে একদিন। পুরো দুনিয়া জানবে ওয়াসিফ পূর্ব বিয়ে করেছে কিন্তু কাকে করেছে এ বিষয়ে কেউ জানবেনা। পূর্বের রাজনৈতিক কার্যকলাপে আনিশাও সমান তালে ক্ষতির তালিকায় ভুগতে পারতো কিন্তু আদৌ পূর্ব ওকে গোপন করে রাখেনি। আজ কেনো পূর্ণতার জন্য এতো কড়াকড়ি নিয়ম? বাইরে যেতে চাইলেও বোরখা পরে মুখে নিকাব মেরে যাওয়া লাগবে, ভার্সিটি যেতে চাইলে আগেরদিন বাবার বাড়িতে দিয়ে আসবে পরদিন সেখান থেকে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা দিবে, শপিংয়ে যাওয়া একদম নিষিদ্ধ। যা কিছুর প্রয়োজন সবকিছু লিস্ট করে কেয়ারটেকারকে দিয়ে দিবে। পূর্ব কাল রাতে বহু উদ্ভট নিয়ম তৈরি করেছে পূর্ণতার জন্য। চিন্তার অতল গহ্বরে ডুবে যেতেই হঠাৎ ফোন বাজতে লাগলো পূর্ণতার। ধড়ফড় করে শোয়া থেকে উঠে বসতেই ফোনের দিকে তাকিয়ে উদাস হয়ে গেলো সে। কলটা আনিশা করেছে। পূর্ণতা ফোনটা রিসিভ করে বেডে গা ছেড়ে দিয়ে বলে উঠলো,
– হ্যালো,
– ভালো আছিস?
– হ্যাঁ আছি, আলহামদুলিল্লাহ..
– তোর কন্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেন?
– এমনেই কিছুনা। কি জন্যে স্মরন করলে?
– আমি কি তোকে কল করতে পারিনা?
– পারো।
– তোর অসুবিধে হলে রেখে দেই। মনে হচ্ছে ঠেলে ঠেলে কথা বলছিস।
– না ঠিক আছি, বলো। একটু মাথা ধরেছে তো এজন্য এমন শোনাচ্ছে।
– কি বলিস! ফোন রেখে দেই তাহলে। তুই ঘুমা।
– না বলো, অতো ব্যথা নেই।
– আমার খুব যন্ত্রণা হচ্ছে পূর্ণতা। কিছুদিন ধরে অনুশোচনায় নিজেকে খুব অসহ্য লাগছে। তুই কি আমায় মুক্তি দিবি?
– পূর্বের ব্যাপারটা নিয়ে এখনো পরে আছো? আমিতো কবেই ভুলে গেছি। তবে অনুশোচনা আমার হওয়া উচিত। সেদিন তোমার গায়ে ওভাবে হাত তুলে খুব জঘন্য কাজ করেছি। আমাকে পারলে ক্ষমা করে দিও আপু।
– তুই কি আমাকে আরো ছোট করবি? কেনো মাফ চাচ্ছিস বলতো? বড় হয়ে তোর সাথে যা আচরন করেছি সেগুলোর জন্য যদি পা ধরে ক্ষমা চাই তাও তো কম। তুই কি আমাকে ক্ষমা ভিক্ষা দিবি? আমি দিহানকে নিয়ে একটু বাচঁতে চাই পূর্ণতা! কৃপা কর আমার উপর!
– একটা শর্ত আছে, তাহলে করবো।
– বলে ফেল। তোর পা ধরে সারাদিন বসে থাকতে বললেও আমি রাজি। তবুও আমাকে মাফ কর বোন। আমি দিহানকে আর কষ্ট দিতে পারছিনা। মরে যাচ্ছি!
– তোমার আমার মধ্যে যত মনোমালিন্য হয়েছে সবকিছুতে মাটি দাও। আমরা ছোটবেলায় কিভাবে মিল দিয়ে খেলতাম মনে আছে?
আনিশা স্বচ্ছ হাসি দিয়ে বললো,
– হ্যাঁ। দুজনের বৃদ্ধাঙ্গুল মিলিয়ে গলা জড়িয়ে বসে থাকতাম।
– একদিন আসো আপু। তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।
– দিহানের ছুটি…এই পূর্ণতা তোর কি মন খারাপ রে? কি হয়েছে খুলে বলতো!
– আপু ও আমার উপর নিয়মকানুন নিয়ে জোর দিচ্ছে…
– এ নিয়ে তোর মন খারাপ? তুই কি একটু মানিয়ে চলতে পারবিনা?
– এটা কি মানিয়ে চলা আপু? আচ্ছা বাদ দাও। দিহান ভাই কেমন আছে?
– ছুটি শেষ হতেই চলে গেলো। ওকে ছাড়া আমি এক মূহুর্ত থাকতে পারিনা। রাতে একঘন্টার জন্য কল করে তাও আমার মন তৃপ্তি পায়না। একঘন্টা কি কোনো টাইম হলো বল? অসহ্য লাগে। কালকে একটু বকা দিয়েছি। ওর কি মন খারাপ হবে আমারই কান্না পাচ্ছে।
আনিশা আপু একটু একটু করে পূর্বকে ভুলতে শুরু করেছে। যেখানে নিজের কোনো মূল্য নেই তাকে আকড়ে রাখার কোনো মানে হয়না। আপুকে নিয়ে সব পুরোনো অতীত একনিমিষে ভুলে নতুনভাবে শুরু করতে মন সায় দিলো। আমার মনের অস্বস্তিগুলো পূর্বের হালচাল না জানা পযর্ন্ত শান্তি পাবেনা। ঠিক করলাম পূর্বকে এবার কল করবোই করবো। ওর পার্টি জাহান্নামে যাক! আমি ওর খোঁজ না নিয়ে কল করা ছাড়বোনা। যতবার কলের টোন টু টু করে যাচ্ছে আমার হার্টবিট ফুলস্পিডে কড়াঘাত করছে। বিশাল প্রহরের মতো সাত জনম শেষে বুঝি পূর্ব কলটা রিসিভ করার সুযোগ পেলো। রিসিভ করতেই ধমক মেরে বললো,
– নাম্বার ব্লকলিস্টে ফেলবো? যদি লজ্জাবোধ থাকে কলটা সেকেন্ড টাইম করবে না!
টুট টুট টুট করে শব্দ হতে লাগলো, পূর্ব কলটা কেটে দিয়েছে। বাড়িতে থাকলে আমাকে জ্বালিয়ে মারে যেই লোক, বাড়ির বাইরে গেলেই সে আমাকে চিনেও না। ভাবটা এমন, যেন কোনো পর মহিলা এসে তাকে জ্বালাতন করছে। দুইগালে দশটা চড় মারলেও আমার শাস্তি পূরন হবেনা ভাই। খাল কেটে মানুষ কুমিরকে ঘরে আনে, আমি যে একদম কোলে করে যত্ন করেছি!!!
.
দুপুরের গোসল শেষে খাবারের জন্য ডাইনিং টেবিল থেকে ডাক আসে আমার। সায়মা মুখটা পটকার মতো কালো করে আমাকে নিয়ে ডাইনিং স্পেসের দিকে যাচ্ছে। ওর পোশাক দেখে এতো লজ্জায় মাথা নুইয়ে চলতে হচ্ছে। হাটু পযর্ন্ত পিংক শর্ট প্যান্ট, হোয়াইট লেডিস টিশার্ট। টিশার্টের গলা টেনে বাঁ কাধটা হা করে রেখেছে সেখানে চিকন পার্পেল স্ট্রিপ দেখা যাচ্ছে। বুঝলাম বাড়িতে বয়স্ক কেউ নেই তাই বলে ভাইদের সামনে এইভাবে চলাফেরা? ডাইনিং টেবিলে পূর্বিকা আপু, ফুয়াদ, জাওয়াদ, মিথুন বসে আমাদের অপেক্ষা করছিলো আমরা আসতেই সবাই খেতে শুরু করলো। পূর্বিকা আপু আমাকে ডেকে নিজের পাশেরটা চেয়ারটা টেনে দিলেন। আমি বসতেই সায়মা আমার অপজিট চেয়ার টেনে ফুয়াদের পাশে বসলো। আপু আমার প্লেটে মাছের টুকরো তুলে দিয়ে বললেন,
– ওই বদের সাথে কথা হয়েছে পূর্ণতা? সকালেও বদমাইশটা না খেয়ে বেরিয়েছে! কি যে করি!
আমি খাওয়া শুরু করলাম মিথ্যা কথা বলে,
– ও ব্যস্ত আপু। বললো, পরে খাবে।
খাওয়ার মধ্যপর্যায় যখন চলছিলো আমার মনে হলো পায়ের উপর কেউ পা ছোঁয়াচ্ছে। আমি একবার দুইবার ব্যাপারটা ইগনোর করলাম কিন্তু তৃতীয়বারের বেলায় সবার মুখের দিকে তীর্যক দৃষ্টি দিলাম। যেই এখন আমার চাহনি দেখে থতমত খাবে সেই পায়ে পা স্পর্শ করছে! সবাই কি সুন্দর নিরিবিলি খাচ্ছে কিন্তু একজন না একজন আমার সাথে জঘন্য ফাজলামি করছে! আমি চট করে টেবিলের নিচে মাথা নুয়ে দেখি পা-টা ফুয়াদের! পাশ থেকে খাওয়া থামিয়ে পূর্বিকা বলে উঠলো,
– পূর্ণতা কিছু হয়েছে? নিচে কি?
আমি তাড়াতাড়ি মাথা উঠিয়ে জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বলে উঠি,
– মশা কামড়াচ্ছে আপু। কিছু না।
আমার উত্তর শুনে ফুয়াদের মুখে শয়তানি হাসি লক্ষ করলাম। ও আমার দিকে তাকিয়ে কেমন একটা সূচালো হাসি দিয়ে টিস্যুতে হাত মুছে চলে গেলো!! সবার খাওয়ার শেষে সায়মা দৃঢ় গলায় আমার পাশে এসে বললো,
– পূর্ণতা? আর ইউ ফ্রি? আই ওয়ান্ট টু ডিসকাস উইথ ইউ। প্লিজ কাম ইন মাই রুম।
পূর্বিকা আপু প্রথম দফায় খুব অবাক হলেও সায়মা ভাওতাবাজি করে বেশ দক্ষভাবে সামলে নেয়। আমি টিস্যু নিয়ে হাত মুছে ওর রুমে যেয়ে দেখি রুমের ভেতর সায়মা নামের কোনো মানুষ নেই! পুরো রুম ফাঁকা! জানালার কার্টেন উড়ছে, বিছানায় টেডি বিয়ার রাখা, গোলাপী দেয়ালগুলোতে ওর শৈশব থেকে কৈশোরের ছবি সাজানো। খুব খটকা লাগছে! ও আমাকে রুমে ডেকে নিজে কোথায় গেলো? আমি দুমিনিট অপেক্ষা করে নিজের রুমের দিকে পা ঘুরিয়ে চলে গেলাম। চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে ঘুমিয়ে পরার ধান্দা আমার।
পূর্ণতা ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা আটকে দিয়ে ঘুরে দাড়াতেই চিৎকার দিতে যেয়েও দিতে পারেনা। দরজার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে ভয়জনিত কন্ঠে বলে,
– তুমি এখানে কেন! এখানে কি করছো! আমার ওয়াশরুমে কি! তুমি কখন এলে! বেরিয়ে যাও! বেরিয়ে যাও বলছি! আমি চিৎকার করে সবাইকে ডেকে আনবো!!!
পূর্ণতা ভয় পেলেও বাইরে থেকে সেটা প্রকাশ করলো না। ফুয়াদ চালবাজি করে সায়মাকে দিয়ে এই কাজ করেছে এতক্ষনে সমীকরণ মেলানো শেষ! ফুয়াদ ধুমিয়ে সিগারেট টানছে, নাক দিয়ে ভো ভো করে নিকোটিন ছাড়ছে। মুখ দিয়ে একস্তুপ ধোয়া ছাড়তেই সৎবিৎ কন্ঠে বলে উঠলো,
– ভাবি আমি কথাটা ঘুরিয়ে পেচিয়ে বলতে চাচ্ছিনা। সোজাসুজি বলছি, আপনাকে আমার ভালো লেগেছে। আই ওয়ান্ট টু হেভ এ্যান ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড উইথ ইউ!
পায়ের নিচ থেকে সমস্ত শরীরে হিম বয়ে গেলো পূর্ণতার। নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ঢোক গিলে দুবার গলা ভেজালো। পায়ে একজোড়া স্যান্ডেল পরে আসা উচিত ছিলো অন্তত স্যান্ডেলটা তুলে ওর গাল লাল করে দিলে একটু শান্তি লাগতো। পূর্ব নিজের বেডরুম থেকে ওয়াশরুমটা এতো নিট এন্ড ক্লিন রাখে জুতা পরে বেড়ানোটা দৃষ্টিকটু লাগে কিন্তু এখন একজোড়া স্যান্ডেল দরকার! দুহাতে দুটো স্যান্ডেল বসিয়ে এই কুত্তার গায়ে, মুখে, পিঠে ইচ্ছামতো পেটানো গেলে ঠিক হবে! পূর্ণতা পরিস্থিতি ঠান্ডা মাথায় সামলে বললো,
– আমি যে তোমার বড় ভাইয়ের বউ সেটা ভুলে গেছো? তোমার ভাই যদি এই কথা শুনে! তোমাকে কুত্তার মতো পেটাবে ফুয়াদ!
– আই ডোন্ট কেয়ার। আপনি ওকে না জানালেই তো হয়। তাছাড়া আ’ম এ্যাম এ্যা গুড বেড পার্ফোমার! আমার সাথে একরাত থাকলেই বুঝবেন পূর্বের চেয়ে আমি আপনাকে আনন্দ দিতে পারবো।
পূর্ণতা চোখ বন্ধ করে নিজেকে আরো একবার সামলালো। পূর্ব যদি ভুলেও এইকথা শুনে ফুয়াদের কি কঠিন অবস্থা হবে পূর্ণতা কল্পনা করতেও ভয় পায়।
– আপনি এতো চিন্তা করছেন কেন? আমার সাথে একবার স্টে করলেই আপনি বুঝতে পারবেন পূর্ব যা করতে পারেনি আমি সেটা আপনাকে দ্বিগুণ দিচ্ছি।
পূর্ণতা শান্ত গলায় বললো,
– ফুয়াদ দেখো, আমি তোমার ভাবী হই। তুমি হয়তো ভাবছো আমি তোমার মতো মর্ডান জেনারেশনের মেয়ে। এটা ভুল। আমি ভালোয় ভালোয় বলছি তুমি সভ্য ছেলের মতো এখান থেকে বেরিয়ে যাও। আমিও ওয়াদা করছি তোমার প্রথম ভুল ভেবে ওকে কিছু বলবো না।
ফুয়াদ কপাল কুঁচকে সিগারেটের শেষ অংশটা হাই কমোডে ফ্লাশ করে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
– ভাবীজান আপনাকে আমার ভালো লেগেছে এটা আপনার সৌভাগ্য! আপনার শরীর তো দেখান না তাও কিভাবে কোমরের ওটুকু অংশ দেখে মাথানষ্টে ভুগছি সেটা বলতে পারছি নাতো!! দেখুন আপনাকে প্রমিস করছি একটুও কষ্ট দিবো না।
পূর্ণতা একচুলও তোয়াক্কা না করে ঠাস করে থাপ্পর মারলো ফুয়াদের গালে। ফুয়াদ রাগে গর্জে উঠবে তার আগেই দরজার সিটকিনি খুলে বেরিয়ে এসে বাইরে থেকে লাগিয়ে দেয় পূর্ণতা। ফুয়াদ ধামধাম করে দরজা ধাক্কাচ্ছে, দরজাটা মজবুত! নাহলে এতোক্ষনে যে হুলস্থুল লাত্থি দেওয়া শুরু করেছে তাতে ভেঙ্গে যাওয়ার কথা। পূর্ণতা নিজের কান্না আটকে রেখেও আটকাতে পারছেনা চোখ থেকে অশ্রান্ত অশ্রুগুলো পরছে। হাতের উল্টো পিঠে চোখ ডলে ফোনটা নিয়ে পূর্বকে কল করে। অনেকবার কল করে পূর্ব ধরেনা। ওদিকে ফুয়াদ জোরে জোরে দরজা ধাক্কাচ্ছে। এ বাড়িতে সবার রুমগুলো এতো দূরত্ববিশিষ্ট যে চিৎকার দিলেও কারোর কানে পৌঁছায়না, কেয়ারটেকারকে পাঠিয়ে খবর দেওয়া লাগে। দুপুরের পর পূর্বিকারা বাড়ির লনসাইডে চলে গেছে। বড়রা এখনো বাড়ি ফিরেনি। এই নিরুপায় সিচুয়েশনে পূর্ণতা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে ফোনের স্ক্রিনে দ্রুত কিছু লিখে পাঠালো,
‘ Tumi amr call receive koro, Purbo!’
ঠিক দুমিনিট পর পূর্বের মেসেজ,
‘ I’m busy in seminar, please don’t disturb me. I’ll call you back ‘
মেসেজটা দেখে শব্দ করে তপ্তকর নিশ্বাস ফেললো পূর্ণতা। বিপদের বেলায় এখন তুমি নেই সেখানে আমিও আর থাকতে পারছিনা! মনেমনে কথাগুলো বলতেই ওয়াশরুমের বিকট শব্দের দিকে একপলক তাকিয়ে আলমারির দিকে পা চালিয়ে এগিয়ে গেলো। দুইদ্বার খুলে পার্স ব্যাগটা নিয়ে ফোনটা সুইচ অফ করে ঢুকিয়ে রাখলো। রুমের নব মোচড়ে মাথায় ঘোমটা টেনে চুপচাপ নিচে নেমে ড্রয়িং স্পেসে একটা চাকরকে দেখে বলে দিলো দশ মিনিটের মধ্যে আসছে। মাথার ঘোমটা লম্বা করে টেনে দারোয়ানকে দিয়ে সিএনজি ঠিক করিয়ে উঠে বসলো। সিএনজি মামা গাড়ি টেনে নিলে আলিশান গেটের সোনালী নেমপ্লেটটায় ‘ওয়াসিফ ভিলা’ দেখতে দেখতে হঠাৎ পিছে চলে যায়। পূর্ণতা মাথার ঘোমটা নামিয়ে চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিয়ে বসে পরে। দুইকোণা থেকে পানি ঝর্ণার মতো পরছে। পূর্বিকা-কে যেয়ে কথাগুলো বলতে পারতো কিন্তু বলার আগেই যে কান্না এসে হামলে ধরবে!! মুখের ভাষা ছিনিয়ে আবেগান্বিত করে কাঁদিয়ে দিবে! পূর্ণতা মায়ের কাছে যেতে চাচ্ছে। মা ওকে হাজার বার মারলেও মান ইজ্জতের ব্যাপার কখনো নিলামে উঠতে দেয়নি। অশান্ত ক্ষুদ্ধ বিক্ষিপ্ত মনটা মায়ের কোলে মাথা রাখতে চাচ্ছে। আজ এবং এই প্রথম ওর মায়ের কথা স্মরন হচ্ছে।
.
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পরছে। রাতের বেলা হালকা বৃষ্টিতে নিয়ন বাতির প্রতিফলনে রাস্তাঘাট চকচক করছে। পূর্ব গাড়িটা পার্কিং এরিয়ায় রেখে এসে বাড়িতে ঢুকতেই দেখে পরিবেশ থমথমে। সবাই গ্রাউন্ড ফ্লোরে ড্রয়িংরুমের সোফায় একত্র হয়ে বসে আছে। পলাশ পায়ের উপর পা তুলে সোফায় মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে। পূর্বকে দেখতেই পলক ওয়াসিফ বলে উঠলো,
– তুমি কোনো খবর জানো পূর্ব?
– না তো, কিসের খবর বড় চাচ্চু?
পলক উত্তরের বদলে ফুস করে নিশ্বাস ছাড়লো। আয়েশা করুণ চাহনিতে ছেলের দিকে তিরিক্ষি গলায় বলে উঠলো,
– তুই বউমাকে কি বলেছিস!
পূর্ব ভ্যাবাচেকা খেয়ে ভ্রু অসম্ভব কুঁচকে বলে,
– পূর্ণতাকে কি বলবো? আমার অনুপস্থিতিতে কিছু হয়েছে?
এবার কথার উত্তরে পূর্বের বড় চাচী বলে উঠলো,
– পূর্ণতা বাড়িতে নেই। কুদ্দসকে বলে গেছে দশ মিনিটের মধ্যে আসবে। এখনো আসেনি।
পূর্ব কিছু মনে হওয়ার ভঙ্গিতে তাড়াতাড়ি প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করলো। ওহ্ শিট…বলে হুঙ্কার দিয়ে হনহন করে সিড়ির দিকে চলে গেলো। তিন সিড়ি একসঙ্গে ভেঙ্গে উঠছে পূর্ব! রুমের নব ঘুরিয়ে দরজা খুলেই দেখে রুম নিস্তেজ। পূর্ণতা সত্যিই নেই। প্রতিদিন নিয়ম করে রাতে ফিরে পূর্ণতার দেখা পেলে সমস্ত ক্লান্তি শরীর নিংড়ে বেরিয়ে যেতো। পূর্ণতা কেনো এই কাজ করলো? কোথায় গেলো? কেনো তখন উতলা হয়ে কল করেছিলো?
.
বিছানায় উপুড় হয়ে বালিশ আকড়ে শুয়ে আছে পূর্ণতা। রুমটা সবসময়ের মতো ঘুট্ঘুটে অন্ধকার করে লাইট নিভিয়ে রেখেছে। বিকেলে এ বাসায় ফিরেই স্বাভাবিক ভাবে আচরন করেছে যেনো কিছুই হয়নি, এমনেই সবাইকে দেখতে এসেছে। নূরানী পূর্ণতাকে পেয়ে খুশিতে গদগদ। রান্নাঘরে চলে গেছে পছন্দসই খাবার তৈরি করতে। টানা আড়াইঘন্টার শাওয়ার নিয়ে শাড়ি পাল্টে নরমাল সালোয়ার কামিজ পরেছে পূর্ণতা। বিয়ের পর এই প্রথম আবার সালোয়ার কামিজে। খোদেজা আর্জেন্ট একটা ডেলিভারী কেস সামলাতে হসপিটালে গিয়েছে। পূর্ণতার বাবা পূর্ণতার আসার খবর শুনেই খুলনা থেকে রওনা দিয়েছে। আসতে আসতে ভোর ছয়টা। বর্তমানে খালি ফ্ল্যাটবাড়িতে অন্ধকারময় রুমে নিস্তব্ধ রাত্রিরে শুয়ে আছে ও। নূরানী রুমের লাইট জ্বালিয়ে বললো,
– আপা খাইতে আসেন। ঠান্ডা হইয়া যাইবো।
– লাইট অফ কর নূরানী। আমার খিদে নেই। প্রচুর ঘুম পাচ্ছে তুই যা।
– আপা খালায় রাগ করবো।
– করুক। তুই খেয়ে নে। আমার চিন্তা করবিনা, আমি পরে খাবো।
নূরানী লাইট অফ করে দরজা চাপিয়ে চলে যায়। বাইরে থেকে দূরের বিল্ডিংয়ের খুবই কম আলো ঢুকছে এ রুমে। পূর্ণতার মন চরমাবস্থায় খারাপ হয়ে আছে। সিএনজির জার্নিটা ভালো যায়নি ওর, রাস্তাঘাটের বাজে দশার জন্য মাথার ভেতর এখনো দপদপ করছে। হঠাৎ রুমের দরজা খুলার শব্দটা এতো আস্তে হলো যে পূর্ণতা মনের ভ্রম ভেবে পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখলোনা। কানে কিছু অদ্ভুত শব্দ হলে ঘুমে ঢুলু চোখদুটো দিয়ে অন্ধকারে তাকিয়ে বলে,
– নূরানী? নূরানী প্লিজ যা। আমি খাবো না বলছি। বিরক্ত করিস না। তুই খেয়ে না!!!
পূর্ণতা আবার বালিশে মাথা লাগিয়ে সোজা হয়ে শুয়ে পরে। চোখ বন্ধ করতেই হঠাৎ ওকে কেউ পাজকোলে তুলে বারান্দার দোলনায় নিয়ে যায়। পূর্ণতা রাস্তা থেকে আসা উজ্জ্বল আলোতে দেখে পূর্বের মুখ, সাদা শার্ট, সাদাটে গ্যাবার্ডিন প্যান্ট। দোলনায় লম্বা হয়ে শুয়ে পূর্ণতাকে বুকের হাড়ের উপর টেনে নেয়। এলোমেলো চুলগুলো আঙ্গুল দিয়ে সরিয়ে গাল ভরে অজস্র ঠোঁটে ছুঁয়িয়ে দেয়। সাদা শার্টের ভেতর থেকে বুকের কিছু উন্মুক্ত হয়ে আছে পূর্বের। পূর্ব ঠান্ডা গলায় বলে উঠে,
– বাড়িতে সবাই তোমার জন্য চিন্তিত ছিলো। একটাবার ওদের বলে যেতে?
পূর্ণতা নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে পূর্বের বুকে মাথা এলিয়ে দিতেই পূর্ব ওর গালে হাত রেখে দিলো। পূর্বের হাতের পিঠে হাত রাখতে যেয়ে পূর্ণতার সেখানে চিপচিপে লাগলো। তৎক্ষণাৎ হাত সরিয়ে সেটা চোখের সামনে এনে দেখলো রক্ত! ঝট করে পূর্বের বুক থেকে মাথা তুলে ওর হাত টেনে দেখলো হাতের মুঠোবন্দির জায়গাগুলোতে রক্ত লেগে আছে! কাউকে বেধড়ক ঘুষালে যেমন ক্ষত হয়ে যায় তেমন ক্ষতবীক্ষত হয়ে আছে হাতে!
– ‘ চলবে ‘
#FABIYAH_MOMO
(রিচেক দিতে পারিনি ক্ষমাপ্রার্থী)
সম্পূর্ণ গল্পের লিংক