ফ্রিজ
পর্ব ৫
মামা আমাদের নিয়ে বাহিরে বের হয়েছে। আমরা বলতে আপু আর আমি। আমার মামা খুব একটা বড়ো লোক না। অনেকটা আমার বাবার মতোই। গ্রামে থাকে ছোটোখাটো চা বিস্কিটের দোকান চালায়। মামার একটা ছোটো আম বাগান আছে।
মামা বলল,” মিলি চলত মা নিউমার্কেটে যাই। এত নাম শুনলাম মার্কেটার অথচ দেখা হলো না। এটা কেমন কথা!”
“মামা তুমি নিউমার্কেট দেখে কী করবা?”
“তা তো জানি না রে মা। বইয়ে অনেকবার নামটা পড়েছি। তোদের নিয়ে একটু ঘুরেই আসি কী বলিস?”
গাউছিয়া মার্কেট থেকে মামা আপার জন্য সুন্দর একটা শাড়ি কিনে ফেলল। আপা বলল, “মামা তুমি শাড়ি কিনলে কেন?”
“এমনই কিনলাম রে মা। শাড়িটা দেখে বেশ ভালো লাগল। মনে হয় পড়লে তোকে ভালোই লাগবে। কী বলিস রুনু?”
“হ্যাঁ, মামা শাড়িটা খুব সুন্দর হয়েছে। “
“মিলি এবার তো আমার ছোটো রানীর জন্য একটা কিছু কিন্তে হয়, কী বলিস?”
আপা কিছু বলার আগেই আমি বললাম, “মামা আমার জন্য কিছু কিনতে হবে না।তুমি চলতো।”
মামা একটা ছোট শ্বাস ছেড়ে বলল, “তোরা এমন বড়ো হয়ে গেলি কেমনে রে! কোথায় তোদের দাবি মিটাতে মিটাতে হিমশিম খাব ভেবেছিলাম।”
আমি চুপ করে রইলাম। আপা বলল,” আচ্ছা চলো মামা রুনুর জন্য একটা সুন্দর জামা কিনি। তারপর তুমি আমাদের খাওয়াবা।”
মামা একটু হেসে বলল, “তাই চল রে মা।”
মামা একটার পর একটা দোকান ঘুরতে লাগল জামা পছন্দ হয় না। দোকানদার যেটাই দেখায় বলে আরেকটু ভালো দেখান।
শেষমেশ আপা বিরক্ত হয়ে গেল।” মামা তুমি আর কত ঘুরবে?”
মামা একটু হেসে বলল,” এইবার একটা কিনেই ফেলি কী বলিস।”
আপা বড়ো বড়ো চোখ করে মামার দিকে তাকিয়ে আছে। “আচ্ছা ঠিক আছে, তুই পছন্দ কর। আমি আর এরমধ্যে নাই।”
মামা আর দেখতে চেয়েছিল। আপা একপ্রকার জোর করে একটা জামা কিনে ফেলেছে। জামাটা দেখতে ভালোই! আকাশী রংয়ের ওপরে হালকা সাদা রংয়ের ছোট ছোট ফুল আঁকা।
মামা বলল, “চল এবার একটু খাওয়া-দাওয়া করা যাক। অনেক পরিশ্রম হয়েছে। “
গাউছিয়া থেকে হেঁটে আমরা নীলক্ষেতের দিকে যাচ্ছি। অনেক মানুষ রাস্তায়। হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছে! নিউমার্কেটের ভিতরে একটা হোটেলে এসে মামা জিজ্ঞেস করল, “কী খাবি রে তোরা?”
“মামা তুমি যা ইচ্ছে অর্ডার করো তো।”
মামা আমাদের বিরিয়ানি খাওয়াল।
এখন সাড় সাতটার মতো বাজে মামা বলল,” চল ঢাকা ইউনিভার্সিটিটা ঘুরে আসি।”
আপা বলল,” মামা এ সব শপিং ব্যাগ নিয়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ঘুরে বেড়াব?”
“ব্যাগ তো খুব বেশি না। একজনের হাতে একটা করে ব্যাগ।”
“আচ্ছা ঠিক আছে চলো।”
মামার সাথে ঘুরতে আমার খুব ভালো লাগে! আমরা নিউমার্কেট থেকে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে গেলাম হেঁটে হেঁটে। অনেক মানুষজনই আমাদের মতো ব্যাগ হাতে হাঁটছে।
মামা আজ চলে যাবে। বাবা -মা মামার সাথে ইদ করতে যাবে না। মামা প্রথমে একটু মনখারাপ করলেও এখন হাসিমুখে বিদায় নিচ্ছে। কারণ আমরা দুইবোন মামার সাথে ইদ করতে যাচ্ছি।
আমরা ট্রেনে রওয়ানা দিবো। আপা বলল, “মামা টিকেট করেছ?”
“এ সব নিয়ে চিন্তা করিস না তো। এ দেশে সব সময় টিকিট পাওয়া যায়। দেখবি ট্রেন ছাড়ার আগ মহুর্তেও তুই টিকিট পাবি।”
আমরা দুইবোন জামা কাপড় গোছাচ্ছি বাবা মনখারাপ করে বসে আছে! দুই মেয়ে কে ছাড়া তার ইদ করতে হবে। এটা মানতে পারছে না! কছু বলতেও পারছে না। অনেক বছর আমরা মামা বাড়ি যাই না।
এবার মামা নিজে এসেছে আমাদের নিতে। সবাই গেলে খরচ বাড়বে বলে মা শুধু আমাদের পাঠাল।
রাত এগোরটায় ট্রেন ছাড়বে। আমরা সাড়ে নয়টায় কমলাপুর রেলস্টেশনে হাজির হলাম। হাতে এখনো দেড় ঘন্টা আছে।
মামা আমাদের স্টেশনের ভিতরে বসতে বলে টিকিট কাটতে চলে গেলেন। স্টেশনের ডিজিটাল বোর্ডে দেখলাম পদ্মা এক্সপ্রেস লাইন নাম্বার সাত। সাত নাম্বার লাইনে আমরা দুইবোন ব্যাগ নিয়ে বসে আছি।
আপা একটা নীল শাড়ি পরেছে। স্টেশনের বাতির আলোতে আপা কে কী সুন্দর লাগছে! অনেকেই ঘুরে ঘুরে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। আমার খারাপ লাগছে!
আপার কোনো বিকার নেই! সে একটা বই বের করে পড়ছে। আপা কী যে মজা পায় এ সব বই পড়ে? যখন-তখন একটা বই খুলে বসে।
আপা বলল, “রুনু পানির বোতলটা বের করত পানি খাব।”
আসার সময় আমি আনোয়ার চাচার বাসা থেকে এক বোতল ঠান্ডা পানি নিয়ে এসেছি। ব্যাগ থেকে বোতলটা বের করে আপাকে দিলাম।
আপা বোতল থেকে এক চুমুক পানি খেয়ে বলল,” মামা মনে হয় টিকিট পাবে না।”
“আমরা যাব কী করে রে আপা?”
“দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেতে হবে মনে হয়। দেখবি শেষসময় এসে বলবে, একটা সমস্যা হয়ে গেছে রে মা। টিকিট তো জোগাড় করতে পারিনি! তোরা একটু কষ্ট করে দাঁড়িয়ে যেতে পারবি না? দেখি ট্রেনে উঠে কোনো ব্যবস্থা করা যায় কিনা।”
আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। ভেবেছিলাম খুব মজা করে দৃশ্য দেখতে দেখতে যাব। দুইসিটের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে সারারাত!
লোকজন ট্রেনে উঠে যাচ্ছে মামা কোনো খবর নাই। আপার কথাই মনে হয় ঠিক হবে মামা কোনো সীট পাবে না!
একটা ছোটো ছেলে হেঁটে হেঁটে বাদাম বিক্রি করছে। রাতের বেলা মনে হয় বেচা কেনা খুব একটা ভালো হচ্ছে না। আমাদের সামনে কয়েকবার এসে বলছে, “আপা বাদাম খাবেন? খুব ভালো বাদাম। নেন না আপা।”
ময়লা একটা জামা পরেছে ছেলেটা। জামার আবার পিছন দিক দিয়ে ছেড়ে। ছেলেটার মনে হয় কোনো বন্ধু নেই। বন্ধু থাকলে এমন জামাটা পুরো ছিঁড়ে ফেলত নাকি বন্ধুরাই ওর জামাটা এমন করে ছিঁড়েছে কে জানে?
আপা বলল, “এই তোর নাম কী রে?”
ছেলেটার মুখে হাসি ফুটেছে! কাছে এসে বলল, “রুবেল।”
“তুই তো সিনেমার নায়ক রে।”
রুবেলের হাসিটা আর বেড়েছে। এবার দাত দেখা যাচ্ছে। ” আপা বাদাম নেন খুব ভালো বাদাম।”
“আচ্ছা দশ টাকার বাদাম দে তো দেখি কেমন তোর বাদাম?”
ছেলেটা একটা ছোটো ঠুঙায় বাদাম দিলো। সাথে বিট লবন।
“আপারা কী রাজশাহী যাবেন?”
“হ্যাঁ।”
“ট্রেনে উঠেন না ক্যা?”
“সময় তো বেশি নাই কা।”
“এখনি উঠব।”
ছেলেটা আরেকজনের কাছে গিয়ে বাদাম বিক্রির চেষ্টা করছে। উনি কিনছেন না। সবাই তো আমার আপার মতো এত ভালো না।
সাড়ে দশটা বেজে গেছে মামা এখনো আসছে না। মামা যে কী করছে কে জানে? যদি মামা আসার আগেই ট্রেনটা ছেড়ে দেয়। তাহলে কী হবে? এরপরে রাজশাহী যাওয়ার কোনো ট্রেন নাই। স্টেশনে আমাদের সারারাত থাকতে হবে। এত রাতে বাড়ি যাওয়া ঠিক হবে না।
লোকজন দৌড়ে দৌড়ে ট্রেনে উঠছে। মামা কে এখনো দেখা যাচ্ছে না! ট্রেন ছাড়ার সময় খুব বেশি নাই। এ সময় দেখলাম মামা দৌড়ে ভিতরে ঢুকছে। আমরা অনেকটা দৌড়ে ট্রেনে উঠে পড়লাম। মামা সীট পেয়েছে কী জানি না। ট্রেনে উঠে মামা এখনো হাঁপাছে!
আপা জিজ্ঞেস করল, “মামা সীট পেয়েছ?”
মামা হাসার চেষ্টা করল। হাঁপানোর কারনে ঠিক মতো হাসতে পারছে না।
আমরা এসি বগিতে উঠে পড়েছি। আমি মনে করেছি দ্রুত উঠার জন্য মামা আমাদের এ বগিতে উঠিয়েছেন। পরে অন্য বগিতে চলে যাব।
মামা আমাদের কে নিয়ে একটা বগিতে ঢুকল। এমন সীটে আমরা কখনো উঠিনি। পুরো রুমে চারটা সোফাসেটের বিছানা। বালিশ, একটা সাদা কম্বল দেয়া আছে। যদিও এখন গরমকাল। এখানে কেমন হালকা সীত সীত লাগছে!
আমার কী যে ভালো লাগছে! আমি মামা কে বললাম, “এখানে আর কারা যাবে মামা?”
“আর কে যাবে রে পাগলি।”
“এই পুরো রুমে শুধু আমরা যাব!”
“হ্যাঁ, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে যাবি।”
আপা বলল, “মামা তুমি এতগুলো টাকা খরচ করলা ক্যান?”
মামা কিছু বলছে না। একটু হালকা হাসি দিয়ে বলল,” টাকা বেশি খরচ হয়নি রে মা।”
আমি জানালার পাশে গিয়ে বসলাম। এখানের জানালা খোলা যায় না। কাঁচের ভিতরে দিয়ে ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। ট্রেনটা দ্রুত গতিতে ছুটে চলছে।
চলবে–
® নাবিল মাহমুদ