আঠারো বছর বয়স .
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২৪
সেদিনের ঘটনা। বিভোর রুহিকে অনন্যার কাছেই রেখে গিয়েছিলো, সব দায়িত্ব দিয়ে। প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়াশোনা করতো, মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। সবাইকে খুব সহজেই আপন করে নিতে পারার গুণটা ওর মাঝে প্রবল ছিলো। ওর এই গুণটা ছোট থেকেই ছিলো। বিভোর আর অনন্যা একই স্কুলে পড়তো৷ বড় হওয়ার পরে যোগাযোগ কমে গেলে ও বন্ধুত্ব ছিলো। বিভোর ওদের বিয়ের কথাটা জানিয়ে গেলেও পরবর্তীতে রুহির কাছ থেকে বিয়ের বিস্তারিত ঘটনা জানতে পারে অনন্যা। রুহির যাবতীয় খরচ, লেখাপড়া সহ বিভিন্নভাবে সাহায্য করতো ওকে৷ নিজদের ফ্ল্যাটে একাই রুহিকে নিয়ে থাকতো৷ বোনের চেয়েও বেশি ভালোবাসতো রুহিকে। এভাবেই কেটে যাচ্ছিলো দিনগুলো। দেড় বছর পরে একদিন শপিং শেষে ফেরার পথে হাইওয়ে পার হওয়ার সময় রুহি সামনের দিকে না তাকিয়েই রাস্তা পার হতে যায়, বিপরীত দিক থেকে বাস আসছিলো। অনন্যা দ্রুত রুহিকে ঠেলে, ধাক্কা দিয়ে সামনে থেকে সরিয়ে দিলেও নিজে সরতে পারেনি। বাসের চাকার নিচেই পিষে যায়। রুহি গিয়ে পড়ে সূঁচালো রডের উপর। হাত-পায়ে মারাত্নক জখম হয়৷ জ্ঞান হারানোর আগে শুধু বুঝতে পারে বোনের মতো সেই মানুষটি আর বেঁচে নেই। অনন্যার চোখগুলো খোলা ছিলো। ঘোলাটে মণির দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল রুহির উপর। সবসময় বলতো তোর একদিন খুব ভালো কিছু হবে, তুই খুব সুখী হবি রুহি। দু’দিন পর যখন রুহি নিজেকে হাসপাতালের বিছানায় আবিষ্কার করে এবং জানতে পারে অনন্যা আর নেই, ওকে দাফন করা হয়েছে। এই ঘটনার পর থেকেই বিভোরের প্রতি আরও রাগ হয় রুহির। ওর জন্যই অনন্যার এই অবস্থা ভেবে নিজেকে কষ্ট দিতো। বিষাক্ত হয়ে উঠে মন। যদিও বিভোরের সেখানে কিছুই করার ছিলোনা।
রুহির কাছ থেকে এই ঘটনা শুনে ‘থ’ হয়ে বসে আছে বিভোর। বাচ্চাদের মতো একটা কান্ড করে বসলো। ছেলেদের নাকি কাঁদতে নেই, এই কথাকে দূরে ঠেলে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো। এই সিচুয়েশনের জন্য নিজেকে দায়ী করতে লাগলো। রুহি শুধু হাসলো। অপরাধবোধে ভুগলেই মনের শান্তি হবে। পরবর্তীতে কোনো ভুল করার সাহস পাবেনা। বিভোরকে অনেক বুঝলো রুহি। একটু দায়িত্ব আর সতর্কতা পালন করলেই ওদের তিনজনের জীবনটাই অন্যরকম হতো। একসময় শান্ত হলো বিভোর। কাঁপানো গলায় শুধু বললো,
‘তোমাকে আর কোথাও ছাড়ছিনা আমি।’
মুচকি হেসে রুহি বলল,
‘সবসময় কী আর সবাইকে ধরে রাখা যায়? হয়তো আমিও একদিন এভাবেই পালিয়ে যাবো।’
বিভোর নিজের বুকের সাথে জাপটে ধরলো রুহিকে। তারপর গম্ভীর শান্ত গলায় বলল,
‘পালিয়ে যেতে চাইলেই পালানো যায়না।’
‘এভাবেই ভালোবাসবেন তো আমায়?’
‘আরো বেশি।’
কাঠফাটা রোদ্দুর। এতো গরম বোধহয় এর আগে কখনো পড়েনি। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি। এই সময় এতো গরম থাকার কথা নয়, কিন্তু আজ তাপমাত্রা চল্লিশ ডিগ্রির কাছাকাছি। রুহি দম ফেলার ফুরসত পাচ্ছেনা। আজকাল অবসাদ গ্রাস করছে ওকে। চোখে ঝাপসা দেখে। রক্ত জমাট হয়ে লাল হয়ে যায়। অফিস শেষ করার পর বিভোরের সাথে দেখা করতে যাবে। কিন্তু আজ যা গরম! তবে ভালোবাসার মানুষটার জন্য এটুকু কষ্ট করতে রুহি এক পায়ে রাজি৷ সারাদিন অফিস শেষে বিভোরের সঙ্গে রিকশায় ঘুরাঘুরি, পার্কে বসে বাদাম খাওয়া, রাস্তায় দাঁড়িয়ে আইসক্রীম-ফুচকা খাওয়া, ছুটির দিনে লং-ড্রাইভে যাওয়া এভাবেই বেশ কিছুদিন কেটে গিয়েছে। সুখের দিনগুলো এতো ক্ষুদ্র হয় কেন আর কেনই-বা এতো দ্রুত চলে যায়?
ফোন এলো বিভোরের। সচরাচর ওকে ফোন করেনা ও, কারণ রুহি বারণ করে দিয়েছে। ফোনে সস্তা প্রেমালাপ, সারারাত কথা বলা ওর মোটেও পছন্দ নয়। তাছাড়া ওদের দুজনে কেউ-ই ছোট বাচ্চা নয়, বড় হয়েছে, সবকিছু বুঝে। দুজনেই সারাদিন অফিস-হসপিটালে কাজ করে। খুব ক্লান্ত হয়ে থাকে। রাতটুকু যদি বিশ্রাম না নেয় তাহলে শরীর খারাপ হতে পারে ভেবেই রুহির এই সিদ্ধান্ত। কিন্তু আজ ফোনের ওপার থেকে বিভোরের কন্ঠ শুনতে খুব ইচ্ছে করছে। সব ক্লান্তি এক নিমিষেই চলে যাবে রুহির। ধরবেনা ধরবেনা করেও ফোন রিসিভ করলো রুহি।
‘আসসালামু আলাইকুম।’
‘ওয়ালাইকুম সালাম। কী করছো?’
‘অফিসে আছি। আজ খুব গরম।’
‘ঠিক আছে, আজ দেখা করতে হবেনা৷ তুমি বরং বাসায় চলে যেও।’
রুহি বলল,
‘না না। আমি আসতে পারবো।’
বিভোর ধমকে উঠতেই রুহি চুপ করে গেলো। এমনভাবে ধমক দেয় যে ওর আত্মা কেঁপে উঠে। কাঁচুমাচু করে বলল,
‘আপনি তো এসির হাওয়া খাচ্ছেন, তাইনা?’
‘নো। কানেকশানে ঝামেলা হয়েছে!’
‘ওহ আচ্ছা। বলছিলাম কী আমি আসতে পারবো। কোনো অসুবিধে নেই। রোদ কমে গিয়েছে।’
বিভোর রেগে উঠলেও সেটা প্রকাশ করলোনা। মৃদু হেসে কবিতার মতো করে বলল,
‘আঠারো বছর বয়সী রমণী
তোমাকে বলছি, শুনো!
রোদে হেঁটো না;
মেঘকে অনুরোধ করো, সূর্যকে যেন ঢেকে দেয়।
তুমি বরং বৃষ্টির ফোঁটা হয়ে যাও,
আমি সেই ফোঁটায় ভিজে নিজেকে সিক্ত করবো।’
রুহি গাঢ় নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘বয়স আমার আঠারো নয়, চব্বিশ।’
‘আমার কাছে সে-ই ছোট্ট রক্তজবা রয়ে গিয়েছো। ওই লাল জবাফুলে রাঙানো শেষ বিকেলের মেয়েটি। রোদেরা তখন লজ্জ্বা পাচ্ছিলো, আর লাল হচ্ছিলো আমার বউয়ের গাল।’
‘যাহ।’
বিভোর বলল,
‘আমার একটা আফসোস হচ্ছে, কেন যে তখন কুটুস করে তোমার গালে চুমু খেলাম না। হায়!’
‘নির্লজ্জ। ভেবেছিলাম দেখা করতে আসবো এখন আর আসবোই না। ফোন রাখছি। সো কল্ড কথাবার্তা অন্য কাউকে শুনান।’
বিভোর হুমকি দেওয়া গলায় বললো,
‘উহু। একদম ফোন রাখবেনা। আজ খুব সস্তার প্রেম করতে ইচ্ছে করছে৷ একবার ভালোবাসি বলো না!’
রুহি তড়িঘড়ি করে ফোন কেটে দিয়ে রিল্যাক্স হয়ে বসলো। কপাল বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। বিভোরটা যে কী না। এই ক’দিন খুব ভালো কেটেছে ওর। মনে হচ্ছে ওর হারানো সব সুখ একসাথে এসে ধরা দিয়েছে। মাঝেমধ্যে ভয় হয়, সুখগুলো আবার হারিয়ে যাবে নাতো!
রুহির হুটহাট রেগে যাওয়াটাকে দারুণ উপভোগ করে বিভোর। মেয়েটা ওকে সবসময় চমক দিতে চায়। ও ম্যাসেজ করলো হোয়াটসএ্যাপে, সিন করলো রুহি৷ তবে উত্তর দিলোনা। এবার সরাসরি ফোন লাগালো৷ রুহি ধরলো। কিছু বলার আগেই বিভোর রাগী গলায় বলে উঠলো,
‘ফোন কাটো কেন হ্যাঁ? তুমিতো ফোন দাওনি, আমার পয়সা খরচ করে আমি ফোন দিই আর তুমি কেটে দাও। সেদিনের বাচ্চা মেয়ে হয়ে আমার সাথে তেজ দেখাও? তুমি জানো আমার বয়স কত? এসব কী ব্যবহার তোমার? নূন্যতম সম্মান দিতে শেখোনি মানুষকে, মানুষের কথা না-হয় বাদই দিলাম। আমি তোমার স্বামী। এটলিস্ট একটু রেস্পেক্ট পাওয়ার যোগ্য নয় কী আমি? বলো? আন্সার মি!’
রুহি ঘাবড়ে গেলো। মিনমিন করে বলল,
‘দুঃখিত। আর কখনো ফোন কাটবোনা।’
-‘তোমার সো কল্ড স্যরি তোমার আঁচলের কাছেই রাখো। আমি, বাবর চৌধুরীর ছেলে বিভোর। রাগ করিনা বলে ভেবোনা আমার রাগ নেই।’
‘বললাম তো স্যরি। আর হবেনা।’
‘এভাবে হবেনা৷ তোমার আশেপাশে কেউ আছে?’
রুহি আশেপাশে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখলো কেউ নেই।সবাই কাজে ব্যস্ত৷ বলল,
‘না নেই। কেন বলুনতো!’
‘আবার প্রশ্ন করছো! মেজাজটাই খারাপ করে দিলে।’
‘কী করবো বলুন৷ আমার ঘাট হয়েছে আপনার ফোন রিসিভ করে। মাফ দেন এবার!’
‘ভালোবাসি বললে মাফ করে দিবো।’
রুহি অবাক হয়ে বলল,
‘নো ওয়ে। কখনোই বলবোনা আমি।’
‘একবার শুধু।’
‘আমি কিন্তু এই কথা বলেছি আপনাকে।’
‘বারবার শুনতে ভালো লাগে।’
তারপর রুহি চুপ করে গেলো। মুখ ফসকে বলেছে তো একদিন যে ভালোবাসি। বারবার বলার প্রয়োজন কী! রুহির ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে৷ কিছুতেই সহজ হতে পারছেনা। ওর নীরবতা টের পেলো বিভোর। কিন্তু প্রশ্ন করলোনা। অনেকটা সময় হয়ে গেলেও বিভোরের রাগের কথা স্মরণ করে ফোন কাটার সাহস হয়নি রুহির। দুজনেই শুনতে পাচ্ছে নিঃশ্বাসের শব্দ। মৃদু বাতাসে গাছপালা দুলছে। ঝিঁঝি পোকারা কর্কশ গলায় ডাকছে৷ ভীষণ একঘেয়ে এবং বিরক্তিকর একটা মুহূর্ত।
বিভোর মিষ্টি হেসে ফোনের মাঝেই অদ্ভুত কোমল স্বরে রবি ঠাকুরের গানের কথাগুলো বলল,
‘ওই কথা বলো সখী, বলো আর বার-
ভালোবাসো মোরে তাহা বলো বারবার।
কতোবার শুনিয়াছি, তবুও আবার যাচি
ভালোবাসো মোরে তাহা বলো গো আবার!’
এবার নীরবতা ভেঙে রুহি বলে উঠলো,
‘বলবোনা, বলবোনা এবং বলবোনা।’
বিভোরের সত্যিই এবার রাগ হয়েছে। রুহি ওকে বুঝতেই চায়না। একবার “ভালোবাসি” বললে কী এমন ক্ষতি হয়ে যাবে? বিভোর তো প্রতিটি নিঃশ্বাস ফেলার সময়ও ভাবে তার একটা রক্তজবা আছে৷ ও না থাকলে সেই রক্তজবাটাও হারিয়ে যাবে। তাহলে কেন এইসব? ফোন কাটলো বিভোর। রাগের বশে মাথা ঠিক নেই। রুহি ওকে বড্ড জ্বালাচ্ছে। বিভোর হুট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলো৷ ঠিক করলো মা-বাবাকে ওদের দুজনের কাহিনী এবার বলে দেবে। অনেক তো হলো, আর কতো? হাঁপিয়ে উঠছে বিভোর। নিজের ভুলের জন্য কত মাশুল দিতে হলো অনন্যাকে। ভেতরে ভেতরে অপরাধবোধ ওকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। রুহিকে ছাড়া আর একটি দিন কাটানোও যেন মৃত্যুর সমান কষ্টের! ভালোবাসায় এতো কষ্ট, দুঃখ থাকে জানলে কখনোই এই ফাঁদে পা দিতোনা। আগেতো এইরকম হয়নি, এবার মনে হচ্ছে সত্যিই কিছু হারিয়ে যাচ্ছে, যাবে! কিন্তু এটা কিছুতেই হতে দেবেনা বিভোর।
শেষ পর্ব না পড়ে ভ্রান্ত ধারণা করবেন না কেউ। যতটুকু লিখেছি তাতেই গঠনমূলক মন্তব্য জানাবেন আশা করছি। ইদ তো, সবাইকে ইদ মোবারক। ইদের দিন গল্প দিতে পারবোনা চাইলেও। আবার নেটওয়ার্ক ঝামেলাও হতে পারে। ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
চলবে…