আঠারো বছর বয়স
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২৫
একটু আগেই বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। এখন আকাশ পরিষ্কার। কেমন ভিজে মাটির গন্ধ আসছে। কোথা থেকে দুটো ভিজে টুনটুনি এসে বসেছে বারান্দায়। একজন আরেকজনের গায়ে ঠুকাঠোকি করছে। বাগানবিলাস গাছটা নেতিয়ে আছে। রুহি এককাপ চা নিয়ে বারান্দায় এসে বসলো। নাদিরার শরীরটা খুব একটা ভালো নেই। প্রেশার ফল করেছে। রুহি জোর করে একটু ভাত খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে এসেছে। এই মহিলাটিকে সে মায়ের মতো ভালোবাসে। কোনোভাবেই চায়না মায়ের মতো সেও হারিয়ে যাক। এই বাসায় চার বছর ধরে আছে রুহি। অথচ নাদিরা বা ইভা কেউ-ই ওকে বুঝতে দেয়নি সে পর। এতোটা ভালোবাসে ওরা রুহিকে। ইভাকে ফোন করেছে রুহি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছে। মায়ের শরীর ভালো নেই শুনে চিন্তায় পড়ে গিয়েছে বেচারি। রাতুল আসলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। চায়ের কাপে চুমু দিতে দিতে রুহির মনে পড়ে বিষন্ন আর ভয়ানক অতীতের কথা। আজকাল জানেনা রুহি ওর সাথে কি হচ্ছে, আগের মতোই হয়ে যাচ্ছে বোধহয়। সবকিছুতে হারানোর ভয়, উল্টোপাল্টা চিন্তাভাবনা। মনে হয় ওর সাজানোর এই পৃথিবীটা কোনো একদিন আবারও ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে।
চার বছর আগে। অনন্যা আর ইভা একই ভার্সিটিতে পড়তো। কীভাবে কীভাবে যেন ওরা হয়ে যায় প্রাণের বান্ধবী। সেই সুবাদেই মাঝেমাঝে অনন্যার ফ্ল্যাটে যেতো ইভা। সেখানেই রুহির সাথে ইভার পরিচয়। তিনজন মিলে ঘুরতো,এটা-সেটা করতো। এক্সিডেন্টের দিন ওরা তিনজন মিলেই শপিংয়ে গিয়েছিলো। ফেরার পথে রুহি ইভার সাথে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হচ্ছিলো। সামনে থেকে আসা বাসটা ওর চোখে পড়েনি। পেছনে অনন্যা ছিলো। ইভা বাস দেখে রুহিকে টান দিতে যাবার আগেই অনন্যা পেছন থেকে ওদের দুজনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। দুজন দুদিকে ছিঁটকে পড়ে। রুহি পড়ে রডের উপর। ইভা একটা রিকশার সাথে বারি খায়। হাত-পা ছিলে যায় কিন্তু খুব বেশি লাগেনি। জ্ঞান ফেরার পরে যখন রুহি অনন্যার মৃত্যুর খবরটা সহজভাবে নিতে পারেনি। যখন রুহির আর কোথাও যাওয়ার জায়গা রইলোনা তখন ইভা ওর পাশে দাঁড়ায়। ছোট একটা সার্জারির মাধ্যমে রুহির পায়ে আঙুল কেটে ফেলা হয়। এই পুরোটা সময় বড় বোনের মতো রুহিকে সামলিয়েছে ইভা আর ওর মা। নিজেদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছে। অনন্যার মৃত্যুর ধাক্কা সামলাতে অনেক সময় লেগেছে রুহির। পুরো একটা বছর শকে ছিলো। মাঝরাতে ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে চিৎকার করে উঠতো। রক্ত দেখলে মাথা ঘুরে পড়ে যেতো। রান্নাঘরে যেতে পারতোনা, আগুন দেখলেই মুখচোখ লাল হয়ে যেতো৷ পড়াশোনায় মনোযোগ ছিলোনা। শুধু দেখতো অনন্যা ওর পাশে বসে আছে, তাকিয়ে আছে আর খিলখিল করে হাসছে। মেয়েটা খুব সুন্দরী ছিলো। স্বপ্নে রুহির সাথে কথা বলতো। রুহি একপর্যায়ে ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে দিনরাত নিজেকে আটকে রাখতো। কাঁদতো খুব। প্রচুর হ্যালুসিলেশন ওকে পাগল বানিয়ে দিচ্ছিলো। অসংখ্য ফোবিয়ায় ভুগতো। এই ভয়ংকর সিচুয়েশন থেকে ইভা ওকে বের করে এনেছে। ডাক্তারদের নির্দেশনা মতো সবকিছু করেছে। যেখানে যাবার দরকার, যা দরকার সব করেছে। কতশত ডাক্তার দেখিয়েছে বলার বাইরে। কোনো আপনজনও বোধহয় এতোটা করেনা কারোর জন্য। দীর্ঘ একটা বছর পরে রুহি স্বাভাবিক হলো। পুরো জার্নিটাতে নাদিরা সবসময় ইভাকে সাপোর্ট করেছিলো। নাহলে আজ রুহি কোথায় থাকতো ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। হয় রাস্তায় নাহয় পাগলখানায়! ভাগ্যবতী বলেই সবসময় সব পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারে রুহি। সবাই ওকে সাহায্য করে, জীবনের কঠিন মুহূর্তগুলো বিভোর, অনন্যা আর ইভাকে পাশে পেয়েছে। একেকটা জীবন-মরণ সমস্যা থেকে বের করে এনেছে এরা তিনজন, বিভিন্ন সময়ে। এদের ঋণ পরিশোধ করার ক্ষমতা রুহির কোনোদিনও হবেনা। শহরের সব মানুষেরা খারাপ বা অকৃতজ্ঞ নয়। রুহি এখন সেটা বুঝতে পারে প্রবলভাবে।
অতীতের কথা ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরুলো রুহির। ওর এমন এলোমেলো জীবনে সদ্য ফোঁটা পদ্মের মতো আবারও ঢু মেরেছে বিভোর নামক মানুষটি। এই কথাগুলো যখন বিভোরকে জানিয়েছিলো তখন অদ্ভুত এক আর্তনাদ ওর চোখে টের পেয়েছে রুহি। বাইরে কিছু প্রকাশ না করলেও ভেতরে ভেতরে নিদারুণ পুড়েছে সেটা ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো। কতোটা ডেস্পারেট হয়ে আছে এখন বিভোর! এক বুক ভালোবাসা আর যত্ন দিয়ে নতুন একটা পৃথিবী গড়ে দিবে সে রুহিকে। অল্প হাসলো রুহি। বেচারা না জানি কতোটা অসহায় অবস্থায় আছে। বাবা-মাকে কীভাবে জানাবে এসব? আর ওনারা রুহিকে মানবে তো? ভাবনার প্রহর কাটিয়ে উঠতেই কলিংবেল বেজে উঠলো। ইভারা এসেছে বোধহয়। পড়ন্ত বিকেলের রোদে চায়ের কাপটা রেখে উঠলো রুহি। চমৎকার শেষবিকেলের দৃশ্য। বাগানবিলাসীরা যেন হাওয়ার সাথে পাঞ্জা লড়ছে। চারপাশে কেমন নীরব-নিস্তব্ধ আর উৎফুল্ল। প্রাণের সঞ্চার করেছে বৃষ্টিরা প্রকৃতিতে। জল-ফড়িংয়ের দলেরা উড়ুউড়ি করছে। সোনাবরণ রোদ্দুরে ঝকমক করছে পুরো পৃথিবী! রুহির বারবার কেমন প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, ‘এতো সুন্দর হওয়ার কোনো দরকার ছিলো পৃথিবী?’
_____
এই নিয়ে চার গ্লাস পানি শেষ করলো বিভোর। নাসিমা চৌধুরী এবার বিরক্ত হয়ে ছেলেকে ধমক লাগালেন। তিনি বুঝতেই পারছেন না বিভোর এতোটা নার্ভাস হয়ে আছে কেন!
বিভোর নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুতেই পারছেনা। কীভাবে বলবে যে সে বিবাহিত? বাবা তো নির্ঘাত ওকে কথা শুনাবে। মনে হচ্ছে এই কথাটা বাবাকে বলার চেয়ে ডাক্তারির পড়া করা ভীষণ সহজ। নাসিমা আর বাবর চৌধুরী পুত্রের মুখের দিকে চাতক পাখির ন্যায় চেয়ে আছে। কি বলতে চায় বিভোর? এতো ইতস্তত করার মানে কী?
মুখচোখ রক্তিম আভায় ছেয়ে আছে বিভোরের। ও একটু বেশিই ফর্সা। যার দরুন লজ্জ্বা বা অতিরিক্ত টেনশনে টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করে। নাসিমা চৌধুরী ওর এই অবস্থা দেখে উতলা হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কী হয়েছে বাবা তোমার? শরীর খারাপ লাগছে?’
মিনমিন করে বিভোর বলল,
‘না আম্মু।’
‘তাহলে চেহারার এই অবস্থা কেন? কিছু খাওনি নাকি দুপুরে?’
‘না না খেয়েছি। একচুয়েলি আজ খুব গরম তো, তাই এরকম লাগছে।’
বাবর চৌধুরী মা-ছেলের কথার মাঝখানে বাগড়া দিয়ে বললেন,
‘শুনো, আমি তোমার বাবা। চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে সিরিয়াস কোনো কথা বলতে চাও। তাই ঝটপট বলে ফেলো আর নিজেকে সামলাও।’
বিভোর নতমুখে বলল,
‘আমি যেটা বলতে চাচ্ছি সেটা শুনলে তুমি নিজেকেই সামলাতে পারবেনা আব্বু।’
‘তবুও শুনি কী বলতে চাও!’
বলতে গিয়ে আবার আটকালো বিভোর। কণ্ঠনালী যেন কেউ চেপে ধরে রেখেছে। আওয়াজই বেরুতে চাচ্ছেনা। বিভোর আরও একগ্লাস পানি ঢকঢক করে খেলো। তারপর ধীরেসুস্থে বসলো। নাসিমা সন্দেহী দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে ঘটনা বোঝার চেষ্টা করছেন। বিভোর শান্ত গলায় বাবর চৌধুরীর উদ্দেশ্য বলল,
‘কথাটা কিন্তু ভীষণ সিরিয়াস। তোমরা প্রচুর শকড হবে। ডোন্ট মাইন্ড প্লিজ!’
বাবর চৌধুরী তাচ্ছিল্য করে বললেন,
‘হুম। মানলাম ভীষণ সিরিয়াস।’
‘আমাকে কিন্তু ভুল বুঝবেনা।’
দাঁতে দাঁত চেপে বাবর চৌধুরী বলল,
‘বলো এবার।’
‘আব্বু তুমি আমাকে বিয়ে দিতে চাও, তাইনা?’
বাবর চৌধুরীর চোখদুটো চকচক করে ওঠলো। তিনি উৎফুল্ল কন্ঠে বললেন,
‘অবশ্যই চাই। কিন্তু একথা জিজ্ঞেস করার কী আছে? প্রতিটা বাবা-মা তাঁদের সন্তানকে স্যাটেল দেখতে চায়। তোমার তো অনেক বয়স হলো, সেই কবে থেকে বলছি বিয়ে কর, বিয়ে কর। আমার কোনো কথাকেই তো পাত্তা দাওনি!’
বিভোর অসহায় চোখে বাবার দিকে তাকালো। বলল,
‘আমি এবার বিয়ে করতে চাই।’
নাসিমা অবাক হয়ে বললেন,
‘ভালো তো। কিন্তু ডিসিশনটা কী আমাদের জোড়াজুড়িতে নিয়েছো? নাকি নিজের ইচ্ছায়? শুনো, জোড় করে কিন্তু কিছু হয়না। বিয়ের পরে তুমি কিন্তু টালবাহানা করতে পারবেনা। তাই যা সিদ্ধান্ত নেবার তা ভেবেচিন্তে নাও।’
বাবর চৌধুরীও কঠিন চেহারায় নাসিমার কথায় সায় জানালেন। ওনি একটু হতভম্বই হয়েছেন। যে ছেলেকে বিগত কয়েক বছর যাবৎ বিয়ে করানোর জন্য তিনি কলুর বলদের মতো ঘানি টানছে সেই বিভোর নিজ থেকে আজ বিয়ের কথা বলছে। স্ট্রেঞ্জ! নাসিমা ছোটছোট চোখ করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। একঘেয়ে, বিরক্তকর এবং একইসাথে ভয়ংকর কয়েকটা মুহূর্ত পার হবার পরে নিস্তব্ধতা ভেঙে বিভোর মৃদু কাঁপা গলায় বলল,
‘আমার বিয়ে করে ফেলেছি আব্বু।’
নাসিমা এবং বাবর চৌধুরী দুজনেই চমকে উঠলো। প্রায় একসাথেই চেঁচিয়ে উঠে বলল,
‘কী বলছো তুমি বিভোর?’
বিভোর কথাটা বলে একটা প্রশান্তির হাসি টানলো ঠোঁটের কোণে। আসল কথাটা বলেছে, এবার সেকেন্ড টপিক অর্থাৎ রক্তজবার কথাটা বলতে পারলেই ওর বুক থেকে একটা পাথর নেমে যাবে। বলল,
‘হুম আব্বু। পিওর সত্য কথা বলছি আমি।’
গঠনমূলক মন্তব্য জানাবেন আশা করছি। সবাইকে ইদ মুবারক। ছোট হয়েছে জানি। আমি দুঃখিত খুব।
চলবে..