আঠারো বছর বয়স পর্ব ২৭
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২৭
তখন মধ্যদুপুর। তিনটে বাজে। শহরটাকে রোদ তার তেজ দিয়ে ঝলসে দিচ্ছে যেনো। কাঠফাটা রোদ্দুরে ঘেমেনেয়ে একাকার রুহি। এই গরমে বের হওয়াটা বোধহয় ভুলই হয়েছে ওর। এর মাঝে ছাতা আনতেও ভুলে গিয়েছে। এর কোনো মানে হয়? নিজের কপাল নিজেরই চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। রিকশায় বসে নিজের উপর বিরক্ত হচ্ছে রুহি। জ্যাম যে কখন ছুটবে খোদা জানেন। মাঝে মাঝে ওর মনে হয় রিকশা, বাস, ট্রেন তৈরি না করে বিজ্ঞানীদের উচিৎ ছিলো ডানা তৈরি করা। তাহলে মানুষ নিজের মতো উড়ে উড়ে যেখানে ইচ্ছে সেখানেই যেতে পারতো। অবশ্য তখনো দেখা যেতো আকাশ পথেও জ্যাম লেগে গেছে। যতো নতুন নতুন প্রযুক্তি সৃষ্টি হচ্ছে ততো জটিলতাও তৈরি হচ্ছে। বাতাসে শান্তিতে নিঃশ্বাস নেওয়াও যায়না। ধুলোবালির এই শহরটার চারদিকে কেমন বিষন্ন ভাব, মন খারাপ করা ধোঁয়াটে আবহাওয়া!
বিভোরের জরুরি তলবে রুহি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বেরিয়েছে। ভরদুপুরে বেরুতে ওর ইচ্ছে করছিলোনা। কিন্তু বিভোর মুড খারাপ করে বসে আছে। কি যেন বলতে চায়। ফোনে নাকি বলা যাবেনা। তাছাড়া ওকে সাদা রঙের শাড়ি পড়তে বলা হয়েছে। খুব জোরালোভাবেই এই হুকুম ওর উপর জারি করা হয়েছে। নাহলে ওকে নাকি আস্ত রাখবেনা। কি এমন জরুরি কথা বলবে রুহি সেটা বুঝতে পারছেনা। রৌদ্রস্নাত প্রকৃতির গাছের পাতাগুলো একটুও দুলছেনা। জ্যাম ছাড়লো আরও আধঘন্টা পর। কয়েক মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলো রেস্টুরেন্টে।
রিকশা ভাড়া মিটিয়ে কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো রুহি। ভেতরে টিমটিমে মায়াবী আলো। খুব চমৎকার করে সাজানো সবকিছু। কেউ নেই আশেপাশে। মৃদু শব্দে সাউন্ড বক্সে একটা সুর বাজছে। অচেনা সুর, তবে ভীষণ করুণ। বাঁশির নয়, পিয়ানোর। ভেতরটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। ঠান্ডা লাগছে একটু একটু। মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেলো রুহির। বিভোরকে আশেপাশে কোথাও দেখতে পেলোনা সে। রুহির একটু ভয়ভয় করতে লাগলো। মানুষজন নেই কেন? বিভোর ওকে এখানে ডাকলো কিন্তু নিজেই এসে পৌঁছালো না, আজব তো! রুহি কয়েকপা পিছিয়ে এলো। ভালো করে আবার খুঁজে দেখলো। নাহ, কোত্থাও নেই বিভোর। এখনো আসেনি বোধহয়।
রুহি বেরিয়ে আসতে যাবে ঠিক তখনই খুব জোরে কোথাও একটা শব্দ হলো। চমকে উঠলো রুহি। শব্দের উৎস খুঁজতে গিয়ে কাচের দরজার ওপাশে চোখ পড়তেই দেখতে পেলো বাইরে হঠাৎ বৃষ্টি নেমেছে। প্রচণ্ড শব্দে মেঘ গর্জন করছে আর বাজ পড়ছে। পাঁচ মিনিটেই আবহাওয়ার এমন বদল দেখে রুহি খুব অবাক হলো। কিন্তু এখন বেরুবে কি করে? বিভোর না আসা পর্যন্ত এখানে থাকার সাহসও হচ্ছেনা। কোনো ওয়েটারকেও দেখা যাচ্ছেনা। এটা এমন ভুতুড়ে রেস্তোরাঁ কেন! হঠাৎই নিজের হাতে টান অনুভব করলো । চোখ বন্ধ করে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলো রুহি। ভূতটূত নাকি? মনেমনে সূরা পড়ে অল্প একটু চোখ খুলে দেখলো ডাক্তারবাবু ওর হাত ধরে ভ্রু কুঁচকে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। দুজনের মাঝে তখন কয়েক ইঞ্চির দূরত্ব। রুহি প্রাণ ফিরে পেলো যেন। বলল,
‘আপনি ছিলেন, ওফফ..?’
‘কেন? কী ভেবেছিলে তুমি?’
‘ভাবলাম কোনো ভূতটূত হবে হয়তো! আপনি কোথায় ছিলেন?’
উত্তর না দিয়ে রুহির হাত ধরে টেনে নিয়ে একপাশে দাঁড়ালো বিভোর। পূর্ণদৃষ্টি মেলে ওকে পরখ করলো রুহি। পরণে সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট। চুলগুলো সুন্দর করে সেট করা৷ অনেক চমৎকার দেখাচ্ছে বিভোরকে। মনে হচ্ছে সে কোনো সিনেমার হিরো, ডাক্তার নয়। অন্যদিনের মতো ফরমাল গেটআপ নয় ওর। বোঝাই যাচ্ছে স্পেশাল। রুহি এ বিষয়ে কিছু বলার আগেই হঠাৎ সব বাতিগুলো নিভে গেলো। রুহি অবাক হয়ে বলল,
‘সবকিছু নিভে গেলো কেন? এই জায়গাটা এতো ভুতুড়ে কেন? মানুষজন নেই কেন?’
আরও কিছু প্রশ্ন করার আগেই বাতি জ্বলে উঠলো। তবে সেটা সাদামাটা আলো নয়। সোনালী রঙের অদ্ভুত আলোতে ছেয়ে গেলো পুরো রেস্তোরাঁ। কাচের দেয়াল বেয়ে বৃষ্টির পানি নামছে ঝর্ণাধারার মতোন। বাইরে সবকিছু নিকষ কালো অন্ধকারে ঢেকে গেছে। ঘড়ির টিকটিক শব্দ জানান দিলো সন্ধ্যা ছয়টা এখন। চারদিকে রাজকীয় ভাব বিরাজমান। বিভোরকে দেখাচ্ছে কোনো এক অচিন দেশের রাজপুত্র। তবে রাজপুত্রদেরকে শার্ট-প্যান্টে মানায় না। বিভোরকে মানিয়েছে। পুরোটা রেস্তোরাঁ সারা বিকেলের জন্য বুকড করে নিয়েছে ও। সেজন্যই মানুষ নেই। রুহি ঘুরে ঘুরে দেখলো আশপাশটা। কেমন রাজকীয় ভাব।
হঠাৎ বিভোর রুহিকে চমকে দিয়েই ওর হাতে তুলে দিলো কালো একটা গোলাপ। গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,
‘আমি তোমাকে ভালোবাসি রক্তজবা। উইল ইউ ম্যারি মি?’
ব্যস। এই দুটো বাক্য শোনার জন্য এতোকাল ধরে চাতক পাখির ন্যায় অপেক্ষা করেছে রুহি। তার প্রিয় পুরুষটির মুখ থেকে নতুন করে, নতুন ভাবে শুনতে চেয়েছিলো কথাগুলো। তবে কী এইসব আয়োজন ওর জন্যই ছিল? চোখের কোণে পানি জমে গেলেও অদ্ভুত এক সুখে মনটা উল্লাসে নেচে উঠলো। টুকটুকে লাল হয়ে গিয়েছে ওর গাল। একটু হাসলো রুহি। প্রপোজ করাটাও ঠিকঠাক শিখতে পারলোনা বেচারা!
রুহিকে হাসতে দেখে বিভোর বলল,
‘হাসছো যে?’
‘আপনার প্রপোজ করার স্টাইল দেখে হাসি চাপাতে পারলাম না।’
‘কেন? এখানে হাসির কী হলো? আ’ম সিরিয়াস।’
‘এভাবে কেউ গম্ভীরস্বরে প্রপোজ করে কাউকে? আর ফুল কী এভাবে দেয়? সুন্দর করে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে ফুলটা এগিয়ে দিয়ে বলতে হয় ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’। বুঝেছেন মাথামোটা ডাক্তার সাহেব!’
বিভোরের মুখটা দেখার মতো হলো। কাঁচুমাচু করে বলল,
‘আমি তাহলে আবার করছি।’
রুহির হাসি পেলো। বিভোরকে আচমকা জড়িয়ে ধরে বলল,
‘আমিও আপনাকে ভালোবাসি। আর করার দরকার নেই। কিন্তু এই কালোগোলাপ কোথায় পেলেন আপনি?’
বিভোরের ঠোঁটের কোণে ঈষৎ হাসির রেখা ফুটে উঠলো। রুহির চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে বলল,
‘আব্বুর গাছ থেকে নিয়ে এসেছি। জানতে পারলে আমাকে এই গোলাপ গাছের নিচে জ্যান্ত পুঁতে দেবে।’
রুহি হেসে উঠলো।
‘তারমানে চুরি করেছেন?’
‘হুম, বাধ্য হয়ে। সকালবেলা বাগানে গেলাম রক্তজবা আছে কিনা খুঁজতে। রতন জানালো নেই। অন্যকোনো ফুল পছন্দ হচ্ছিলোনা৷ হঠাৎ কালোগোলাপ দেখে ভাবলাম এটা নিয়ে যাই। বেশ সুন্দর কিন্তু এটা। তোমাকে প্রপোজ করার জন্যই চোরের তকমা লাগাতে হলো। ডাক্তার থেকে সোজা চোর। নিজেকে চোর চোরই মনে হচ্ছে।’
রুহি হাসতে হাসতে বলল,
‘চোর! হা হা। বাইরে থেকে কিনে নিলেই পারতেন।’
সাদা রঙা জামদানী শাড়িতে, সোনালী রাজকীয় আলোতে বিভোরের রক্তজবাকে তখন ঠিক কতোটা মোহনীয় লাগছিলো সেটা বুঝানোর সাধ্য ওর নেই। এতো মায়াভরা মুখ কেন ওর? বিভোর একদৃষ্টিতে ওর রক্তজবার দিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটার বয়স কত এখন? গুণে গুণে দেখলো পঁচিশে পড়বে। অথচ ওর কাছে এখনো প্রথম দিনের সেই ছোট্ট মেয়েটিই আছে। এই সন্ধ্যেটা বিভোরের সারাজীবন মনে থাকবে। এই শ্রাবণ সন্ধ্যাটুকুর মুহূর্তটা যদি ফ্রেমে বন্দি করে রাখা যেতো তাহলে ও তা-ই করতো। মুগ্ধ হওয়া কন্ঠে বলে উঠে,
‘এভাবে হেসোনা তো। এখানে লাগে।’
বিভোর বুকের মাঝখানে হাত রেখে কথাটা বললো। রুহি লজ্জ্বা পেয়ে মুখটা নিচু করে ফেললো। চুলগুলো এদিক-ওদিক উড়ছে। বিভোর কানের পাশে গুঁজে দিয়ে মৃদু হেসে বলল,
‘আমাদের ব্যাপারটা আব্বু-আম্মুকে জানিয়ে দিয়েছি।’
রুহির মুখ থেকে হাসিটা মুহূর্তেই উধাও হয়ে গেলো। কম্পিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
‘ওরা আমাকে মানেনি, তাইনা? জানতাম আমি। এমন একটা এতিম, আশ্রিতা মেয়েকে কেন মানবে ওরা? আপনার পাশে আরও কত সুন্দরী, ভালো, এডুকেটেড মেয়েরা ঘুরে। সেখানে আমিতো নিছকই সাদামাটা।’
বিভোরের বুকটা জ্বালা করতে লাগলো রুহির কথায়। মেয়েটা এতো অবুঝ কেন? কোনোকিছু না বলে ওর হাত ধরে গাইতে লাগলো,
‘আমার সারাটা দিন, মেঘলা আকাশ, বৃষ্টি তোমাকে দিলাম।
শুধু শ্রাবণ সন্ধ্যাটুকু তোমার কাছে চেয়ে নিলাম।
আমার সারাটা দিন, মেঘলা আকাশ, বৃষ্টি তোমাকে দিলাম।
হৃদয়ের জানালায় চোখ মেলে রাখি, বাতাসের বাঁশিতে কান পেতে থাকি।’
রুহি শুধু ওর দিকে চেয়ে থাকে। মাথাটা হঠাৎ ঘুরে উঠে। সবকিছু কেমন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। বিভোর বিষয়টি লক্ষ্য করলো। উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘শরীর খারাপ লাগছে?’
রুহি শুকনো গলায় বলল,
‘না।’
বিভোর একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘আব্বু-আম্মু আমাদের বিয়েটা মেনে নিয়েছেন। তবে বকাবকিও করেছে কেন আগে তাঁদেরকে জানালাম না। নাদিরা আন্টির বাসায় বোধহয় জানিয়ে দিয়েছে।’
এই কথা শুনেই রুহি লাফিয়ে উঠে বলল,
‘ইভা আপু জানতে পারলে আমাকে নির্ঘাত মেরে ফেলবে।’
‘কেন? ওকে জানাওনি বলে?’
‘হ্যাঁ। এতো বছর আগে থেকেই যে আমি বিবাহিতা এবং আমার স্বামী যে স্বয়ং তাঁর ভাই এটা জানার পরেও কি আপনি ভাবছেন আপু আমাকে আস্ত রাখবে? আর নাদিরা আন্টি? ও মাই গড! আমি ওদেরকে ফেইস করতে পারবোনা। আমি সেই শক্তি পাবোনা।’
বিভোর মুখটা বাঁকা করে হাসলো। চোখে কেমন অন্যরকম দৃষ্টি। রুহির হাতটা নিজের মুঠোতে নিয়ে বলল,
‘ভালোবাসলে সেই ভালোবাসাকে সবার সামনে প্রকাশ করতে এতো সংকোচ কেন তোমার! এই পরিস্থিতি সবাইকে ফেইস করতে হয়, আমাকেও করতে হয়েছে। ভয় পেলে চলবে কেমন করে বলোতো! একটু তো ভরসা করো আমায়, কিচ্ছু হবেনা। সবাই খুশিই হবে!’
রুহি শুধু চুপ করে সব শুনলো। ওর অস্বস্তি ভাবটা যাচ্ছেনা। বিভোর ওয়েটার ডাকলো। কয়েকপ্রকার খাবারের আইটেম অর্ডার করে রুহির দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো। পুরোটাই ও ঢকঢক করে খেয়ে নিলো। কপালের রগ দপদপ করছে, বুকে হাতুড়ি পেটাচ্ছে যেন কেউ। বাসায় ফিরে কোন মুখে ওদের সামনে দাঁড়াবে বুঝতে পারছেনা। ইভাও বাসায় আছে আজ পাঁচদিন। নাদিরার শরীরটা এখন একটু ভালো। প্রেশার নিয়ন্ত্রণে আছে। কিন্তু এই খবর শোনার পরে যদি শকড হন তাহলে? রুহিকে ভুল বুঝবে না তো? ভীষণ হতাশ হলো সে। বিভোর ওকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে যাচ্ছে। বোঝার চেষ্টা করছে ওর মনের অভিব্যক্তি। সন্ধ্যের হিম বাতাস গায়ে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। রুহি নড়েচড়ে বসলো। গায়ে আঁচলটা ভালো করে জড়িয়ে নিলো। চোখমুখ শুকনো। নিজেকে যেন নিজেই চিনতে পারছেনা।
কোনোমতে খাবারগুলো খেলো রুহি। কিন্তু ভালো করে কিছুই খেতে পারলোনা। চিকেনের টুকরোতে কামড় বসাতেই বমি এসে গেলো। মাথাব্যথা করছে উল্টাপাল্টা চিন্তা করার কারণে। কিন্তু ওর এই অবস্থা বিভোরকে বুঝতে দিলোনা। অবশ্য বিভোর ওকে লক্ষ্য করছে। অল্প হেসে জানালো ও ঠিক আছে। সব বিল মিটিয়ে ওকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো বিভোর। গাড়ি নিয়ে এসেছে। বিভোর রুহির সঙ্গে নানান কথা বলছে আর রুহি হাসছে। গাড়িতে একটা ইংরেজি গান বাজছে। রাস্তাঘাট চকচক করছে কেমন। বৃষ্টি হওয়ায় হাওয়া সতেজ। রুহি গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি দিলো। কি সুন্দর রাতের এই শহর। আগে কেন লক্ষ্য করেনি ও? ভালোবাসার মানুষটি পাশে থাকলে বোধহয় পৃথিবীর সবকিছুই সুন্দর দেখায়। আহা, ভালোবাসার মানুষ!
রুহি একটু নার্ভাস বলে বিভোরও এলো সঙ্গে। নাদিরার বাসায় ঢুকার মুহূর্তে রুহি বিভোরের শার্ট পেছন থেকে টেনে ধরে বললো,
‘আমার ভীষণ ভয় করছে। দেখুন আমি বোধহয় হার্ট-অ্যাটাক করে ফেলবো।’
বিভোর হেসে বলল,
‘আমিতো হার্টের ডাক্তার। তোমাকে সুস্থ করে দিবো একদম। আসো আমার হাত ধরো। আমি আছিনা? এতো ভয় কীসের তোমার? আন্টি কিছু বলবেনা, দেখবে খুব খুশি হবে।’
রুহির হাতটা চেপে ধরে কলিংবেল বাজালো বিভোর। নাদিরা দরজা খুলে ওদের দুজনকে একসাথে দেখলো। তবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। উৎসাহী কন্ঠে ইভাকে ডেকে বলে উঠলো,
‘এই, ওরা এসে পড়েছে। তুই কোথায়?’
ভেতরে ঢুকে ওরা দুজনই চমকালো। বিভোরের বাবা-মা, নাদিরা, ইভা-রাতুল সবাই বসার ঘরে। সায়হে একগাদা শপিং ব্যাগ। সবাই ওদেরকে দেখে হাসলো। পাশে বসিয়ে সব শপিং দেখাতে লাগলো। ওগুলো নাকি রুহি আর বিভোরের বিয়ের শপিং। নাদিরা ইভাকে ওদের জন্য লেমনেড বানিয়ে আনতে বললো। এসব দেখে রুহি হতবাক। বিভোর আড়চোখে ওকে দেখে হাসছে৷ তার মানে ও এসব প্ল্যান জানতো। আর রুহির ভয় দেখে মজা নিচ্ছিলো। কিন্তু নাদিরা আর ইভা এতো স্বাভাবিক আচরণ করছে কেন? ওরা কি তবে খুশি হয়েছে! রুহি ওদেরকে এক পলক দেখে স্বস্তির হাসি হাসলো। সবাই ওকে এতো ভালোবাসে কেন আর ওরা এতো ভালো কেন! অন্যকেউ হলে ওকে নিশ্চয়ই খারাপ আর সুবিধাবাদী মেয়ে ভাবতো। ফ্রেশ হয়ে আসার জন্য সবার কাছ থেকে উঠে লেমনেডের খালি গ্লাসটা টেবিলের উপর রেখে উপরে যাওয়ার সিঁড়িতে উঠার জন্য পা বাড়ালো। পেছন ফিরে বিভোরের দিকে একবার তাকালো, দেখলো সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে বিভোর ওকে ইশারায় করছে। আবার চোখও টিপ মারছে। রুহি হেসে ফেললো আর সামনে না তাকিয়েই যে-ই না পা বাড়িয়ে উপরের সিঁড়িতে পা ফেলতে যাবে তখনই শাড়িতে পা প্যাঁচিয়ে মাথা ঘুরে নিচে পড়ে গেলো। রেলিঙের উপরদিকটাতে লেগে মাথায় প্রচন্ড বারি খেলো, ফলে মাথার পেছন দিকটা ফেটে রক্ত বেরিয়ে এলো। শব্দ শুনে সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে এই দৃশ্য দেখে রুহির এই অবস্থা দেখে হতভম্ব।
সবার প্রথমে দৌড়ে এলো বিভোর। রুহির জ্ঞান ইইতিমধ্যে হারিয়ে ফেলেছে৷ রক্ত দেখে ওর বুক কেঁপে উঠলো বিভোরের। দ্রুত কোলে তুলে কাউচে নিয়ে শুয়ালো। ইভা রুহির চোখেমুখে পানির ছিঁটা দিলো, কিন্তু ওর জ্ঞান এলোনা। বিভোর একজন ডাক্তার হয়েও বুঝতে পারছেনা এখন তার কি করা উচিৎ। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আছে। ওর রক্তজবাকে এই লাল রক্ততে মানাচ্ছেনা। নাদিরা চিৎকার দিয়ে কেঁদেই দিলো। সবাই তাড়াহতাড়ি হসপিটালে নিয়ে যাওয়াটাই বেটার মনে করলো। বিভোর তখনো ওর হাত ধরে বসে আছে। এই অবস্থা কোনোমতেই মানতে পারছেনা। কিছুক্ষণ আগেও রক্তজবার মুখে সে হাসি দেখতে পাচ্ছিলো। কয়েক মুহূর্তেই পরিস্থিতি কেমন পালটে গেলো! রুহিকে গাড়িতে তোলা হলো। বিভোর ওর পাশে বসা। হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছে আর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর রক্তজবার মোমের মতো সুন্দর মুখটায়। রুহির হাতের মুঠোতে এখনো ওর দেওয়া সেই কালোগোলাপ ফুলটি। শুভ্র শাড়ির সঙ্গে কি চমৎকার দেখাচ্ছে এই দৃশ্যটি! বিভোর মনে মনে দোয়া পড়তে লাগলো। এই দৃশ্যটি ও আর সহ্য করতে পারছেনা, রুহির কিছু হতে দেবেনা। হঠাৎ পাগলের মতো কান্ড করে বসলো বিভোর। রুহির উষ্ণ ঠোঁটজোড়ায় নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে আর্তনাদ করে বলল,
‘এরকমভাবে কেউ ভয় পায়? আমিতো সব সামলে নিচ্ছিলাম। হার্ট-অ্যাটাক করলে আমি চিকিৎসা করবো বলেছিলাম তো, তাহলে এই রক্তের মানে কী? রক্তজবা বলে ডাকি তাই শোধ নিলে? আমি আর ডাকবোনা তোমাকে এই নামে,তবুও প্লিজ চোখ খুলো। দয়া করো আমাকে!’
অনেক বড় পর্ব দিলাম। আশা করি গঠনমূলক মন্তব্য জানাবেন।
চলবে…
ইনশাআল্লাহ!